একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৫

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৫
writer Mousumi Akte

আমাকে অগ্নিচোখে তাকাতে দেখেই উনার মুখের হাসি নিভে গেল। দ্রুত ফোনটা কেটে আমার দিকে সরল চোখে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
আমি সাথে সাথে উঠে কোমরে হাত বেঁধে দাঁড়ালাম। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম, ‘কী বললেন, আর্জেন্টিনা আজে বাজে দল?’

উনি বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, ‘তো তোমার এতে রেগে যাওয়ার সায়েন্স বুঝলাম না। তুমি তো ব্রাজিলের সাপোর্টার।’
‘আমি ব্রাজিল সাপোর্টার হ্যাঁ? আপনাকে কে বলেছে আমি ব্রাজিল সাপোর্টার? আর আপনি কোন সাহসে আজেবাজে দল বললেন, তার কৈফিয়ত দেন।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘অদ্ভুত! তোমার রুমে গিয়ে দেখেছিলাম নেইমারের একটা ছবি টাঙানো।’
‘ওটা আমি নই, আমার আপু টাঙিয়েছে।’
‘ওহ! তার মানে তুমি ব্রাজিলিয়ান নও?’
‘আপনি ভাবলেন কীভাবে, আমি ওই সেভেন- আপ খাওয়া দলের সাপোর্ট করব?’

উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কীহ? সেভেন আপ খাওয়া দল? যে দল পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তাকে তুমি সেভেন আপ খাওয়া দল বলছ? ৫ বার কাপ নিয়েছে ব্রাজিল।’
‘ওহ, আপনি তাহলে কাপ দেখে দল সাপোর্ট করেন? অবশ্য এটা আপনার একার দো’ষ নয়। বেশিরভাগ ব্রাজিল সাপোর্টাররা ওই ৫ বার কাপ নিছে দেখেই ব্রাজিল সাপোর্ট করে। না হলে করত না।’

‘তাহলে তুমি কী দেখে আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করো?’
‘আমি খেলা দেখে দল সাপোর্ট করি। আমি একজন রিয়্যাল দর্শক, যে কাপ দেখে নয় বরং খেলা ভালো দেখে দল সাপোর্ট করে।’

‘আর্জেন্টাইন ভালো খেলে তাহলে ব্রাজিল এত বার কাপ পেল কেন? ভালো না খেললে কেউ কাপ পায়?’
‘কাপ টাফ ভাগ্যের ব্যাপার, বুঝেছেন? কাপ পাইছে বলেই কি ভালো হয়ে গেল? আমরা আর্জেন্টিনা সাপোর্টাররা কাপ দেখি না। আমাদের কাছে হারলেও আর্জেন্টিনা ভালো, জিতলেও আর্জেন্টিনা ভালো।’

‘হ্যাঁ, ওইটা জাতীয় স্লোগান তোমাদের।’
‘হোক জাতীয়, আপনারে বলতে বলেছি আমি?’
‘না, আমার এ ব্যাপারে কিছুই বলার নেই।তোমাদের কিছু থাকুক বা না থাকুক মুখ তো আছে।’
‘সেভেন আপ তো আর নেই।ভালো করে সেভেন আপ খান, বুঝছেন? ছিঃ! ছিঃ! তাই বলে সেভেন আপ!’

‘গোল দিয়েছিল জার্মানি দল, তোমাদের এত আনন্দ কেন বুঝলাম না। তখন কি জার্মানির সাপোর্টার হয়ে গেছিলে? নিজেরা না পেরে অন্যর দেওয়া গোল নিয়ে মাতামাতি। লজ্জা থাকা উচিত।’
‘কী! এত বড়ো কথা! আমার লজ্জা নেই!’

উনি খিল খিল করে হেসে উঠলেন। সেই হাসিতে শরীরে রাগের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। উনাকে হাসতে দেখে বললাম, ‘এমন বিশ্রী ভাবে হাসছেন কেন? মেজাজটাই খারাপ করে দিছেন। ইচ্ছা হচ্ছে আমি টিভির ভিতর ঢুকে কয়েকটা গোল দিয়ে আসি। আমি হলে দেখতেন কী পরিমান গোল দিতাম।’

‘সেভেন আপ খেতে ইচ্ছা হচ্ছে নাকি তোমার?’
‘শুনুন, আজে বাজে কথা বলবেন না কিন্তু।আপনাদের সেভেন আপ আপনারাই খান।’
‘আমার মনে হচ্ছে, তোমারও সেভেন আপ খাওয়া উচিত, তা না হলে রাগ কমবে না তোমার।’
আমি কিছু বলার আগেই উনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে গলায় সাতটা চুমু দিয়ে বললেন, ‘নাউ, সেভেন আপ খাইয়ে দিলাম।’

উনার গাল ভরা হাসি।ভীষণ মিষ্টি হাসি।ঠোঁট কামড়ে ধরে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার চোখও যেন হাসছে।আকস্মিক উনার এহেন কান্ডে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী বলব, বুঝতে পারছি না।উনি আমার থুতনি ধরে বললেন, ‘তাও রে’গে থাকবে? চাইলে তুমিও আমাকে সেভেন আপ খাওয়াতে পারো, যেভাবে আমি খাওয়ালাম। স্যরি, সেভেন কেন, মিলিয়ন-বিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারো আমি একটুও রা’গ করব না।’

লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললাম।কী সব বলেন উনি!
আমাকে উনার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কীভাবে রে’গে যাও তুমি? যত রা’গো তত ভালো লাগে। তুমি কি পা*গ*ল? আমি বাচ্চাদের মতো খেলা নিয়ে ঝ*গ*ড়া করে ঘরে অশান্তি করব। মানুষকে দেখি এসব করে। খেয়ে কাজ না থাকলে মানুষ অনেক কিছুই করে। একদল সাপোর্ট করে বলে অরেক দলকে অপমান করা মানুষ ফুটবলপ্রেমী হতে পারে না। সব দলই বেষ্ট। আর খেলায় হার জিত থাকবেই।’

‘আপনি তাহলে প্রকৃত ফুটবলপ্রেমী?’
‘না, আমি আমার বউপ্রেমী।’
এ কথা বলেই আমাকে আরও খানিকটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। ঝগড়ার মুড কোথায় হারিয়ে গেল, জানি না। আমাকে কন্ট্রোল করার অসীম ক্ষমতা আল্লাহ এই মানুষটাকে দিয়েছেন। দিন দিন উনার প্রতি আমার আসক্তি বেড়েই চলেছে।এত বেশি আসক্তি যে, একটা মুহূর্ত উনাকে ছাড়া কাটাতে পারি না ।মানুষ, মানুষকে এতটা ভালো কীভাবে বাসতে পারে! এই মানুষের শরীরের আশ্চর্যরকম এক ফুলের খুশবু পাই আমি।যে খুশবুতে মন মাতোয়ারা করে তোলে।হারিয়ে যায় এই মানুষের প্রেমের গহীন অতলে।

ছাড়ুন বাবা আর দাদুকে ফোন দিতে হবে।
উনি আমায় ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা ফোন দাও।’
উনি সোফায় বসে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছেন।
বাবার নাম্বারে ফোন দিতেই ফোনের ওপাশ থেকে বাবা বললেন,
‘হ্যালো মা কেমন আছো?’

‘জি বাবা, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।বলছি, দাদুকে নিয়ে চলে আসুন। আর কতদিন পরের বাড়ি থাকবেন?’
‘এই তো, আসব মা।পরের বাড়ি কোথায়?তোমার ফুফু আসতেই দিচ্ছে না।’
‘কিন্তু আপনাদের ছাড়া আমাদের ভালো লাগছে না। বাবা কালই কিন্তু চলে আসবেন।’
‘আসব মা।তার আগে আমার একটা ইচ্ছা আছে, সেটা পূরণ করে নিই আগে।’

‘কী ইচ্ছা, বাবা?’
‘রোশানের কাছে ফোনটা দাও তো মা।’
আমি ফোন এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ নিন বাবা কথা বলবে আপনার সাথে।’
উনি ফোন কানে দিয়ে সালাম দিয়ে বললেন,
‘বাবা, এসব কী হচ্ছে? আজ না কাল, কাল না পরশু এসব কেন করছেন? আমি যেন কাল ভোরে আপনাদেরকে এখানে উপস্থিত থাকতে দেখি।’

‘আসব বাবা, তার আগে আমার কিছু স্বপ্ন আছে। সেসব পূরণ করতে চাই; যদি তুমি অনুমতি দাও।’
‘কী স্বপ্ন বাবা?’
‘তোমার দাদু আমাকে মানুষ করতে অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়েছেন।মানুষটা বুড়ো হয়েছেন কিন্তু জীবনের কোনো শখ তার পূরণ হয়নি। আমি ভেবেছি আমার বাবাকে নিয়ে আমি সারাদেশ ঘুরব। আমার বাবাকে আমি সমুদ্র-পাহাড়সহ বাংলাদেশে দেখার মতো যা যা আছে সব দেখাব।

পাসপোর্ট করব, বাবাকে নিয়ে ইন্ডিয়াও ঘুরব; হজে নিয়ে যাব। আমার খুব ইচ্ছা হয়েছে নতুন করে দেশ-বিদেশ ঘুরিয়ে দেখানোর। প্রতিটা বুড়ো মানুষেরই শখ থাকে, কিন্তু আমরা তাদের শখ-আহ্লাদেকে গুরুত্ব দিইনা। নিজেরা ঘুরি অথচ যাদের জন্য ঘোরাঘুরি করার মতো সামর্থ্য অর্জন করলাম, তাদের নিয়ে ঘোরার কথা ভাবি না।’
‘বাবা, আমি আপনার ছেলে হতে পেরে সত্যি গর্ববোধ করছি। আপনার এমন মন- মানসিকতায় আমি ধন্য।’
‘আমি কিছু জমি ব্রিক্রি করতে চাচ্ছি।তোমার কি আপত্তি আছে?’

‘না বাবা কীসের আপত্তি? তাছাড়া টাকা আমার থেকে নেন। আপনার একাউন্টে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘তোমার এখন টাকার সমস্যা আমি জানি।তরী রোহানের খরচ, নিজের সংসার। এসব নিয়ে ভাবতে হবে না? সারাজীবন তো জমিই রাখলাম। রেখে রেখে তোমার আম্মা আর ওশানের মতো অমানুষ খাইয়েছি।

জমি দিয়ে কী হবে বাবা। তোমার জন্য যা রাখা আছে তোমার সমস্যা হবে না।তোমার দাদুর নামের যে জমি আছে সেগুলো তোমার আর রোহানের নামে লিখে দিতে চাচ্ছে। আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি শহরের দিকে যে জমি আছে সেখান থেকে ৫ শতক বিক্রি করে দিব। কিছু ব্যাংকে রেখে দিব তুমি বাড়ি করার সময় নিয়ো। আর বাকি টাকা দিয়ে তোমার দাদু আর আমি ঘুরব।’

‘বাবা আপনার জমি যা ইচ্ছা করুন।আমার কাছে শুনে কেন লজ্জা দিচ্ছেন, বলুন তো?’
‘তোমার কাছে না শুনলে আমি কিছুই করতে পারি না।তুমিই আমার বল-ভরসা সব।’
‘বাবা, আম্মার বিষয়ে কি কিছু ভেবেছেন?আমার সব সময় আম্মার জন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু আম্মার পাপের কথা ভেবে খারাপ লাগা উধাও হয়ে যাচ্ছে। মানসিক ভাবে খুব অশান্তিতে আছি। কী করব বুঝতে পারছি না।’

‘শোনো, ওই মহিলার নাম উচ্চারণ করো না।ওই মহিলাকে আগেই শায়েস্তা করা উচিত ছিল, যেভাবে ওশানের বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছিল ঠিক সেই ভাবে আমার আরেকটা বিয়ে করা উচিত ছিল। তাহলে নিজের সতিনের সাথে ঝামেলা করতে করতে আর ছেলের বউদের ঘরে সতিন আনার কথা ভাবত না।ভুলটা আমিই করেছি।’

‘বাবা, আম্মা অনুতপ্ত। ‘
‘আইন যা শাস্তি দেবে তাই হবে।অনুতপ্ত হলে কী পাপ কমবে?’
‘জি বাবা, কেউ অনুতপ্ত হলে ক্ষমা করতে হয়।’
‘শোনো, তোমাদের আম্মা, যা খুশি করো।তবে আমি ওই মহিলার মুখও দর্শন করব না। আমি আর এক সেকেন্ডও ওই মহিলার মুখ দেখব না। আপাতত যেখানে আছে থাকুক। বছরখানিক থাকুক, টাইট হয়ে যাবে।’

‘বাবা আমি একটা জমি নেওয়ার কথা ভাবছি।’
‘কোথায়?’
‘বাবা শহর থেকে দূরে, নিরিবিলি জায়গা।’
‘কী করবে, চাষ?’
‘না বাবা অন্য প্লান আছে, আপনাকে জানাব।’

রাতে খাওয়া শেষ করে দুজনেই কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছি।
ফোন চাপতে চাপতে বললাম, ‘এখন কীসের জন্য জমি কিনবেন?’
‘কিনব, এমনি।’
‘ফাঁকা জায়গা জমি কেন?’
‘দেখি কী করা যায়।’.
‘আরেকটা বিয়ে করে ওখানে নিয়ে তুলবেন নাকি?’

উনি ফোনটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,’ সারাদিন কি মাথায় এসব ঘোরে, হুম?’
‘আজকাল পুরুষদের বিশ্বাস নেই।’
‘লেখাপড়ার তো কোনো নাম গন্ধ নেই তোমার। লেখাপড়ার কথা কী ভুলে গেলে?’
‘পড়তে ভাল্লাগে না।’
‘কী ভাল্লাগে তাহলে?’
‘এই যে যেমন আছি, তেমন।’

‘তুমি আমার বউ, বুঝলে? সময় থাকতে লেখাপড়ায় মন দাও।’
‘আমি কি চাকরি করব না কি, যে এত পড়ব? পাশ করলেই হলো।’
‘কেন করবে না চাকরি?’
‘আমার বর চাকরি করে, আমি কী জন্য চাকরি করব?’

‘আমি করি তো কী হয়েছে? তোমার করতে আপত্তি কীসের?’
‘বউয়ের ইনকাম খাওয়ার এত লোভ কেন?’
উনি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
‘কী! আমি বউ-এর ইনকাম খেতে চাচ্ছি?’
‘তা ছাড়া কী?’
‘আমারে মাফ কইরা দ্যান ম্যাডাম, আপনাকে আর পড়তে বলব না।’

এ কথা বলেই উনি ফোন রেখে কম্বল মুড়ি দিলেন।আমিও বেশ কিছুক্ষণ ফোন চাপাচাপির পর ঘুমিয়ে গেলাম।ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি আমি ফুটবল খেলছি। নিজেকে মেসির অবস্থানে দেখতে পারছি। মানে আমি নিজেই মেসি হয়ে গিয়েছি।

ব্রাজিলের বিপক্ষে প্রচুর গোল দিচ্ছি। চারদিকে সবাই আমাকে উদ্দেশ্য করে উল্লাস করছে।দর্শকের এমন উত্তেজনা দেখে ভীষণ প্রাউড ফিল করে মনে হচ্ছে এইবার ফুটবলে এমন লা** থি দিব বল মাঠ ছেড়ে গ্যালারিতে গিয়ে পড়বে। বলটা পায়ের কাছে আসতেই জোরে লা** থি মেরে বলে উঠলাম,’ গোল!

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৪

সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে বসলাম।আর তখনই বুঝতে পারলাম আমি কী ঘটিয়েছি।খাটের নিচে থেকে রোশান স্যার অদ্ভুত ভঙ্গিতে কোমরে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মানে আমি কী গোল গোল করে চিৎকার দিয়ে উনার কোমরে লা** থি মে** রে নিচে ফেলে দিয়েছি!

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৬