একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৬২

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৬২
writer Mousumi Akte

আরিয়ান ভাই আমাকে হ্যাঁচকা টানে ছাদে নিয়ে গিয়ে জোরে ধাক্কা মেরে বললেন,
‘তুই আমার বউ হতে চাস, সারাহ? আমার বউ? তোর সাথে আমার ঠিক কোন দিকে যায়, কখনো ভেবে দেখেছিস? আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমার ওয়াইফ কখনো তোর মতো টেনেটুনে পাশ করা মেয়ে হবে না। আমার ওয়াইফ হবে একজন উচ্চ শিক্ষিতা মেয়ে।

তুই তো জীবনে গ্রাজুয়েশনও কম্পিলিট করতে পারবি না।শোন সারাহ, তোকে আমি কাজিন ছাড়া কিছুই ভাবি না, জাস্ট কিছুই না। আমার ব্যাক্তিগত লাইফে রুচি সম্পূর্ণ আলাদা। তোর মতো বাচাল টাইপ মেয়ে যার কোনো ডিসিপ্লিন নেই তাকে নিজের ওয়াইফ হিসাবে কল্পনাও করতে পারি না। হ্যাঁ, তুই দেখতে সুন্দর আছিস, তোর জন্য ছেলের অভাব হবে না। তোর মতো সাদা মূলার জন্য দেশের আর্মি পুলিশরা আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

একমাত্র ওরাই টেনেটুনে পাশ করা দেখতে সুন্দর মেয়ে বিয়ে করে। হাইয়ার এজুকেটেড ছেলেদের কোনো সাদা মূলা পছন্দ হয় না। তারা নিজেদের লেভেলের মেয়ে পছন্দ করে।আমার জিএফ আছে। ইউরোপ কান্ট্রিতে স্টাডি করছে। তুই ওর পা ধুয়ে পানি খাওয়ারও যোগ্য না, বুঝলি? সবাইকে বলে দিবি, যে তুই এই বিয়ে করবি না। তুই আমার কাজিন, ব্যাস এটুকুই।’

‘বাহ! আরিয়ান ভাই, কী জঘন্য চিন্তা ভাবনা আপনার! কেউ ফরসা হলে তাকে মূলা বলবেন? ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে কোনো শিক্ষিত ছেলে পছন্দ করে না এসব চিন্তা ভাবনা আপনার!’
‘না, করে না। আমি তো অন্তত করি না।’
‘আপনাকে আমার ভালো লাগত এটা ঠিক।আগে যদি বুঝতাম আপনার মন-মানসিকতা এত নীচ তাহলে কোনদিন এই সম্বন্ধে রাজি হতাম না। আপনি আমাকে কী বিয়ে করবেন না? আমিই তো আপনাকে বিয়ে করব না।একদিন না একদিন আপনি আফসোস করবেন, বলে দিলাম।’

তারপর বিয়েটা ভেঙে গেল। উনাদের সাথে আমাদের আর রিলেশন নেই। তারপর এতদিন পর উনি এখানে এসেছেন। নিশ্চয়ই আপনাকে এসব বলতে এসেছে। বা বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলবেন। যা সত্য আমি জানিয়ে দিয়েছি। উনি জানানোর আগে আমিই জানিয়ে দিলাম। বাট উনি আপনার বন্ধু এটা জানতাম না তো।
‘তার মানে আরিয়ান তোমার প্রাক্তন প্রেমিক ?’
‘প্রেমিক না। প্রেমই তো হয়নি। বিয়ে ঠিক ছিল।’
‘তাহলে ক্রাশ ছিল?’
‘স্যরি।’
‘কেন?’

‘আমি অন্যায় করেছিলাম। সব আপনার দোষ। কেন আরও আগে আসেননি আমার জীবনে? এলে কী এই ভুল করতাম?
আমাকে ক্ষমা করে দিন আমার অতীতের জন্য।’
বলেই কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলাম।
‘বিয়ে ঠিক ছিল, আর তো কিছু না? আর আমি এসব জেনেই তোমাকে বিয়ে করেছি।এই সামান্য ব্যাপারে তোমাকে আমি ভুল বুঝব? এতে ভ’ য় পাওয়ার কী আছে?’
‘কী জানতেন?’

‘পারিবারিক বিষয়ে সব। তোমার কী মনে হয়, বাসর ঘরেই প্রথম তোমায় দেখেছিলাম? বহু আগেই দেখেছিলাম।আরিয়ানকে ধন্যবাদ ওর মাধ্যমেই তোমাকে চিনি। ওর জন্যই তোমাকে পেয়েছি।
‘মানে! কীসব বলছেন আপনি?’
‘হুম, সব সত্য বলছি।’
‘কী জানতেন, আমাকে বলুন?’

‘আরিয়ান বিদেশ যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। ওকে খুব ডিপ্রেসড লাগছিল দেখতে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে। সেদিন ও বলেছিল, ‘একটা বাজে কাজ করে ফেলেছি। এক দিকে ডেইজির সাথে রিলেশন। ডেইজিকে আমি মারাত্মক ভালবাসি। অপরদিকে আমার কাজিন সারাহ আমাকে লাইক করে।সাথে বাসা থেকে বিয়েও ঠিক করেছে। আম্মা আমার কথা বুঝতে চাইছে না।সারাহ’র সাথে বিয়ে দিয়েই দিবে। আমি অনেকগুলা বাজে কথা শুনিয়েছি। সারাহ’র জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। আমাদের পারিবারিক সম্পর্কটাও নষ্ট হলো। ট্রাস্ট মি আমি চাইনি পারিবারিক রিলেশনটা নষ্ট হোক বা সারাহ’র সাথে এমন বাজে বিহ্যাভ করি। বাট বলে ফেলছি।’

‘তোর কাজিনকে তোর পছন্দ নয় কেন, দেখতে ভালো না?’
‘দেখতে এমন সুন্দর, যে কারো তাক লেগে যাবে। চঞ্চল, দুষ্টু, প্রতিবাদী, প্রাণ খুলে হাসে। ওকে দেখে প্রেমে পড়ার হাজারটা কারণ আছে। শুধু যদি লেখাপড়ায় আর একটু ভালো করত।’
‘তুই কিন্তু ভুল করলি আরিয়ান। ডেইজি কিন্তু সুবিধার না। উচিত ছিল এখনি ভেবে চিন্তে ডিসিশন নেওয়া।’
‘তুই যা ভাবছিস তা নয়। ডেইজি আমাকে ভীষণ ভালবাসে।’

‘হীরা রেখে কাঁচ বেছে নিস না। পস্তাতে হবে তোকে।’
‘রোশান, মেয়ে খুঁজছিস না? আমার কাজিনকে বিয়ে কর।’
‘নিজের জিনিস আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছিস ক্যান ভাই?’

‘তুই সারাহকে বিয়ে করলে অপরাধবোধ কমবে। হোয়াটস অ্যাপে ছবি দিচ্ছি, দ্যাখ।পছন্দ হলে দেখতে পারিস বিষয়টা।’
‘সেদিম সন্ধ্যায় আমি পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে উপস্থিত হতেই দেখি আরিয়ান ছবি পাঠিয়েছে। ট্রাস্ট মি, ঐ এক দেখাই আমি শেষ। আল্লাহ যার জন্য যাকে সৃষ্টি করেছেন তাকে দেখলেই মনে হয় আর চোখ সরানো যায় না।আমিও পারিনি চোখ সরাতে। সেই যে মুগ্ধ হলাম আর চোখ সরাতে পারলাম না। মুগ্ধতা বেড়েই চলল।ওইদিন পাত্রী না দেখেই উঠে এলাম।সারারাত তোমার ছবি দেখেছিলাম।

খোঁজ নিতে শুরু করলাম। কাকতালীয় ভাবে তুমি অনার্সে ভর্তির পরেই আমার ও এম এম কলেজে পোস্টিং হয়ে যায়। ইচ্ছা ছিল তোমাকে প্রপোজ করব। কিন্তু যখন দেখলাম তুমি আমার স্টুডেন্ট তখন খুব ব্যাক্তিত্বে আঘাত লাগল আমার। টিচার হয়ে কীভাবে ছাত্রীকে প্রপোজ করব। প্রপোজ আর করা হয়ে উঠল না। রোজ আড়ালে তোমার দিকে তাকাতাম। তোমার দিকে অজস্রবার তাকাতাম। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে তোমার বিষয়টা বাদ দেব।

কারণ আমার পক্ষে সম্ভবপর নয় নিজের ছাত্রীকে বিয়ে করা। একটা বছর নিজের সাথে যুদ্ধ করলাম। কিন্তু আমি পারলাম না।নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি সহস্রবার। তোমাকে যত ভোলার চেষ্টা করেছি ততই বেশি মনে পড়েছে তোমার কথা। একটা বছর নিজেকে সময় দিয়েও তোমাকে ভুলতে পারিনি। কেমন যেন দিন দিন আরও বেশি খিটখিটে আর রুক্ষ হয়ে যাচ্ছিলাম। কারো সাথে শান্ত ভাবে কথা বলতে পারতাম না।মেজাজ বিগড়ে থাকত।

আর আমি জানতাম আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইলে তুমি রাজি হবে না। কারণ কলেজে আমার মতো রাগী, গম্ভীর স্যার দেখে কার-ই বা ভালো লাগবে। তাই তোমার দাদুর সাথে কথা বললাম। আমি সরাসরি তোমার দাদুকে আমার বিষয়টা খুলে বললাম। আর প্লান করলাম কীভাবে বিয়ে করা যায়। জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বিয়ে করলে বিয়ের আগে আমাদের দেখা হয়ে যেত আর তুমি আমাকে রিজেক্ট করে দিতে।

তাই তো কাউকে না বলে তোমাকে না জানিয়ে হুট করে বিয়ে হলো। তাছাড়া ওই টাইমে আরিয়ানের ঘটনার পরে তুমি আর নিজে থেকে কাউকে পছন্দ করবে না, সে বিষয়ে জানিয়েছিলে ফ্যামিলিতে। ফ্যামিলির পছন্দই তোমার পছন্দ। তারপর হয়ে গেল বিয়ে। আর তুমি জানলে তোমার দাদু আর আমার দাদু বন্ধু ছিলেন। এসব কিছুই ছিল না। তোমার ফ্যামিলির সবার আমাকে দেখেই পছন্দ করেছিল। এইজন্য আর কেউ আপত্তি করেনি।’

উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘এত কাহিনি আর আমি কিছুই জানি না!’
‘অনেক কিছু জানলে তো আর আর ইন্টারেস্ট থাকে না। তুমি যদি জানতে আমি তোমাকে ভালোবাসি তাহলে আমার প্রতি তোমার আগ্রহ থাকত না।’
‘আর আরিয়ানে বিষয়টা আমাকে কেন জানালেন না?’

‘কী দরকার? তোমার অতীত আমি জানি, এটা তোমাকে বলে তোমাকে কষ্ট দেব! আমার তো আপত্তি নেই ঐ অতীত নিয়ে।তাহলে কেন ওই আজেবাজে সাবজেক্ট তুলে আমাদের সুন্দর সময় নষ্ট করব। তাছাড়া আমি চাইনি আরিয়ানের কথা মনে করে তুমি কষ্ট পাও। যে অতীত তোমাকে কষ্ট দিয়েছিল, সেই অতীতকে আমি ঘৃনা করি।’
‘আপনার ফোনে আরিয়ান নামে সেভ করা যে নাম্বার থেকে কল আসত, সে কে?
‘সে এই আরিয়ান ছিল।’
‘আমার সামনে রিসিভ করতেন না কেন?’

‘তুমি যদি ওর কথা ভেবে আবার ওর প্রেমে পড়ে যেতে। যতই হোক কালো ছেলের প্রতিদ্বন্দ্বী যখন আরিয়ানের মতো সুদর্শন ছেলে। তখন ভ* য় তো থাকেই।’
‘কে সুদর্শন, আরিয়ান?’
‘হুম।’
‘দেখুন আপনার থেকে সুদর্শন পুরুষ এই দুনিয়াতে নেই। আরিয়ান কোন দিক দিয়ে আপনার থেকে সুন্দর?
‘সব দিকে দিয়ে, ফরসা, লম্বা, স্মার্ট।’
‘আপনি নিজেও জানেন না আমার চোখে আপনি কত সুন্দর পুরুষ। এত সুন্দর পুরুষ এ জীবনে দ্বিতীয়টা দেখিনি।’
‘সে তো তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ।’

‘হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখেছি আপনাকে, ভালোবাসার চোখ দিয়ে দেখেছি আপনাকে।ভালোবাসার চোখ জানে তার প্রিয় মানুষ কত সুন্দর।’
‘আমি জানি তোমার চোখে আমি সুন্দর। আর এভাবে অকারণ কাঁদবে?’
‘আমি ভ**য় পেয়েছিলাম।’

‘তুমি আমার অর্ধাঙ্গী সারাহ। আমার বাম পাজরের হাড় তুমি। জীবনের যত দুঃখ কষ্ট, যত খারাপ আছে আমার কাছে শেয়ার করবে। ভুল বোঝাবুঝি কোনো সমাধান নয়। স্ত্রীর সমস্যা স্বামী বুঝবে, স্বামীর সমস্যা স্ত্রী বুঝবে। দু’জনের মাঝে কোনো গোপনীয়তা রাখা ঠিক নয়। আমাদের সম্পর্ক এমন সম্পর্ক যেখানে দুজনে এক সাথে হেসে কথা বললেও সওয়াব হয়।

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৬১

সেখানে ভুল বোঝার প্রশ্নই আসে না। সারা জীবন তোমাকে হাসাতে চাই, তোমার সাথে হাসতে চাই।তোমার ভালো খারাপ সব আমাকে বলবে।তোমার সব কিছু এক্সেপ্ট করে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার আছে।’

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৬৩