একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২
সাদিয়া জাহান উম্মি

-‘ ভাবি! ভাবি! ও ভাবি শুনো নাহ ভাবি!’
হেমন্ত এক নাগারে প্রাহিকে ভাবি ভাবি বলে ডেকেই যাচ্ছে।শেষ মেষ বিরক্ত হয়ে প্রাহি বললো,
-‘ কাউয়া কোথাকার আর একবার ভাবি ডাকবি তো তোর জিহ্বা ছিড়ে ফেলবো।’
-‘ ভাবি! ভাবি!’
-‘ হেমন্ত আমাকে বিরক্ত করিস না।আমি ল্যাবে কাজ করছি দেখছিস তুই।’

হেমন্ত প্রাহিকে জ্বালাতন করে খুব মজা পাচ্ছে।দীর্ঘ একঘন্টা যাবত সে এমন করছে।কারন ভার্সিটিতে আসার পর থেকে প্রাহি একবারও হেমন্ত’র সাথে কথা বলেনি।সেইজন্যেই হেমন্ত প্রাহিকে বিরক্ত করছে যাতে বিরক্ত হয়েও প্রাহি ওর সাথে কথা বলে।আর সেটাই হলো।এদিকে হেমন্ত’র বলা বার বার ‘ ভাবি!’ ডাকটা একেবারে কলিজায় গিয়ে লাগছে প্রাহির।কি যে সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে বলে বুঝাতে পারবে না প্রাহি।তবে সেই খুশিটা মনেরটা মনেই চেপে রেখেছে।হেমন্তকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না ওর মনের কথা।তাই মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে রেখেছে।প্রাহির ভাবনায় ছেদ ঘটে হেমন্ত’র ওর হাত ধরাতে।ছেলেটা ওকে টেনে হিছরে নিয়ে যাচ্ছে।প্রাহি রাগে কিরমির করে বলে উঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ তুই এমন করছিস কেন?প্লিজ থাম! কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে।থাম হেমন্ত।উফফ!’
কে শুনে কার কথা হেমন্ত প্রাহিকে টানতে টানতে ওর বাইকের কাছে এনে দাড় করালো।প্রাহি হেমন্ত’র কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছোটাছুটি করছে।হেমন্ত’র তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।ও শান্ত ভঙিতে ইশিকে ফোন দিয়ে বললো ক্যাম্পাসে পার্কিং প্লটে যেন চলে আসে ও।প্রায় ১০ মিনিট পর ইশি এসে পৌছাতেই হেমন্ত বাইকে উঠে বসলো।তারপর ইশি উঠে বসলো।প্রাহি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।হেমন্ত এইবার দাঁত খিচিয়ে বললো,
-‘ দেখ প্রাহি! ভালোই ভালোই বলছি বাইকে উঠে বস।নাহলে কিন্তু তোকে ঘারে তুলে নিয়ে এক আছাড় মারবো।’
প্রাহি তাকালো।হেমন্তকে ভেংচি কেটে বাইকে উঠে বসলো।নাহলে দেখা যাবে হেমন্ত সত্যি সত্যি ওকে তুলে আছাড় মেরে দিয়েছে।আর প্রাহি এতো তাড়াতাড়ি কোমড় ভেঙ্গে বসে থাকতে চায়না।বিয়ের পর কোমড় ভাঙ্গলে সমস্যা নেই।তখন তো তারই সুবিধা হবে সারাদিন সে তার প্রেমিক পুরুষের কোলে চড়ে টইটই করে ঘুরে বেড়াবে।আহা! ভাবতেই সুখ সুখ ফিলিংস আসছে প্রাহির।

-‘ কিরে ভ্যাটকাইতেছোস কেন?’
প্রাহি থতমত খেয়ে গেলো ইশির কথায়।জোড়পূর্বক হেসে বললো,
-‘ কই না তো!’
-‘ তাহলে আমাকে টাইট করে ধরতে বলছি শুনতে পাচ্ছিস না কেন? রাস্তায় উলটে পরে মরার ইচ্ছা জেগেছে নাকি।’
প্রাহি নাক মুখ কুচকে বলে,
-‘ বেশি কথা বলিস তুই।সামনের দিকে তাকা তো।ফাউল প্যাচাল করিস না!’
প্রাহি ইশিকে শক্ত করে ধরে বসলো।এদিকে ইশি ব্যাক্কল হয়ে বসে।সে কখন ফাউল কথা বললো?আজব!

ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে প্রাহি,ইশি।চুপচাপ করে বসে আছে।মনে হচ্ছে ওদের মতো ভদ্র আর কেউ নেই।প্রাহি মনে মনে হেমন্তকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করছে।ছেলেটা এতো খারাপ।শেষমেষ টেনেহিছড়ে শিকদার বাড়িতে নিয়ে আসলো।আর এসেই ওদের এখানে বসিয়ে দিয়ে ও লাপাত্তা।ও কি বুঝে না প্রাহির এখানে আসলে অসস্তি হয়। এই বাড়ির বড় ছেলেকে ভালোবাসার আগে এই অসস্তিটা ছিলো না।কিন্তু ভালোবাসা বুঝার পর থেকে এই বাড়িতে আসার নাম নিলেও প্রাহির কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে।প্রাহির ইচ্ছা সে একেবারে বউ হয়ে এই বাড়িতে আসবে।তার আগে এখানে আসার কোন মানেই হয়না। প্রাহিকে অন্যমনস্ক দেখে ইশি ওকে হালকা ধাক্কা দিলো।বললো,
-‘ কিরে? কি ভাবছিস এতো?’
প্রাহি কিছু বলবে তার আগেই ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় রায়হানা বেগম। প্রাহি আর ইশি উনাকে দেখেই সালাম জানান।বিনিময়ে উনিও সালামের জবাব দিয়ে বলেন,

-‘ কি হলো আম্মুরা?খাচ্ছো না কেন?সেই কখন নাস্তা পাঠালাম এখনো কিছুই তো দেখছি খেলে না।’
প্রাহির হৃদয় জুড়িয়ে যায়।কি সুন্দর অমায়িক ব্যবহার।আসলে এই বাড়ির প্রতিটা মানুষেরই ব্যাবহার চমৎকার সুন্দর।প্রাহির অবাক লাগে। ও নাকি এই বাড়ির বউ হবে।কতোটা ভাগ্যবতী সে।এখন শুধু ওই বড়লোক খারুসটা রাজি হলেই হয়।
মনে মনে কথাটা গুলো বলেই মিষ্টি হেসে রায়হানা বেগমকে বললো,
-‘ তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।তুমি নিজে এসে খাইয়ে দেও।কতোদিন পর এলাম। হেনা আন্টি কোথায় তাকে যে দেখছি না?’
-‘ এইতো আমি আম্মুরা!’
রান্নাঘর হতে হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে কথাটা বলে উঠেন হেনা বেগম।ইশি আর প্রাহি উনাকেও সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে নিলেন।
ইশি বললো,
-‘ আন্টি আসো এখানে এসে বসো তো একটু।’
হেনা বেগম বসতেই রায়হানা বেগম বললেন,
-‘ দেখেছিস হেনা।সেই কখন নাস্তা পাঠালাম।তারা কিছুই খেলো না।ওদের নাকি আমাদের হাতে খাওয়ার শখ জেগেছে।’
বিনিময়ে হেনা বেগম হালকা হাসলেন।বলেন,

-‘ এতো বেশ ভালো কথা।আপা তুমি প্রাহিকে খাইয়ে দেও আমি ইশি খাইয়ে দিচ্ছি।’
প্রাহি আর ইশি বেজায় খুশি হলো।রায়হানা আর হেনা মিলে ওদের দুজনকে খাইয়ে দিলো।ইশি হেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর চোখজোড়া ছলছল করছে।আজ কতোদিন পর এতোটা মমতা নিয়ে কেউ ওকে খাইয়ে দিলো।ওর মা থাকলেও বুঝি ওকে এইভাবে খাইয়ে দিতো? মার কথা খুব করে মনে পড়লো ইশির।না চাইতেও টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো ওর চোখ থেকে।সাথে সাথে হেনা বেগম ব্যাকুল কন্ঠে বলেন,
-‘ সে কি ইশি কাঁদছো কেন?নুডুল্সগুলোতে কি বেশি ঝাল দিয়ে ফেলেছি আমি?’
সাথে সাথে ইশি না বোধক মাথা নাড়ায়।তারপর হুট করে হেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে।হেনা বেগম পরম স্নেহে ইশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

-‘ কি হয়েছে আম্মু?’
ইশি ক্রোদন স্বরেই বলে,
-‘ জানো আন্টি।মা মারা যাওয়ার পর কেউ আমাকে এতো স্নেহ করে কোনদিন খাইয়ে দেয়নি।তাই মার কথা খুব মনে পড়ে গেলো।’
প্রাহি,রায়হানা বেগম, হেনা বেগম সবার খারাপ লাগলো অনেক ইশির কথা শুনে।আসলে ইশির মা ইশির যখন চার বছর বয়স তখন মারা যান।ইশির একটা বড় ভাইও আছে।ইশির মা মারা যাওয়ার মাস কয়েক পরেই তার বাবা আরেকটা বিয়ে করেন।বেশ ভালোই যাচ্ছিলো।কিন্তু আস্তে আস্তে ইশির সৎমায়ের আসল রূপটা বেড়িয়ে আসে।ইশির ভাই থাকতো হোস্টেলে সেখান থেকেই পড়ালেখা করতো।ইশি শুধু একা ছিলো বাড়িতে।ওর বাবা ব্যাবসার কাজে বেশির ভাগ বিভিন্ন জেলায় জেলায় যেতেন।সেই সুবাদে তিনিও বেশি বাড়িতে আসতেন না।আর সেটারই সুযোগ নিয়ে ইশির সৎমা ওর উপর নানান ভাবে টর্চার করতো।ওকে দিয়ে সব কাজ করাতো।ছোট্ট ইশিকে ভয় দেখাতো ওর বাবার কাছে যেন বিচার না দেয় সেই জন্যে।একদিন ধৈর্য’র বাধ ভেঙ্গে ইশি একদিন ওর বাবার কাছে বিচার দেয়।কিন্তু ওর সৎমা ওর বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিভিন্ন মিথ্যে কথা বলে ওর বাবাকে পটিয়ে ফেলে।পরে ওর বাবা সেটাই বিশ্বাস করে নিয়ে ইশিকে ইচ্ছামতো মারধর করে।ইশি পরে ফোন দেয় ওর মামাকে ওর মামারা সব শুনে ইশিকে তাদের কাছে নিয়ে যান।ইশির বাবাও এতে আপত্তি করে না।মামারা আর নানু ইশিকে অনেক ভালোবাসে।কিন্তু ওর দুই মামি কেউ ওকে দেখতে পারে না।নানু মারা যাওয়ার পর যেন মামিদের কটু কথা আরো বেড়ে যায়।ওর মামারা বাড়িতে থাকলে কেউ কিছু বলে না।কিন্তু তারা না থাকলেই দুই মামির আসল রূপ বেড়িয়ে আসে।সেই থেকেই ইশির দিনকাল এমনই যাচ্ছে।এরশাদ সাহেব আর রাবেয়া বেগম ইশিকে উনাদের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন।কিন্তু ইশি রাজি না।শুধু কেন অন্যের ঘারে বোঝা হয়ে থাকবে ইশি।এর থেকে ও যেমন আছে সেইভাবেই দিনকাল চলুক না।

হেনা বেগম ইশির চোখের পানি মুছে দিলো।কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
-‘ পাগল মেয়ে এতে কাঁদতে হয়।যখনই মার কথা মনে পরবে চট করে এখানে এসে পরবে।আমি তো বলি রোজই এসো আমি নিজ হাতে তোমাকে খাইয়ে দিবো।’
রায়হানা বেগম বলে উঠেন,
-‘ আমিও আছি এতে ভাগিদার।আমিও খাইয়ে দিবো।’
ইশি মৃদ্যু হাসলো।প্রাহি মুগ্ধ হয়ে দেখছে ওদের।ঠিক কতোটা উদার মনের হলে কেউ কাউকে এতোটা আপন করে নিতে পারে।প্রাহি মনে মনে শপথ করলো এই বাড়ির বউ হয়ে আসলে এই বাড়ির প্রতিটা মানুষকে অনেক ভালোবাসবে। অনেক অনেক।প্রাহি ঠোঁটের কোনে মৃদ্যু হাসি ফুটে উঠলো।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ১

-‘ যা কান্না করার কয়েকদিন করে নে ইশি।বড় ভাইকে বিয়ে করার জন্যে রাজি করিয়ে।প্রাহিকে তার বউ বানাতে পারলেই।তার কয়েকদিন পর তোকেও আমার কাছে নিয়ে আসবো।আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিবো।এই বাড়ির ছোট বউ করে আনবো তোকে।আর একটু সবুর কর ইশি।আর একটু।’
কথাগুলো মনে মনে বলেই ইশির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো হেমন্ত।এই মেয়েটার চোখের পানি তার একদম সহ্য হয়না।একদম না।মেয়েটাকে যে সে অনেক ভালোবাসে।কিন্তু অবুঝ মেয়েটা তার ভালোবাসা বুঝেই না।তবে হেমন্ত আর অপেক্ষা করবে না।ইশিকে ওর বউ করে আনবে শীঘ্রই।অপেক্ষা শুধু একজনের বিয়ে করার জন্যে রাজি হওয়ার।ব্যস তাহলেই হবে।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩