বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৮

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৮
তাসফিয়া হাসান তুরফা

আমাকে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতে দেখেই পাশ থেকে এগিয়ে এলো প্রিয়া। ওকে দেখে আরেকদফা চমকে গেলাম আমি! ভাইদের সাথে সে-ও এসেছে? হচ্ছেটা কি এখানে? আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়ার কণ্ঠস্বর,
—কংগ্রেটস, ভাবী! আমি খুব খুশি তোমার জন্য।
—থ্যাংকিউ, প্রিয়া। তোমরা সবাই হঠাৎ একসাথে এলে যে?

—আর বলোনা। তোমার সাথে তো রেজাল্টের পর দেখাই হলোনা আমাদের। বাবা মিস্টি নিয়ে এসেছিলো, সে তোমাকে বাসায় না দেখে নারাজ। বলেছে আমরা আজই যেন তোমার মিস্টিমুখ করি। সাথে আংকেল-আন্টির জন্যও মিস্টি পাঠিয়েছেন। যেহেতু ভাইয়ারা আসছিলো তাই ভাবলাম আমিও চলে আসি সাথে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রিয়ার হাসোজ্জল চেহারা দেখে হাসি চলে এলো আমার মুখেও। মেয়েটা বড্ড সরল, সবার সামনে নিদারুণ চঞ্চলতায় কথা বলছে। আমি ওকে নিয়ে সোফায় বসলাম। পূর্ণ ওভাবেই ঠাই তাকিয়ে আছেন আমার হাতের দিকে। বিরক্ত হলাম আমি। কি সমস্যা উনার? সবার সামনে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন!

কিছুক্ষণ সবাই কথাবার্তা বলে ডিনার করতে গেলো। খাওয়া শেষ করে প্রান্ত ভাইয়া চলে আসতে চাইছিলেন সেসময় আন্টি জেদ করলেন তাদের থাকার জন্য, প্রান্ত ভাইয়া রাজি হলেন নাহ। তাদের সকালে অফিস আছে, সাথে ব্যাগ-ফাইল কিছুই আনেননি তাই থাকতে চাচ্ছেন নাহ। পূর্ণ মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তাদের কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার জন্য আন্টি তাড়া দিলেন আমাদের,
—রাইসা, তুরফা জামাইদের তোদের রুমে নিয়ে যা। মাত্র খেয়ে উঠলো, রেস্ট নিক কিছুক্ষণ।
আমরা মাথা দুলিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। দুই ভাই এলেন পিছু পিছু।

রুমে ঢুকতেই চুপচাপ খাটে গিয়ে বসলাম আমি। পূর্ণর দিকে তাকালাম না পর্যন্ত। উনি ধীর পায়ে এসে বসলেন আমার পাশঘেঁষে। আমি খানিকটা সরে বসলাম, পূর্ণও সরে এলেন। বেশ কয়েকবার একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো! আমি যত সরছি উনি ঠিক ততই আমার পাশঘেঁষে বসছেন! এদিকে সরতে সরতে যে কখন আমি খাটের কিনারায় চলে এসেছি নিজেও বুঝিনি।

একটু নড়তেই খাট হতে পড়ে যেতে নিয়েছিলাম এমন সময় উনার বলিষ্ঠ হাত শক্তভাবে চেপে ধরলো আমার কোমড়! মুহূর্তেই টেনে আমাকে খাট থেকে উনার কোলে বসিয়ে দিলেন পূর্ণ। ঘটনার আকস্মিকতায় অক্ষিদ্বয় কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম আমার! উনি গভীর চোখে আমার দিক চেয়ে আছেন। স্তম্ভিত আমি ভ্রু কুচকে উনার দিক চেয়ে সরে যাওয়ার জন্য ছটফট করলাম বারকয়েক। তবুও উনার শক্তির সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম হলাম নাহ! একপর্যায়ে উনার প্রগাঢ় চাহনি ও শক্তহাতের স্পর্শ নিতে না পেরে বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে উঠলাম,

—কি শুরু করেছেন? এভাবে কোলের উপর বসিয়েছেন কেন? ছাড়ুন আমায়।
—আমার বউকে আমি কোলে তুলে রাখি, না হয় মাথায় তুলে রাখি। সেটা একান্তই আমার ইচ্ছা। এতে তোমার কি?
পূর্ণর কথায় বেকুব সেজে গেলাম আমি। ক’দিন যাবত উনার চোখের সামনে ঘুরঘুর করলাম, তখন ঠিকই ইগ্নোর করলেন আর এখন উনাকে একা থাকতে দিয়ে আন্টির বাসায় চলে এসেছি তাতে যেন সোহাগ উপচে পড়ছে উনার! কেমন বউ বউ করছেন! উনাকে পাত্তা না দিয়ে তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে বললাম,

—অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসায় চলে যান।
—সারাদিন পর মাত্র তোমার দেখা পেলাম, তুরফা। আর তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো? নট ফেয়ার।
দুঃখী কণ্ঠে বললেন উনি। শুনে আমার হঠাৎ রাগ হলো। এখন উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন সব দোষ আমার।
—আমি থাকলেও আপনার কি যায় আসে? আমি থাকা, না থাকা সমান আপনার কাছে। এখন বাসায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আর ছাডুন আমায়!

—আমি তো একা যাচ্ছিনা। তোমাকেও নিয়ে যেতে এসেছি।
উনার কথা শুনে গোলগোল চোখে চেয়ে রইলাম। আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন? কিন্তু কেন? উনি কি জানেন না আমি থাকবো আজ এখানে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললাম,
—আমি যাবোনা আপনার সাথে। আজ আন্টিকে কথা দিয়েছি এখানে থাকার। বড়াম্মুকেও বলে দিয়েছি। তিনি আপনাকে বলেননি?

—মা বলেছে আমায়। তাতে কি? আমি তোমার আন্টিকে রাজি করাবো। তুমি রাজি হলেই হচ্ছে। এখন তুমি আমার সাথে বাসায় যাবে।
জেদি গলায় বললেন পূর্ণ। আমিও দ্বিগুণ জিদ দেখিয়ে বললাম,
—অসম্ভব! আমি আপনার সাথে যাবোনা মানে যাবোই না আজ। আর আপনার সাথে যেয়েও বা কি? আপনি তো দিব্যি নিজের মতোই থাকবেন। মাঝখান দিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে যাবে। এর চেয়ে আমি আন্টির এখানেই ভালো আছি৷ কেউ তো আমার কথা ভাবে, আমাকে মিস করে।

—তুমি বলতে চাইছো আমি তোমার কথা ভাবিনা? আমি তোমাকে মিস করিনা? তাহলে তোমাকে এই রাতের বেলা কেন নিতে এসেছি?
রেগে বললেন পূর্ণ। এই মুহুর্তে উনার চেহারা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আমায় “পূর্ণ তোমায় খুব মনে করে”। তবুও উনার মুখ থেকে শুনার অদম্য ইচ্ছে জাগলো মনে। উনার থেকে স্বীকার করিয়ে নেওয়ার এটাই সুযোগ। তেজী গলায় বললাম,

—অবশ্যই করেন না। আমার কথা মনে করলে এই যে আজ আমার রেজাল্ট দিলো, আপনি একটাবারও ফোন দিয়েছেন আমায়? ফোন তো দূরের কথা, মেসেজ অব্দি দেন নি! সবাই আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে, গিফট দিয়েছে শুধু আপনি বাদে। এখন এসব আদিখ্যেতা দেখাতে হবেনা আপনার। আমাকে ছাড়ুন বলছি৷

আমার এত রাগি গলার তেজ দেখে যেন বিস্মিত হয়ে গেলেন পূর্ণ। হাতের বাধন আপনা-আপনিই আলগা হয়ে গেলো উনার। সেই সুযোগে উনার কোল থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলায় হাপিয়ে গিয়েছি। তবে মনে মনে খুশিও হলাম। উনাকে জানানো দরকার ছিলো আমার মনের অবস্থা। কখনো সুন্দর ব্যবহার করবেন তো কখনো অবহেলা করবেন এমনটা হয় নাকি? উনার এত মুডসুইংস সহ্য হয়না আমার!

এসব ভাবতে ভাবতেই জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি চুপচাপ। আকাশে মেঘ। চাঁদের দেখা নেই আজ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে যেন! জানালা দিয়ে সাই সাই করে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে ঘরে, চুলগুলো ছন্নছাড়াভাবেই দুলছে মুখের আশেপাশে। বিরক্তিতে আলতো হাতে এলোমেলো চুল খোপা করলাম আমি। খানিকক্ষণ বাদে ঘাড়ের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস পেতেই পেছন ঘুরার চেস্টা করলাম। তবে আমায় পিছনে ঘুরার সুযোগ দিলেন না পূর্ণ!

আচমকা উনার বড়সড় হাতজোড়া দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। মুহুর্তেই স্থির হওয়া শ্বাসপ্রশ্বাস যেন দ্বিগুণ গতিতে উঠানামা করতে লাগলো আমার! উনার উষ্ণ হাতের স্পর্শেও ঠান্ডা হয়ে এলো আমার হাত-পা। অদ্ভুত সব অনুভূতির বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম যেন আমি৷ এমন সময় পূর্ণ কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর গলায় নরম সুরে বললেন,

—সরি। তুমি রাগ করোনা। ভেবেছিলাম সবাই তো ফোনেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, আমি না হয় সরাসরিই জানাবো। নয়তো সবার আর আমার মধ্যে পার্থক্য থাকলো নাকি?
মস্তিষ্ক জবাব দিতে চাইলেও মন তাতে দ্বিমত জানালো। মনের বিরুদ্ধে যেয়ে কথা বলতে পারলাম না আমি। শিউরে উঠে চুপচাপ শুনতে লাগলাম উনার কথা। এই নরম-কোমল পূর্ণকে আমি সচারাচর দেখিনা, কিন্তু যখন তার দেখা পাই তখন শুধু উনার কথা শুনতেই মন চায়। আমায় চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ আবারো বললেন,

—কথা বলছোনা কেন? এখনও অভিমান করেছো? আমি সবার মতো তোমায় কংগ্রেটস জানাবোনা। কার‍ণ এটা তোমার সফলতার প্রথম ধাপ মাত্র, আসল পরীক্ষা এখনও বাকি আছে। আমি চাই তুমি সেটাও সফল হও ভালোভাবে। আমি চাইনা তুমি ঢাকার বাহিরে যাও। তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। এটা মাথায় রাখবে, বুঝেছো?
চুপচাপ উনার কথায় মাথা নাড়লাম আমি। এতক্ষণের জমে থাকা অভিমান যেন নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেলো! এই গম্ভীর লোকটা ভালো করেই জানেন কিভাবে আমার অভিমান ভাঙ্গাতে হয়। এই যে উনার কোমল আচরণ যে আমার হৃদয়ে কম্পন তুলে সেটা কি উনি জানেন?

আচমকা চুলে টান অনুভব হতেই নড়ে উঠলাম আমি! পূর্ণ হালকা সুরে ধমক দিলেন,
—উফ, তুরফা! নড়োনা তো৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।
উনার কথা মেনে কৌতুহলের সাথে চুপচাপ ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কিছুক্ষণ পর উনি কাজ শেষ করে আমায় নিয়ে অপরপাশ ঘুরলেন আয়নার দিকে। নিজের খোপায় বেলিফুলের মালা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি। নাকে এসে ঠেকলো তাজা ফুলের মিস্টি ঘ্রান, যা বৃষ্টির সুবাসের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে!

—বুঝতে পাচ্ছিলাম না তোমার জন্য কি নিবো। হঠাৎ এটা চোখে পড়লো ফেরার পথে। আমি অবশ্য চুলে ঠিকমতো লাগাতে পারিনা এগুলো। তাও বেধে দেওয়ার চেস্টা করলাম। ভালো লেগেছে তোমার?
হালকা হেসে বিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন পূর্ণ। উনার সরল মুখ বলছে তার এসব বিষয়ে কোন পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই। তবুও এই মানুষটা ধীরে ধীরে সব চেস্টা করছেন।

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৭

শুধু আমার জন্য! এর চেয়ে বড় ভালো লাগা আর কি হতে পারে আমার কাছে?
মুহুর্তেই এক পশলা ভালো লাগার বৃষ্টি নামলো আমার হৃদয়জুড়ে! বাইরে প্রকৃতির বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, খানিকটা ছিটেফোঁটা এসে ছুয়েও দিচ্ছে আমাদের দুজনকে! এদিকে বেখেয়ালি মন বলছে, এটাকেই বোধহয় প্রেমের বৃষ্টি বলে, তাইনা?

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৯