এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ১৮

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ১৮
কায়ানাত আফরিন

বিগত কয়েকদিনে আনভীরের মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি আমি। উনি যেন আগের তুলনায় আরও বেশি পজেসিভ হয়ে গিয়েছেন আমায় নিয়ে। আমি উনাকে এড়িয়ে চললেই উনি যেন আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আমি কখন কোচিং যাচ্ছি, কি পড়ছি, কি খাচ্ছি সবকিছুর ব্যাপারেই উনার খেয়াল রাখতে হবে।

প্রথম কিছুদিন এগুলো আমাকে তেমন একটা ভাবায়নি, তার ওপর ছিলো পড়াশোনার ব্যস্ততা। মেডিকেল এক্সামের আগে কোচিংয়ে এবারই আমার লাস্ট টেস্ট ছিলো, তাই উনাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে নিজের সর্বস্ব সময়টুকু পড়ালেখায় দিয়েছি। আর কিছুদিন পরই আমার মেডিকেল এডমিশন টেস্ট। চিন্তা, পড়াশোনা, ভয় সবকিছু একসাথে জেঁকে বসেছে মনে। সেই সাথে আনভীরের হঠাৎ পরিবর্তনও।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সন্ধ্যাবেলা কিছুক্ষণ বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে রাতে শিউলি ভাবির সাথে কিচেনে কফি খাচ্ছি আর গল্প করছি আমি। যদিও এ সময়টাতে আনভীর বাসায় থাকলে নিজ দায়িত্বে আমায় কফি বানিয়ে দিতেন তবুও আজকে উনি বাসায় ছিলেন না। উনার ভার্সিটির কিছু প্রফেসরদের সাথে কি যেন একটা ছোট পার্টি আছে, সেখানেই গিয়েছেন। নুড়ী আপা তখন রুটি বানাচ্ছেন মায়ের জন্য। মা’র ডায়বেটিস আছে বলে উনি স্বভাবতই রাতে ভাত খান না। শিউলি ভাবি কথার এক প্রসঙ্গে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,

-‘তোমার আব্বু কল দিয়েছে এই কয়েকদিনে?’
আব্বুর প্রসঙ্গ উঠতেই আমার হাসি মুখটিতে নিমিষেই অন্ধকার ছেয়ে গেলো।বিগত সময়গুলোতে আমার আব্বু একমুহূর্তের জন্যও ফোন করেনি আমায়, চাচা চাচি তো দূরের কথা। আমি তো এতগুলো বছর আপদ ছিলাম উনাদের মাঝে,আপদ যেহেতু বিদায় হয়েছে তাহলে এখন আমার সাথে যোগাযোগ করবে কেনো? শিউলি ভাবি হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন আমার মুখ দেখে। যদিও উনি আমার অতীত সম্পর্কে খুব বেশি একটা জানেন না তাই আগবাড়িয়ে কিছু বলতেও পারছেন না খুব একটা। গ্যাসে খাবারগুলো গরম করতে করতে বললেন,

-‘মাঝে মাঝে খারাপ লাগে যখন আপনজনেরাই নিজের আপনজন না হয়। অনেকের কাছে কন্যাসন্তান মানে বিরাট এক বোঝা। তাকে যতদ্রুত সম্ভব বিদায় দিলেই পরিবারের একজন আপদ কমে যায় ভেবে তারা শান্তি পায়।কিন্ত তারা বুঝে না গো আহি, তারা একটা কহিনূরকে হারিয়ে ফেলে এমন করার জন্য।’
আমি মৌনিভাবে কফির মগে চুমুক দিলাম এবার। শিউলি ভাবি যে এগুলো কোন দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন তা আমি ভালোমতই জানি। নুড়ী আপা রুটিগুলো তাওয়া থেকে নামিয়ে ভাবিকে বললেন,

-‘ঠিক কইসেন আফা। এল্লেগাই তো মাইয়্যা মাইনসে গো নো নিজ পায়ে খাড়ানোর দরকার। আমি কোনো ট্যাকা রুজি করতাম না দেইখ্যা আমার সোয়ামি বহুত পিটাইসে আমারে। শেষমেষ ছাড়াছাড়ি কইরা অন্য বেডির লগে ভাইগ্গা গেলো। এহন আমি টাকা রুজী করতে পারি, তাই এলাকায় দামও বেশি। চাইলেও কেউ আমার লগে উচু গলায় কথা কইতে পারবো না। যদি কাম না করতাম,তবে ডরে ডরে দিন পার করবার লাগত।’
নুড়ী আপার কথাগুলো আমার ভালোলাগলো বেশ। ভাবি মিহি হেসে বললেন,

-‘মেয়েদের নিজ পায়ে দাঁড়ালে অনেক সম্মান পাওয়া যায় সমাজে। অনেক শ্বশুড়বাড়িতেই তো বিয়ের পর বউকে কাজ করতে দেয় না, পড়ালেখা করতে দেয় না। এদিকে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। কারন আমি পড়ালেখা শেষ করেই বিয়ে করেছি। এখন চাইলে চাকরিও করতে পারবো যদি ইচ্ছে থাকে। বাবা-মা বা আজরান কেউই দ্বিমত করবে না। আবার আহিকেই দেখো।

পরিস্থিতির চাপে অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে গেলেও বাবার কথামতো আনভীর ওকে পুরো সুযোগ দিয়েছে পড়ালেখা করার। মাও রাজি আছে এতে। আহির কি দরকার না দরকার সবকিছুর খেয়াল আছে আনভীরের। একটা মেয়ে যতটাই ওর পরিবারের কাছে বোঝা থাকুক না কেন,,,,, যদি নিজের হাজবেন্টের কাছে এত প্রায়োরিটি পেয়ে থাকে এর বেশি কি তার আর কিছু দরকার সুখে থাকার জন্য?’

শিউলি ভাবির কথায় শরীরে এক অন্যরকম অনুভূতি জেগে ওঠলো আমার,,,,,অনুভূতিটা আনভীরকে নিয়ে। উনি যদিও মুখে অনেক কথাই বলেছেন রাগের বশে, কিন্ত ওগুলো সবই কি সত্যি? বিয়ের প্রথম উনি আমার সাথে যেরকম ব্যবহার করতেন, এখনকার ব্যবহারের সাথে যেন আকাশ পাতাল তফাৎ। উনাকে কড়াকড়ি ভাবে ইগ্নোর করার পর থেকেই উনি যেন আমার প্রতি আরও ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছেন। কিন্ত আমি জানি এগুলো সবই উনার দায়িত্ব,,,,,শুধু একপ্রকার দায়িত্ব। এছাড়া আর কিছুই না।

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমি টিভি দেখছি সোফায় বসে। টিভি দেখছি বলে ভুল হবে , নুড়ী আপা টিভিতে কি দেখছে সেটাই দেখছি আমি আর ভাবি। এসময় জি বাংলা চ্যানেলে ‘মিঠাই’ নামের একটা নাটক হয়,নুড়ী আপা কখনোই এই নাটকটা মিস করেন না।আমার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে যে এই নাটকটার মধ্যে আছে কি , আজ তাই উনার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে দেখছি আমি। হঠাৎ দরজায় শব্দ পড়াতে ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি উঠতে নিলেই ভাবি বললো,

-‘আমি দেখছি।’
আমি তখনও টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একটা বিশেষ সিন চলছে।হঠাৎ আমার পাশে আনভীর বসে পড়লেন দ্রুতসময়ে। শীতল কন্ঠে বললেন,
-‘দুদিন পর তোমার পরীক্ষা আর এখন বসে বসে নাটক দেখছো তুমি?’

আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম উনার দিকে। আনভীর চোখজোড়া হালকা কুচাকানো । মসৃন কালো চুলগুলো কপালে পড়ে লাগাতে সুন্দর লাগছে। সবুজ শার্টের ওপর ধূসর রঙের টাইটা একটু ঢিল করে রেখেছেন ক্লান্তির জন্য। ওপরের একটি বোতাম খুলে থাকার জন্য গলায় চিকচিক করা সূক্ষ্ণ ঘাম দৃশ্যমান আমার কাছে। আমি উনার এমন দৃশ্য দেখে একপ্রকার থমকে গিয়েছিলাম কিছুটা। ইসসস! এই মানুষটা আমার বর?উনি তাজ্জব হয়ে বললেন,

-‘রাতে ভাত খাওনি? এখন বসে বসে আমায় খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে যে এভাবে চোখ দিয়ে গিলছো আমাকে?’
আমি অবাকমিশ্রিত চাহিনী নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। ড্রইংরুমে শিউলি ভাবি,নুড়ী আপার সাথে আজরান ভাইয়াও ছিলেন। আনভীরের কথায় তিনজনেই মিটমিটিয়ে হাসছেন এবার। লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। মনে মনে একশো এক টা গালাগাল দিলাম উনাকে। ব্যাটা ঠোঁটকাটা এটা তো আগেই জানতাম, তাই বলে মানুষের সামনেও যে এমন বেফাঁস কথা বলবে সেটা সম্পর্কে আমার আগেই ভাবা উচিত ছিলো। আমি ততক্ষণে উনার কাছ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছি। ভাবি এবার বললেন,

-‘থাক আনভীর! মেয়েটাকে আর লজ্জা দিতে হবে না।’
আনভীর কিছু বললেন না এবার। আমি উনার আর আজরান জন্য কিচেন থেকে দুই গ্লাস পানি নিয়ে আসতেই দুজনে তা শেষ করে সামনের টেবিলে রেখে দিলেন।আজরান ভাইয়া এখন বললেন,
-‘আনভীর ! আহির পরীক্ষার পর কি প্ল্যান আছে তোমার?
অবাক হলাম আমি। সাথে আনভীরও। তাই জিজ্ঞেস করলেন,
-‘আমার আবার কি প্ল্যান হবে?’
-‘আহা! এতটুকুও জানো না? বিয়ে হলো তো বেশ সময় আর হয়নি। নিউলি ম্যারিড কাপল তোমরা। একটু হানিমুন টানিমুন করতে যাবে না?’

আমি এবার অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম আজরান ভাইয়ের এমন কথায়। হয়তো আনভীরও। কিন্ত উনার চেহারা দেখে মনে হলো না যে উনি কোনোরূপ কোনো বিস্ময়ে আছেন। মুখের ভাব স্বাভাবিক। চশমার মধ্য দিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে থাকলেন আজরান ভাইয়ার দিকে। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললাম,
-‘হ-হ-হানিমুন? হানিমুন কেনো ভাইয়া? আমরা এভাবেই ঠিক আছি।আগে নাহয় পরীক্ষাটা দিয়ে নেই। তারপর ওসবের কথা ভাবা যাবে।’
আমার কথায় আজরান ভাইয়া যেন সন্তুষ্ট হলেন না। বলে ওঠলেন,

-‘এটা কোনো কথা বললে আহি? কেনো এসব পরে ভাববে? আমি যেহেতু ঘরের বড় তাই তোমাদের ঘোরাফেরার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে না? এই ছেলে তো শুধু স্যার গিরি করে দেখায়, একটু বই-খাতার বাইরে বউয়ের সাথে ঘুরাফিরাও তো করতে হবে। তাই না?’
আমি যদি আজ আনভীরের বউ না হতাম আমিও তুমুল গলায় বলতাম হ্যাঁ। কেননা এই মানুষটা আসলেই বই-খাতার বাইরে কিচ্ছু বুঝে না, রোম্যান্সের বেলায় তো বোধহয় আকডুম বাকডুম। কিন্ত ব্যাপারটা যেহেতু আমার সাথে আর আমি উনার ওয়াইফ তাই অগত্যাই চুপ থাকতে হলো আমায়। আনভীর এবার আজরান ভাইয়াকে বললেন,

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ১৭

-‘আমি কি বলেছি যে আমরা হানিমুনে যাবোনা?’
উনার কথা শুনে আরও একদফা অবাক হলাম। বলছেনটা কি উনি? বাহির থেকে গাজা-টাজা খেয়ে এসেছেন নাকি ! আজরান ভাইয়ার চোখে চমক দেখা গেলো হঠাৎ। বললেন,
-‘তাহলে কবে যাবে তোমরা? আর টেনশন নট। এবার সব খরচ আমি দিবো।’
আনভীর মিহি হেসে বললেন,
-‘ওর পষীক্ষাটা আগে শেষ হোক , তারপর।’

আমার রীতিমতো মাথা ঘুরাচ্ছে উনার কথা শুনে। যেদিকে আমায় বউ মানতেই উনার শত বাধা তাহলে হানিমুন এর কথা আসলো কিভাবে?এদিকে আজরান ভাইয়া আর শিউলি ভাবিও রীতিমতো প্রেশার দিচ্ছে কোথায় যাবো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। আমার এতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ফেলে আনভীর বাঁকা হেসে আমার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে চলে গেলেন রুমে।এই হাসিটা কেমন যেনো ভালো লাগলো না আমার। এই পাগল লোকটা সত্যিই তবে পরীক্ষার পর আমায় হানিমুনে নিয়ে যাবে?ও মাই গড!

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ১৯