মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩ 

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩ 
ফাবিয়াহ্ মমো

#নোটবার্তা : এই পর্বটা আগেও লিখেছিলাম। কিন্তু, সেখানে ছিলো অগোছালো। তাই চেষ্টা করলাম, একটু নতুনভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখি। জানিনা কতটুকু ফলপ্রসু হলো। সমস্ত পাঠক যেন ছোট্ট মন্তব্যে একটুখানি জানিয়ে দিবেন। সবার প্রতি ভালোবাসা এবং অবশ্যই আমার নিরন্তর কৃতজ্ঞতা রইলো। ❤

চিৎকার করার সুযোগ পেলো না! মেহনূর বেহুঁশ হয়ে গেলো। সমস্ত শরীরের ভার একনিমেষে ছেড়ে দিলো। নিসাড় দেহটা লুটিয়ে পরতে নিলে একজোড়া পুষ্ট বাহু তার দিকে অগ্রসর হলো। আহত-ব্যথিত ছোট্ট প্রাণীর মতো পাঁজকোলে আবদ্ধ করলো। ছোট্ট প্রাণীর দেহটা যেমন খুব নরম হয়ে কুঁকড়ে যায়, তেমনি মেহনূরের ছোট্ট দেহটা গুটিশুটি পাকিয়ে ক্ষুদ্র হয়ে গেলো। পাঁজকোলে নিয়ে তিমির রাত্রিরে বাইরে বেরুলো সে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আকাশে কোনো তারা নেই। আশেপাশে মানুষ নেই। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই অন্ধকার। বড্ড শোঁ শোঁ করে আসন্ন বৃষ্টির হাওয়া বইছে। গাছের ডালপালা আছড়া-আছড়ি করে প্রচণ্ড শব্দ করছে। এমনই একটি ছমছমে জায়গায় হেঁটে-হেঁটে আসলো সে। হাতদুটো নিচু করে ঘাসের উপর শুইয়ে দিলো। ডানহাতের মুঠোয় সামান্য পানি নিয়ে হুঁশহীন মুখে ছিটিয়ে দিলো। বৃষ্টির মতো ছিঁটেফোঁটা পেয়ে চোখ কুঁচকালো মেহনূর। শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ সামান্য নড়াচড়া করে খুবই ধীরে-ধীরে চোখ খুললো। চোখ কয়েকবার ঝাপটা দিতেই যা দেখতে পেলো, তাতে থমকে গেলো মেহনূর। সামনে যে বসে আছে, তার মুখের অবস্থা করুণ। অজানা শঙ্কায় বুকের হৃদপিন্ড ছুটছে। পলকহীন দৃষ্টিতে ঘন-ঘন নিশ্বাস নিতেই প্রশ্ন করলো মেহনূর,

– আপনি..আপনি একটু আগে কি করলেন?
ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে হাতের বোতলটা ছুঁড়ে মারলো মাহতিম! হিংস্র ভঙ্গিতে মেহনূরের দিকে একধাপ এগুলো। তৎক্ষণাৎ ঘাসের উপর মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালালো সে। চোয়াল শক্ত করে হুঙ্কার মেজাজে বললো,
– মায়ের কাছে বিচার দিয়েছো কি জন্যে? কি প্রয়োজন ছিলো? এই ধরনের ছেলেমানুষি কাজ করতে লজ্জা করে না? তুমি কোন সাহসে নোমানের কাছে ওসব কথা বলেছো? মোল্লাবাড়িতে সব বোঝানোর পরও তোমার ঘিলুতে কথা ঢুকেনি? বেকুবের মতো করলে কেন? জবাব দাও মেহনূর, জবাব দাও! চুপ করে থেকে আমার রাগ তুলো না!

চরম ধমকানি খেয়ে শিউরে উঠলো মেহনূর। ভয়াবহ ক্রোধের কাছে মিইয়ে গেলো সে। বুকটা হাতুড়ির মতো ধ্বক-ধ্বক করছে। দুটো ক্রুদ্ধ চোখের দিকে থরথর করে দাঁত কাঁপাচ্ছে। ভয় যুক্ত চোখে কিছু বলার জন্য ঠোঁট কাঁপালো মেহনূর; কিন্তু আমতা-আমতা করে কিছুই বলতে পারলো না। মাহতিম তখন চূড়ান্তরূপে নিজেকে দমানোর চেষ্টায় আছে। রাগের তীব্র উচ্ছ্বাসে তার প্রশস্ত বুকটা ফুলে-ফুলে উঠছে। নিচের ঠোঁটটা দাঁতের দংশনে কামড়ে রেখেছে ও। হাতের মুঠোয় কচি-কচি ঘাসগুলো নিষ্ঠুরভাবে ছিঁড়লো। উপর থেকে সব দেখতে পাচ্ছে সিয়াম। সে গার্লফ্রেন্ডের সাথে লুতুপুতু ফোনালাপ সারতে জানালার ধারে এসেছে। হঠাৎ নিচের দিকে চাইতেই যে দৃশ্যটা দেখতে পেলো, তাতে ওর চোখদুটো আতঙ্কে নিবদ্ধ।

– সিয়াম? কথা বলছো না কেন?
সিয়াম কথাগুলো শুনলোই না। একদম বেখেয়ালি সুরে জবাব দিলো,
– গান গাবো? না বাবু। আজ কোনো গান হবে না।
মেয়েটা ভিড়মি খাওয়ার মতো হকচকিয়ে গেলো। কি বলছে? কিসের গান? গানের কথা তো বলেনি। আহাম্মকের মতো কিছু বলবে, সেই সুযোগটাও দিলো না। সিয়াম কল তো কাটলোই, উলটো ফোনটাই বন্ধ করে দিলো। তাড়াতাড়ি তৌফকে হুলস্থুল কায়দায় ডাকতে শুরু করলো,

– বন্ধু? ও বন্ধু? ওই বান্দির পোলা হুনোস না? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়! দেইখা যা কি হইতাছে।
বিনা কারণে গালি খেয়ে ভ্রুঁ কুঁচকালো তৌফ। সে গভীর মনোযোগে গেম খেলছিলো, কিন্তু সিয়ামের ওমন উৎসুক চাহনি দেখে চটপট ছুটে গেলো। কাধে হাত দিয়ে ‘ ডাকলি কেন? কি হইছে — ‘ বলতে নিবে, ওমনেই তার চোখদুটো সিয়ামের মতো দৃষ্টিবদ্ধ হলো। বিষ্ময়ে হতবাক হলো তৌফ! মুখটা কাতলা মাছের মতো হা করে চিন্তিত সুরে বললো,

– নিচে হইতাছে কি মামু? ওরা কি ঝগড়া করতাছে? পরিস্থিতি তো সুবিধার লাগে না! মাহতিম ওমনে খিঁচ্চা আছে কেন? নিচে যাবি?
সিয়াম সাথে-সাথে বাঁধা দিয়ে থামালো। নিচু সুরে বললো,
– ধুর ব্যাটা! নিচে গিয়া কি করবি? মিয়া-বিবির মধ্যে ঢুকবি? উলটা মাহতিম তোরে মোরব্বার মতো ক্যাচা-ক্যাচা কইরা দিবো। আমার মন কইতাছে, ভাবী মনেহয় কিছু করছে।
তৌফ আরেকটু মনোযোগ দিয়ে তাকালো। মেহনূরের হতবিহ্বল মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো। মনে-মনে একটা অনুমান করে বললো,

– তোর মন তো কতকিছুই কয়। টয়লেটে গেলে রিয়া, খাইতে গেলে বিয়া, শুইতে গেলে খালি বাবু-বাবু করোস। তোর এই নষ্ট মনরে আমি পা দিয়া লাত্থি মারি। আউলফাউল লজিক না মাইরা খাম্বার মতো তাকায়া থাক।
তৌফের কাছে একপ্রস্থ কটুক্তি শুনে ক্ষেপে গেলো সিয়াম। তৌফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,
– তোর এতো চুলকানি ক্যান? কথায়-কথায় রিয়ার টপিক না-উঠাইলে চলে না? ছ্যাঁচড়ার মতো কথা শুনাস কোন দুঃখে?
বাইরে থেকে চোখ সরালো তৌফ। সিয়ামের দিকে একপলক তাকাতেই দুম করে এক কিল বসালো। সিয়াম পিঠের ব্যথায় ‘ উঃ রে ‘ বলে চোখ খিঁচালে তৌফ তখন মুখ ভেংচিয়ে বললো,

– আমার চুলকানিও নাই, চুস্কামিও নাই। তোর মতোন বুইড়া বাবু পালি না। ফারিনরে যদি বাবু ডাকি, ওয় আমার কান এক টানে ছিঁইড়া লুভ্যর মিউজিয়ামে চালান দিবো। এখন এই মোমেন্টে আর ছ্যাবলামি না-কইরা সিচুয়েশনটা বুঝতে দে।
তৌফের এক ঘায়ে জব্দ হলো সিয়াম। দুজনই উপর থেকে বাকিটুকু দেখতে লাগলো। যদি পরিস্থিতি বিপর্যয়ের দিকে যায়, তাহলে ওরা নামবে, নইলে নামবে না। মেহনূর দুহাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠে বসলো। চোখ নিচু করে কাতর সুরে বললো,

– মা বাধ্য করেছে তাই বলেছি। আমি কারো নামে অভিযোগ করিনি। সকালে চুলার ধারে অন্যমনষ্ক হয়ে কেন হাত পুড়লাম, ওটা দেখতে গিয়ে মা কসম দিয়েছে। এখন সে যদি কসম কেটে জানতে চায় আমি কি মিথ্যা বলবো?
মেহনূর নিচু মুখেই বাঁহাতটা বাড়িয়ে দিলো। হাতের মুঠো খুলতেই মাহতিম দেখলো, তেলোর ফর্সা চামড়াটা কালচে হয়ে আছে। আগুনের ছ্যাঁকায় জায়গাটা কিন্ঞ্চিত দগ্ধ। হাত থেকে চোখ সরিয়ে নতমুখটার দিকে তাকালো। কোলের উপর টপটপ করে অশ্রুফোঁটা ঝরছে। দৃশ্যটা দেখে মাহতিম দাঁড়ালো না। সশব্দে নিশ্বাস ছেড়ে মোবাইলটা নিয়ে চলে গেলো। অন্ধকারে শীতল হাওয়ার মাঝে পরে রইলো মেহনূর। সেই পুড়ে যাওয়া হাতটা পুনরায় মুঠোয় চেপে নিঃশব্দে অশ্রু ফেললো। প্রকৃতির বাতাস বারবার চোখের পানি শুষ্ক করতে চাইলো, কিন্তু হায়! নীরব অশ্রু বড় সাংঘাতিক। মেহনূর কোলের দিকে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে দিলো।

উপর থেকে সবই দেখলো ওরা। তৌফের মনটা খুব খারাপ হলো। মনে-মনে মাহতিমকে প্রচুর গালাগাল করলো। কেন যে ওদের মধ্যে সমস্যাটা হলো, সেটাই ওরা জানে না। সিয়াম হাপিত্যেশ করে বুক ভারী নিশ্বাস ছাড়লো। তৌফের কাধে হাত রেখে আস্তে করে বললো, ‘ চল বন্ধু, ঘুমায় পর ‘ ।

অন্ধকারে পা টিপে-টিপে ফিরে আসলো মেহনূর। রুমের কাছাকাছি আসতেই চোখদুটো আরেকবার আঁচলে ঘষে নিলো। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বিছানায় চোখ পরলো; দেখলো, মানুষটা ড্রিমলাইটের আলোয় শুয়ে পরেছে। আজ তার জন্য অপেক্ষা না-করেই ঘুমাতে এসেছে। দরজাটা লক করে বিছানায় আসলো মেহনূর। খাটের বাঁদিকটা খালি রেখে ওপাশ ফিরে শুয়েছে। যতটুকু বল নিয়ে রুমে ফিরলো, তার চেয়ে শতগুণ যন্ত্রণা এইটুকু দৃশ্য দেখে হচ্ছে। কোয়ার্টারে এখন পযর্ন্ত আলাদা ঘুমায়নি, মাহতিম সজ্ঞানে কখনো পিঠ দিয়ে শোয়নি; অথচ, আজ সামান্য কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মেহনূর বালিশ ঠিক করতে-করতেই হঠাৎ হাতে কি যেনো স্পর্শ করলো। একটু বিষ্মিত হয়ে জিনিসটা মুঠোয় টেনে আনলো। ডানহাতের উপর মোবাইলের আলো ফেলতেই অবাক হলো সে! সাদা কাগজে ছোট্ট একটা চিরকুট। সেখানে টানা-টানা অক্ষরে নীল কালিতে লিখা,

‘ কাল আমার সাথে ঘুরতে যাবে? ‘
বারবার, বহুবার, অসংখ্যবার চিরকুটটা পড়লো মেহনূর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তেই থাকলো। খুশিতে-আমোদে-প্রফুল্ল হয়ে ওই অবস্থায় কেঁদে দিলো সে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ফিসফিসিয়ে উঠছে। ভেজা চোখে ওই মানুষটার দিকে চাইলো মেহনূর। এমুখো পিঠ দেওয়া ওই নিষ্ঠুরটাকে পেছন থেকে জাপটে ধরলো। পিঠের কাছে নিজের মাথাটা উন্মাদের মতো লুকিয়ে নিলো। তার বুকের উপর রাখলো নিজের বাঁ-হাত। মাহতিম দগ্ধ হাতটা তুলে ঠোঁটে এনে রাখলো। ঘুম-ঘুম চোখে তেলোর ক্ষতে আদর করতে লাগলো। যতক্ষণ পযর্ন্ত দু’চোখের পাতা কঠিন ঘুমে তলিয়ে না-গেলো, ততক্ষণ সে ছুঁয়ে দিলো, ছুঁয়ে দিলো, ছুঁয়েই দিলো।

খুব সকালে উঠলো মেহনূর। নাস্তা বানিয়ে সবকিছু রেডি করে ফেললো। একে-একে সবাই ঘুম থেকে উঠে নাস্তা পর্ব সারলো। তখনই সবাই জানতে পারলো, মাহতিম আজ বেরুবে। সঙ্গে একটু অফিশিয়াল কাজ এবং দুটো দিন বেশি ছুটি পাচ্ছে। এই সুযোগে মেহনূরকে নিয়ে একটু পরেই বের হবে। কথাটা শুনে মিটিমিটি হাসছে তৌফ। সিয়ামের দিকে ভ্রুঁ নাচিয়ে ওর কানের কাছে বললো,

– ফিলিং জুশ মামু। কাহিনি কিছু বুঝছো?
সিয়াম তৌফের সাথে তাল মিলিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– হ, মামু। কালকের আশিকি টু দেইখাই বুঝছি।

দুজনের ফিসফিসানি কারবারটা দেখতে পেলো ফারিন। সে সবেমাত্র ডালের বাটিতে রুটি ঘুরাচ্ছিলো, ঠিক তখনই ওদের চুপিচুপি আলাপ দেখে ডানপাশে কনুই গুঁতা মারলো। হঠাৎ মুখে রুটি পুড়তে গিয়ে বিষম খেলো সৌভিক। কনুইয়ের গুঁতা খেয়ে বিরক্ত চোখে তাকালে ফারিন চক্ষু ইশারা করলো। ফারিনের ইশারা ধরে সামনে তাকাতেই দুই বদমাশের ফুসুর-ফুসুর দেখতে পেলো সে। সৌভিক কিছু না-বলে ফারিনের দিকে বোতলের ক্যাপ এগিয়ে দিলো। ফারিন গোল ক্যাপটা তুলে তৌফের কপাল বরাবর মারলো ছক্কা! সাথে-সাথে আর্তনাদে চিৎকার দিলো তৌফ,

– ও মা গো! কি রে, কি হইলো? উহঃ রে, কপালটা মনে হয় গেছে।
কপালে হাত বুলাতেই ফারিনের হাসিটা দেখতে পেলো তৌফ। রাগে নাক ফুলিয়ে সোজা মারজার কাছে নালিশ করলো,
– দ্যাখছেন আন্টি? আমার মতো সুস্থ পোলারে ক্যামনে ইন্ঞ্জুর্ড করলো দ্যাখছেন? ফারিনরে যদি কিছু না-বলছেন, আমি এখুনি খাবার রাইখা উঠলাম!
ঠাস করে মাথায় এক গাট্টা খেলো তৌফ। মুখটা বিকৃত করে পিছু তাকাতেই মাহতিমকে দেখতে পেলো। মাহতিম ডানহাতে তুড়ি বাজাতে-বাজাতে বললো,

– উঠ, উঠ; তুই উঠ্! অলরেডি চারটা রুটি গিলে ভদর-ভদর করছিস। আর গেলা লাগবে না, উঠ।
তৌফ দুই ভ্রুঁ এক করে গর্বের সাথে বললো,
– আপনা টাইম আয়ে গা। আজকে যেই অপমানটা করলি না? এটার প্রতিশোধ অবশ্যই নিমু বন্ধু। তোমার পোলাপানরে দেখিও আমার বাচ্চাকাচ্চা দিয়া ভাগায়া আনমু।

হো-হো করে হেসে দিলো সবাই। সৌভিক হাসির চোটে রুটিই খেতে পারলো না, নীতি তাক-লাগা হাসিতে জমে আছে, প্রীতি হাসতে-হাসতে মাথা নিচু করেছে। মারজা হাসি থামাতে-থামাতে আবার হেসে ফেলছেন। মাহতিম হাসতে-হাসতে হঠাৎ চোখ আঁটকে ফেললো। পেটফাটা হাসিতে মেহনূরের মুখটা লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। এই লালাভ মুখের দৃশ্যটা মাহতিম দুটো কারণে দেখলো। প্রথমটা ছিলো সন্ধিক্ষণের লজ্জায়, পরেরটা হলো এই হাসির রাজ্যে।

আকাশটা দারুণ দেখাচ্ছে। একটু অভিমানী চেহারায় গুমিয়ে আছে। মাঝে-মাঝে উত্থাল হাওয়াটা শীত ধরিয়ে দেয়। মেঘলা আকাশের ফাঁকে-ফাঁকে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে আবারও গ্লাসটা ঝাপসা হয়ে গেলো। একটা সুইচ অন করতেই দু’পাশ থেকে দুটো কাটা বৃষ্টির ছাঁট সরাতে লাগলো। টয়েটো গাড়িটা ঘন্টায় ষাট কি.মি.তে ছুটছে। পাশেই মেহনূর জানালার কাঁচ নামিয়ে বৃষ্টির পানির বুলাচ্ছে। মাহতিম ড্রাইভের ফাঁকে-ফাঁকে লক্ষ করতেই প্রসন্ন গলায় বললো,
– তোমার কি ভিজতে মন চাচ্ছে?

মেহনূর জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। ভেজা হাতদুটো পরস্পর ঝারা দিতেই বললো,
– না, হালকা বৃষ্টিতে আমেজ নেই। ঝুম বৃষ্টি হলে শান্তি। যদি সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস থাকে, একটু নিরিবিলি জায়গা হয়, কয়েক হাতের মধ্যে বড় একটা গাছ থাকে, তাহলে তো আরো আনন্দ। আমি ওরকম বৃষ্টিতে চাই। ওরম বৃষ্টির জন্য আপত্তি করবেন?

মাহতিম স্পিড বাড়িয়ে একটু হাসলো। ওর দিকে একপলক চেয়ে ফের ড্রাইভ করতেই বললো,
– অবশ্যই করতে হবে। ওরকম বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার সমস্যা। তোমার শুধু জ্বর-ঠান্ডা লাগে না। তোমার ডিরেক্ট নিউমোনিআ হয়ে যায়। তোমাকে নিয়ে কেন বের হই না জানো? একমাত্র বৃষ্টির জন্য। যখনই একটু স্পেস নিয়ে বের হই, ওমনেই দেখি বৃষ্টি হাজির।

হঠাৎ আধ ঘন্টার ভেতর তুখোড় বৃষ্টি নামলো। আকাশটা যেন আরো কালো করে আছে। রাস্তাগুলো জনশূন্য। গাড়ির ভেতরটা সন্ধ্যার মতো অন্ধকার। বৃষ্টির প্রবল ধারায় পথঘাট শেষ। গাড়িটা পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় উঠেছে। জায়গাটা গ্রামও না, শহরও না; ছিমছাম একটা মফস্বল। জানালার বাইরে দেখতে-দেখতে মেহনূর প্রশ্ন করলো,
– এখানেও আপনার কানেকশন আছে?

মাহতিম কথাটা শুনে ফিক করে হাসলো। গাড়িটা ডানে নিতে-নিতে বললো,
– জায়গাটার সাথে স্মৃতি জড়ানো আছে। তাই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
মেহনূর উৎসুক চোখে তাকালো। কৌতুহল গলায় বললো,
– কেমন স্মৃতি?

এটার জবাবে মাহতিম শুধুই হাসলো। আপাতত মেহনূর কিছুই জানলো না। ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় পুরোনো একটা বাড়ির কাছে গাড়ি থামলো। দোতলা বাড়িটায় কেমন সেকেলে-সেকেলে ভাব। তবুও একটা শৌখিনতার ছোঁয়া এখানে-সেখানে গেঁথে আছে। যেন কেউ খুব যত্ন করে এখনো বাড়িটা আগলে রেখেছে। একটা ছাতা খুলে দুজন একসঙ্গে ভেতরে ঢুকলো। মেহনূর চারপাশের অবস্থা দেখে অবাক হয়ে বললো,
– এখানে কি কেউ থাকে? দেয়াল-মেঝে সব চকচক করছে।
মাহতিম ছাতা বন্ধ করে সিঁড়ি ধরে বললো,

– হ্যাঁ, একজন বিধবা খালা থাকেন। এই বাড়িটা দেখভাল করার জন্য উনাকে বেতন দেওয়া হয়। আজ যে এখানে আসবো, তাই উনি বিশেষ ভাবে যত্ন করেছেন।
দরজাটা ধাক্কা দিতেই দ্বারদুটো খুলে গেলো। সুবিশাল একটি রুম, জানালায় আদিকালের মতো লম্বা-লম্বা শিক দেওয়া, চারিদিকে বিভিন্ন ঘরোয়া আসবাবপত্র। সবচেয়ে বেশি নজর কাড়লো শোবার খাটটা। স্ট্যান্ড খাটটা যেন নবাবী আমলের রাজা-বাদশাদের মতো। খাটের চর্তুদিকে পর্দা দিয়ে আবৃত। ফিনফিনে সাদা পর্দাগুলো বাতাসে খুব দুলছে। মাহতিম ট্রাভেল ব্যাগ থেকে জরুরী কিছু বের করছে। ঠিক তখনই মেহনূর ইতস্তত চোখে বললো,

– শুনুন,
মাহতিম চোখ তুলে তাকালো। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দম্ভের সাথে বললো,
– বাইরে যাওয়া নিষেধ।
মেহনূর সংশয়ের চোখে তাকালো। অনুনয় করে বললো,
– একটু ভিজে আসি?
মাহতিম কড়া গলায় জানালো,
– না।
মেহনূর আবার আকুতি-মিনতি করে বললো,

– একটু ভিজি? বেশি না, একটু? শুধু পাঁচ মিনিট?
মাহতিম একটু ভাবলো। চিন্তা করে বললো,
– আচ্ছা, ঠিকআছে। পাঁচ মিনিট, কিন্তু বেশি দেরি কোরো না।

মেহনূর সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। ছুটে গেলো ভিজতে; দু’হাত ছড়িয়ে বৃষ্টির আস্বাদন নিতে; চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাতে। এই ঠান্ডা পরশ জাগানো বৃষ্টি যেন সব ধূলো-ময়লা ঘুচিয়ে দিক। প্রাণে-প্রাণে হৃদয়ে-হৃদয়ে চান্ঞ্চল্যকর অনুভূতি পৌঁছে দিক। দোল লাগিয়ে প্রফুল্ল করুক মন। মেহনূর প্রাণভরে দু’হাত জুড়ে ভিজতে লাগলো। গুনগুন করলো মনে-মনে। সময়ের হিসেব রইলো না, ভিজতে-ভিজতে বহুক্ষণ পেরিয়ে গেলো। অপরদিকে মাহতিম আইপ্যাডে ব্যস্ত। কিছু ডকুমেন্ট চেক করতে-করতে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। আইপ্যাডটা সাইডে রেখে ফোনটা হাতে নিলো মাহতিম। আইপ্যাডটা সাইডে রেখে সাগ্রতর কলটা রিসিভ করলো,

– হ্যালো,
ধীরে-ধীরে দরজা খুলে গেলো। ঘরে প্রবেশ করলো সদ্য স্নাতা মানবী। স্নিগ্ধ সেই মুখ; নেশাময় সেই বেশভূষা। টুপটুপ করে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে। গা চুয়ে-চুয়ে ঝরছে অসংখ্য বৃষ্টি-ফোঁটা। গায়ে হালকা হলুদ রঙের শাড়িটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। হলুদের নিচে কালো ব্লাউজটা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। শীতে কাঁপছে ওই স্নাতা দেহ; চোখ লুটিয়ে রেখেছে মেঝেতে। মাথার ডানপাশে সিঁথি; লম্বা-লম্বা কেশরাশি বুকের দুপাশে ঝুলছে। এখনো ফর্সা চামড়ায় অসংখ্য বিন্দু মুক্তোর মতো জ্বলছে। যেন ছোঁয়া পাবার আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষা করছে।

লজ্জায়-কুণ্ঠায় ছোট্ট মুখটা এখনো নুইয়ে আছে। যদি চোখ তুলে তাকায়, তাহলে সাংঘাতিক কিছু একটা হয়ে যাবে! মাহতিম সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে তখনও জানতো না, তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। এখনো ফোনের ওপাশ থেকে সাগ্রত চেঁচিয়ে যাচ্ছে, আপ্রাণভাবে জানিয়ে যাচ্ছে কিছু! কিন্তু, সেদিকে হুঁশ নেই মাহতিমের। তার দৃষ্টিজোড়া শুধু দরজার দিকে আবদ্ধ। মেহনূর অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে তাকালো, সেই চাহনিটুকু দেখে মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো মাহতিম আনসারীর। সে আকুল চোখে ব্যকুল ঠোঁটে শান্তির হাসি দিলো। সেই হাসিতে অধীর হয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,

‘ প্রহর শেষে রাঙা আলোয় সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ ‘

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২২

#নোটবার্তা : এই পর্বটা আগেও লিখেছিলাম। কিন্তু, সেখানে ছিলো অগোছালো। তাই চেষ্টা করলাম, একটু নতুনভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখি। জানিনা কতটুকু ফলপ্রসু হলো। সমস্ত পাঠক যেন ছোট্ট মন্তব্যে একটুখানি জানিয়ে দিবেন। সবার প্রতি ভালোবাসা এবং অবশ্যই আমার নিরন্তর কৃতজ্ঞতা রইলো। ❤

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৪