এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৬

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৬
কায়ানাত আফরিন

আনভীর আমায় বাড়ির সামনে নামিয়েই চলে গেলেন উনার ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। আমি তাই এবার দ্রুত পায়ে বাসায় এসে পড়লাম। উদ্দেশ্য একটাই, যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে।বৃষ্টিতে সামান্য ভিজে যাওয়ার কারনে খানিকটা সিক্ত আছি আমি। তাই দ্রুত শুকনো কাপড় পড়ে আলমারি থেকে কাপড়-চোপড় নামিয়ে ব্যাগ গুছাতে থাকলাম। গতরাতেই মামার সঙ্গে কথা হয়েছে। উনাকে শুধু এতটুকুই বলেছি যে আমি আসছি। কেন আসছি, কার সাথে আসছি এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি৷ প্রথমে উনাদের কাছে যেয়ে নেই তারপর বিস্তারিত সব বলবো। আমার ব্যাগ গুছানোর মধ্যেই আচমকা মা ঘরে প্রবেশ করলেন। উনার উপস্থিতিতে আমার হাত আপনা আপনি কেমন করে যেন থেমে গেলো।

মা নির্বাক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছেন আমার কাজকর্ম। মলিনভাবে বললেন,
-‘আমিই হয়তো প্রথম শ্বাশুড়ি যে কি না নিজের বৌ মাকে ছেলের কাছ থেকে আলাদা হতে দেখে কিছু বলছি না।’
আমি নীরব। উনি এবার বললেন,
-‘একটা কথা বলবো আহি, তোমায় আমি কিন্ত সবসময় নিজের মেয়ের মতোই দেখেছি। শিউলির মতো তোমাকেও প্রচন্ড স্নেহের মনে করি তবে তুমি আর আনভীর আমাদের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো তা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমার চোখজোড়া টলমল করছে অশ্রুতে। অজান্তেই এই মানুষটিকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি। আর উনি এত বড় সত্য,জানার পরেও একবারও বাবাকে কথাটি বললেন না যাতে উনি এখন কষ্ট না পায়, তবে একদিন না একদিন আমাদের সত্য উনাকে তো জানতেই হবে।মা আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-‘আহি, আনভীরকে কি আর একটাবার সুযোগ দেওয়া,,,,,,, ‘
উনি কথাটি সম্পূর্ণ না করতেই আমি থমথমে গলায় বললাম,

-‘কি সুযোগ দিবো আমি মা? আবারও যাতে আমায় কষ্ট দেয় সেই সুযোগ?,,,,(কিছুটা থেমে),,,,আনভীর আমায় নিজের একজন রেসপন্সিবিলিটি ছাড়া আর কিছুই মনে করেননি। উনার সাথে আমার সকাল শুরু হয়েছে পড়াশোনা নিয়ে আর রাতও হয়েছে পড়াশোনা নিয়ে৷ উনি কখনোই আমায় বলেননি যে আমার প্রতি উনার কোনো অনুভূতি আছে৷ পুরো দুটো মাস উনার সঙ্গে কাটিয়েছি আমি মা। উনার এই কোল্ড বিহেভ আমি আর সহ্য করতে পারছি না৷ আমি চাই উনাকে উনার দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করে দিতে।’

মা কিছু বললেন না বিনিময়ে। যেখানে আমার হঠাৎ এত বড় সিদ্ধান্তের কারনই আনভীর ছিলেন সেখানে ছেলের পক্ষে কি সাফাই দিবেন উনি! মা একটা সুক্ষ্ম হাসি দিলেন এবার। আড়ষ্টতা ভাব নিয়ে বলে ওঠলেন,
-‘এর উত্তরগুলো আমি কেনো দিলাম না জানো? কারন আনভীরই সময়মতো তোমায় উত্তর দিয়ে দিবে। তোমায় আমি চলে যেতে বলেছি এই কারনে যাতে আনভীর তোমার প্রতি দুর্বলতাটি অনুভব করতে পারে৷ আমি তোমার বাবা, আজরান ভাইয়া আর শিউলি ভাবিকে এটাই বলবো যে তুমি কিছুদিনের জন্য তোমার মামার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছো। তবে আনভীরকে কিছুই বলবো না।’

উনার কথার তেমন পরোয়া করলাম না আমি৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম মামার সাথে ব্যাপারটি নিয়ে কথা বললে উনি পরে বাবার সাথে কথা বলবেন। তবুও আনভীরেক আর মেনে নিতে পারবো না আমি। শিউলি ভাবি যেহেতু আমার সত্যটা জানেন না তাই বারবার বলছিলনে আমায় একা এতদূর না যেতে, আজরান ভাইয়া বা আনভীর আসুক, তারপর যেতে।কিন্ত আমি সাফ না করে দিলাম। যার থেকে পালানোর জন্য এতকিছু আবার তাকেই ডাকবো আমি ! এছাড়া আমি নিশ্চিত আমাদের বিয়ের সেই ঘটনার পর আনভীর আর যাই হোক আমাদের বাসায় মোটেও যাবেন না। তাছাড়া আমার মামার বাসা কোথায় সেটাও জানেন না উনি। এসব ভাবতে ভাবতেই আমি সবাইকে দেখে নিলাম একপলক। কেননা এর পর আমি হয়তো উনাদের মুখোমুখি আর হবো না।

আমার মামু’বাড়িটি ঢাকার অদূরেই গাজীপুরে অবস্থিত। বাস চেপে সেখানে গেলে ঘন্টা পাচেক সময় লাগে। ট্রেনে গেলে সময় লাগে আরও কম। তবে ট্রেনের টিকেট না পাওয়ার জন্য অগত্যাই বাসে যেতে হয়েছে আমায়। তারপর সেখান থেকে অটোরিকশায় মধুগন্জ। বাস থেকে নেমেই দেখি আমার ছোট মামু দাড়িয়ে আছে আমার জন্য। মহাশয় এখনও বেকার বিধায় বড় মামুর সাথেই থাকছে, খাচ্ছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর ছোট মামুর সাথে ২০ মিনিটের মধ্যেই চলে গেলাম সেই প্রত্যন্ত ভিটেবাড়িতে। মা মারা যাওয়ার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আসলাম এখানে। আগের তুলনায় সড়কের অবস্থারও বেশ উন্নত হয়েছে।

বাড়িতে বড় মামু-মামী আমার মামাতো ভাইবোনেরা বেশ ভালোভাবেই অ্যাপায়ন করেছে আমায়। আমি আসার কথা শুনে খালামণিও খালুজানকে নিয়ে ছুটে এসেছে। আমার নানা-নানি মারা গিয়েছিলেন আমার জন্মেরও আগে। তাই তাদের দেখার সৌভাগ্য কখনও হয়নি। সেই সুবাদে মায়ের সঙ্গে তার ভাই-বোনদের সম্পর্ক অনেক সুগভীর ছিলো। তবে মায়ের মৃত্যুর পর আমার বাবা একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় উনাদের সাথে।

মামু বহুবার আমায় এডপ্ট করার প্রস্তাব দিলেও তাতে বাধা দেয় চাচা চাচী, তাই তাদের খালামণি-ছোট মামু বা আমার মামাতো ভাইবোন কারও সাথেই আমার কোনো যোগাযোগ ছিলো না। তবে বড় মামু প্রায়ই দেখা করে যেতেন আমার সাথে। মায়ের পর একমাত্র উনিই একজন মানুষ ছিলেন যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি আমি। এমনকি অপূর্ব ভাইয়ার পাগলামি থেকে আমায় বাচানোর জন্য উনিই নিজ তদারকে ভাইয়াকে প্রবাসে পাঠিয়ে দেন।

এসব ভাবতে ভাবতেই আমি সবার সাথে কথপোকথন চালালাম। এর মধ্যে মামি আমায় জিজ্ঞেস করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছেন যে , জামাই কই , জামাই কই ! এভাবে একা ঢাকা থেকে চলে এলে কেন ; কিন্ত আমি এসবের কিছুই প্রতিউত্তর দিলাম না। বলতে গেলে সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেলাম। আমার এই বিষয়টা কেউ আন্দাজ করতে না পারলেও আমি জানি যে বড় মামু ঠিকই ধরতে পেরেছেন কোনো একটি সমস্যা। কিন্ত এখানে কিছুই বললেন না উনি। একপর্যায়ে ছোট মামু অধৈর্য হয়ে বললেন,

-‘আহা ভাবি ! ওকে এত অস্থির করছো কেনো? কত লম্বা জার্নি করে এসেছে। একটু রুম দেখিয়ে দাও মেয়েটাকে, ফ্রেশ টেশ হওয়ার পর জামাই কেনো; জামাইয়ের চৌদ্দগুষ্টির খবর নিও।’
তারপর ছোটমামুর কথামতো আমার মামাতো বোন নীলু আমায় রুমে নিয়ে গেলো। আজ সারাটাদিন বড্ড ধকল গিয়েছে আমার শরীরে। তাই জামাকাপড় পাল্টে দ্রুতই বিছানায় একটা হালকা ঘুম দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বড় মামুর মুখোমুখি বসেছি আমি। বাইরে ফুরফুরে বাতাস। বাগান থেকে হাওয়ার তালে ফুলের ঘ্রাণ মৌ মৌ করে বেড়াচ্ছে বাড়ির বাইরে এই লম্বা বারান্দায়। মধুগন্জ এলাকাটি আটটার পরই কেমন যেন থমথমে রূপ ধারন করে। তবুও এই মৌনতার মধ্যে কাজ করে আলাদা একরকম প্রশান্তি। আমি জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিলাম এবার। গলা দিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করছি। মামু আমায় এতটা উদ্বিগ্ন দেখে গম্ভীর স্বরে বললেন,

-‘শান্ত হও আহি। আমি ধৈর্য ধরে শুনবো তোমার কথা। এতটা তোমায় উদ্বিগ্ন হতে হবে না।’
আমি নিঃশ্বাস ফেললাম বারকয়েক। তারপর মিহি কন্ঠে বললাম,
-‘আমি আপনার কাছে থাকতে চাই মামু। আমি ফিরে যেতে চাই না !’
মামু কিঞ্চিত হাসলেন আমার কথায়। বললেন,
-‘জামাইয়ের সাথে রাগ করে এসেছো নাকি ! তবে এখানে এসে ভালোই করেছো। নাহলে তোমার বাবা তো কখনোই এ বাড়িতে আসার অনুমতি দিতো না।’

আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। যদি উনিও একবার শুনেন যে আমার আর আনভীরের মধ্যকার সম্পর্ক একটা চুক্তির ভিত্তিতে করা তবে শুনে খুব কষ্ট পাবেন। তবুও একবুক সাহস নিয়ে উনাকে বলতে যাবো তখন ছোটমামী মামুর জন্য ওষুধ নিয়ে আসতেই আমি থেমে গেলাম। আমায় দেখে মামী হেসে বললেন,
-‘মামু-ভাগনীর মধ্যে কি আলাপ হচ্ছে গো?’
আমি কিছু বললাম না প্রতিউত্তরে। পরে মামুই একটা উত্তর সাজিয়ে বললেন। আমি বুঝলাম এখন উনার সাথে কথা বলার উপযুক্ত সময় না। তাই উনাদেরকে শুভরাত্রি জানিয়ে আমি ঘুমোতে চলে গেলাম। স্থির করলাম , সকালে উঠেই মামুর সাথে কথা বলবো।

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৫

বিছানায় হাত পা মেলে ঘুমানোর মধ্যে আলাদাই এক আনন্দ আছে। আনভীরের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে সে আনন্দটাকে আমার মাটিচাপা দিয়ে দিতে হয়েছিলো। এমনিতেও অসভ্য মানুষ, আমার ভুলবশত এমন হওয়াতে কখন কি বলে ফেলতো হিসাব নাই। তবে এতদিন পর এমন একটা ঘুম দিয়ে ভালোলাই লাগছিলো আমার। এতটাই ভালোলাগছিলো যে কম্বল থেকে মাথা বের করার ইচ্ছে করছিলো না।

সকাল হয়ে গিয়েছে। আলো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এর মধ্যে আড়মুড়িয়ে পা দিয়ে গায়ের থেকে কম্বল সরিয়ে অন্যকাত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। তবে অদূরে যা দেখতে পেলাম তা দেখে আশ্চর্যের সীমা রইলো না আমার। আনভীর সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন। পরনে ব্ল্যাক শার্ট আর গ্রে জিন্স। উনার ঐতিহ্যবাহি চশমা এবার শার্টে রেখে দেওয়াতে সেই বিপদজনক চোখজোড়া যেন পাগল করে দিচ্ছে আমায়। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে বসলাম।উনি শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘বিছানায় দাপাদাপি করা হয়েছে তোমার? এখন উঠো তাহলে, তুমি আজই আমার সঙ্গে ঢাকায় ব্যাক করছো?’
আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম এই কথায়।মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি। এটা আদৌ স্বপ্ন নাকি আসলেই এই আনভীর পাগলটা এসেছেন আমায় নিয়ে যেতে? ও মাই গড আহি , তুই এবার শেষ!

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৭