একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৪

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৪
writer Mousumi Akte

ঘর্ণায়মান সন্ধ্যা। চারদিকে সন্ধ্যার হলদেটে আলো। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি সারিবদ্ধভাবে উড়ে যাচ্ছে। এমন ঢেউ খেলানো সেই সারি যেন, শিল্পির আঁকা আকাশের বুকে নিখুঁত কোনো নৈসার্গিক দৃশ্য। যা কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখা যায়। এখনি একটা ছবি তুলতে পারলে আজকের সন্ধ্যার বেষ্ট ছবি হতো এটা।

রাস্তার দু’পাশে শিমুল ফুল ফুটে আছে।শিমুল ফুলের মাঝে আমি বিশেষ কিছু সৌন্দর্য খুঁজে পাই। এই কাঁটাযুক্ত বিশাল গাছের মাথায় শত শত লাল টকটকে ফুলে যখন ছেয়ে যায়, আমি মুগ্ধ হয়ে সেটা দেখি। কেউ যদি কখনো হাতে নিয়ে একটা শিমুল ফুল দেখে, নিশ্চিত সে এই ফুলের প্রেমে পড়ে যাবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গাছের নিচ থেকে একটা ফুল তুলে হাতে নিলাম। ফুলটা কেবলই গাছ থেকে ঝরে পড়েছে। ফুলের পাঁপড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে উত্তর দিকে তাকালাম। উত্তরে হিম বাতাস ছেড়েছে।ধোঁয়া ওড়া কুয়াশা আরও বেড়ে চলেছে। প্রতিটা মানুষের মাথায় টুপি বা মাফলার প্যাঁচানো, পরনে সোয়েটার বা চাঁদর, পায়ে জুতা।এম এম কলেজের সাইড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরনো লাইব্রেরীর সামনে এসে দাঁড়ালাম। লাইব্রেরীর পাশেই বেশ বড়ো একটা ফুচকা আর চটপটির দোকান।দোকানদার আমাকে আগে থেকেই চেনে। আমাকে দেখেই বলল, ‘আপা আজ এ সময়ে এখানে?আপনার দলবল কই?’

আমি স্বভাবসুলভ হেসে বললাম, ‘এদিকেই বাসা নিয়েছি। একটু ঘুরতে এসেছিলাম।’
‘চটপটি দেব?’
‘নাহ,আজ খেতে ইচ্ছা করছে না।’
‘মন খারাপ আপা?’
‘নাহ!এমনিই। পরে এসে খেয়ে যাব।’
এরই মাঝে একটা রিকশা আমার সামনে থেকে অতিক্রম করে বলল,
‘দড়াটানা যাবেন?’
‘জি যাব।’

রিকশায় উঠে বেশ মন খারাপ লাগছে। সেই দুপুর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। একটা বার আমাকে ফোন করল না। মানুষ কী এত বিজি থাকে যে এক মিনিট ফোনও দিতে পারে না! ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘শুধুই তার দোষ? তুমি কেন তাকে ফোন দাওনি? সে পুরুষ মানুষ অনেক ঝামেলায় থাকে। তুমিও তো ফোন দিতে পারো।’

আমি কেন ফোন দিব? সে যদি আমাকে ভালোবাসে নিশ্চয়ই সে আমাকে ফোন দিবে। সে না দিলে আমিও দিব না। নিজেই নিজের সাথে যুদ্ধ করছি। এরই মাঝে ফোনে মেসেজের রিংটোন বেজে উঠল। এই যে সব মান-অভিমান এক মুহূর্তের মাঝে উধাও হয়ে গেল। ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে শ্যামসুন্দর পুরুষ নামটা। মেসেজটা ওপেন করেই দেখি লেখা আছে,

‘নিশ্চুই রেগে আছো? স্যরি! কান ধরেছি দ্যাখো। আই রিয়েলি মিসড ইউ। ফোন সার্ভিসিং-এ ছিল, তাই ফোন দিতে পারিনি।’

কী ছিল এই একটা মেসেজে! একটা মেসেজ পেয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল।এই যে মনে মনে তার বিরুদ্ধে শত শত অভিমান সব উড়ে গেল হাওয়ায়। রিকশায় আসতে আসতে দেখি রাস্তার পাশে হালকা গোল্ডেন কালার মতো সুন্দর একটা জ্যাকেট ঝোলানো। জ্যাকেটটা দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সাথে সাথে পার্স খুললাম।

পার্স-এ ৫০০০ টাকা আছে। সেদিন আম্মু পাঠিয়েছে জামাইকে শীতের কাপড় কিনে দেওয়ার জন্য। কিন্তু উনি খুব রা’গ করেছেন। বরং আব্বু-আম্মুর জন্য শীতের কাপড় কিনে আমাকে পাঠিয়ে বলেছিলেন আব্বু-আম্মুকে টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে আসবে কিন্তু। আমি গিয়েছিলাম; তবে আব্বু বা বাবা কেউই ফেরত নেয়নি। বলেছে আমি যেন তাকে না জানিয়ে কিনে দিই। রিক্সা থেকে নেমে দোকানে ঢুকে জ্যাকেটের দাম জিজ্ঞেস করতেই কর্মচারী বলল, ‘আপা সাড়ে সাত হাজার দাম।’
চোখ কপালে তুলে তাদের দিকে তাকালাম।তাদের বলা দামটা যে আমার পছন্দ হয়নি সেটা আমার মুখ দেখেই বুঝে গেলেন।অমায়িক হেসে বললেন, ‘আপা নেন, কম রাখা যাবে।’

খুব কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত কম নিবেন?’
‘নেন, ১০০ টাকা কম রাখা যাবে।’
আমি আবারও কথা না বলে চোখ কপালে তুলেই তাকালাম। যা মনে আসছে তা মুখে প্রকাশ করতে না পেরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকালাম। তারা আবারও অমায়িক হেসে বলল, ‘আপা ৫০০ কম রাখব। এই মিন্টু, জ্যাকেটটা এই আপাকে প্যাকেট করে দে তো।’

চোখ-মুখে বিরক্তি ভাব এনে বললাম, ‘৫০০ তে দিবেন ভাই?’
সাড়ে সাত হাজার টাকার পোশাকের দাম ৫০০টাকা শুনে বোধহয় দোকানের মালিকসহ সকলের চোখ কপালে। মনে হলো কোনো জোকস শুনেছে। এই টাইপ একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আপা কিনতে আইছেন না ইয়ার্কি করতে আইছেন?’
‘কী মনে হয়?’
‘তাই বলে ৫০০ টাকা দাম বলবেন?’

‘তাহলে কত বলব? গোল্ড মিক্সিড করা পোশাক না কি এটা?এতো কোনো ব্রান্ডও নয়। ইয়ার্কি কি আপনারা পাইছেন? এত দাম বলেন যে মানুষ কনফিউজড হয়ে যায় কত দাম বলা উচিত।’
‘কী করব! দাম যদি সঠিকটাও চাই তাও মানুষ দামাদামি করে।’
‘কারণ, মানুষ জানে আপনারা ১ টাকার জিনিস ১০ টাকা দাম চান। এখন বলেন কত হলে দিবেন।’
‘৩০০০, লাস্ট দাম আপা।’

‘পছন্দ হয়েছে খুব, তাই পছন্দের মানুষের জন্য নিচ্ছি। কাপড় যেন এলোমেলো না হয় বুঝেছেন? আমার জামাই কিন্তু পুলিশ। বলে দিব এ দোকান থেকে কিনেছিলাম।’
‘আপা কোনো বাজে রিপোর্ট দিয়েন না যেন।আমরা কিন্তু আপনাকে ঠকাইনি। এই আপাকে আর ২০০ টাকা ফেরত দে নাস্তা খেতে।’

আরও ২০০ টাকা ফেরত দিয়ে হাতে প্যাকেট টা ধরিয়ে দিল। দোকান থেকে বেরিয়ে একা একা হাসতে হাসতে গড়িয়ে যাচ্ছি। যেখানে সেখানে ঢপ মারা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। বাসায় ফিরে রুমের লাইট অন করে প্যাকেটটা রেখে বসলাম।

কিছুক্ষণ পরেই উনি এলেন।বাইরে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপছেন। দরজা খুলতেই উনি মিষ্টি হেসে ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি ঠেস মেরে বললাম,
‘কী ব্যাপার, আজ এত দ্রুত বাসায়?’

উনি সোফায় বসে পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বললেন, ‘আজ এত দ্রুত মানে?আমি তো রোজই দ্রুত বাসায় ফিরি। দুই একদিন লেট হয়।’
‘দুই একদিন! বাবাহ! প্রায়ই রাত বারোটা বাজে।’
হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললেন, ‘মাঝে মাঝে একটু কাজ থাকে।বোঝো না কেন তুমি?’
আমি পায়ের উপর পা তুলে বসে পা দুলাতে দুলাতে বললাম,

‘ভাবছি এখন থেকে আমি রোজ বাহিরে থাকব। রাত বারোটা করে বাসায় ফিরব।’
উনি কপাল টানটান করে তাকিয়ে বললেন, ‘চেঞ্জ করে এসে শুনছি বাকিটা। ওয়েট।’

আলমারি খুলে ট্রাউজার আর গেঞ্জি নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর কালো ট্রাউজার আর সাদা গেঞ্জির উপরে কালো শীতের কোট পরে এলেন। আমার বিপরীত পাশের সোফায় বসলেন। উনিও পায়ের উপর পা তুলে বসলেন, কোটের দুই পকেটে দুই হাত গুঁজে রাখা।

কপাল টানটান করে আমার পায়ের দিকে তাকালেন। আমি যে পায়ের উপর পা তুলে নাচাচ্ছি তাতে নূপুরের রিনঝিন শব্দ হচ্ছে। কালো জরজেট শাড়িতে পা দুটো বেশি ফরসা দেখাচ্ছে। উনি সেদিকে খেয়াল রেখে বললেন, ‘আচ্ছা তারপর বলো। বাহিরে থেকে কী করার ইচ্ছা?’

‘দোকানে বসে চা খাব, সিগারেট খাব পলিটিক্যাল গল্প করব।পুরুষ মানুষ যদি ঘরে বউ রেখে বাইরে এসব করতে পারে আমি কেন পারব না?’
উনি এমন ভাবে তাকালেন কপালের চামড়ায় তিন চারটা ভাঁজ পড়ে গেল।এমন অদ্ভুত কথা শুনে বেশ অবাক বনে গেলেন।একভাবে তাকিয়েই আছেন আমার দিকে।কোনো উত্তর দিচ্ছেন না।
ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, ‘কী দেখছেন?’

‘দেখছি না, ভাবছি।’
‘কী?’
‘এই যে কখন পা*গ*ল টা*গ*ল হয়ে যাব।’
‘কেন?’
‘বউ সারাক্ষণ মুগ্ধ করে চলেছে।শাড়ি পড়ে সেজে বসে থাকলে পা*গ*ল না হলেও অন্যায় হবে।’
‘পাম দিচ্ছেন কেন?’

উনি চট করে আমার পাশে এসে বসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কী হয়েছে, এত ঝ* গ* ড়া করছ কেন?’
‘আমি তো ঝ * গ* ড়াই করি।ভালো হচ্ছে- জিনাত আপা।’
আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কী জিনাত জিনাত করছ। তোমার এই চঞ্চলতার জন্য বেশি মুগ্ধ আমি।’
‘থাক হয়েছে,আর বলতে হবে না।’
‘একটা চা বা কফি খাওয়াবে, উইথ চুমু?’

আমি লজ্জা পেয়ে উঠে গেলাম চা বানানোর উদ্দেশ্য। পেছন ফিরে দেখি উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চট করে ফিরে এসে উনার গালে চুমু দিয়ে আবার রান্না ঘরের দিকে গেলাম। উনি ভুবন ভোলানো একটা হাসি দিলেন। গ্যাসে পানি দিয়ে উনাকে ডেকে বললাম, ‘সোফার উপর রাখা প্যাকেটটা খুলুন তো।’

উনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে প্যাকেটটা পেলেন। প্যাকেটটা খুলে জ্যাকেটটা পেলেন।জ্যাকেটের উপর আমি একটা লাল কাগজে লিখে রেখেছি, ”শ্যামসুন্দর পুরুষ এটা আপনার গায়ে খুব মানাবে। যখন এটা পরবেন আমার খুশবু পাবেন।”
উনি জ্যাকেটের গায়ে চুমু দিয়ে বললেন, ‘ডিয়ার বউ দিস গিফট ইজ ভেরি এক্সসেপশনাল ফর মি। থ্যাংক ইউ সো মাস প্রিন্সেস।’

চায়ের কাপে চা এনে উনার হাতে দিলাম।দুঃজনেই বসে চা খাচ্ছি। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি উনি হঠাৎ ঝুঁকে এসে আমার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। সাথে সাথে ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিশে গেল। উনি লাজুক চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমিও হেসে দিয়ে চায়ের কাপ ছেড়ে দিলাম।

এরই মাঝে উনার ফোন বেজে উঠল। আমি উঠে গিয়ে উনার ফোনটা এনে দিলাম। উনি ফোন কানে দিয়ে টিভি অন করলেন। এখনি খেলা শুরু হবে। ব্রাজিল বনাম আর্জান্টিনা।ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল,
‘কী ভাই, কী করছেন?’
‘তোমার ভাবিকে নিয়ে খেলা দেখছি।’

‘ভাবি কোন দল ভাই? আমার বউ তো আর্জেন্টিনা। খুব প্যারা দিচ্ছে। ঘরে টিকা যাচ্ছে না।’
উনি আমার কাঁধের উপর হাত দিয়ে আমাকে উনার কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘আমার বউ ওই সব আজেবাজে দল আর্জেন্টিনার সাপোর্টার নয়।শী ইজ ভেরি কিউট গার্ল।তাই সে ব্রাজিল-এর সাপোর্টার। ‘

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫২+৫৩

এটুকু বলেই উনি আমার থুতনি ধরে বললেন, ‘তাই না সারাহ?’
আমি অগ্নিচোখে তাকালাম উনার দিকে।

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৫