মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২২

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২২
ফাবিয়াহ্ মমো

এটা খারাপ কিছু। এটা স্বাভাবিক না। ভয় লাগছে। কিন্তু কি করবে? মাহতিম নিশ্চয়ই শুনবে না, আঁটকাতে চাইলে থামবে না। কি করা যায়? চিঠিটা সাধারণ না। মাথা চাপড়াচ্ছে মেহনূর। প্রচণ্ড ভয়ে তটস্থ। কেন পাঠালো চিঠি? ইচ্ছে করছে কুটিকুটি করতে; কিন্তু পারছে না। অস্থির ভাবে পায়চারি করতেই থেমে গেলো সে। চোখের সামনে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। চটজলদি ফোন তুলে কল বসালো মেহনূর। ফোনটা রিং হচ্ছে, কল যাচ্ছে, কিন্তু ধরছে না। বাজতে-বাজতে ফোনটা বন্ধ হলো, কেউ ধরলো না। মেহনূর পাগলের মতো আবার কল দিলো। ফোনটা এবার বাজতে-বাজতে রিসিভ হলো। হাঁপ ছাড়লো মেহনূর, বিচলিত গলায় বললো,

– কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আগে আমার কথা শুনুন। আমি টেনশনে আছি। আমি শান্তি পাচ্ছি না। গতকাল একটা চিঠি আসে। ওটা ভুলবশত পড়ে ফেলি। ওখানে স্পষ্ট করে অনেককিছু লিখা নেই। কিন্তু, ওটা বিপদজনক। ওখানে মালিবাগ যাওয়ার কথা আছে। তাও রাত এগারোটার দিকে। খুব জরুরী ভিত্তিতে সোমবার একা যেতে বলেছে। কিন্তু, আমার ভয় লাগছে ভাইয়া। আপনি দয়াকরে কিছু করুন। উনাকে একা যেতে দিবেন না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনি যতবার এসব কাজে একা নেমেছে, উনি সুস্থ ভাবে ফিরেনি। হয় আহত হয়ে ফিরেছে, নয় দূর্বল ভাবে। আমি নিশ্চিত এবারও গণ্ডগোল হবে। যেটা সামান্য গণ্ডগোল বলে মনে হচ্ছে না। এবার উনি দলবল কিচ্ছু নিবেন না। উনার ঝাঁপিয়ে পরার স্বভাবটা ভয় জাগাচ্ছে। উনি যে সরাসরি এ্যাকশন নেন, যদি কিছু হয়? আপনি কিছু করুন, উনার যাওয়াটা আঁটকে দিন। আপনার বস্ আমার কথা শুনবে না। হাসিঠাট্টায় উড়িয়ে দিবেন। আমি নিরুপায় হয়ে কল দিয়েছি ভাইয়া। কিছু করুন।

একনাগাড়ে বলে ফেললো মেহনূর। হাঁপাচ্ছে খুব। নিশ্বাসে টান পরছে। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। কথাগুলো চুপচাপ শুনলো নোমান। তার অবস্থা এখন শোচনীয়। ঠিক সামনে যে ব্যক্তি দম্ভ কায়দায় বসে আছে, তাকে নিয়েই কথাগুলো বলছে। নোমান ঠেলেঠুলে একটা হাসি দিয়ে বসের উদ্দেশ্যে বললো,

– স্যার, একটু যাই? মানে কথা বলছিলাম তো —
নোটপ্যাডে কলম থামালো মাহতিম। চোখ তুললো সে। নোমানের অবস্থা আপাদমস্তক দেখে সন্দিগ্ধ চোখে চাইলো। কপালের মধ্যখানে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে খটকা গলায় বললো,
– এ্যানি সিরিয়াস কেস? মুখ ফ্যাকাশে লাগছে কেন?

সাংঘাতিক! বস্ ধরে ফেললো নাকি? বসের চতুরতা নিয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু, তাই বলে এতো সতর্ক? নোমান দ্রুত নিজেকে আড়াল করলো। অপ্রস্তুত অবস্থাকে শান্ত করলো। হাসি দিয়ে বললো,
– নো, স্যার। নো ইস্যুস।

টালমাটাল বাহানা দিয়ে কেটে পরলো সে। কেবিন থেকে বেরুতেই সাইডে চাপলো নোমান। পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করে শুনলো। তাকে কিছু জানানো হয়নি। গুরুতর চিঠি সম্পর্কে কিছুই বলেনি। বস্ সব লুকোচ্ছে। প্রত্যেকটা কথা শোনার পর তার অবস্থা কাহিল। এবারের প্রতিপক্ষ কোনো ফেরারী আসামী নয়। প্রতিপক্ষ দল প্রচুর চতুর, ক্ষমতাবান। তাদের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু! বস্ কেন এসব করছে? মাহদির কেস নিয়ে অতোদূর কেন যাচ্ছে? নাকি ষড়যন্ত্রের ফলা অন্য রাস্তায় ঢুকেছে? এবার তো মনেহচ্ছে, কঠিন কিছু! সব যেন একটা-আরেকটার সাথে যুক্ত। তাহলে কি ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা এই কেসে যুক্ত?

মেহনূর লজ্জায় চোখ বুজে আছে। এই মূহুর্তে তাকাতে পারছে না। কি এক যন্ত্রণা! তাকাতে গেলে ভয়-ভয় লাগে; আবার না-তাকিয়েও হচ্ছে না। মেহনূর ঢোক গিলে বললো,
– না করলে হয়না? ভয় লাগছে। আমি পারবো না। যদি কেটে যায়?
মাহতিম মুখ শক্ত করলো। অনুচিত সুরে বললো,
– কাটলে কাটুক। হাত চালাও।

মেহনূর ঢোক গিলে তাকালো। হাত কাঁপছে। খুব কাঁপছে। তবুও, হাতটা গালের উপর রাখলো। আসল কথাটা কখন বলবে? মেহনূর অনুনয় করে বললো,
– কাটলে কি করবো? আমিতো আপনার মতো পটু না।
মাহতিম গাল বাড়ালো। কোনো কথা শুনলো না। গালে শেভিং ফোম মাখা। বিছানায় বসেছে সে। সামনে মেহনূর দাঁড়িয়ে। রেজারটা চালাতে বলে ছোট্ট সুরে বললো,
– কাটলে চুমু দিও।

সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ওর। মেহনূর লজ্জায় চোখ সরালো। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ালো সে। তা দেখে মাহতিম হাসি আঁটকে রেখেছে। মেহনূর আবার সাহস জুগিয়ে চোখ তুললো। হাতের রেজারটা শক্ত করে ধরলো। মাহতিমের প্রখর দৃষ্টি এড়িয়ে রেজারটা গালে বসায় সে। সাবধানে কাঁপতে থাকা হাতটা চালাতে থাকে। কোথাও যেন না-কাটুক, এমন চিন্তায় ডুবে আছে। মাহতিম একদৃষ্টিতে স্বচ্ছ ঠোঁটে হাসছে।

মায়ার সাথে নির্মল ক্ষণটা উপভোগ করছে খুব। এভাবে দেখতে পারার আকাঙ্ক্ষায় যদি গাল কাটে; কেটে যাক, আফসোস নেই। তার হাতদুটো ধীরে-ধীরে ওর কোমর জড়িয়ে ধরলো। মেহনূর একটু কাঁপলো যেনো; তবুও শক্ত হয়ে রইলো। এখন ভোর‍ের সময়। ঘড়িতে পাঁচটা বিশ। এখনো অরুণ গোলাটা উঠেনি। জানালা দিয়ে ভোরের টাটকা হাওয়া ঢুকছে। রন্ধ্রে-রন্ধ্রে শীত লাগানো হাওয়া, আহা! গোটা শহরটা কি নীরব! একটুখানি শোরগোল নেই। এমন নীরব-নিস্তেজ প্রকৃতির কাছে দুটো জাগ্রত প্রাণ নিজ-নিজ কর্মে যুক্ত। মেহনূর স্বচ্ছভাবে শেভিং শেষ করলো। গালের অবশিষ্ট ফোমগুলো মুছতে-মুছতে বললো,

– একটা কথা ছিলো। আবদার হিসেবে বলবো?
মাহতিম তখনও স্থির নেত্রে তাকিয়ে ছিলো। তার দুচোখে নেশা-নেশা ঘোর। সে আবেগী কিছু আবদারের জন্য উন্মুখ ছিলো। ভেবেছিলো, মেহনূর তাকে আর্দ্র কিছু বলবে। সে নরম সুরে বললো,
– বলো দেখি।
মেহনূর মলিন চোখে চাইলো। সদ্য শেভ করা গালটা টেনে ছোট্ট চুমু খেলো। মাথাটা দুহাতে বুকে জড়িয়ে নিলো। উন্মুক্ত পিঠটায় হাত ছুঁয়ে অনুরোধের সাথে বললো,

– না গেলে হয়না? মালিবাগ নামটা স্বস্তি দিচ্ছে না। আজ তো বুধবার। এখনো চারদিন সময় আছে। আপনার সহকারীকে ছুটি দিয়ে দিন। নোমানকে বলে দিন মালিবাগ যেতে। উনি আপনার বিশ্বস্ত লোক; উনি সুন্দরভাবে কাজটা করে দিবেন।
এমন অদ্ভুত বায়না শুনে সমস্ত আবেগ যেন চুরচুর করে ভাঙ্গলো। কোমল বাহুবাশ থেকে ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়ালো মাহতিম। থমথমে মুখে ওর দিকে তাকালো। ক’মিনিট শুধু তাকিয়েই রইলো। আবদার ও আজ্ঞার মাঝে ঝুলে আছে সে। কি বললো মেহনূর? কি চাইলো সে? কন্ঠে তেজ মিশিয়ে ক্ষিপ্ত সুরে বললো,

– মাথা ঠিক আছে? আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছো? কোথায় তুমি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে, সেটা না; তুমি ছুটির কথা তুলছো! এমন আবদার আশা করিনি মেহনূর। সাতসকালে এই জাতীয় কথাবার্তা একদম পছন্দ করি না। তুমি, তুমি দেখি…

দাঁত খিঁচালো মাহতিম। রাগে কথা বলতে পারছে না। রাগটা কন্ট্রোল করতে হবে। ধপ থেকে বিছানা থেকে উঠলো। ওয়াশরুমের দিকে যেতে-যেতে হঠাৎ পা থামিয়ে বললো,
– আমার ইউনিফর্ম রেডি করো; গোসলে যাচ্ছি।পনেরো মিনিটের মধ্যে নাস্তা তৈরি করবে। এই টপিক যেন এখানেই শেষ হয়। এটা নিয়ে কেচ্ছা বানাতে যেও না। একটা সুন্দর সকাল শুরু করতে চেয়েছিলাম, সেটা নষ্ট করে দিলে।

মেহনূর নির‍্যুত্তর মুখে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে নিজের হাতদুটির দিকে। যে হাত দিয়ে হৃদয়মৃণালের একমাত্র মানুষটিকে শক্ত করে ধরেছিলো, সে যেন ভুল বুঝেছে। আঙ্গুল গুটিয়ে হাতটা মুঠো করলো সে। ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে নীরব চোখে তাকালো। বুকের গভীরতম শ্বাসটা ছাড়তে-ছাড়তে চোখ বুজলো মেহনূর। এখনো সময় আছে। এখনো চারদিন বাকি। বৃহস্পতি-শুক্র-শনি-রবি।

মেহনূর পরাস্ত হয়ে মারজার কাছে গেলো। খুলে বললো ঘটনা। সবটা শোনার পর চুপ হয়েছে মারজা। একদিকে ছেলের জেদ, অন্যদিকে বউয়ের চিন্তা। দুটোই ঠিক, আবার দুটোই ঠিক না। কাকে রেখে কাকে বলবে বুঝতে পারছেন না। মারজা কিছুক্ষণ নীরব থেকে আপনমনে ভাবলেন। যোগ্য সুরে বললেন,

– তোকে কোনোদিন ছেলেবউয়ের মতো দেখিনি। নিজের সন্তানের মতো দেখেছি। মেয়ের মা হয়ে একটাই কথা বলবো, তুই কি ওর ইচ্ছাতে নিজের সুখ বিসর্জন দিবি? আমি এতোদিন জানতাম, তোরা স্বামী-স্ত্রীর মতো চলছিস। দেখেও তোদের বুঝতে পারিনি। একত্রে আছিস, একত্রে চলছিস, তাও তোদের মধ্যে ফারাক? মানলাম তোদের আত্মিক সম্পর্ক হয়ে গেছে। কিন্তু, অন্যান্য সম্পর্ক নিয়ে ঢিলেমি? তোরা কি বিয়েটাকে ফাজলামি পেয়েছিস?

তুই কি জানিস না, সব সম্পর্ক একটা-আরেকটার সাথে জড়িয়ে আছে? এ কেমন চিন্তাধারায় চলছিস তোরা? ও তোকে দূরে রাখলো, তুইও হেসে-খেলে দূরে থাকলি? তোদের উপর যথেষ্ট রাগ হচ্ছে মেহনূর। যেই কারণে মাহতিমের সমস্ত কথা আমি শুনলাম, ও দেখি একটাও শোনেনি। আমি বারোটা মাস অসুস্থ থাকি বলে তোরা ধোঁকা দিবি? এই চটক দেখাবি? আমি কিন্তু সহ্য করবো না! ওকে ফোন দে। এক্ষুনি ফোন দিবি। না ধরলে দিতেই থাকবি। নে, ফোন ধর্।

মারজার বাড়িয়ে দেওয়া ফোনে কল দিলো মেহনূর। দুটো কলিং টিউন যেতেই রিসিভ করলো সে। ব্যস্ত গলায় বললো,
– হ্যাঁ মা। শর্টকাটে বলো,
মারজা জুত করে বসলেন। গলাটা চড়া করে ক্রোধের সাথে বললেন,
– আমার সাথে নাটক করিস? কল কাটবি না! যা জিজ্ঞেস করছি ঠিকঠাক মতো উত্তর দিবি।
বিষম খেলো মাহতিম। ওপাশ থেকে নীরব হলো সে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আন্দাজের সুরে বলে,

– বাহ্, চমৎকার! চালাকির লেভেল এই পযর্ন্ত এসে গেছে? মাহদির ভাবীকে বলে দিও ওর কথা…
ক্ষেপে উঠলেন মারজা। প্রচণ্ড ধমকে উঠলেন তিনি,
– চুপ ! ‘ মাহদির ভাবী, মাহদির ভাবী ‘ করবি না। ও তোকে নাচায়, না তুই ওকে নাচাস? তোর কানটা ছিঁড়ে ফেলবো মাহতিম! আমার সাথে ওস্তাদিপনা বন্ধ করবি। তোর বাপ যা করেছে তা করে গেছে। এখন যদি আমার সাথে বাটপারি করিস, আজন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো।

মাহতিম ক্ষণিকের জন্য চুপ হলো। পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে জব্দ গলায় বললো,
– তুমি আমার উপর ক্ষেপে আছো কেন? ওর হিসাব তো বুঝলাম। বেচারি অতিরিক্ত চিন্তার ঠ্যালায় লাউ-কদু বলছে। কিন্তু, তুমি আমার উপর হাউকাউ করছো কেন?
মারজা নাক ফুলিয়ে দম ছাড়লেন। ক্রোধটা ঠান্ডা করে প্রস্তুত গলায় বললেন,
– চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো। এতো বড় হয়েছিস এখনো বুঝতে পারিস না? কি নিয়ে ক্ষেপতে পারি জানিস না? আমি মরলে পরে সন্তান নিবি?

হাঁফ ছাড়লো মাহতিম। কপালে ঠাস করে ডানহাত রাখলো। হায়রে মহিলা মানুষ রে! জিন্দিগী একেবারে তামা-তামা হয়ে শেষ। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাপ পযর্ন্ত কথা তুললো। মাহতিম ডেস্কের নোটপ্যাডটা বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলো। চোখদুটো বন্ধ করে ক্লান্ত গলায় বললো,
– তুমি আছো সুখের চিন্তায়, আমি আছি কাজের ঠ্যালায়। মেহনূর পাশে আছে? থাকলে সাইডে পাঠাও।
মারজা ছেলের কথা শুনে বউয়ের দিকে তাকালেন। যদিও চায়ের তেষ্টা নেই; তবুও ফরমাশ করলেন তিনি। মেহনূর বাধ্য বউয়ের মতো বিদায় হলে কলটা লাউডে রাখলেন। আরাম করে বললেন,

– হ্যাঁ, গেছে।
চেয়ারে দোল খাচ্ছে মাহতিম। গোল-গোল পাক খেতেই প্রসন্ন সুরে বললো,
– আমার ইচ্ছা তোমাকে ডজনখানেক নাতি-নাতনী দিবো। কিন্তু, সবকিছুরই সময় আছে মা। তুমিও যদি আট-দশটা মায়ের মতো কথা বলো, তাহলে কিভাবে হবে বলো? ওকে এসবের জন্য বকাবকি কোরো না। ওর তো দোষ নেই। আমি নিজেই থেকেই পিছিয়ে আছি। আমি একটা কেসে খুবই ব্যস্ত মা।

সামনে ওরও ফাইনাল এক্সাম। আমি কোনো চাপের মধ্যে থেকে প্ল্যানিং করতে চাচ্ছিলাম না। তাছাড়া ওর যদি ইচ্ছে থাকতো, এতদিনে মুখ ফুটে বলতো। ও আমাকে বলেনি। হয়তো মেন্টালি প্রস্তুত না। সবটা গোছাতে টাইম নিচ্ছে। মাত্রই তো কোয়ার্টারে এনে উঠালাম। ওকে একটু খাপ খাওয়ানোর সুযোগ দিচ্ছি। স্বামী হিসেবে এইটুকু কর্তব্য যদি পালন না-করি, তাহলে কি বাইরের মানুষ এসে পালন করবে? ভবিষ্যতে যদি আমার একটা মেয়ে হয়, তাহলে ওর ভাগ্যে আমার কুকর্ম জুটবে না?
ছেলের কথা শুনে শান্ত হলেন মারজা। কিছুটা কোমল হয়ে বললেন,

– বাবা রে, তুই যে দেরি করছিস এটা কি আশেপাশের মানুষ বুঝবে? তারা তো নাক গলাবে, হাসি-ঠাট্টা করবে, বউকে নিয়ে নানান কথাও শোনাবে। আমিতো বাবা আজ আছি, কাল নেই। মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে। ওর তো দেখভালের জন্য কেউ নেই। সারাটা দিন তোর কোয়ার্টারে পরে থাকে। এমন জায়গায় রেখেছিস ওর কেউ নেই। ওর দিকটা তো ভাবতে হবে। এমনেই মানুষ তোর বিয়ে নিয়ে কত কথা বলছে। ওগুলো মানা যায় বল্?
স্মিত হাসলো মাহতিম। প্রত্যুত্তরে যুক্তি ছুঁড়ে বললো,

– প্র‍্যাক্টিক্যালি ভাবতে হয় মা। ধরো, মেহনূরের সাথে চুটিয়ে চার বছর প্রেম করলাম। কোনো বিয়ে-ফিয়ে করলাম না। তখন সমাজ আমার চরিত্র নিয়ে যেই সার্টিফিকেট দিতো, আজও বিয়ে করার পর একই সার্টিফিকেট দিচ্ছে। তখন সোজাসুজি মুখের উপর ‘ লুইচ্চা ‘ বলতো, আজ ইনিয়ে-বিনিয়ে বয়সের খুঁত ধরছে। এটা হাস্যকর মা। সমাজের ছুঁচোলো কথায় যদি বেঁকে বসি, আমার বিপদের বেলায় কেউ হেল্প করতে যাবে না।

সবাই গা বাঁচাতে পটু। আমার বউ, আমার সংসার; ইনকামটাও আমিই করি। ওকে পেলে-পোষে বুড়ি করবো, না জননী বানাবো সেটাও আমার চিন্তা। তুমি মানুষের কথা বাদ দাও তো। কটা দিন শান্তিমতো কাটাও। আমি বিকেলের দিকে ফিরছি। বাসায় এসে বাকি কথা বলবো।

মারজা আর তর্কে গেলেন না। কথাগুলো কোনো অংশে ভুল না। বিয়ে ছাড়া প্রেম করলে বিপদ। আবার, বিয়ের পর প্রেম করলে সমস্যা। ছেলের মোক্ষম কিছু যুক্তির কাছে মান্য হলেন মারজা। নতশীর হয়ে ফোনটা কেটে দিলেন তিনি। দরজার ওপাশ থেকে সবটা শুনে ফেললো কেউ। তার হাতে ছোট্ট একটা ট্রে; তাতে ধোঁয়া উঠা এক কাপ চা।

বহুদিন পর বই নিয়েছে মেহনূর। বুকের তলায় বালিশ রেখে উপুড় হয়ে পড়ছে। মাথার উপর ত্রি-ফলা ফ্যানটা ফুলস্পিডে ঘুরছে। বেসামাল হাওয়ায় চুলগুলো মৃদ্যু-মন্দ উড়ছে। সেই পুরোনো দিনের মতো অনুভূতি হচ্ছে। সেই গোয়ালঘর, সেই গ্রামের গন্ধ, সেই ছোট-ছোট স্মৃতি! ওগুলো মনে পড়লে শিরশিরে হাওয়া লাগে। মেহনূর যেন সবই অনুভব করছে। এখনো আসেনি মাহতিম। আজ বড্ড দেরি করছে। সুলেখক নিমাই ভট্টাচার্যের চমৎকার একটি উপন্যাস।

‘ মেমসাহেব ‘ বইটা পড়তে-পড়তে ডুবে গেলো সে। এক অদ্ভুত রোমান্ঞ্চে বশীভূত হলো। দেখতে-দেখতে সময়ের কাটা বহুক্ষণ পেরুলো। বইটা যখন মধ্যভাগে এসেছে, ঠিক তখনই মেহনূর চমকে গেলো। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িতে চাইলো। কি সর্বনাশ! ইয়া আল্লাহ্! ঘড়িতে দশটা বাজে কেন? মেহনূর ধপ করে শোয়া করে উঠলো। চটপট দুহাতে খোপা পাকিয়ে বিছানা থেকে নামলো। উদ্দেশ্য এখন ফোন করবে।

কিন্তু ফোন কোথায়? ফোনের জন্য এদিক-ওদিক তাকাতেই হঠাৎ বাতি নিভে গেলো। কি ব্যাপার? বাতি নিভলো কেন? এখন তো লোডশেডিং হয় না। ঢোক গিললো মেহনূর। কেমন যেন লাগছে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। মেহনূর দেয়াল হাতড়ে-হাতড়ে রুম থেকে বের হলো। অন্ধকারটা চোখ সয়ে গেছে। এক-পা এক-পা করে এগুতেই হঠাৎ গা শিউরে উঠলো! থেমে গেলো মেহনূর। একটা সুক্ষ্ম শব্দ পেছন থেকে আসছে।

শব্দটা খুব মিহি। ওর দিকেই আসছে। মেহনূর যেন ঠান্ডা হয়ে গেলো। কোয়ার্টারে কেউ ঢুকেছে? এতো সিকিউরিটি সত্ত্বেও কেউ প্রবেশ করেছে? মেহনূর সাহস সন্ঞ্চার করে একটু-একটু করে পিছু ঘুরতে নিলো। পেছনের দিকেই ঘুরতেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো সে! আর্তনাদে গোঙানি দিতেই মুখ চাপলো কেউ।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২১

মেহনূর অস্থিরভাবে নড়াচড়া করতেই শূন্যে তুলে ফেললো। মেহনূর শব্দ করতে পারছে না! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, শব্দ হচ্ছে না।
প্রচণ্ড ভয়ে হাত-পা ছেড়ে দিলো মেহনূর। এক ভয়াবহ ত্রাসের কাছে নত হয়ে সংজ্ঞা হারালো সে।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩