এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪২

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪২
কায়ানাত আফরিন

বাসের ঝাঁকুনিতে একটু নড়ে উঠছি আমি৷ সেই সাথে অনুভব করছি কারও উষ্ণ আলিঙ্গন। ফুরফুরে হাওয়ার আদলে আমার শরীরে যে শীতলতা ছেয়ে গিয়েছিল সেটা এই উষ্ণ স্পর্শে অনেকটাই কেটে যাচ্ছে৷ আমি ধীরে ধীরে নিজের চোখজোড়া খুললাম। নিজের মাথার অবস্থান পেলাম উনার বুকে। উনি সাধারন ভাবেই আমায় দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছেন শক্তভাবে৷

যেন না আঁকড়ে ধরলেই আমি হয়তো খাগড়াছড়ির এই মেঘের ন্যায় উড়ে যাবো সমানতালে। আনভীরের এই স্পর্শটুকু আমার মাত্রাতিরিক্ত ভালোলাগছে। এতটাই ভালোলাগছে যে এখনও এই আলিঙ্গন ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছে না। তবুও সকল অলসতা পাড়ি দিয়ে আমি মাথা খানিকটা উঁচু করে পরখ করে নিলাম উনার মুখ। আনভীর ঘুমিয়ে আছেন নিশ্চিত হয়ে। চুলগুলো স্বভাবতই নিচের দিকে পড়ে আছে৷ এ যেন শান্ত এক বাচ্চা। অবশ্য ঘুমালে উনাকে শান্ত বাচ্চার মতোই লাগে।আর জেগে থাকলে উড়াধুরা চিল্লাচিল্লি টাইপ চশমিশ বাচ্চা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমার বারবার মনে পড়ছে আজরান ভাইয়া যখন থেকে আমায় খাগড়াছড়ি যাওয়ার জন্য রাজি করালো তখন থেকেই উনি কি শুরু করেছেন। অবশ্য এতে আজরান ভাইয়ারও একটু দোষ ছিলো ৷ উনি এমন শুরু করেছেন যেন আমরা বিয়ে বাড়িতে তো না, হানিমুনে যাচ্ছি৷ আনভীর এসব দেখে যেমন মহা বিরক্ত, তেমনি অস্থির ৷
এইতো সেদিনের কথা৷ অস্থির ভাবে রুমে পায়চারি করছিলেন উনি৷ আমি শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললাম,

-‘ আজব তো! আপনি এমন করছেন কেনো? খাগড়াছড়ি যাওয়ার কি আপনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই?’
উনি কথা বললেন না৷ নিজের অস্থির ভাব বিরাজমান রেখে হাত ধরে আমায় বসিয়ে দিলেন খাটে। কাতর কন্ঠে বললেন,
-‘না গেলে হয়না আহি?’
উনার এই আদুরে আহি ডাকেই বুঝে নিলাম অসভ্যটায় ভনিতা শুরু করেছে। অন্য সময়ের মতো এবার তাই আর মোমের মতো গলে গেলাম না। বললাম,
-‘না গো আহি’র বরসাহেব। না গেলে হবেনা। তাছাড়া আমি কি বোকা যে এমন একটা সুযোগ মিস করবো?আপনি এমন করছেন কেন?’
উনি এবার দম নিলেন। বলে ওঠলেন,

-‘বিয়ে বাড়ির আন্টিদের সবচেয়ে বেশি ভয় পাই আমি৷ ওই মহিলাগুলা তো বিয়ে ইন্জয় করতে যায় না, যায় ঘটকালি করতে৷ কোনো সুন্দরী মেয়ে পেলেই ব্যাস! শুরু হয়ে যায় ঘটকালি। মহিলার ছেলের জন্য বউ লাগবো, ভাইয়ের ছেলের জন্য বউ লাগবো, দেবরের জন্য বউ লাগবো, পারলে বাড়ির দারোয়ানের জন্যেও বউ খুঁজতে ভুলে না। তুমি তো এমনিতেই পচ্চি। দেখলেই গাপুস গুপুস টাইপ ফিলিং আসে। এখন তুমি যে আমার বউ এটা তো আমি তোমার গলায় আর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিতে পারবো না। যদি ওই মহিলাগুলো তোমার জন্যেও ধরে বেঁধে জামাই নিয়ে আসে?

আমি সত্যি উনার কথা শুনে এবার প্রচুর হাসি পাচ্ছে ৷ মানে, উনি সত্যিই এই কথা ভেবে যেতে চাচ্ছেন না? তবুও আমি একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পা দুলাতে মগ্ন। বলে উঠলাম,
-‘তো সমস্যা কি, আপনারে যেভাবে বিয়ে করেছি ওইটারেও ওমনে বিয়ে করে নিবো।’

আর এই কথাটিই হয়তো আনভীরের সামনে বলা ছিলো একটা বিশাল অপরাধ। শুধু অপরাধ বললে ভুল হবে, দণ্ডনীয় অপরাধ। উনি আমার ওপর এতটাই ক্ষেপে গিয়েছিলেন যে তড়িঘড়ি করে আজরান ভাইয়াকে বলেন যে উনি যাবেনা না। আর যাই হোক আমায় নিয়ে তো একেবারেই যাবেন না। বাবা-মা, শিউলি ভাবি হাজার চেষ্টা করলেও উনি অনড়। মুখে একটাই বুলি, পিচ্চি বউ নিয়ে তো এমনিতেই ফ্যাসাদে আছে এখন উনি এর ভাগীদার চান না।
আজরান ভাইয়া হাসফাস করে বলে ওঠলেন,
-‘ছেলেটা তোমার বউ পাগলা হয়ে গিয়েছে রে মা! ‘

তবুও অনেক অনুনয় বিনিময় করে রাজি করানো গেলো এই পাগলটাকে। পাগল বলবো না তো আর কি বলবো! যে একটা মজাকে সিরিয়াস মনে করে যে সত্যি সত্যিই না যাওয়ার মতো একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাও আবার আমার আজগুবি সব সিকিউরিটির জন্য৷ আর যাই হোক এমন লোককে তো আর সুস্থ বলা একজন অসুস্থ মানুষের পক্ষেই সম্ভব।

সেদিনের পর থেকেই আনভীর কথা বলা অফ করে দিয়েছেন। আমি কত ট্রাই করলাম উনার সাথে কথা বলার জন্য, সাথে হুটহাট দু’তিনটা ফ্রি চুমুও দিয়ে দিলাম। তবুও বর সাহেবের মন গলাতে পারলাম না৷ অন্য সময় হলে এই বর সাহেব পাল্টা নিজের চুমু থেরাপিতে আমার অস্তিত্ব সাধন করে ফেলতো তবে এখন এমন কিছুই করেনি। আমি বুঝলাম, মহাশয় বেজায় ক্ষেপেছে আমার ওপর৷ এবার উনারে ঠান্ডা করার জন্য অন্য এক উপায় বের করতে হবে৷

গতকাল যখন সবাইকে বিদায় দিয়ে এসে খাগড়াছড়ি যাওয়ার জন্য মতিঝিল এর বাসে উঠলাম তখন থেকেই উনার রাগ যেন দমে এলো। প্রতিটা মুহুর্তে বারবার আমায় এডভাইস দিচ্ছেন ও বাড়িতে গিয়ে আমায় কি করতে হবে। সাথে কড়াকড়ি ভাবে আরোপ করেছেন ইমম্যাচিউর টাইপ ব্যাবহার না করতে। ঠোঁট কামড়ানো তো দূরের কথা। আমি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শুধু হ্যাঁ বললাম। বিরক্ত হলেও উপায় নেই। এই লোকের মাথা এমনিতে ঠিকাছে তবে আমার ব্যাপারটা উঠলেই ওভার পজেসিভ এর চোটে পাগল হয়ে যায়। পরে উল্টা পাল্টা কিছু বললে হুট করে না জানিয়ে আবার বাস থামিয়ে বাসার দিকো রওনা দেয়। তারপর বাসে যে কখন ঘুমিয়ে গেলাম তা আর টের পাইনি।

তবে খাগড়াছড়ির এই প্রথম সকালটা বেশ সুন্দর হয়েছে আমার। যদিও সেটা হয়েছে বাসে, তবে দৃশ্যটা অনন্য।সেই সাথে আনভীরের উপস্থিতিটুকুও নেহাত কম আনন্দের নয়। এই অঞ্চলে অন্যান্য এলাকার তুলনায় কিছুটা ঠান্ডা। এসি বাস না হওয়ার কারনে জানালা খোলা আর বাতাস ধেয়ে আসছে হু হু করে। পূব দিগন্তের সকালটা বেশ মনমাতানো কর দৃশ্য। আমি বেশ কিছুক্ষণ দৃশ্যটাতে বুদ হয়ে ছিলাম।

আমি আবেশিত হয়ে বাহিরে মাথাটা নিয়ে গেলাম এবার। একধারে বিশাল খাদ আর সরু পথের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের বাসটি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই খাগড়াছড়িতে আমার আর আনভীরের জন্য চরম কিছু ওয়েট করছে। আজরান ভাইয়াও বললো এমন কিছু একটা। উনি নাকি আমাদের জন্য কি জানি এক সারপ্রাইজ রেডি করেছেন৷ কে জানে কি হতে পারে!

হঠাৎ আনভীর আমায় টান দিয়ে নিজের কাছে আনলেন। আমি উনার কাজে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। কারন বেশ কিছুক্ষণ আগেই দেখেছিলাম মহাশয় ঘুমে বিভোর৷ তাই আমি অবাক প্রসন্ন হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তার আগেই উনি বললেন,
-‘এভাবে মাথাটা বাহিরে নেওয়ার মানে কি আহি? ভেতরে বসে দেখতে পারো না?’
উনি এবার আলতো হাতে ঠিক করে দিলেন আমার অগোছালো চুল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-কখন উঠেছেন আপনি?’
-যখন তুমি বাইরে মাথা বের করে চুলগুলো ভুতনির মতো উড়াচ্ছিলে।
আমি চোখ কুচকে ফেললাম। উনি ঠোঁট চেপে রম্য হাসি হাসছেন। আমি তাই বলি,
-আমি ভুতের মতো চুল উড়াইনি বুঝতে পেরেছেন? ওটা জাস্ট বাতাসের জন্য এমন হয়েছিলো।’

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪১

-তাই তো দেখলাম। রাস্তা থেকে তোমায় কেউ দেখলে যে কেউ ভাববে ঢাকা থেকে বাসে পিচ্চি ভুত আসছে।’
উহ! এই লোকটার সাথে কথায় পারা অসম্ভব। আমি তাই উনার সাথে একদণ্ডও কথা বাড়ালাম না৷ বাস সাড়ে সাতটা নাগাদ খাগড়াছড়ির বাস স্ট্যান্ডে এসে নামলো। আশেপাশে মানুষের প্রচন্ড ভীড়৷ আনভীর একহাতে লাগেজ নিয়ে আগলে রেখেছেন আমার হাত। একবারের জন্যও আমার হাত ছাড়েননি। তখনই বিয়ে বাড়ি থেকে আসা এক ভাইয়াকে দেখা গেলো। আনভীর আর ছেললটার কথাবার্তা শুনে বোঝা গেলো আনভীরের কোনো কাজিন সে। অদ্ভুত ভাবে আনভীর বারবার ছেলেটাকে বলছেন;

-‘তোর ভাবি কিন্ত, উল্টাপাল্টা কিছু বলবি, এক থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ছুটিয়ে ফেলবো।’
উনার চাচ্চুর বাড়িতে গিয়েও একই অবস্থা। বিয়ে বাড়ি প্রচন্ড ব্যস্তময় হলেও উনার চাচী, ফুপি সবাই অনেক অ্যাপ্যায়ন করেছেন আমাদের। আর সবাই এসেই অবাক গলায় আমায় জিজ্ঞেস করছে,

-তুমি আনভীরের বউ না? তাহলে তো আনভীর একটু আগে সত্যি সত্যিই বললো, আসলেই তুমি পিচ্চি।’
আমার মাথা ঘুরাচ্ছে এগুলো শুনে। বুঝতে পারলাম উনি সবাইকে এসেই মাইক হাকিয়ে পৈ পৈ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে আমি উনার বউ। আন্ডাবাচ্চাদেরও বলতে ভুলেননি। আশ্চর্য ব্যাপার তো ! উনি কি ভরা বিয়ে বাড়িতে জনে জনে স্লোগান দিচ্ছনে যে আমি উনার বউ? মানুষ যে এতটাও পজেসিভ হতে পারে ভাবা যায়?

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪৩