এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪৪

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪৪
কায়ানাত আফরিন

আনভীরকে কড়াকড়িভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি আমি। কেনো এড়াচ্ছি তা আমি নিজেও জানিনা। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছি চুমু দেওয়ার পরিবর্তে উনি যে এমন রিয়্যাকশন দেবেন সেটা জানলে আমি কখনোই ওই লোকের দিকে এমন একটা ভয়ঙ্কর চিন্তা নিয়ে এগোতাম না। একে তো উনি মানুষটা যেমন ভয়ঙ্কর, কথাবার্তায় সেই ভয়ঙ্করতার পরিমাণ ট্রিপল ক্রস করেছে। আমি নিশ্চিত উনি এ ব্যাপার নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন। তাই ভয়ে উনার ধারে কাছে যাওয়ার সহস পাচ্ছিনা। না জানি আবার কি উল্টাপাল্টা বলে বসে!

রাফিদ ভাইয়ার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটি বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই এখানকার কয়েকটা ছবি তুলে শিউলি ভাবিকে পাঠিয়ে দিলাম। ভাবি খুব মিস করছে আমাদের। এদিকে অনুষ্ঠানের গান বাজনার জন্য এত হৈ চৈ যে ভাবির সাথে ফোনে কথা বলার আর সুযোগ পেলাম না। অদূরেই ব্যস্তভাবে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে চলছেন আনভীর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হলুদের অনুষ্ঠান বিধায় অন্য চার পাঁচজন যুবকের মতো উনিও হলুদ রঙের পান্জাবি পড়েছেন। হাতাগুলো খানিকটা ওপরে তোলা। আমি কিছুক্ষণ দূর থেকে আড়নজরে ব্যস্ত এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিলাম। কথা বলতে থাকলাম বাকি সবার সাথে। রাফিদ ভাইয়ার ছোট বোন রুনি আমার থেকে দেড় বছরের ছোট। সেই সুবাদে ওর সাথেই আমার ভাবটা একটু বেশি হয়েছে। বাকি সবার কথা শুনেও একটা জিনিস বুঝতে পারলাম আনভীরকে সবাই যমের মতো ভয় পায়। উনি কথা বলেন কম, ধমকি ধামকি দেন বেশি।

আর ওদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে পাড়া-শহর ঘুরে বেড়াতেই দেখলেই যেনো আরও বেশি ক্ষেপে যান। আমি ওদের প্রত্যেকের কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। এটা অবশ্য সত্য। কেননা আমার স্কুল পড়াকালীন সময় আনভীরের পরিবার যখন আমাদের এলাকায় প্রথম আসলেন উনার ব্যবহারেই একটু অবগত হয়েছিলাম। আমি ছিলাম এক নাম্বারের পড়া চোর আর ইনি তো রীতিমতো বিদ্যাসাগর। তাই দু’চোক্ষে দেখতে ইচ্ছে করতো না উনাকে। কিন্ত কপাল আমার ! ঘুরেফিরে উনার ভাগ্যেই আমি উড়ে এসে জুড়ে বসলাম।

আনভীরের চাচি এবার আমায় আর রুনিকে ডাক দিলেন রাফিদ ভাইয়াকে হলুদ দেওয়ার জন্য। আমি কথা না বাড়িয়ে তাই স্টেজের কাছে গেলাম। আমি আলতো করে উনাকে হলুদ মাখিয়ে দিলেও রুনি ভাইয়ার মুখ হলুদ দিয়ে জুবুথুবু অবস্থা করে ফেলেছে। সে কি কান্ড! রাফিদ ভাইয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে আমার প্রচন্ড হাসি এসে পড়লো। কোনোমতে হাসি দমিয়ে অপর পাশে তাকাতেই হঠাৎ আনভীরের সাথে চোখাচোখি হলো আমার।

উনি একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হাত ভাঁজ করে। তীব্র চোখজোড়ার প্রখর দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার দিকে। ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে একটা স্মিত হাসির রেশ। উনার এমন চাহিনী দেখে আমার হার্টবিট রীতিমতো মিস হয়ে গেলো যেনো। চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আনভীরের এ দৃষ্টির সাথে প্রথম পরিচিত আমি। কেননা উনাকে এতটা এগ্রোসিভ হতে আমি এর আগে কখনোই দেখিনি। আমার ধ্যান ভাঙলো চাচির ডাকে। অতঃপর আমরা স্টেজ থেকে নেমে আসার সময়েও আড়নজরে একবার দেখে নিলাম উনাকে। উনি তখনও দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের শীতল দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, তখনকার কান্ডের জন্য আমার একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়বে।

রাত প্রায় সাড়ে ১১ টা বাজে। প্রায় সব অতিথিরাই একে একে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে এখন। আমাদের মতো যারা দূরপাল্লার মেহমান তাদের জায়গা হয়েছে বড় ঘরটিতে। রাফিদ ভাইয়া ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় একপ্রকার ঢুলু ঢুলু হয়েই চলে গেলো নিজের ঘরে। বেচারাকে উনার দস্যু ভাই বোনগুলো হলুদের দিনই জ্বালিয়ে মেরেছে। না জানি বাসর রাতে আবার কি করে বসে ! আমার সেদিকে ধ্যান নেই।

আমি ভীত সতন্ত্র চোখে আশপাশে ভালোমতো দেখে নিলাম আনভীর আছেন কিনা। না, উনাকে দেখা যাচ্ছে না। এটাই মুখ্য সময় দ্রুত ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার। তাহলেই আর উনার মুখোমুখি হয়ে কোনো জবাবদাহীতা করতে হবে না ভেবেই আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। নাহিদ ভাই ,যে কিনা আমাদের বাস থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলো সে আমায় এভাবে উকি ঝুঁকি মারতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-‘কারে খুঁজছেন ভাবি?’
নাহিদ ভাই বয়সে আমার বড় হবে বেশ। তবুও আমায় ভাবি ডাকছে দেখে আমি অপ্রতিভ গলায় বললাম,
-এভাবে আপনি করে বলছেন কেনো? আমি আপনার বয়সে অনেক ছোট হই।
নাহিদ ভাইয়া পরোয়া করলো না আমার কথায়। বলে ওঠলো,

-আপনারে নাম ধরে ডাকার সাহস নেই গো ভাবি। এমনিতেও আনভীর ভাই কড়ায় গন্ডায় বলে দিয়ছে, আমারে যদি আপনার সাথে টিটকারী করতে দেখে, থাপড়াইয়া আমার দাঁত সব ফালায় দিবে। এহন এটা কি ঠিক কথা কন তো? কাল ভাইয়ের বিয়ে , কই মেয়ে পটাবো আর আমার আনভীর ভাইয়ের ডরে লুকায় লুকায় থাকতে লাগতেসে।

আমি একটা চাপা হাসি দিলাম। বেচারার মতো প্রায় সবাইকে উনি এমন কথা বলে অতিষ্ঠ করে ফেলেছেন। এ বাড়িতে তো আমি অতিথি হিসেবে না, আছি দ্য মেন্টাল ম্যান আনভীর রেজওয়ান খান এর বউ ওরফে উনাদের ভাবিসাহেবা হিসেবে। নাহিদ ভাইয়া হঠাৎ আমার দিকে একটা কোকের বোতল এগিয়ে দিলো। বললো,
-‘কোকাকোলা খাবেন ভাবি?’

আমি না বলতে গেলেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা পুরুষাত্নক কন্ঠ ভেসে এলো আমার কানে,
-‘কিরে নাহিদ, তোরে না বলেছি ভাবি হয় তোর। ভাফির সাথে এত কিসের কথা হ্যাঁ?’
আমি পেছনে ফিরলাম। আনভীর পান্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নাহিদ ভাইয়া কিছুক্ষণ বোকা হয়ে রইলো আনভীরের কথায়। অতঃপর জড়ানো গলায় বললো,
-আমি তো ভাবিরে শুধু কোকাকোলা খাওয়ার জন্য অফার করলাম।

উনি এগিয়ে আসলেন নাহিদের দিকে। অগোছালো চুলগুলো আরও আগোছালো করে বলে ওঠলেন,
-তুই কি চাস এই রাতে এসব হাবিজাবি খেয়ে আমার বউয়ের পেট খারাপ হোক?
-মোটেও না। আমি এমন কেনো চাইবো? আপনার বউ মানেই আমার বউ….(আনভীর চোখ রাঙানি দিতেই)ইয়ে মানে, আপনার বউ মানেই আমার ভাবি ; জাতির ভাবি। উনার সাথে আমি এমন করতে পারি?

-পকর পকর টা ইদানীং একটু বেশিই করস তুই। শোন, তোর ভাবি তো এমনিতেও পিচ্চি। তুই হলি আরেক দামড়া পিচ্চি। তাই তোরে ওয়ার্নিং দিলাম আমার পিচ্চি বউটার সাথে কম কম কথা বলবি।যদি আমি আবার শুনি, তুই আমার বদনাম করে ওর ব্রেইনওয়াশ করছোস , তোরে আমি নিজেই নর্দমায় ফেলে দিবো।
আনভীরের এ কথায় নাহিদ ভাইকে আর পায় কে।সে পাতলা গলি দিয়ে টুপ করে কেটে পড়লো এবার। আনভীর এবার কথা না বাড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরে নিয়ে এলেন বেডরুমে। আমার তো আতঙ্কে রীতিমতো জান শুকিয়ে যাচ্ছে। রুমে আসতেই আমি কোনোমতে হাত ছাড়িয়ে বলে ওঠলাম,

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪৩

-আমার…….আমার ঘুম পাচ্ছে। যাই ফ্রেস হয়ে আসি।
কিন্ত আমার কাজ বাধা দিলেন আনভীর। মিহি কন্ঠে বললেন,
-তখনকার সারপ্রাইজড গিফটে আমি তো শকড হয়ে গিয়েছিলাম আহি বেবি। এখন তাহলে রিটার্ন গিফট নিয়ে যাবে না?
-আমি অনেক দয়ালু বুঝেছেন? আমার রিটার্ন গিফটের প্রয়োজন নেই।
-বাট আমার প্রয়োজন।

বলেই উনি আমার কোমড় চেপে টেনে নিয়ে এলেন নিজের কাছে। নিজের গালে কপালে থাকা হলুদগুলো সন্তর্পণে আমার গালে কাধে গলায় লাগিয়ে দিতে মশগুল হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় শরীরে আমার এক আলাদা শিহরণ বয়ে গেলো। বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ ক্রমশ যেন বেড়েই চলেছে। উনি আর এগোলেন না, বরং আমার ঠোঁটের কোণে গভীর একটা স্পর্শ করে আমার খাটে শুয়িয়ে দিলেন। গলায় মুখ গুঁজে নিরাময় করতে থাকলেন নিজের সকল ক্লান্তি। উনি ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে মগ্ন। সেই সাথে আমিও। উনি গলায় ঠোঁটজোড়া লাগিয়েই নেশাক্ত গলায় বললেন,

-‘একটু চুলে হাত বুলিয়ে দাও তো আহি?’
উনার ‘আহি’ সম্বোধনটা বরাবরই আমায় পাগলপ্রায় করে দেয়। আমি আনমনে উনার ক্লান্তিমাখা চুলে হাত বুলাতে থাকলাম।উনার চোখজোড়া বন্ধ। নিঃশ্বাসের দরুন পিটপিট করছে পাপড়িগুলো। নিঃসন্দেহে সুন্দর একটি সময়। সেই সাথে সুন্দর আমার গলায় মুখ গুঁজে থাকা আমাতে পাগল এই মানুষটাও।

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৪৫