অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫১

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫১
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

পাঁচদিন কেটে গেছে। ইকবালকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে খোঁজায় চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেননি রাশেদ। কিন্তু লাভ হয়নি। ইকবালের বৃদ্ধা মা কান্নাকাটি করে গেছেন। তার চাচাতো ভাইয়েরা থানায় ডায়েরি করেছে গত পরশু। পুলিশও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। ফলাফল এখানো শূণ্য।

সকাল দশটার দিকে আমের ফাউন্ডেশনে এসে উপস্থিত হলো ইন্সপেক্টর আজিজ। বিল্ডিংয়ের সামনে বড়বড় করে ‘আমের ফাউন্ডেশন’ লেখা সাইনবোর্ড। লেখাটা পড়ে বরাবরের মতোই বিদ্রুপের হাসি হাসল সে। সরাসরি রাশেদের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে তাকিয়ে দেখল রাশেদ নিজের চেয়ারে বসে ফাইলে কিছু দেখছেন। রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর তিনজনই উপস্থিত।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজিজ প্রবেশের অনুমতি নিতেই যাচ্ছিল তার আগেই রাশেদ বলে উঠলেন, ‘আসুন ইন্সপেক্টর।’
আজিজ স্পষ্ট দেখল তার দিকে না তাকিয়েই রাশেদ তার উপস্থিতি টের পেয়েছে। মনে মনে আরো একবার লোকটার অদ্ভুত ইন্দ্রিয়ের প্রশংসা করতে বাধ্য হলো আজিজ। বাকি তিনজন একপলক আজিজের দিকে তাকিয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজিজ মুচকি হেসে ভেতরে গিয়ে বলল, ‘ভালোই হলো চারজনই আছেন এখানে।’

‘বসুন,’ রাশেদের দৃষ্টি এখনো ফাইলে।
আজিজ একটা চেয়ার টেনে বসল। রুদ্র ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল। নিজেকে সে কাজে ব্যস্ত রেখেই বলল, ‘চা, কফি নাকি শরবত জাতীয় কিছু?’
আজিজ ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বলল, ‘চা।’
দরজার কোণে রঞ্জু দাঁড়িয়ে ছিল। রুদ্র তাকাতেই রঞ্জু চলে গেল। চা আনতে হয়তো। আজিজ হাসিমুখেই রাশেদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আবার আরেকটা কেইস। এবারও আপনারই ফাউন্ডেশনের লোক। কাকতালীয় ঘটনা যেন পেছনই ছাড়েনা আমাদের। তাইনা?’

এতক্ষণে ফাইল থেকে চোখ সরালেন রাশেদ। চশমাটা খুলে তাকালেন আজিজের দিকে। নিজের সেই বজ্র কন্ঠে বললেন, ‘সেভাবে বললে জগতে যা ঘটে সবই কাকতালীয় ইন্সপেক্টর।সেসব ছাড়ুন। ইকবালের কোন খবর?’
‘বিশেষ কিছু না। তবে গতকাল ইকবালের ঘরটা সার্চ করেছিলাম আমরা। কিন্তু আমার দেখে মনে হলো আমরা পৌঁছনোর আগেই কেউ একজন ওখানে পৌঁছেছিল। এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সরিয়েছে।’

কথাটা শুনে রুদ্র আর উচ্ছ্বাস একে অপরের চোখের দিকে তাকাল। কেইসটা পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছুতেই ইকবালের ঘরে সার্চ করেছে ওরা। দল সম্পর্কিত সমস্ত কাগজ এবং অন্যান্য তথ্য সরিয়ে দিয়েছে। পুলিশের হাতে কিছু আসার কথা নয়। রাশেদ বলল, ‘তো সেখানে আমার করণীয়?’
‘করণীয় কিছুই নেই। কিন্তু যেহুতু আপনার ফাউন্ডেশনেই কাজ করতো তাই জানিয়ে রাখলাম। তবে ওর ঘরে একটা পি’স্ত’ল পাওয়া গেছে। ওয়াশরুমে।’

উচ্ছ্বাস দেঁতো হেসে বলল, ‘ওয়াশরুমে পি’স্ত’ল? বিশাল ব্যপার। আরশোলা মারতে রেখেছিল বোধ হয়।’
আজিজ হেসে ফেলল। হাসিটা দীর্ঘস্থায়ী না করে বলল, ‘সে যে কারণেই রাখুক। পি’স্ত’লটা লিগ্যাল ছিলো না। এ বিষয়ে আপনার কী মতামত, রাশেদ বাবা?’
রাশেদ নির্বিকারভাবে নিজের চশমাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘আগেও বলেছি, ওরা আমার এখানে কাজ করে। কিন্তু কাজের বাইরে কে কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কেন করছে, কার কাছে কী আছে এসব আমার দেখার বিষয় না। ওটা আপনার কাজ। আপনিই দেখুন।’

মাথা ঝাঁকাল আজিজ। বুঝল এই লোককে দিয়ে নিজের মনের মতো একটা শব্দও উচ্চারণ করাতে পারবে না। সে যত চেষ্টাই করুক। আজিজকে চুপ থাকতে দেখে রাশেদ আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আর কিছু বলবেন?’
‘না। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম ভাবলাম খবরটা দিয়ে যাই।’

রাশেদ উত্তর দিলেন না। রঞ্জু চা নিয়ে এলো। আজ বেশ সময় নিয়ে বসে বসে চা-টা শেষ করলেন আজিজ। চা খাওয়ার সময়টা ভালো খরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন আমের ফাউন্ডেশন। দেখলেন উপস্থিত প্রত্যেকটা লোকের গতিবিধি। সবকিছুই কত সহজ, সরল, স্বাভাবিক। যেন জীবনের কোনরকম জটিলতা এরা বোঝেনা। নিতান্তই নিরীহ মানুষ। কথাগুলো চিন্তা করে মনে মনে ভীষণ হাসি পেল আজিজের।
রুদ্র আর আজিজ একসঙ্গেই বের হলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আজিজ প্রশ্ন করল, ‘কোথায় যাবে এখন?’

‘মিল ফ্যাক্টরিতে।’
‘আরেকটা থিওরি ভেবেছি বুঝলে?’
‘বুঝলাম।’
‘শুনবে না কী থিওরি?’
রুদ্র বাঁকা হেসে বলল, ‘শোনানোর জন্যেই তো বললেন। বলে ফেলুন। কান খোলাই আছে।’
আজিজ রুদ্রের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘এবারে বিশ্বাসঘাতকতা তাহলে ইকবাল করল? লাশটা কোথায় রেখেছো বলোতো?’

সিঁড়ি শেষ হল। জীপের সামনে এসে দাঁড়াল দুজন। রুদ্র নিজের রোদ চশমাটা শার্ট থেকে বের করে বলল, ‘থিওরি আপনার। প্রমাণ আপনিই খুঁজুন।’
আজিজ রুদ্রের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, ‘প্রফেশনালি তুমি আমার শত্রু হলেও পার্সোনালি আমার তোমাকে পছন্দ রুদ্র। তাই বলছি, আমার আগের থিওরিগুলো প্রমাণ করতে না পারলেও একটা ভবিষ্যৎ বাণী করতে পারি। এবং তা হবে।’

রুদ্রও তাকাল আজিজের দিকে। চোখে অদ্ভুত হাসি খেলছে ওর। মুখে বলল, ‘জ্যোতিষচর্চাও করছেন নাকি আজকাল? ভালো। কী ভবিষ্যৎ দেখলেন শুনি?’
আজিজ ঠান্ডা, স্হির কন্ঠে বলল, ‘তোমাদের বিনাশকাল চলে এসেছে রুদ্র। সোলার সিস্টেমের ধ্বংস খুব নিকটে। আর তোমারও।’

আজিজের এমন ভয়ংকর ভবিষ্যৎবাণী কোন প্রভাব ফেলল না রুদ্রের ওপর। ও নির্বিকারভাবে রোদ চশমাটা চোখে পরতে পরতে বলল, ‘সেদিনটা আপনার উৎসবের দিন হবে, স্যার। আমার নাম রুদ্র। যার নামেই ধ্বংস আছে তাকে ধ্বংসের ভয় দেখাচ্ছেন? যেদিন আমি শেষ হবো, সেদিন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।’

কথাটা বলে আর অপেক্ষা করল না। জিপে উঠে বসল রুদ্র। জিপ স্টার্ট দিয়ে আজিজকে একটা স্যালুট দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। তপ্ত শ্বাস ফেলল আজিজ। ওর যাওয়ার পথে চিন্তা করল এই ছেলেটা আর পৃথিবীতে নেই। পৃথিবীটা বুঝি কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল!

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল রুদ্র। সারাদিনে অনেকরকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। ইন্সপেক্টর আজিজের ভবিষ্যৎ বাণী নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই ওর। ও ভাবছে ইকবালের কথা। আজিজের থিওরিটা অর্ধেক সত্যি ছিল। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ইকবাল। সেটাও ওরা জানতে পেরেছে ইকবালের ঘর থেকে সব ইনফরমেশন সরানোর সময়। ওর ঘরে কিছু কাগজপত্র আর পেনড্রাইভ পাওয়া গেছে। যেটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ইকবাল তথ্য পাচার করেছিল। কিন্তু আরেকটা সত্যি হচ্ছে ওরাও ইকবালকে মারেনি। আর না নিখোঁজ করেছে। তাহলে সে কোথায়? দুটো সম্ভাবনা আছে।

এক, ইকবাল পালিয়েছে। দুই, ইকবালকে তারাই মেরে ফেলেছে বা গুম করেছে যাদের হয়ে ও কাজ করছিল। কিন্তু কাদের হয়ে কাজ করছিল? ডার্ক নাইটের হয়ে? নাকি ব্লাক হোলের হয়ে? ডেলিভারী দেওয়া অ’স্ত্রে’র সঙ্গে ওকে এটা নিয়েও মাথা ঘামাতে হবে এবার। শওকত মীর্জা নামটা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সম্রাটের খবরও নেওয়া হয়নি অনেকদিন হলো। সবদিকেই নজর বাড়াতে হবে। কথাগুলো চিন্তা করতে করতে বসার ঘরে এলো রুদ্র। প্রিয়তা, উচ্ছ্বাস, কুহু, জ্যোতি চারজনই বসে আছে। বোঝাই যাচ্ছে চা-নাস্তার আড্ডা হবে এখন এখানে। রুদ্রর উপস্থিতি লক্ষ্য করে থেমে গেল ওরা। রুদ্র প্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘প্রিয়, আমার কফিটা রুমে দিয়ে যাও প্লিজ।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘দিয়ে যাও মানে কী? যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন। এখানে বসে সবার সঙ্গে খাবেন।’
‘আজ না প্রিয়। ক্লান্ত আমি।’
প্রিয়তা উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলল, ‘সবার সঙ্গে বসে আড্ডা দিলে ক্লান্তি চলে যাবে। আর আপনি কেমন বিশ্রাম নেবেন আমার জানা আছে। সেইতো গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানবেন আর ভাবনার সমুদ্রে ডুব দেবেন। আজ সেসব হবেনা। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।’

রুদ্র ক্লান্ত কন্ঠে বলল, ‘প্রিয় প্লিজ?’
কিন্তু প্রিয়তা গলল না। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুদ্রের দিকে। সে দৃষ্টি উপেক্ষা করার ক্ষমতা রুদ্রের নেই। তাই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ফাইন।’
বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ল। প্রিয়তা পেছন থেকে বলল, ‘গেঞ্জি আর ট্রাউজার বের করে রেখেছি। বিছানার ডান সাইডে পাবেন।’

রুদ্র যেতেই প্রিয়তা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বসল সোফায়। কুহু ইশারায় স্যালুট দেখাল ওকে। জ্যোতি এতক্ষণ গালে হাত দিয়ে দেখছিল সবকিছু। হঠাৎ বুকের ভেতর কেমন করে উঠল ওর। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি গিয়ে দেখি চা কতদূর হলো।’
প্রিয়তা বলল, ‘তুমি বসো, আমি যাই।’
জ্যোতি বাঁধতে দিয়ে বলল, ‘না, তুমি বসো। আমিই যাচ্ছি।’

বলে জ্যোতিও চলে গেল। উচ্ছ্বাস ফোন স্ক্রোল করতে করতেই বলল, ‘এই ডানপিটেকে সোজা তুমি-ই করতে পারো বউমনি। আমাদের সঙ্গে আজকাল আড্ডা দিতে বসছে। এগুলো আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। ডাবল স্যালুট।’
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, ‘কিন্তু তোমাকে তো সোজা করতে পারছিনা। এখন তোমাকে সোজা করতেও তো কাউকে আনা দরকার। কী বলো? কথা বলব রাশেদ বাবার সঙ্গে?’
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসল। ফোন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, ‘আমার মতো ক্রিমিনালকে কে বিয়ে করবে বউমনি? সবাইতো আর তুমি নও।’

প্রিয়তার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। বুঝতে পারল কথাটা বলা ঠিক হয়নি। উচ্ছ্বাস যতই হাসিখুশি থাকুক। মনের ঘা-টা এখনো তাজা। কুহুও মলিন মুখ করে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে। সেটা দেখে উচ্ছ্বাস বলল, ‘তোর আবার কী হলো? নীরব ছ্যাঁকা দিলো নাকি? চোখমুখ কালো করে রেখেছিস কেন?’
কুহু কিছু না বলে এগিয়ে এসে উচ্ছ্বাসকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। উচ্ছ্বাস হাসল। কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘এতো তেল মেরে লাভ নেই। তোর পেছনে লাগা বন্ধ করছিনা।’

কুহু আরও শক্ত করে উচ্ছ্বাসকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। প্রিয়তা একটা লম্বা শ্বাস ফেলল। সকলের সামনে হাসি মুখ থেকে সরেই না ছেলেটার। কিন্তু একান্তে না জানি কী চরম যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পার করছে।
সেদিন নাজিফা চলে যাওয়ার পর কোনরকম যোগাযোগ করেনি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে। উচ্ছ্বাস ইচ্ছে থাকলেও যোগাযোগের কোনরকম চেষ্টা করেনি।

কী দরকার? নিজের অনিশ্চিত জীবনে নাজিফাকে জড়ানোটাই ওর প্রথম ভুল ছিল। নাজিফা নিজেই যেহেতু সেই ভুলটা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওরও উচিত হবেনা আবার নাজিফাকে নিজের সঙ্গে জড়ানো। তবে ভেতরে ভেতরে গুমরে যাচ্ছিল ছেলেটা। বাড়ির সবাই বুঝতে পারতো কোনো মানসিক অশান্তিতে ভুগছে উচ্ছ্বাস। কিন্তু ওকে দিয়ে হাজার চেষ্টা করেও কিছু বলাতে পারেনি। তবে প্রাণোচ্ছল উচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল।

এভাবেই দীর্ঘ একটা মাস কেটে গেল। রাত দুইটা ত্রিশ। আমের ভিলার করিডরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল উচ্ছ্বাস। আরও একটা নির্ঘুম রাত পার হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। ফোনের রিংটোনে ভাবনায় ছেদ ঘটে ওর। ফোনটা বের করে চমকে ওঠে উচ্ছ্বাস। দীর্ঘ একমাস পর অতি পরিচিত নাম্বারটা থেকে কল পেয়ে ভেতরসহ কেঁপে উঠল ওর। ব্যপারটা বিশ্বাস করতেই মিনিট খানেক লেগে গেল। ততক্ষণে কেটে গেছে কলটা। আবার বাজল। কোনরকমে নিজেকে সামলে কল রিসিভ করল উচ্ছ্বাস। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘বলো।’

ওপাশ থেকে কোন উত্তর এলোনা। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো। উচ্ছ্বাস আবার বলল, ‘নাজিফা?’
আরও দশ সেকেন্ডের নীরবতার পর নাজিফা বলল, ‘একটাবারও মনে পড়েনি আমার কথা?’
উচ্ছ্বাস হালকা হেসে বলল, ‘তোমরা কী মনে হয়? আমি এক্সের দুঃখে কেঁদে ভাসানোর ছেলে? আর আজকালকার যুগে ব্রেকআপের পর কে কাকে মনে রাখে?’
‘তুমি কী কোনদিন সিরিয়াস হবেনা? আমি মরে গেলেও হয়তো হেসে উড়িয়ে দেবে।’
‘আমার আয়ু তোমার হোক।’

উচ্ছ্বাসের অনায়াসে বলে দেওয়া কথাটায় নাজিফা থমকে গেল। কিছুক্ষণের অসহ্যকর নীরবতার পর নাজিফা বলল, ‘আজ আমাকে দেখতে এসেছিল উচ্ছ্বাস। হয়তো পছন্দও করেছে।’
উচ্ছ্বাস আরও কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, ‘তোমাকে অপছন্দ করবে এমন বোকা আছে না-কি?’
নাজিফা অধৈর্য গলায় বলল, ‘উচ্ছ্বাস আমি অন্যকারো হয়ে যাবো!’
‘আমার হতে চাইলে কই?’ কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল উচ্ছ্বাসের।

‘আমি অনেক ভেবেছি উচ্ছ্বাস। চেষ্টাও করেছি। ভেবেছিলাম কষ্ট হলেও পারব। এই একটা মাস কষ্ট হলেও বেঁচে ছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওরা আমাকে পছন্দ করে গেল, তখন থেকে আমার দম আটকে আসছে। যখন ভাবছি আমি আর তোমার থাকবনা আমার চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসছে। তোমার কষ্ট হচ্ছেনা উচ্ছ্বাস? আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে তুমি?’
‘এই প্রশ্নটার কী আর কোন গুরুত্ব আছে নাজিফা?’

‘আছে! অবশ্যই আছে। আমি অনেক ভেবেছি। অতীত সবার সাথে। কিন্তু আসল বর্তমান তাইনা? অতীতকে ভুলে চাইলেই এগিয়ে যাওয়া যায়। তুমি সব ছেড়ে দাও উচ্ছ্বাস। ফিরে এসো ঐ জগৎ থেকে। বিশ্বাস করো আমি সব ভুলে যাব। সৎ পথে উপার্জন করে তুমি যদি আমাকে শুধু নুনভাতও খাওয়াও, আমি সেটাও হাসিমুখে খেয়ে নেব। কোন অভিযোগ করব না। প্লিজ উচ্ছ্বাস ছেড়ে দাও ওসব।’
উচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে শুনছিল নাজিফার অনুরোধ। নাজিফা কথা থামাতেই উচ্ছ্বাস কাঁপা গলায় বলল, ‘সেটা সম্ভব নয় নাজিফা।’

‘উচ্ছ্বাস!’
‘হ্যাঁ নাজিফা। কোনকিছুর বিনিময়ে-ই সেটা সম্ভব না।’
‘আমার বিনিময়েও নয়?’
নাজিফার কাতর কন্ঠে বলা কথাটা উচ্ছ্বাসকে অস্হির করে তুলল। কিন্তু মুহূর্তে-ই নিজেকে শক্ত করে কঠিন ভাষায় বলল, ‘না।’

নাজিফা চুপ হয়ে গেল। উচ্ছ্বাসের এমন কঠোর বয়ানে হয়তো প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিল মেয়েটা। ফোন কাটার আগে কেবল শুধু একটা কথাই বলেছিল, ‘একদিন তোমার আফসোস হবে উচ্ছ্বাস। আমাকে হারানোর যন্ত্রণা তোমাকে শেষ করে দেবে।’
উচ্ছ্বাস কোন জবাব দেয়নি। সেদিন সারারাত ঐ মুক্ত বারান্দায় দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। এরপর কেটে যায় আরও দুই সপ্তাহ।

উচ্ছ্বাস যখন নিজেকে সামলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তখন ওকে ভেঙে দিতে আরও একটা নিষ্ঠুর খবর এসে পৌঁছালো। সামনের সপ্তাহে নাজিফার বিয়ে। নাজিফার বাবা নিজে রাশেদ আমেরকে এসে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। আর এই খবরটায় রুদ্র, প্রিয়তা, কুহু, জ্যোতি কারোরই বুঝতে বাকি থাকেনা উচ্ছ্বাসের এমন পরিবর্তনের কারণ। কিন্তু এই বিষয়ে কেউ ওর সঙ্গে কোনরকম আলাপ করতে পারেনি। সেই সুযোগটাই দেয়নি উচ্ছ্বাস কাউকে।

প্রিয়তার সঙ্গে বিয়ের পর রাতে বারে যায়না রুদ্র। কিন্তু ঐদিন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গেল। রুদ্র মাত্র দু পেগ নিলেও উচ্ছ্বাস একের পর এক গ্লাস ফাঁকা করে করছে। রুদ্র বলল, ‘ছাড়াছাড়ি হলো কেন?’
উচ্ছ্বাস গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গিয়ে বলল, ‘কীসের?’
‘তুই জানিস আমি কীসের কথা বলছি। আমার সামনে ওভার স্মার্ট সাজতে আসিস না।’
উচ্ছ্বাস মাতলামোর হাসি দিয়ে বলল, ‘একটা ক্রিমিনালকে কে বিয়ে করবে বস? সবার কপাল তোমার মতো সোনায় বাঁধানো নাকি?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এরপর আস্তে করে বলল, ‘শুধু এটাই কারণ ছিল?’
‘হুম।’
‘এরমধ্যে আর ফোন করেনি?’
‘করেছিল তো।’
‘কী বলল?’
উচ্ছ্বাস ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘ছাড় তো। প্রেম সারাজীবন কজনের টেকে? স্বাভাবিক ব্যাপার। চল বাড়ি যাই।’
‘তুই আমাদের দল ছেড়ে দে।’
রুদ্রর কথায় উচ্ছ্বাস দাঁড়াতে নিয়েও বসে পড়ল। অবাক হয়ে বলল, ‘কী?’

রুদ্র উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে কতোটা কষ্ট হয় আমি বুঝি। প্রিয়কে যখন চট্টগ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম তারপরের সেই চৌদ্দটা দিন আমি কীভাবে পার করেছি সেটা শুধু আমি জানি। তুই আমাদের দল ছেড়ে দে।’
‘পাগল হয়ে গেছিস তুই। মাথা ঠিক আছে?’

‘সব ঠিক আছে। আমি জানি তুই আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন। কিন্তু তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তোর জীবন। তোর অভাব যেভাবেই হোক আমি পূরণ করে নেব। কাল সকালেই আমি কথা বলছি বাবার সাথে। গুলশানের বাইরে একটা ফ্ল্যাটও দিয়ে দেব তোকে। নাজিফাকে নিয়ে_’

উচ্ছ্বাস বাঁধা দিয়ে বলল, ‘থামবি তুই? তোর কী মনে হয় তুই বললেই আমি দল ছেড়ে দেব?’
‘যদি বের করে দেই?’ একটু কঠোর শোনাল রুদ্রের গলা।
উচ্ছ্বাস মলিন হেসে বলল, ‘তবুও নাজিফাকে বিয়ে করব না। ভাবব ওর জন্যে আমি তোদেরকে হারিয়েছি।’

রুদ্র কিছু বলার ভাষা পেলোনা। বিকেলে নাজিফার সঙ্গে কথা বলেছিল ও। নাজিফা নিজের সিদ্ধান্তে অটল। উচ্ছ্বাসকে নাজিফা প্রচন্ড ভালোবাসে সেটা সত্যি। কিন্তু সেই ভালোবাসার জন্যে ও নিজের নীতি ছাড়বে না সেটাও সত্যি। কিন্তু নাজিফাকে কীভাবে বোঝাবে এই ছেলে প্রাণ ত্যাগ করতে পারবে, কিন্তু রুদ্র আর রাশেদকে ত্যাগ করতে পারবে না।
নাজিফার বিয়ের তিনদিন আগের কথা।

সন্ধ্যাবেলা আমের ফাউন্ডেশন থেকে বেরিয়ে সোজা পার্কে চলে গেল উচ্ছ্বাস। যেখানে বসে ও আর নাজিফা সময় কাটাতো। ইউনাইটেড হসপিটালের কাছেই। এক সাইডে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সিগারেট টানছিল। এগারো মাসে নাজিফার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো হাতরে দেখছিল। যার স্মৃতি হাতরে বেড়াচ্ছে, তিনদিন পর সে অন্যকারো ঘরে থাকবে। অন্যকারো বউ হয়ে। সিগারেটের সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটাও অদ্ভুতভাবে জ্বলছিল। স্মৃতির একেকটা পাতা সেই অসহ্য জ্বালা বাড়িয়ে চলছিল। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঐ সময়ই পেছন কেউ এসে জাপটে ধরল ওকে।

প্রথমে চমকে উঠলেও নাজিফার স্পর্শ আর কান্নার শব্দ চিনতে ভুল করল না উচ্ছ্বাস। নাজিফার কান্নার কথা চিন্তা করে উপলব্ধি করল ওর চোখটাও ভেজা। স্মৃতির রাজ্যে বিচরণ করতে করতে কখন চোখ ভিজে উঠেছে নিজেও বুঝতে পারেনি। উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে বলল, ‘নাজিফা?’

বলে নাজিফার থেকে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। নাজিফার দিকে ঘুরতেই নাজিফা আবারও ওকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেলেও নিজেকে সামলাতে বেশি সময় নিলোনা উচ্ছ্বাস। নাজিফাকে ছাড়িয়ে ওর দু বাহু ধরে বলল, ‘কী করছো?’

নাজিফা ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘এতোই যখন ভালোবাসো তাহলে কেন করছো এরকম? কেন?’
উচ্ছ্বাস একটা ঢোক গিলে বলল, ‘তিনদিন পর তোমার বিয়ে নাজিফা। এখানে কী করছো? বাড়ি যাও।’
‘আমি এই বিয়ে করতে চাইনা উচ্ছ্বাস। প্লিজ তুমি সবটা ছেড়ে দাও। প্লিজ! আমিতো তোমাকে রাশেদ বাবার সাথে যোগাযোগ শেষ করে দিতে বলছিনা। শুধু ওনার হয়ে কাজ করা ছেড়ে দাও প্লিজ। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই উচ্ছ্বাস। তোমাকে ছাড়া অন্যকারো সঙ্গে কীকরে থাকব বলো? আমি মরে যাব। আমার জন্যে হলেও এইটুকু করো প্লিজ। আমাকে বাঁচাও।’

নাজিফার কথাগুলো ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল উচ্ছ্বাসকে। নাজিফা শক্ত ব্যক্তিত্বের মেয়ে। নিজের আত্মসম্মানের সঙ্গে একচুলও আপোষ করেনা। সেই মেয়েটা এরকম অবস্থা কীভাবে সহ্য করবে ও? কিন্তু নাজিফা যেটা চাইছে সেটা সম্ভব নয়। উচ্ছ্বাস লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘সেটা সম্ভব না নাজিফা। তুমি বিয়েটা করে ফেলো। আমি জানি প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হবে তোমার। বিশ্বাস করো আমারও হবে। খুব কষ্ট হবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিকও হয়ে যাবে। তখন আর কষ্ট হবেনা। একটা সময় তুমিও সুখে থাকবে আর আমিও।’

নাজিফা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। চিৎকার করে বলল, ‘চাইনা আমি এরকম সুখে থাকতে। তোমাকে ছাড়া সুখে থাকার দিনটা আমার জীবনে কোনদিন না আসুক। যে জীবনে তুমি থাকবেনা সেই জীবন আমার নরকের চেয়েও বেশি যন্ত্রণার হোক।’

উচ্ছ্বাস অস্হির হয়ে নাজিফাকে কাছে টেনে বলল, ‘এভাবে বলেনা। তুমি সুখে না থাকলে যে আমি কীকরে বেঁচে থাকব বলো? তোমার থেকে দূরে থাকলেও এইটুকু জেনেই তো শ্বাস নেব যে তুমি ভালো আছো। সুখে আছো।’

তখনই এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসল নাজিফা। উচ্ছ্বাসের পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। হিঁচকি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি পারব না। বিশ্বাস করো আমি পারব না। প্লিজ আমার কথাটা শোন। আমাকে এভাবে জীবন্ত লাশ করে দিওনা। একজন ক্রিমিনালের সঙ্গে আমি জীবন কাটাতে পারব না। কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতেও পারব না। প্লিজ, দয়া করো আমার ওপর প্লিজ।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫০

উচ্ছ্বাস বরফের মতো জমে গেল। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে। সবকিছুই অন্ধকার মনে হলো ওর কাছে। গা গুলিয়ে উঠল। নাজিফার এমন হৃদয় আকুতি উচ্ছ্বাস কীকরে ফেরাবে? অপরদিকে নাজিফা যা চাইছে তা কোনদিন সম্ভব না। উচ্ছ্বাসের প্রাণের বিনিময়েও না।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫২