অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫২

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

নাজিফা উচ্ছ্বাসের পা জড়িয়ে ধরে এখনো কেঁদে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেছে। উচ্ছ্বাস অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখল প্রেয়সীকে। যাকে সবসময় বুকে রাখতে চেয়েছিল, সেই মেয়েটা ওর পায়ে পড়ে আছে। এটা উচ্ছ্বাসের কল্পনারও অতীত ছিল। যেই মেয়েটার আত্মসম্মানে এতো ধার ছিল তার এই অবস্থা করে দিয়েছে ও! ভাবতেই নিজের প্রতি রাগ, ঘৃণা দুটোই তীব্রভাবে অনুভব করল।

উচ্ছ্বাস লম্বা একটা শ্বাস টেনে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। চারপাশে তাকিয়ে দেখল অনেকেই দেখছে ওদেরকে। ফিসফাস করছে। নাজিফাকে দু হাতে জোর করে টেনে তুলল উচ্ছ্বাস। ওকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে নিজেও বসল। নাজিফার দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘এমন কেনো করছো? তিনদিন পর তোমার বিয়ে। আশেপাশে চেনা কোন লোক দেখতে পেলে কী হবে বুঝতে পারছো? তোমার বাবার সম্মানের কথাটা ভাবো।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমি পারছিনা উচ্ছ্বাস। আমি আজ আর কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা। আমার অস্তিত্বে মিশে গেছো তুমি। প্লিজ আমাকে এভাবে শেষ করে দিওনা।’
উচ্ছ্বাস করুণ চোখে তাকাল নাজিফার দিকে। চারপাশ থেকে একবার ঘুরে এলো ওর অসহায়তা দৃষ্টি। হতাশ, নিস্তেজ গলায় বলল, ‘প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। তুমি যা চাইছো আমি তোমাকে সেটা দিতে পারব না।’
‘কেন উচ্ছ্বাস? ভালোবেসেতো মানুষ নিজের প্রাণও দিতে পারে। সেখানে তুমি একটা দল ছাড়তে পারবেনা? তারমানে কী তুমি কখনও আমাকে ভালোই বাসোনি?’

উচ্ছ্বাস নাজিফার হাত ছেড়ে দিল। চোখ সরিয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। চোখ জ্বালা করছে। বুকে ভীষণ ব্যথা করছে ওর। নাজিফা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিছুক্ষণের নীরবতার পর উচ্ছ্বাস বলতে শুরু করল, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই কখনো জানতাম না আমার পরিচয় কী। আমার বাবা-মা কে। কোথা থেকে এসেছি। যেদিন থেকে জ্ঞান হয়েছে, যতটুকু মনে পড়ে রেললাইনের ধারে ভিক্ষা করে, লোকের কাছে খাবার চেয়ে খেয়েই বেঁচে ছিলাম আমি।

ওভাবে যেদিন টাকা পেতাম না, সেদিন পেটের দায়ে চুরিও করতাম। একদিন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম ইকবাল ভাইয়ের কাছে। উনি পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখালে হাতে, পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম। সেটা দেখে দয়া হয়েছিল ওনার। তাই বলল, উনি আমাকে কাজ দিতে পারেন। যদি আমি কোনরকম শয়তানী না করে ভালোভাবে কাজ করি তাহলে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আধপেটা অবস্থায় লোকের মার খেয়ে রেললাইনের ধারে পরে থাকার চেয়ে ভালো ছিল সেই কাজ।

আমের ফাউন্ডেশনে চা দেওয়া, ঘর পরিষ্কার রাখা সব আমিই করতাম। বদলে তিনবেলা পেটপুড়ে খেতে পেতাম। তিনদিনেই রাশেদ বাবার নজরে পড়ে গেলাম আমি। একদিন ডেকে আমার সম্পর্কে সবকিছু জিজ্ঞেস করল। আমিও ভয়ে ভয়ে সব বললাম। ভাবলাম যদি ঘাড় ধরে বার করে দেয়? আবার সেই রেলস্টেশনে পরে থাকতে হবে। সেদিন কিছু না বললেও দুদিন পর আবার ডেকে পাঠালেন রাশেদ বাবা।

কড়া গলায় বললেন, এখন থেকে এখানে না ওনার বাড়িতে কাজ করতে হবে। আমার না করার উপায় ছিলোনা। সেদিন প্রথম পা রাখলাম আমের ভিলায়। ওমন রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে থাকতে পারব ভেবে মনে মনে খুশিই হলাম। সেদিন ছাদে গিয়ে প্রায় আমার বয়সী একটা ছেলেকে দেখতে পেলাম। বেঁধে রেখেছে। ছেলেটা ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দেখে মায়া হলো আমার। আমি গিয়ে বাঁধন খুলতে গেলে ছেলেটা ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল, ‘এই! তোকে বলেছি খুলতে? আমি নিজেই নিজেকে ছাড়াতে জানি।’ আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।

আমাকে অবাক করে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছিল ছেলেটা। কিন্তু মুক্তির আনন্দ ছিলোনা ওর চোখে-মুখে। যেন এসব দুধভাত। ছেলেটা চোখভর্তি বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গিয়েছিল নিচে। আমি ভীষণ অবাক হলেও পরে আর সেসব নিয়ে ভাবিনি। পরে জেনেছিলাম ছেলেটার নাম রুদ্র। রাশেদ বাবার ছেলে। জ্যোতির সাথেও কথা হলো। ভাবও হলো। কুহু তখন প্রায় তিন বছরের বাচ্চা। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো দুদিন পাড় হয়ে গেলেও কোন কাজ করার সুযোগ পেলাম না আমি। সবই বাকি সার্ভেন্টরা করে রাখতো।

একদিন রাশেদ বাবা একটা পোশাক আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন তৈরী হয়ে নিতে। আমি তৈরী হলাম। জাফর কাকা আর রুদ্রর সঙ্গে বের হতে হলো। আমি তখনও জানিনা কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু পরে জানতে পারি আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছে। বিশ্বাস করো নাজিফা, আমার মনে হচ্ছিলো আমি স্বপ্ন দেখছি। আর তারপর থেকে বাকিসব স্বপ্ন-ই লাগতো। ঐ বাড়ির ছেলের মতোই যত্ন পাচ্ছিলাম আমি। রুদ্রর জন্যে যা বরাদ্দ ছিল আমার জন্যেও তাই ছিল। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতাম। কিন্তু কিছু বলার ভাষা পেতাম না।

আমার উচ্ছ্বাস নামটা রাশেদ বাবারই দেওয়া। সবাইতো টোকাই বলে ডাকতো। প্রথম দিকে রুদ্রর ব্যবহার আমার প্রতি সহজ-স্বাভাবিক ছিলোনা। খারাপ ব্যবহার করতো না, আবার যেচে কথাও বলতো না। কেমন গম্ভীর হয়ে থাকতো। কিন্তু কখনও হিংসেও করতো না ওর সমান সবকিছু পাচ্ছি বলে। অদ্ভুত ছিল। যদিও এখনো অদ্ভুতই। কীভাবে যে ওর সঙ্গে বন্ডিংটা হয়ে গেল। নিজেও এখন বুঝতে পারিনা। আর এই আঠারো বছর পরেও আমি এখনো সেভাবেই সেই বাড়িতে আছি। বাড়ির ছেলে হয়ে। বিশ্বাস হয় নাজিফা? একটা রাস্তার ছেলেকে কেউ এভাবে ঘরের ছেলে বানিয়ে দিচ্ছে।’

নাজিফা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে এতক্ষণে। উচ্ছ্বাস এবার নাজিফার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার তুমিই বলো। আমি তাদেরকে কীকরে ছেড়ে দেই যারা আমায় কখনও ছাড়েনি। রেলস্টেশনে পড়ে পড়ে মার খাওয়া একটা ছেলেকে নিজেদের ঘরে জায়গা দিয়েছে। আর বর্তমানে দলে আমাকে ভীষণ প্রয়োজন নাজিফা। এই অবস্থায় নিজের সুখের জন্যে, নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্যে ওদের ছেড়ে দেব? এতোটা স্বার্থপর কীকরে হই বলোতো? তুমি যদি আমার কাছ থেকে আমার প্রাণটাও চেয়ে নাও আমি হাসিমুখে দিয়ে দেব নাজিফা। কিন্তু সোলার সিস্টেম ছাড়তে পারব না। তারমানে এই না যে আমি তোমাকে ভালোবাসিনা। বাসি নাজিফা। প্রচন্ড ভালোবাসি। আজ আমি তোমাকে না, আমার প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছি।

নাজিফা কী বলবে বুঝতে পারল না। এরপর কী বলা যায়? এইসব শোনার পরেও ও কীকরে বলবে উচ্ছ্বাসকে যে সব ছেড়ে চলে এসো? বললেও বা উচ্ছ্বাস শুনবে কেন? নাজিফা অসহায় বোধ করল। সবকিছুই কেমন এলোমেলো মনে হলো ওর কাছে। উচ্ছ্বাসের হাত ধরে অস্হির গলায় বলল, ‘কিন্তু আমার কী হবে উচ্ছ্বাস? আমি কীভাবে থাকব তোমাকে ছেড়ে? তোমাকে ভুলে অন্যকারো সঙ্গে কীকরে জীবন সাজাবো? এটা সম্ভব না। কিছুতেই না।’

উচ্ছ্বাস নাজিফার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল, ‘সব সম্ভব নাজিফা। পৃথিবীতে কজন আছে বলোতো যারা নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করতে পারে? তাদের সাথে জীবন কাটাতে পারে? কিন্তু তারাতো মরে যায়না তাইনা। মানিয়ে নেয়। আমরাও মানিয়ে নেব।’
নাজিফা আবার কেঁদে ফেলল। অস্হির হয়ে উঠল। ছটফট করতে করতে বলল, ‘না, না। আমার দ্বারা হবেনা। আমি পারব না। কিছু একটা করো প্লিজ।’

উচ্ছ্বাস নাজিফাকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কিছু করার নেই নাজিফা।’
নাজিফার কান্নার গতি বাড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসের কলার ধরে বলল, ‘আগে কেন নিজের সত্যিটা বললে না? শুরুতেই কেন সবটা শেষ করে দিলেনা? নিজের সাথে আমাকে জড়িয়ে। আমার শরীর, মন, আত্মার সঙ্গে এভাবে মিশে যাওয়ার পরেই কেন বললে। আমাকে এভাবে কেন শেষ করে দিলে? কেন?’

উচ্ছ্বাসের প্রচন্ড কান্না পেল। মনে হলো কেউ ওর গলা চেপে ধরেছে। শ্বাসনালী রোধ করে দিয়েছে। উচ্ছ্বাস নাজিফার সামনে হাত জোর করে আহত, পরাজিত কন্ঠে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও।’
কথাটা বলে কেমন ফুঁপিয়ে উঠল উচ্ছ্বাস। নাজিফা উচ্ছ্বাসের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে কার জন্যে অপেক্ষা করবে?’

‘জানিনা।’ মাথা নুইয়ে আস্তে করে বলল উচ্ছ্বাস।
‘এই পার্কে এসে, মাথা রেখে শোয়ার জন্যে নতুন কোন কোল খুঁজে নেবে বুঝি?’
‘চুপ করো।’
‘ঐ চায়ের দোকানটায় চা খেতে বসলে আমার কথা মনে পড়বেনা তোমার?’
‘নাজিফা প্লিজ।’

প্রচন্ড অধৈর্য অস্হির দেখাল উচ্ছ্বাসকে। নাজিফা ডুকরে কেঁদে উঠল। এক পা এক পা করে পেছাতে পেছাতে বলল, ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করবোনা উচ্ছ্বাস। কোনদিন ক্ষমা করব না। কোনদিন না।’
নাজিফা উল্টো ঘুরে প্রায় দৌড়ে চলে গেল। যতদূর নাজিফাকে দেখা গিয়েছিল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল উচ্ছ্বাস। পলক ফেলেনি। নাজিফা চোখের আড়াল হতেই উচ্ছ্বাসের চোখ দিয়ে জ্বল গড়িয়ে পড়ল। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ভেঙ্গে এলো ওর অজান্তেই। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে তাকাল মুক্ত আকাশের দিকে। ব্যস্ত হাতে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে বের করল। কিন্তু প্যাকেটটা খুলে দেখল একটা সিগারেটও নেই। ফাঁকা। ঠিক ওর জীবনের মতোই। প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে দিল। সামনে থাকা একটা ইটে জোরে লাথি মারল। পায়ে ভীষণ লাগল। চোখ দিয়ে আবার জল বেরিয়ে গেল উচ্ছ্বাসের। পায়ের ব্যথায় নাকি মনের ব্যথায়, কে জানে?

সেটাই ছিল উচ্ছ্বাসের সঙ্গে নাজিফার শেষ আলাপ। তার তিনদিন পর নাজিফার বিয়ে হয়ে গেল। নিমন্ত্রন রক্ষা করতে কেবল রাশেদ আর জাফর গিয়েছিলেন। রুদ্র বা উচ্ছ্বাস কেউ যায়নি। তবে নাজিফার বাড়ির আশেপাশেই ছিল উচ্ছ্বাস। সবার অলক্ষ্যে। শেষবারের মতো নাজিফাকে একটাবার দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। নাজিফার বিদায়ের সময় সেই দেখা পেল উচ্ছ্বাস। দূর থেকে দেখছিল নাজিফাকে লাল শাড়ি পড়ে, বধু বেশে। নিজের প্রিয়তমাকে নববধূর সাজে দেখার দীর্ঘ এগারো মাসের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল সেদিন। কিন্তু আফসোস, সেই সাজ অন্যকারো জন্যে ছিল। নাজিফাকে বধূ বেশে অপূর্ব লাগছিল। কিন্তু মুখটা ছিল প্রাণহীন। বিদায়ের সময়ও একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি মেয়েটা।

নাজিফার পাশে ওর বরকে দেখে বুকের ভেতরে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল উচ্ছ্বাসের। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো ওর। চোখ দিয়ে ওর অজান্তেই অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল। কিন্তু যখন দেখল নাজিফার বর ওকে সযত্নে গাড়িতে তুলছে। ঝুঁকে শাড়ির আঁচল গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। তখন চোখে জল থাকলেও মুখ‍ে হাসি ফুটেছিল ওর। আনমনেই বলেছিল, ‘সুখী হও।’
তারপর থেকে উচ্ছ্বাসের জীবনের মোড় বদলে যায়। কিন্তু সেই বদল বাইরে থেকে কারো চোখে পড়েনা।

সকলের সামনে হাসি-খুশিতে মাতিয়ে রাখা, দলের কাজকর্ম পূর্ণ সমর্পনের সাথে করে যাওয়ার, এসবের আড়ালে চাপা পড়ে যেত ওর একেকটা নির্ঘুম রাত। একের পর এক শেষ করা সিগারেটের প্যাকেট। পেটে অতিরিক্ত মাত্রায় পড়তে থাকা অ‍্যালকোহল। এ সবকিছু রুদ্রর নজর এড়াতো না। বাকিরাও বুঝতো ছেলেটা ভেতরে ভেতরে জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারো কিছু করার ছিলোনা। সকলেই ছিল নিরুপায়। আর এভাবেই দেখতে দেখতে একটা বছর পাড় হয়ে যায়। এখন সবকিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু সব স্বাভাবিকতার মধ্যেও কোথাও একটা প্রচ্ছন্ন অস্বাভাবিকতা রয়েই গেছে। কোথাও একটা চাপা পড়ে আছে নির্ঘুম রাতের দীর্ঘশ্বাস।

রাত একটা বেজে বিশ। আকাশটা তখন মেঘলা। মাঝেমাঝে ঘেম মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠছে। হঠাৎ হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে সব ঠান্ডা করে দিয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া চিৎকার করে বলছে, শীত আসছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আজ সন্ধ্যায় আবার মিটিং বসেছিল বৈঠক ঘরে। দুই মাসের মধ্যে মাল আসছে। দ্রুত ডেলিভারী হবে। আসল গন্ডোগোলটা ঠিক কোথায় হচ্ছে ধরার জন্যে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছে ও। এখন শুধু সে অনুযায়ী কাজ হওয়ার অপেক্ষা।

কিছুক্ষণ পর প্রিয়তা এলো। দু হাতে দুটো কফির মগ। প্রিয়তাকে দেখে রুদ্র সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দিল। তারপর অ‍্যাশট্রেতে গুজে রাখল। হাত বাড়িয়ে নিল কফির মগটা। প্রিয়তাও রুদ্রর পাশে দাঁড়াল। দুজনের ঘুম আসছেনা তাই ঠিক করেছে রাত জেগে গল্প করবে। কাল সবাই বাড়িতেই থাকছে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার কোন ব্যাপারই নেই। রুদ্র কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছি। তুমি কখনও আমাকে সিগারেট ছাড়তে বলোনি। সাধারণত বউরা যেভাবে ফোর্স করে। তুমি করোনি। বিশেষ কোন কারণ?’

প্রিয়তা বলল, ‘বললে শুনতেন?’
রুদ্র জবাব দিলোনা। প্রিয়তা হাসল। নিজেও কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আপনিই তো বলেছিলেন জীবনটা সিনেমা না। সেইজন্যেই তো আপনাকে এরকম জীবন থেকে ফেরানোর চেষ্টা করিনি। কারণ আপনি শুনবেন না। অপরদিকে আপনাকেও ছাড়তে পারিনি। নাজিফার মতো ভালোবাসাকে ত্যাগ করে, আদর্শকে আকড়ে ধরতে পারিনি। কারণ নাজিফার সবাই আছে। কিন্তু আমার আপনি ছাড়া আর কে আছে বলুন? একজন বন্ধু ছিল। মীরা। সেও_’

কথাটা বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো প্রিয়তার। ওদের বিয়ের ছ’মাসের মাথাতেই মীরার মৃত্যুর খবর পায় ওরা। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সবাই বলছে সুই’সাইড করেছে। কিন্তু সুই’সাইডের আসল কারণটা আজ ও অজানা। রুদ্র একহাতে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। কিছু বলল না। মীরার মৃত্যুর ধাক্কাটা সামলে নিতে এক সপ্তাহ লেগেছিল প্রিয়তার। তাই এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চাইল না ও। প্রসঙ্গ বদলে বলল, ‘তোমার আকাশ এতো পছন্দ কেন?’

প্রিয়তা লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে তাকাল আকাশের দিকে। মুচকি হেসে বলল, ‘জানিনা। কিন্তু ভালোলাগে। আকাশকে রঙ বদলাতে দেখে ভালো লাগে। অন্ধকারে হাজার তারায় ভরা আকাশটা দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। পূর্ণিমার গোল চাঁদটা দেখলে মনে হয় যেন আমার সাথে কথা বলছে। ধূসর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখলে মনটা কেমন করে ওঠে। তবে আকাশের একটা রূপ আমার এখনো দেখা হলোনা। আরও কতবছর অপেক্ষা করতে হবে সেটা দেখার জন্যে।’

রুদ্র হেসে বলল, ‘২০৬১ সাল। অলমোস্ট আরও চল্লিশ বছর।’
‘ততদিন বেঁচে থাকবতো আমরা?’
‘জানিনা। তবে যদি বেঁচেও থাকি তো বুড়োবুড়ি হয়ে যাবো। হাই পাওয়ারের চশমাও লাগতে পারে দেখার জন্যে।’
প্রিয়তা হেসে ফেলল। রুদ্র বলল, ‘কিন্তু তোমার মাথায় এই ধুমকেতু দেখার ভুত কীভাবে চাপল বলোতো?’
‘কী-জানি? ছোটবেলায় প্রথম যখন বইতে এই সম্পর্কে পড়েছিলাম। তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল ধুমকেতু দেখব। ইচ্ছেটা কবে যে এতো সিরিয়াস হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি।’

রুদ্র প্রিয়তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘একদিন আমরা দুজনে একসঙ্গে আকাশে ধুমকেতু দেখব, প্রিয়।’
কথা বলতে বলতে দুজনে খেয়াল করল জিপ নিয়ে গ্যারেজের দিকে যাচ্ছে উচ্ছ্বাস। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে আস্তে আস্তে ভেতরে চলে এলো। রুদ্র ঘড়ি দেখল। দুটো বাজতে চলেছে। ফোঁস একটা শ্বাস ফেলল রুদ্র। প্রিয়তা বলল, ‘রাশেদ বাবাকে বলে ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করলে হয় না?’
‘ও রাজি হবেনা। নাজিফার জায়গাটা ও কোনদিন কাউকে দিতে পারবে বলে মনে হয়না। এতো তাড়াতাড়ি তো না-ই।’

পরেরদিন সকালে সকলেই খুব আস্তেধীরে ঘুম থেকে উঠল। কারো কোন কাজ নেই। ঘুম থেকে ওঠার পরেও যেন অলসতায় পেয়েছে সবাইকে। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস সোফায় হেলান দিয়ে বসে বসে ফোন দেখছে। মাঝেমাঝে লম্বা হাই তুলছে। কুহু নিচে ফ্লোরে বসে ল্যাপটপে ভিডিও দেখছে। রাশেদ আর জাফর আছেন নিজেদের বৈঠক ঘরে। প্রিয়তা আর জ্যোতি ধীরেসুস্হে রান্না করছে। তারকারি নাড়তে নাড়তে করতে করতে জ্যোতি বলল, ‘কতদিন পরপর বাড়ির এমন দৃশ্য চোখে পড়ে বলোতো? বাড়ির অতি ব্যস্ত মানুষজন সব ল্যাদ খেয়ে পড়ে আছে।’

প্রিয়তা পরোটা বেলতে বেলতে হেসে বলল, ‘যা বলেছো! সবগুলোর অবস্থা দেখো। বিশেষ করে ঐযে বাড়ির দুজন ইয়াং ম্যান। টিশার্ট আর শর্টস্ এ কেমন লাগছে! আর চুল তো নয় যেন কাকের বাসা।’
দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠল। নার্গিস বেগম একা একাই মুখ বাঁকালেন। এতো ন্যাকামি অসহ্য লাগে তার। জ্যোতি বলল, ‘একটা জিনিস কী জানো প্রিয়তা, তুমি বাড়ির সবাইকে এতো অল্প সময়ে আপন করে নেবে আমি ভাবতেও পারিনি। এটা মানতে বাধ্য যে, আজকাল তোমার মতো মেয়ে দেখা যায়না। তুমি সত্যিই খুব ভালো।’

প্রিয়তা মুচকি হাসল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে পরোটা তাওয়ায় দিয়ে বলল, ‘এটা তোমার মনে হচ্ছে আপু। মাটিতে হাঁটার সময় পথে যে খড়কুটোকে আমরা পা দিয়ে ঠেলে দেই, পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় সেই সামান্য খড়কুটোকেই আকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করি। কারণ তখন সেটা আমাদের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। তাকে খড়কুটোর প্রতি ভালোবাসা না, প্রয়োজনের প্রতি ভালোবাসা বলে। আমার নিজের কে আছে বলো? এতো সুন্দর একটা পরিবার পেয়ছি। পায়ে ঠেলার মতো বোকামি করব কেন? তোমাদের সবাইতো আমার খুব প্রয়োজন। এতে আমার কোন ভালোমানুষী প্রকাশ পাচ্ছেনা।’
জ্যোতি হেসে বলল, ‘আচ্ছা হয়েছে। কথায় পারব না তোমার সাথে।’

সকলে একসঙ্গে সকালের খাওয়ার পর রাশেদ আর জাফর আবার চলে গেলেন নিজেদের ঘরে। তাদের কফি তাদের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আর ওরা বসার ঘরে একসঙ্গে কফি খেতে খেতে গল্প করতে বসল। তখন কুহুর ল্যাপটপে ভিডিও কল দিল নীরব। সকলের সঙ্গে কথা বলবে তাই। ভিডিও কলে অনেকক্ষণ হাসি-মজা হলো। উচ্ছ্বাস নানারকমভাবে নীরবকে খোঁচা মারল। তবে রুদ্রর সঙ্গে কেবল সালাম দেওয়া নেওয়া টুকুই হলো। এর বেশি কিছু না। নীরব মাস দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসছে সেটাও জানালো। কল কাটার পর প্রিয়তা রুদ্রকে বলল, ‘আজ বিকেলে সবাই মিলে শপিং করতে যাব। কতদিন যাইনা। এইযে স্যার? আপনাকেও যেতে হবে কিন্তু।’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমি গিয়ে কী করব? গার্ডস্ যাচ্ছেতো।’
‘ আজব। গার্ডস যাবে বলে আপনি যাবেন না? কেমন পুরুষ আপনি? বাড়ির মেয়েদের এভাবে অসহায়, অবলা_’
প্রিয়তা আর কিছু বলার আগেই রুদ্র হাত জোড় করে বলল, ‘ব্যাস! আমি যাচ্ছি। হ্যাপি? কখন যেতে হবে বলে দিও।’
সবাই একেওপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসল। উচ্ছ্বাস একটু এগিয়ে এসে রুদ্রর কাছে বসল। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘একটা বউ পেয়েছিস বটে। বাঁধিয়ে রাখার মতো।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫১

রুদ্র উচ্ছ্বাসের বলার ভঙ্গি নকল করে বলল, ‘এতেই প্রমাণ হয়, শকুনের অভিশাপে গরু মরেনা।’
উচ্ছ্বাস দেঁতো হাসল। একটু চুপ থেকে বলল, ‘তাইতো আমার দেওয়া অভিশাপগুলো আমার গায়ে এসেই লাগল।’
রুদ্র একপলক উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। এই ছেলেটাকে সামলানোর কিংবা সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা ওর জানা নেই। আছে কেবল সহানুভূতি আর দীর্ঘশ্বাস।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৩