একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৬

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৬
writer Mousumi Akte

আমি ভীষণ ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছি, এমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকা মানুষটার দিকে। যেন আমি কিছুই জানি না, কী ঘটেছে সেটাও বুঝতে পারিনি। না বোঝার অভিনয়ে অটুট থেকে চোখ ঢলতে ঢলতে আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললাম,

‘আল্লাহ! আপনি পড়ে গিয়েছেন? কীভাবে পড়লেন? ব্যাথা পেয়েছেন? শিঘ্রি উঠুন।’
উনি কোমরে হাত রেখেই উঠে দাঁড়ালেন।সেই অদ্ভুত চাহনিতে স্থির থেকে বললেন, ‘তুমি জানো না, কীভাবে পড়েছি?’
‘না তো। আপনি কি স্বপ্ন দেখেছেন কিছু?মানে উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন এমন। শুনুন, আপনি বসুন, আমি ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে আসি। আপনার শরীর দূর্বল হয়েছে। শরীর দূর্বল হলে মানুষ এসব উলটা-পালটা স্বপ্ন দেখে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘রিয়েলি?’
‘হ্যাঁ, রিয়েলি।’
‘আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে গোল খেয়েছি, আর বিখ্যাত প্লেয়ার গোলটা দিয়েছে।সো, তোমাকে এত কষ্ট করতে হবে না। এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছ।’
‘কী করেছি আমি?’
‘কিছুই না জাস্ট কোমরের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছ।’
‘এই বয়সে কোমরে সমস্যা আপনার?’

‘যার বউ, বরকে বল ভেবে লা**থি মা**রে তার কোমর যে এতদিন টিকে আছে সেটাই অনেক। নাও ঘুমোও এখন।’
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি বিছানায় নেই। আমি শীতের কাপড় গায়ে দিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই চোখ আটকে গেল পৃথিবীর বেষ্ট হ্যান্ডসাম পুরুষেটিকে দেখে।

উনার পরনে কালো ট্রাউজার, খালি গায়ে বুক ডাউন দিচ্ছেন।এই কড়া শীতে ঘেমে তিরতির অবস্থা।আমার পরনে লাল রঙের একটা উলের লং সোয়েটার,পরনে লেগিংস। দরজায় হেলান দিয়ে ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। বুক ডাউনের ওঠা-নামার প্রতিটা স্টেপ দারুণ ভাবে মুগ্ধ করছে আমাকে।হঠাৎ আমার দিকে উনার চোখ পড়ল। উনি আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বুক ডাউন দিচ্ছেন। ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি।দুজনই দুজনের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। উনি উঠে দাঁড়িয়ে টাওয়াল নিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘ট্রাই করবে না কি আমার সাথে?’

‘করব।’
‘ওকে কাম।’
আমি পা বাড়াতেই বললেন, ‘এক সেকেন্ড, এই পোশাকে শরীর চর্চা হয় না ম্যাডাম।এত মোটা কাপড়-চোপড় পরে বুক ডাউন দিতে পারবে না।’
‘তাহলে?’

‘লুক এট মি। তুমি চাইলে আমার মতো পোশাকেও বুক ডাউন দিতে পারো।’
‘আপনার মতো মানে, খালি গায়ে?’
‘থাক কাপড় খুলতে হবে না।আমার লজ্জা করবে।’
‘ছিঃ! কী অসভ্য!’
‘টি-শার্ট পরে এসো।’

রুমে গিয়ে সাদা একটা টি-শার্ট পরে নিলাম।মনে মনে ভালো লাগছে। উনার সাথে শরীর চর্চা করাটাই যেন ভীষণ আনন্দের বিষয় আমার কাছে। টি-শার্ট পরে পেছনে তাকিয়ে দেখি উনি দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আমি চেঞ্জ করার সময়ে কি উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন! জড়ানো কন্ঠে বললাম,

‘এ কী! আ আপনি এখানে?আমার চেঞ্জ করা দেখছিলেন?’
‘না অন্য কিছু দেখছিলাম।’
‘অন্য কিছু মানে?’
‘দু’চোখ সার্থক হলো আজ।’
‘হোয়াট ডু ইউ মিন? আপনি এসব কী বলছেন?’

এ কথা বলেই বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়ালাম।
উনি নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হেসে বললেন, ‘মনে হচ্ছে আজ প্রথম দেখলাম!’
বলেই সদ্য গজানো খোঁচাখোঁচা দাঁড়িতে হাত বোলালেন।
আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে বললাম,

‘মানুষ যে এত অসভ্য হতে পারে আগে জানতাম না। কী দেখেছেন না দেখেছেন কেউ জানতে চেয়েছে? পুরুষ মানুষের লজ্জা না থাকতে পারে কিন্তু লজ্জা তো নারীর ভূষণ। যান তো কোনো এক্সসারসাইজ টাইজ করব না।’
উনি ওড়না টেনে নিয়ে নিজের গলায় পেঁচিয়ে আমার দুই ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে মাদক মিশ্রিত কন্ঠে বললেন, ‘কী সারাহ! এসব কী করছ? বিয়ে করা বউ আমার তুমি।এত ওড়না প্যাঁচা পেঁচির কী আছে? তুমি চাইলে কিছু না পরেও আমার সামনে দিয়ে ঘুরতে পারো।আমার কোনো আপত্তি নেই।জাস্ট লজ্জা টজ্জা কমিয়ে ফেলো।’

‘আপনার কি লজ্জা-শরম সব উবে গেছে?
‘কীভাবে লজ্জা থাকবে?ইউ নো হোয়াট সুইটহার্ট, ইউ’র লুক সো হট।সাদা টি-শার্ট, লেগিংস,এলোমেলো চুল। জাস্ট পা*গ*ল করা, নেশা ধরানো লুক।’ বলেই জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন।
লজ্জায় কী বলব বুঝতে না পেরে বললাম, ‘বার বার ঠোঁট ভেজাচ্ছেন কেন?লিপজেল ইউজ করুন।’
‘ঠোঁটে কিছু একটার অভাববোধ করছি।সেটা পেলেই ঠিক হয়ে যাবে।লিপজেলে এসব অভাব যাবে না।’
আমি বুঝতে পারলাম উনি কী বোঝাচ্ছেন।তবুও প্রশ্ন করলাম,’কীসের অভাব?’

‘তোমার ঠোঁটের উষ্ণতায় শুষ্কতা কেটে যাবে।’ বলেই গাঢ় চুমু দিলেন অনেক্ষণ ধরে।মাঝে মাঝে এই মানুষকে ভালবাসার চেয়েও বেশি ভালবেসে ফেলি। এমন রোমান্টিক হয়ে যান প্রেমে পড়তে বাধ্য হই।চুমু শেষ করে বললেন, ‘চলো।’
উনার সাথে বিভিন্ন রকম শরীরচর্চা করে বুক ডাউন দেওয়া শুরু করলাম।তাকিয়ে আছি উনার দিকে উনিও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।দুজনেই মৃদু হেসে দিলাম।মুহূর্তগুলো যেন স্বপ্নের মতো।মাঝে মাঝে মনে হয় একটা মেয়ে কত বেশি ভাগ্যবতী হলে এমন ভালোবাসার মানুষ পায়! আমার ভাগ্য কী একটু বেশি ভালো!

দুজনে ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং-এ বসে চা খাচ্ছি।এরই মাঝে আরিয়ান নামে সেভ করা একটা নম্বর থেকে উনার ফোনে কল এলো। উনি নম্বারটা দেখে আমার দিকে তাকালেন।চাহনিতে কেমন শীতল একটা ভাব।ফোনটা কেটে দিলেন। কেটে দিয়ে অনিচ্ছাকৃত মৃদু হাসলেন। আরিয়ান নামটা দেখে আমার বুকের মাঝে কেমন যেন একটা বাড়ি মেরে উঠল।

এটা কোন আরিয়ান! যার কথা ভাবছি সে হওয়ার কথা তো নয়। আবারও একই নাম্বার থেকে ফোন এলো। উনি ফোনটা কেটে দিলেন। সাথে সাথে মেসেজ এলো, ‘আমি ওকে একবার দেখতে চাই।জাস্ট একবার।প্রমিস অন্য কিছু বলব না।’
উনি রিপ্লাই দিলেন, ‘ও এখন আমার কাছে নেই। আর আমি এখন ঢাকা আছি।বিশেষ একটা কাজে।’

উঁকি মেরে মেসেজটা দেখলাম। উনি মিথ্যা বললেন কেন! উনি তো মিথ্যা বলেন না।কিছু একটা কাহিনি আছে, বাট কী হতে পারে সেটা? আর এটা কোন আরিয়ান! উনি চা খাওয়া শেষ করে ফোন কানে নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন । নিশ্চয়ই এই আরিয়ান নামক মানুষটার সাথে কথা বলতেই বাইরে গেলেন। কী এমন কথা যা উনি লুকাচ্ছেন! উনি তো কিছু লুকান না। আমার জীবনে আবার কোনো অশান্তি হবে না তো!

এটা যদি সেই আরিয়ান হয় তাহলে কী হবে!সে উনার কাছে কী চাই! এতদিন পরে কেন উনার সাথে যোগাযোগ করবে। তার তো যোগাযোগ করার কোনো কারণ নেই। আমি ভ**য় পাচ্ছি কেন? আমি তো কিছু করিনি। তাহলে কেন ভ** য় পাচ্ছি?

রোশান স্যার এসব ব্যাপারে কিছু জানলে আমাকে ভুল বুঝবেন, আমি কী সেই ভ**য় পাচ্ছি! কেন পাচ্ছি আমি ভ*য়! উনি তো সেরকম মানুষ নন যে, অকারণ আমাকে ভুল বুঝবেন।আজ আমি বুঝতে পারছি ওই মানুষটাকে আমি কত বেশি ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই এত ভ**য় হচ্ছে। ফোনটা নিয়ে আপুর নাম্বারে ডায়াল করলাম।
আপু ফোন রিসিভ করে বলল, ‘স্যারের বউ, ম্যাডাম বলেন।’

‘আপু একটু কথা ছিল।’
‘এত অস্থির কেন তুই?’
‘অস্থির হব না কেন? তুমি কি জানো, আরিয়ান ভাই কোথায়?’
‘আমি জানব কীভাবে? ওদের সাথে কথা বলি না কি আমরা, আর তুই রোশানের মতো জামাই পেয়ে ওর কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?’
‘আপু, আসলে রোশান স্যারের ফোনে আমি একটা নাম্বার দেখেছি ‘আরিয়ান’ নামে সেভ করা। আরিয়ান ভাই আবার উনার নাম্বার যোগাড় করেনি তো?’

‘তুই কি পা*গ*ল, আরিয়ান ভাই কীভাবে রোশানের নাম্বার পাবে? আর ওর উদ্দেশ্য বা কী হবে? তোর তো আর রিলেশন ছিল না তাই না? তাছাড়া আরিয়ান ভাই অতটা খারাপ ছেলেও না যে এসব করবে। মাথা থেকে ঝাড়, এসব বাদ দে।’
আপুর সাথে কথা বলেও মনটা শান্ত হলো না। কেমন যেন অস্থিরতা বেড়ে চলেছে।

এরপর কেটে গেল আরও কতগুলো দিন। অথচ ওই নাম্বার আর দেখলামই না। উনার ইনবক্স, ডায়াল বা রিসিভ কল কোথাও না।কোথায় যেন হারিয়ে গেল আরিয়ান নামক চ্যাপ্টারটা। উনিও বেশ স্বাভাবিক আছেন এ ব্যাপারে।
দিন আস্তে আস্তে এগোচ্ছে।

সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে। তরীকে আবার ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তরী সব কিছু ভুলে লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়েছে। একটা বিষয় কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছি। কেউ একজন তরীর গহনাগুলো সম্পূর্ণ কিনে নেয়। বেশ ৩-৪ বার এমন করার পর তরী এখন বেশ কিছু টাকার মালিক। এখন আর আমাদের ওকে হেল্প করা লাগে না।

নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারে। নিজস্ব মূলধনে এখন গহনার সমস্ত ম্যাটারিয়ালস কিনছে। তাছাড়া ওর নিজের ভেতরও এখন অনেক চেঞ্জ এসেছে। আগের সেই তরী নিজেকে বেশ খানিকটা পরিবর্তন করে ফেলেছে। চেহারায় অন্যরকম একটা মাধুর্যতা ফিরে এসেছে।

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৫

সময় ঘুরতে ঘুরতে আমাদের বিবাহবার্ষিকী চলে এলো। আমরা কাউকে কিছু বলিনি।ইচ্ছা নেই মানুষ ডেকে এই দিনটা সেলিব্রেট করার। উনার ইচ্ছা ছিল আমরা দুজন দুজনকে সময় দিব। তবুও আমার আপু, দুলাভাই, তরী, পিহু, ছোঁয়া, তন্ময়, মৃন্ময়, দ্বীপ উপস্থিত হলো। সবাই ভীষণ আড্ডা দিচ্ছিলাম; কিন্তু এরই মাঝে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল। তরী যখন আমাদের ঘর সাজাচ্ছিল তখনই মৃন্ময় প্রবেশ করল সেখানে। আর ঘটনাটা সেখানেই ঘটল।

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৭