একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৮

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৮
writer Mousumi Akte

মৃন্ময় এমন ভাবে বেরিয়ে গেল, ওকে আটকানোর সুযোগটুকুও পেলাম না। আবার বেশি বাড়াবাড়ি করলে রোশান স্যার, পিহু বুঝে যাবে। আমি দ্রুত আমাদের রুমে প্রবেশ করলাম। তরীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি রুমে প্রবেশ করতেই তরী ওর চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। অনিচ্ছাকৃত হাসল। কিন্তু হাসিতে কোনো প্রাণ নেই। চোখ-মুখ অন্যরকম লাগছে। আমার কাছ থেকে পালাতে বলল, ‘ভাবি রোহান কোথায়? ওকে দেখছি না যে।আমি রোহানকে দেখে আসি।’ বলেই রুম থেকে বেরোতে গেল।

আমি ওর পথ আটকে দাঁড়ালাম। শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘রোহান ওর বড়ো পাপ্পার সাথেই আছে। খুঁজতে যেতে হবে না।’
‘তাহলে রান্না ঘরে যাব ভাবি?’
‘কোথাও যেতে হবে না তরী। কী লুকাচ্ছ? আমি সবটা দেখেছি। কী করেছে মৃন্ময়?’
তরী কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। আমার দিকে তাকিয়ে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে শুধু। আর শুকনো ঢোক গিলছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তরীকে ঘাবড়ে যেতে দেখে ওর কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বললাম,
‘মৃন্ময়ের গায়ে হাত তুলেছ? তুমি তো অকারণে কারো গায়ে হাত তোলার মতো মেয়ে নও তরী। হঠাৎ কী হল?’
‘ভাবি উনি, মানে– তোমার বন্ধু আমার মুখে হাত দিয়েছিলেন। উনি আমাকে ভালবাসার কথা বলছিলেন।’
‘সব স্পর্শতে পাপ থাকে না তরী। কিছু স্পর্শে সরলতাও মিশে থাকে। মৃন্ময়কে তুমি ভুল বুঝছ। আর যাই হোক, বাজে উদ্দেশ্য কাউকে স্পর্শ করার মতো ছেলে ও নয় তরী। আমার বন্ধু বলে বলছি না, ও সত্যি ভালো ছেলে।’

‘উনি ভালো ছেলে সেটা আমি জানি ভাবি। কিন্তু উনিতো এমন আচরণ আগে করেননি। হঠাৎ মুখে হাত রাখলেন। ভালোবাসার কথা বললেন। আমার কেমন যেন হচ্ছিল ভাবি। হঠাৎ ভ**য় পেয়ে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি প্রেম-ভালবাসা নামক শব্দ দুটোকে বড্ড বেশি ভ**য় পাই। আমি পুরুষ মানুষকে ভীষণ ভ**য় পাই। আমি পুরুষের স্পর্শ সহ্য করতে পারি না। শরীরের মাঝে ঘিনঘিন করে ওঠে। কেমন বাজে একটা অনুভূতি হয়। আমি ভয়ানক এক অতীত দেখে এসেছি। পুরুষ মানুষ কত বেশি ভয়ানক হতে পারে, আমি দেখে এসেছি। তাই আমি এসব সহ্য করতে পারি না। কানে শুনতেও পারি না।’

‘তুমি কি জানো, আমিও ভয়ানক পুরুষ দেখে জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ মানুষও দেখেছি? ছোঁয়াও দেখেছে। ‘
‘ভাবি সবার জীবন আর আমার জীবন এক না। আমি এই জীবনে আর কোনো পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারব না। আমার ভিতরে কোনো অনুভূতি নেই। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার বন্ধুকেও বলুন ক্ষমা করে দিতে। ‘
এরই মাঝে দ্বীপ ঘরে প্রবেশ করে বলল, ‘তুমিই মায়াবিনী?’

‘আমিই মায়াবিনী মানে?’
‘মৃন্ময়ের মায়াবিনী।’
‘এসব কী বলছেন আপনি?’
‘তুমি ঝিকড়গাছার মেয়ে না?’
‘আপনি কীভাবে জানেন?’
‘আমি জানতাম না, মৃন্ময় জানিয়েছে।’
‘কী জানিয়েছে?’
‘ওর গ্রামের বাড়িও ওখানে।’
‘উনার গ্রামের বাড়ি ওখানে মানে?’

‘তরী, আমি তোমাকে মৃন্ময়ের সাথে রিলেশনে যেতে বলব না। তবে কিছু কথা তোমাকে বলতে চাই। না বললে ভারি অন্যায় হবে।’
‘কী বলবেন আপনি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘ রিনি নামের একটা মেয়ে তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড ছিল না?’
‘হুম ছিল তো।’
‘কখনো কোনো ছেলের কথা বলত, যে তোমাকে খুব পছন্দ করে?’
‘হুম বলত।’

‘রিনির চাচাতো ভাই মৃন্ময়। মৃন্ময়রা ইদে গ্রামে যেত। তুমি তখন এইটে পড়ো। মৃন্ময় নাইনে পড়ে। ওই কিশোর বয়সেই ইদের দিন রিনির সাথে তোমাকে দেখেই প্রেমে পড়েছিল। তখন ওর বয়স কম। ওই বয়সেই তোমার জন্য ওর মনে উথাল-পাথাল ঝড় উঠেছিল। সপ্তাহে ৩-৪ দিন করে গ্রামে যাচ্ছিল নিজের স্কুল কামাই করে। লেখাপড়া কোনো কিছুর প্রতিই মন ছিল না। মনটা সারাক্ষণই গ্রামে পড়ে থাকত। রিনিকে দিয়ে তোমাকে বলাত।

তুমিও তখন ছোটো। এসবে পাত্তা দাওনি। আর এর মাঝেই তোমার বিয়ে হয়ে যায়। মৃন্ময় তোমার নাম দিয়েছিল ‘মায়াবিনী’। যার মায়ায় ও আসক্ত হয়েছিল। এর মাঝেই কীভাবে তোমার বিয়ে হয়ে গেল। মৃন্ময় আর কোনদিন খুঁজে পেল না তোমাকে। অন্য কেউ হলে সবটা ভুলে যেত কবেই। মৃন্ময় ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল এক তরফা ভালবেসে।

এসএসসি-তে রেজাল্টও খারাপ করল। আমাদের কাছে হাস্যকর লাগত, আমরা মজা নিতাম। ভাবতাম সামান্য এইটুকু ব্যাপারে কেউ এত সিরিয়াস হয়! আসলেই হয়, যদি ভালবাসাটা মন থেকে হয়ে যায়। সেই ভালবাসাটা আর কোনদিন ভোলা সম্ভব হয় না। ভালবাসার ক্ষেত্রে সময় কোনো ফ্যাক্ট নয়। কার সাথে কার কতদিনের পরিচয় সেটা ফ্যাক্ট নয়। ফ্যাক্ট হলো কে কতটুকু ভালবাসতে পারল।

কেউ এক যুগ পাশে থেকেও বাসতে পারে না ভালোবাসা ধরে রাখতে পারে না।কেউ আবার একদিনের ভালোবাসা আজীবন মনে ধরে রাখে। এর পর মৃন্ময় স্বাভাবিক হয়েছিল ঠিক; তবে তোমাকে কখনোই ও ভোলেনি। ভুলতে পারেনি। আমরা ফ্রেন্ডরা অনেক মজা করতাম বিষয়টা নিয়ে। আসলেই হাস্যকর না ব্যাপারটা? সেই কত বছর আগে কাকে দেখেছিল তার জন্য প্রায়শই সিগারেটে আসক্ত হওয়া।

একদিকে তুমি এমন একটা ছেলের কাছ থেকে এসেছো তোমার জায়গা দাঁড়িয়ে কাউকে ভালোবাসাটাই অসম্ভব ব্যাপার। আর এই দিকে মৃন্ময়ের শুদ্ধতম ভালোবাসার কথা ভাবলে একটা ছেলের প্রতি সম্মান হাজার গুণ বেড়ে যাওয়ার কথা। যেদিন তুমি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এলে, মৃন্ময় তোমাকে আনতে গিয়েছিল।

এতগুলো বছর পরে তোমাকে দেখে ওর বুকের মাঝে ভয়ংকর প্রলয় শুরু হয়েছিল। ও তোমাকে পায়নি সেটা ওর কষ্ট নয়। ওর কষ্ট ছিল তোমার জীবনের করুণ পরিণতি দেখে। সেদিন থেকে মৃন্ময় আর একটা রাতও ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি । সিগারেটে আসক্ত হয়েছে বেশি । ও যাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছে তার জীবনের এমন অবস্থা দেখে যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। তোমাকে এক মুঠো সুখ এনে দিতে অনেক চেষ্টা করছে। তুমি আস্তে আস্তে সবই জানতে পারবে। ‘

আমি দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তরীই সেই মেয়ে?’
‘ হ্যাঁ তরীই সেই মেয়ে।’
দ্বীপ বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তরীর চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি অনেক্ষণ তাকিয়ে দেখছি মেয়েটাকে। হঠাৎ কেমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। আমি শুধু বললাম, ‘কেঁদো না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

রুম থেকে বেরিয়ে রান্নায় মনোযোগ দিলাম।আমার সাথে ছোঁয়াও আছে। দ্বীপের কথাগুলো ভুলতে পারছি না। কেউ কাউকে এতটাও ভালোবাসতে পারে! এতটা গভীর ভালোবাসাও সম্ভব! একেকজনের ভালোবাসার ধরণ একেক রকম। একেকজনের গল্প একেক রকম, তাদের গল্পে তারাই প্রকৃত নায়ক। রান্না শেষে সবাই খেয়ে বেরিয়ে গেল। মৃন্ময়ের কথা উঠতেই বলা হলো ওর ইমারজেন্সি কাজ পড়ে গিয়েছে।

তরী যাওয়ার সময় ওর চিঠিটা ফেলে গিয়েছে। হয়তো পড়েই রেখে গিয়েছে।আমি চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলাম,
‘মায়াবিনী।’
আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসতে পারিনি আমি। যত্ন করে আগলেও রাখতে পারিনি। যদি পারতাম তোমার জীবনটা হয়তো এমন এলোমেলো হতো না।একজন প্রেমিক হিসাবে ব্যর্থ আমি। সে ছোট্ট কিশোর বয়সে তোমার চোখের মায়ায় ডুবেছিলাম, ভীষণ ভালোবেসেছিলাম।

এটুকু পড়তেই রোশান স্যারের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। দ্রুত চিঠিটা বিছানার নিচে রেখে দিলাম। উনার হাতে বাইকের চাবি। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,
‘মাই ডিয়ার বউ, আই মিস ইউ। নিড এ টাইট হাগ।’
আমি কিছু না বলেই উনার বুকে মাথা রেখে উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘সারাদিন তো চোখের সামনেই ছিলাম, তাও মিস করছেন কেন?’

উনি আমার চুলে থুতনি ঠেকিয়ে বললেন, ‘সারাদিন সবার সামনে থেকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখতে পারিনি তোমাকে। আমার অভ্যাস, সারাক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে তোমাকে দেখা। একদম সূক্ষ্ম নজরে দেখি তোমাকে। আজ ভালো ভাবে দেখতে পাইনি। আজ সারারাত দেখব।’

‘আপনি এত ভালোবাসেন কেন আমায়, শ্যামসুন্দর পুরুষ? আপনার মতো গোছালো একজন মানুষ আমার মতো অগোছালো মেয়েকে ভালোবাসে কেন?’
‘তুমি বরং অগোছালো হয়েই থেকো, আমি রোজ গুছিয়ে দেব তোমায়।’
‘নিজেকে এত ভাগ্যবতী মনে হয় কেন?’

‘তুমি তো ভাগ্যবতীই। আমার জা*ন পাখিটা। চলো নির্জন রাস্তায় হেঁটে আসি।’
‘চলুন।’
ফাঁকা রাস্তা চাঁদের আলো। প্রকৃতির ঠান্ডা হিম বাতাস। শীত উপেক্ষা করেও দুজন দুজনার হাত ধরে হাঁটছি।অভিমানী কিশোরীর মতো চাঁদ মাথার উপর দাঁড়িয়ে সোনালি আলো ছড়াচ্ছে। প্রিয় মানুষটির সাথে নির্জন রাস্তায় হাঁটার অনুভূতিটাই অন্যরকম। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আচ্ছা সারাহ, প্রিয় মানুষকে দেওয়ার জন্য বেষ্ট গিফট কী হতে পারে?’
‘তার প্রিয় কিছু।’
‘আচ্ছা তোমার প্রিয় কিছু চাও এখন, না কি আমার সঙ্গ?’
‘আমার প্রিয় তো আপনিই তাই আপনার সঙ্গ-ই চাই।’
‘আমি বাদে, ধরো পছন্দের কোনো গহনা বা শাড়ি চাও না কি আমার সঙ্গ?’
‘আপনার সঙ্গ।’

‘আমি জানতাম আমার সঙ্গই পছন্দ হবে।প্রিয়জনকে দেওয়া বেষ্ট গিফট হলো–সময়। সময় না দিয়ে সুন্দর মুহূর্ত না দিয়ে টাকায় কেনা উপহার কাউকে সুখ দিতে পারে না।প্রিয় মানুষের দেওয়া সময়ই হলো অমূল্য গিফট। তাই তোমার জন্য আমি এনিভার্সারী গিফট হিসাবে এমন একটি রাত ভেবে রেখেছিলাম।’

‘আপনি কত ভাবেন, দেখুন! আমার মন ভালো রাখার ম্যাজিক আপনি।’
‘মন খারাপ করলে, ভাবছ কিপ্টা বর এসব বলে গিফট এড়িয়ে যাচ্ছে?’
‘মোটেও না, আর আপনি কিপ্টাও নন।’
‘চোখ বন্ধ করো।’
‘করলাম।’

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৭

হাতের অনামিকা আঙুলে কিছু একটা অনুভব করলাম। চোখ খুলে দেখি একটা গোল্ডের রিং। উনি হাতের আঙুলে চুমু দিয়ে বললেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া তুমি। আল্লাহর দেওয়া বেষ্ট গিফট তুমি। তোমাকে না পেলে এ জনমে অনেক কিছুই পাওয়া হতো না।আমার শত জনমের সাধনা তুমি, আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা। আমার জীবনে আসার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
‘হ্যাপি এনিভার্সারী মাই লাইফলাইন।’

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৯