একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৩

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৩
সাদিয়া জাহান উম্মি

ফুলে সজ্জিত রুমের বিছানায় চুপটি করে বসে আছে প্রাহি।কেমন যেন লাগছে ওর কাছে।এই দিনটার জন্যে কতোকাল ধরে অপেক্ষা করেছে ও।অথচ কাঙ্খিত দিনটা আসতেই মনে মনে ভয় কাজ করছে প্রাহির।অস্থিরতা ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে ওকে।প্রাহি ঘোমটার ভীতর হতেই রুমের চারদিক চোখ বুলালো।খুব সুন্দর করে রুমটা সাজিয়েছে ওরা।চারদিকে ফুল আর ক্যান্ডেল লাইট দিয়ে ভরা।মোহময় পরিবেশ।বারান্দায় যাওয়ার জন্যে স্লাইডিং ডোরটা পুরো খুলে দেওয়া সেখানে সাদা পর্দা টানানো।পর্দাগুলো বাতাসের দাপটে খানিকবাদে উড়ে উড়ে আবার থেমে যাচ্ছে।বাহির থেকে হেমন্ত,হিয়া আর আরাফের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।ওরা অর্থকে টাকা দেওয়ার জন্যে বলছে।খানিকবাদে চেঁচামেচি থেমে গেলো।খট করে দরজাটা খুলে গেলো।প্রাহির মনে হলো দরজাটা খোলার শব্দে যেন কলিজাটা ছ্যাত করে উঠেছে।ভয়ে গায়ের শাড়িটা খামছে ধরলো সজোড়ে।মাথা ঘুরাচ্ছে অধির চিন্তার কারনে ওর।

এদিকে রুমে ডুকেই সর্বপ্রথম বিছানায় বসে থাকা প্রাহির দিকে নজর গেলো অর্থ’র।যেই অর্থ মেয়েদের ধার কাছেও যেতো না।আর সেই অর্থ না-কি আজ থেকে একটা মেয়ের সাথে একই রুমে সারাজীবন কাটাবে।অদ্ভুত, অদ্ভুত,জীবটা বড্ড অদ্ভূত।অর্থ আস্তে করে প্রাহির পাশে বসলো।প্রাহি হালকা নড়ে উঠলো।অর্থ প্রাহি ঘোমটাটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেললো।ঘোমটা সরাতেই প্রাহির মায়াবি মুখটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো অর্থ।মুখে কোন ভারি মেক-আপ নেই।শুধু চোখে গাঢ়ো করে কাজলটানা আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপ্সটিক্লক। এতেই যেন সৌন্দর্যে অর্থ’র চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে।অর্থ নিজের অজান্তেই বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘মাশা-আল্লাহ!’
অর্থ’র এমন ঘোরলাগা কন্ঠস্বর শুনে বুক কেঁপে উঠলো প্রাহির।আঁড়চোখে তাকালো অর্থ’র দিকে।লোকটা এখনো তাকিয়ে আছে ওর দিকে।প্রাহি আস্তে করে এইবার সালাম দিলো।এতে ধ্যান ভাঙ্গে অর্থ’র।অর্থও সালামের জবাব দিলো।অর্থ এইবার প্রাহির হাতে একটা ছোট প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। প্রাহি অবাক হয়ে তাকালো অর্থ’র দিকে।বললো,

‘ এইগুলো কি?’
অর্থ’র গম্ভীর কন্ঠস্বর,
‘ এইগুলো তোমার মোহরানার টাকা। আমি সব পরিষোধ করে দিলাম।এইবার তুমি এইগুলো দিয়ে কি করবে তোমার ব্যাপার।’
প্রাহি মাথা নাড়িয়ে স্বায় জানালো।অর্থ এইবার প্রাহির কপালে হাত দিয়ে দোয়া পড়তে লাগলো।প্রাহি অবাক নয়নে চেয়ে আছে। লোকটাকে সাদা পাঞ্জাবিতে অনেক স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। সুদর্শন এই যুবকটা আজ থেকে ওর স্বামি।ভাবতেই প্রাহির মনের ভীতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। অর্থ দোয়া পড়ে শেষে প্রাহির গায়ে ফুঁ দিয়ে দিলো। ধীর আওয়াজে বললো,
‘ চলো ওজু করে আসি।নফল নামাজ পরে আল্লাহ্’র কাছে আমাদের নতুন জীবনটা যেন সুখের হয় সেই দোয়া করি।’
‘ হুম চলুন।’
প্রাহি আর অর্থ দুজন ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো।নামাজ শেষে অর্থ বললো,

‘ বারান্দায় যাবে?’
‘ হুম চলুন!’
বারান্দায় গিয়ে অর্থ দোলনায় বসে পড়লো,তারপর প্রাহিকেও বসতে বললো।প্রাহি বসতেই অর্থ বলে উঠে,
‘ গান শুনবে?’
প্রাহির অবাক কন্ঠ শোনা গেলো,
‘ আপনি গান গাইবেন?’
অর্থ চারদিকে নজর বুলিয়ে ভ্রু-কুচকে প্রাহির দিক তাকিয়ে বলে,
‘ এখানে তো আমি ছাড়া আর কাউকে দেখছি না।তাহলে নিশ্চয়ই আমি শোনাবো।’
প্রাহি ফিঁক করে হেসে দিলো।অর্থ প্রানভরে সেই হাসি দেখলো।আজ আকাশে মস্তো বড় একটা চাঁদ উঠেছে।চাঁদের আলো যেন প্রাহিকে মায়াময়ী করে তুলেছে।নীল আর সাদার সংমিশ্রনে শাড়ি পরেছে প্রাহি।মেয়েটা শাড়ি পরলে অর্থ’র যেন হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়।এইযে মেয়েটা হাসছে।এইটা তো রিতিমতো অপরাধ একটা।এইভাবে নিজের হাসি দিয়ে যে মেয়েটা সামনের ব্যাক্তিটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে তা তো মেয়েটা জানলই নাহ।অর্থ প্রাহির দিক তাকিয়েই গান গেলো,

?♪♪♪`তোমার চোখে আকাশ আমার চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা
ভেতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয়তমা
তোমার চোখে আকাশ আমার চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা
ভেতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয়তমা
পথের শুরু থেকে শেষে যাবো তোমায় ভালোবেসে
বুকে আছে তোমার জন্য অনেক কথা জমা
তোমার চোখে আকাশ আমার চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা
ভেতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয়তমা
তোমার চোখে আকাশ আমার চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা
ভেতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয়তমা`♪♪♪?
(পুরোটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন)

গান শেষে অর্থ তাকিয়ে দেখে প্রাহি ওর কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরেছে।মুঁচকি হাসলো অর্থ।প্রাহিকে কোলে নিয়ে বিছানায় এনে সুইয়ে দিলো।নিজেও অন্যপাশে সুয়ে তারপর প্রাহিকে বুকে টেনে নিলো।প্রাহির কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে অর্থ বললো,
‘ জানিনা।কেন আমি তোমাকে এতোটা চাই।আমার হৃদয়ে তুমি এমনভাবে গেঁধে গিয়েছো যে এখন চাইলেও আমি তোমাকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নাহ।এই ক’টা দিন আমি প্রচন্ড অস্থিরতায় পার করেছি।আজ আমি আমার কাঙ্খিত চাওয়া পেয়ে গিয়েছি।আজ আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাবো।’
প্রাহির গালে আলতো করে চুমু খেয়ে প্রাহিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো অর্থ।

ভোর সকাল।পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে।বাতাসে ফুলের ঘ্রান।স্নিগ্ধময়ী পরিবেশ।আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো প্রাহি।চোখ খুলতেই নিজেকে অর্থ’র বুকে আবিষ্কার করলো।লজ্জায় গালজোড়া লাল হয়ে গেলো।ইসস, সে কিনা এই লোকটার বুকে ঘুমিয়েছে সারারাত।আর লোকটাও কি সুন্দর ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে।কি সুন্দর নিষ্পাপ দেখাচ্ছে লোকটাকে ঘুমন্ত অবস্থায়।প্রাহি আলতো হাতে অর্থ’র কপাল,গাল,নাক ছুঁয়ে দিলো।ঠোঁট জোড়া ছুঁতে গিয়েও ছুঁলো না।কেমন যেন লজ্জা লাগছে প্রাহির।প্রাহি অর্থ’র হাতজোড়া সরিয়ে উঠে যেতে নিতেই।প্রাহিকে হেঁচকা টানে নিজের বুকের উপর ফেলে দেয় অর্থ।প্রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।প্রাহিকে আরো অবাক করে দিয়ে অর্থ দুষ্টু হেঁসে বললো,

‘ আমার সব জায়গা ছুঁয়ে দিলে নিজের কোমল হাতজোড়া দিয়ে।তাহলে (নিজের ঠোঁট দেখিয়ে) এইখানে কি দোষ করলো?’
প্রাহি অর্থ’র কথা শুনে লজ্জায় চোখ নামিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো।আর অর্থ মুঁচকি হেসে হুট করে ওর গালে একটা চুমু দিয়ে দিলো।প্রাহি সাথে সাথে চমকে উঠে নিজের গালের সেখানে হাত দিলো।কি করলো এটা অর্থ?অর্থ ওকে কিস করলো?সারাশরীর কেঁপে উঠলো প্রাহির।জায়গাটায় এখনো ভেজা ভেজা আবেশ লেপ্টে আছে মনে হচ্ছে।প্রাহিকে এইভাবে চমকে তাকাতে দেখে অর্থ নিজের ঠোঁট কামড়ে হাসলো।বললো,
‘ এইভাবে অবাক হওয়ার কিছু নেই।এইটা নিয়ে তিনটা কিস করে ফেলেছি আমি ওলরেডি।’
প্রাহি ঝটকার পর ঝটকা খাচ্ছে।তুতলিয়ে বললো,

‘ মা…মানে?’
অর্থ’র কন্ঠ গম্ভীর শোনালো,
‘ মানে সিম্পল। কাল তুমি আমার গান শুনতে শুনতে আমার কাঁধেই ঘুমিয়ে পরেছিলে।আমিও সেই সুযোগে তোমার গালে আর কপালে চুমু খেয়ে নিয়েছি। হলো না দুটো?আর এখন একটা খেলাম।মোট তিনটা।’
‘ আপনি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে চুমু খেয়েছেন?’
অর্থ প্রাহির দিকে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে বললো,
‘ এইভাবে অবাক হওয়ার কিছু হয়নি।তুমি আমার বউ।এই সামান্য তিনটা চুমু তো কিছুই না আমি চাইলে আরো অনেক কিছু করতে পারি।সেই অধিকার আমার আছে।’
অর্থ’র কথায় প্রাহি শুকনো ঢোক গিললো।অর্থ এইবার প্রাহিকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে ওর কানে ফিসফিস করে বললো,
‘ কিন্তু আমি করবো না।কারন আমি চাই আমার বউ নিজ ইচ্ছায় আমার কাছে আসুক।সে যতোদিন না চাইবে আমি তাকে কোনদিন জোড় করবো না।তবে মাঝে মাঝে ছোট ছোট দু একটা চুমু খেতে পারি।সাথে বউও আমাকে দু একটা চুমু রিটার্ন গিফট হিসেবেও দিতেই পারে।এতে কোন সমস্যা নেই।’

কথাগুলো শেষ করে অর্থ তাকালো প্রাহির দিকে।মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে আছে।প্রাহির ঠোঁটের কোণের মুঁচকি হাসিটাও চোখ এড়ায় না অর্থ’র।সাথে সাথে ওর নিজেও হেসে দেয়।অর্থ প্রাহিকে সরিয়ে উঠে বসলো।প্রাহি হকচকিয়ে তাকালো অর্থ’র দিক।অর্থ হুট করে প্রাহিকে কোলে তুলে নিলো।প্রাহি নিজেকে সামলাতে অর্থ’র গলা জড়িয়ে ধরলো।প্রাহি অবাক হয়ে বলে,
‘ কি করছেন এইগুলো?’
অর্থ তার দৃষ্টি সামনের দিকে রেখেই জবাব দেয়,
‘ কিছুনা।বউকে কোলে তুলেছি।আর হ্যা শুনে রাখো আজ থেকে প্রতিদিন এইভাবেই তোমাকে আমার কোলে চড়ে ওয়াশরুমে যেতে হবে।আনরা দুজন একসাথে ফ্রেস হবো প্রতিদিন।’
প্রাহি হাসলো।মাথা ঝাকিয়ে বললো,

‘ আচ্ছা!’
অর্থ আর প্রাহি দুজন একসাথে ফ্রেস হয়ে নিলো।প্রাহি এইবার অর্থকে বললো,
‘ এইবার আপনি বের হোন আমি শাড়ি চেঞ্জ করবো।’
‘ আচ্ছা ঠিকাছে।কিন্তু তুমি তো শাড়ি আনোনি।’
প্রাহি জিভ কাটলো,
‘ ইসস। আপনিই তো কোলে করে নিয়ে আসলেন।আচ্ছা আপনি বাহিরে যান আমি নিয়ে আসছি।’
অর্থ প্রাহিকে থামিয়ে দিলো।বলে,
‘ তার দরকার নেই।আমি তোমাকে শাড়ি দিচ্ছি সেটাই পরবে তুমি।’
অর্থ বেড়িয়ে গেলো। প্রাহি মনে মনে ব্লাস হতে লাগলো।কিছুক্ষন পর অর্থ প্রাহিকে একটা লাল টকটকে মখমলে কাপড়ের শাড়ি দিলো।প্রাহিও সেটা নিয়ে সুন্দরভাবে পরে বের হয়ে আসলো।প্রাহি বের হতেই অর্থ মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো প্রাহিকে।লাল শাড়িতে যেন মেয়েটাকে কোন ফুটন্ত লাল গোলাপ লাগছে।অর্থকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসলো প্রাহি।আস্তে করে বলে,

‘ এইভাবেই তাকিয়ে থাকবেন নাকি নিচেও যাবেন?’
অর্থ সম্ভীত ফিরে পায়।মাথা চুলকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
‘ এখনো না।এক মিনিট দারাও।কাল রাতে আমি তোমাকে উপহার দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।সেটা এখন দিয়ে নেই।’
অর্থ ড্র‍য়ার খুলে উপহার খুজতে লাগলো।এইফাকে প্রাহি গিয়ে নিজের চুল আচড়ে নিলো,মুখে ক্রিম লাগালো,চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপ্সটিক দিলো।হঠাৎ প্রাহি ঘারে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠলো।হাত থেকে কাজলটা পরে গেলো ঠাস করে।সারাশরীর শিরশির করে উঠলো।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১২

নিভু নিভু চোখে আয়নায় তাকায় প্রাহি ।অর্থ যত্নসহকারে প্রাহির চুলগুলো একসাইডে নিয়ে প্রাহির গলায় একটা ডায়মন্ডের লকেট পড়িয়ে দিচ্ছে।প্রাহি তাকিয়েই আছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে দুজনকে একসাথে।প্রাহি মনে মনে আল্লাহ্’র কাছে প্রার্থনা করলো।ওরা যেন সারাজীবন এইভাবেই একে-অপররের সাথে থাকতে পারে।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১৪