এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৮

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৮
কায়ানাত আফরিন

কোনো ছেলে যদি ক্ষিপ্ত হয়ে বলে যে সে নিজ হাতে কোনো মেয়েকে শাড়ি পড়িয়ে দিবে আমার মনে হয়না এর থেকে অস্বস্তিকর কোনো বাক্য একটি মেয়ের কাছে আর আছে।আনভীরের কথায় আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তেমন। কানের কাছে ঝংকারর মতো বেজে চলছে আনভীরের বলা শেষ দুইটি কথা, ‘আমি চাইলে এক্ষুণি তোমায় শাড়ি পড়াতে পারি ,তাও আবার নিজ হাতে।ওয়ানা সি ইট?’

আমি জড়ানো গলায় এবার বললাম,
-‘এসব ক-কি বলছেন আপনি?’
আনভীর যেন আমার কথার পরোয়া করলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-‘কেনো খুব তো কানের কাছে প্যান প্যান করছিলে যে শাড়ি দিয়ে আমি কি করবো , এখন উত্তর শুনে শান্তি পাওনি?তুমি তো এটাই চাচ্ছো যে আমি নিজ হাতে তোমায় শাড়ি পড়িয়ে দেই।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এই অসভ্য মানুষটার লাগাম ছাড়া কথাবার্তায় কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হচ্ছে আমার। শরীরের সর্বত্র যেন উত্তেজনার ছড়াছড়ি। আমি স্পষ্ট বুঝেছি আমার তখনকার কথা শুনেই উনি রেগে এখন এসব উদ্ভট কথা বলছেন। এজন্যই চাচি সবসময় আমায় বলতো ,’আহি! বেশি পকর পকর করবি না। নাহলে সামনে অনেক ঝামেলায় পড়বি।’ চাচির এই কথাটার সত্যতা হাড়ে হাড়ে বহুবার টের পেয়েছি আমি। তবুও বদঅভ্যাসটা আর ছাড়তে পারিনি। এখন সামলাও এই ঠোঁটকাটা বরকে। আমি আমতা আমতা করে উনাকে বললাম,

-আমি কখন বললাম যে আমি আপনার হাতে শাড়ি পড়বো?
-‘ওওও বলো নাই তাহলে? আচ্ছা থাক আর বলার দুঃসাহস করতে হবে না। এখন আয়নার সামনে দাঁড়াও।’
-‘কেনো?’
-‘যেটা বলেছি সেটা করো।’
আনভীরের থমথমে কন্ঠ শুনে আমি ভয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। উনি আমার ঠিক পেছন বরাবর দাঁড়িয়ে শাড়িটা আমার শরীরের সামনে মেলে ধরতেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো।আনভীর দাঁড়িয়ে আছেন আমার ঠিক পেছনে। যার কারনে উনার উত্যপ্ত নিঃশ্বাস আমার ঠিক কাধ ও ঘাড় সংলগ্ন জায়গাটিতে পড়ছে। আনভীরের সেদিকে নজর নেই। সে শাড়িটা আমার শরীরের ওপর রেখে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। অতঃপর গম্ভীর স্বরে বললো,

-‘উমমম,,,,শাড়িটা চলবে।’
-‘মানে?’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আনভীর শাড়িটা নিয়ে সরে আসলেন আমার থেকে। গম্ভীর স্বরে বললেন,
-‘আগামীকাল ভাইয়া-ভাবির সাথে আমরাও অনুষ্ঠানে যাচ্ছি।’
আমি এবার বিস্ময়ের আরও এক ধাপে পৌঁছালাম। এই না সকালে বাবার সাথে তর্কাতর্কি লাগালেন যে উনি কিছুতেই আমার সাথে যাবেন না। তাহলে এসবের মানে কি?আমি তাই জিজ্ঞেস করলাম,

-‘আপনি যাবেন?’
-‘হ্যাঁ।’
উনার মৃদু প্রতিউত্তর। আমি বিরক্তি নিয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম এবার। আরে ব্যাটা তুই যাবি ভালো কথা তাহলে সকালে এমন সিরিয়াল দেখানোর মানেটা কি ছিলো? হুহ,,ভাব দেখলে বাঁচি না।আনভীর আমার দিকে না তাকিয়েই শাড়ি ক্লোজেটে রাখতে রাখতে বললেন,
-‘আমায় গালি দিতে হবে না আর। আর লিসেন, আমি বিয়েতে যাচ্ছি শুধুমাত্র আজরান ভাইয়ের জন্য। সো ভেবো না সকালে ওটা কোনো ভাব ছিলো। এখন যাও। শুয়ে পড়ো। সকালে ১০ টায় তোমার কোচিং আছে।’

আমার চোখ ছানাবড়া। এর কোনো ট্যালিপ্যাথি ক্ষমতা আছে নাকি যে আমার বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলোই চট করে ধরে ফেললো?উনি আমার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালেন পুনরায়। বললেন,
-‘কি হলো? ঘুমাতে যাও?’
-‘হ-হ-হ্যাঁ যাচ্ছি।’
বলেই খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। আনভীরও এবার লাইট অফ করে আমার পাশে শুয়ে পড়লেন। একমাত্র এই সময়টাতেই আমি সবচেয়ে কাছাকাছি থাকি এই মানুষটার। আমি মাথার ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে উকি দিলাম উনার দিকে। বরাবরের মতোই উনি আমার উল্টোদিকে মুখ করে ঘুমিয়ে আছেন। বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো আমার। ভেবেছিলাম রাত জেগে বরের সাথে গল্প করবো কিন্ত এই চশমিশ বিলাই তো আমার সব স্বপ্ন পানিতে ভাসিয়ে দিলো। নিরামিষ একটা !!

‘আহি ! এই আহি! উঠছো না কেনো?’
কারও কন্ঠ কানে শব্দতরঙ্গের ন্যায় অপরূপভাবে ভেসে আসছে। আহা ! কি মনোমুগ্ধকর মানুষটার কন্ঠ! কিন্ত চোখ খোলার মতো অবস্থা এখনও আমার হয় নাই। আমার চোখে এখনও চরছে ঘুমের রাজত্ব। দু একটা ভালো স্বপ্নও দেখেছি। কিন্ত সেই স্বপ্ন গুলো থেকেও স্বপ্নদূতের কন্ঠটা ভালোলাগছে শুনতে। আমি এবার কম্বল মুড়ি দিয়ে আরও ভালোভাবে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। অতঃপর কানে ভেসে আসলো আবারও সেই মোহনীয় কন্ঠ। একপর্যায়ে বলিষ্ঠ হাতের কড়াকড়ি ধাক্কাধাক্কাতিতে পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখি আনভীর আমায় ঘুম থেকে তুলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

-এই মিয়া! ঠেলাঠেলি করেন কেনো? আমি কি ঠেলাগাড়ি?
আনভীর কপাল ভাঁজ করে আমার দিকে সুক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলেন এবার। মুখে অল্পবিস্তর বিস্ময়। উনার এমন মুখ দেখে আমি একেবারেই চূুপসে গেলাম। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলা এই মানুষ যে আবার রাগের গোডডাউন। আনভীর ঠোঁট চেপে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন,

-‘তাড়াতাড়ি উঠো। কোচিংয়ে যেতে হবে তোমার। ‘
আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার মিহি ভাবে বললাম,
-‘এখন না! একটু পরে উঠবো।’

আমি চোখ বন্ধ করে আছি এবার। উনি আমার পাশে বসে থাকলেও কিছু বললেন না। আমি মনে মনে খুশিই হলাম। হয়তো আর জ্বালাবে না। কিন্ত আমার ভাবনাটি ভুল প্রমাণ করে দিলেন উনি। আচমকা আমার গায়ের ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে ফট করে আমায় কোলে তুলে নিলেন। আমি এবার হতভম্ব। ঘুম থেকে উঠে এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াতে আমার আমার মাথা রীতিমতো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আনভীর আনায় ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেসিনের সামনে নামিয়ে দিলেন। কল ছেড়ে দু’তিনবার পানির ছিটা দিতেই আমার যেন ধ্যান ফিরলো। আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। আনভীর শীতল কন্ঠে বললেন,
-‘তোমার মাথায় তখন পানি ঢাললে আমার বিছানা ভিজে যেতো। তাই তুলে এখানে নিয়ে আসলাম। ১৫ মিনিট টাইম দিলাম। জলদি ব্রাশ করে রেডি হও। নাহলে এভাবেই কোচিংয়েই নিয়ে যাবো।’

আমি কিছু বলার আগেই উনি বড়ো বড়ো পা ফেলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফট করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ দেওয়ার মতো আর ইচ্ছে নেই। হুট করে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে যে কীর্তিটি উনি করেছেন এতে আমার চোখের ঘুম উড়ে গিয়েছে। আমি দ্রুত তাই দাঁত ব্রাশ করে বেরিয়ে এলাম। আনভীর রুমে নেই। বিছানাও ইতিমধ্যে গুছিয়ে ফেলেছেন। সেখানেই আমার জামাকাপড় রাখা। সেগুলো দেখে তপ্ত শ্বাস ছাড়লাম আমি। আসলে উনার কাজকর্মগুলো বেশ অদ্ভুত লাগছে আমার। এই উনার কথাবার্তা শুনে মনে হয় এগুলো শুধু দায়িত্ববোধ তবে আসলেই কি তাই? আসলেই সেই দুর্ঘটনার পর উনি চাইলেও আমায় ভালোবাসবেন না?ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ইতিমধ্যে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি তাই দ্রুত রেডি হয়ে ডাইনিরুমের দিকে গেলাম।

আনভীরের পাশে বসে আছি আমি। বাকি সবাই নিজের খাওয়াতে মগ্ন। আমি আড়চোখে উনার দিকে তাকালাম। আনভীর আজ ব্লু টিশার্ট পড়েছেন। বরাবরের মতোই চুলগুলো পেছনে আছড়ে রাখা আর চোখে চিকন ফ্রেমের খয়েরি রঙের চশমা। নিঃসন্দেহে চমৎকার পার্সোনালিটির একজন মানুষ। আমি আবার খাবারে মনোযোগ দিলাম। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ইতিমধ্যে লেট হয়ে যাচ্ছে। আনভীর থেকে কোচিংয়ের এড্রেস নিয়ে নিয়েছি আমি। এখন সময়মতো পৌঁছালেই হবে।
খাওয়ার মাঝেই আনভীর বললেন,

-‘আহি! খাওয়ার পর গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি তোমায় দিয়ে আসছি।’
আমি খাওয়া রেখে উনার দিকে তাকালাম। আনভীর নির্বিকারভাবে খাচ্ছে। আমি মনে মনে বললাম , মানুষটার হলো কি?গতরাত থেকেই কিসব উদ্ভট উদ্ভট কাজ করে যাচ্ছে । যে বিয়ের শুরুতে আমার সাথে ধমকি-ধামকি ছাড়া কথা বলতো না, আমি কি করছি না করছি সে বিষয়ে নজর রাখতো না তার এত কেয়ারিং দেখে আমি রীতিমতো যেন হিমশিম খাচ্ছি। এতদিন তো ভালোই ভাব দেখাচ্ছিলেন,তাহলে এখন কেন এত দরদ। আমি শীতল ভাবে বললাম,

-‘আমার কাছে এড্রেস আছে। আমি একা যেতে পারবো।’
আনভীর খাওয়া রেখে তীর্যক চোখে আমার দিকে তাকালেন। জড়ানো কন্ঠে বললেন,
-‘বেশি কথা বলো না। আমি তোমায় ড্রপ করছি দ্যাটস ইট। এটা আমার রিকোয়েস্ট না , অর্ডার।’

আমি এবার কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারলাম কিছু। আমাদের কথোপোকথন শুনে বাবা শুকনো কাশি দিলেন। ঠোঁটে স্মিত হাসি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা। এদিকে আজরান ভাইয়া, শিউলি ভাবি, নুড়ী আপা সবাই ঠোঁট চেপে হাসছে এমনকি মা’ও।এদের কান্ড দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। এরা সবাই মনে করছে আমাদের মধ্যে হয়তো সব ঠিকঠাক। আসলে আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা যে ঠিক কেমন আমি নিজেও জানি না। আমার এই বরটা তো মিনিটে মিনটে গিরগিটির মতো রং পাল্টায়। আনভীর এবার খাওয়া থেকে উঠে বাইরে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে ইশারায় বললেন দ্রুত নিচে আসতে। উনি যাওয়ার পরপরই শিউলি ভাবি বলে উঠলেন,

-‘বাব্বাহ ! আমার দেবরটা দেখি বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।এতই ভালোবাসা যে বউকে প্রথম দিন একা বাইরে যেতেই দিবে না। এই বদটাকে কিভাবে ম্যানেজ করলে বোন?’
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। বাবা ইতিমধ্যে মিহি হেসে বলে ওঠলেন,
-‘আমি জানতাম যে একদিন না একদিন আনভীর ওকে মেনেই নিবে। আহি মামাণিটাই যে এত মিষ্টি।’
মুখ খুললেন মা’ও,

-‘শুরুতে আমারও ওদের হুঠাৎ বিয়েটা মানতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো আনভীরের হঠাৎ এত পরিবর্তন দেখে। তবে আমার মনে হয় যে আনভীরকে ম্যানেজ করার জন্য আহিই বেস্ট।’
এদিকে সবার কথাবার্তা শুনে আমার রীতিমতো মাথা চক্কর দেওয়ার মতো উপক্রম। আমি আনভীকে ম্যানেজ করেছি?কবে?কখন?কিভাবে? আমার যেন বিষয়টা মাথা দিয়েই ঢুকছে না। এখন তো আমার নিজেরই সন্দেহ হচ্ছ,,,,এই বরসাহেব কি আমার প্রেমে পড়ে গেলো? খুব তো সেদিন বলেছিলো যে আমায় ভালোবাসতে পারবে না। আমিও তাহলে এত সহজে পটবো না, হুহ!

লিফট দিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমেই পার্কিং লটে আনভীরের গাড়ি পেয়ে গেলাম আমি। আনভীর গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। আমায় দেখে গাড়ির ভেতর থেকেই দরজাটা খুলে দিলেন। ইশারায় আমাকে বসতে বললেই আমি উনার পাশে বসে পড়লাম। শীতল কন্ঠে বললাম,
-‘জলদি গাড়ি স্টার্ট করুন।’
আমার এমন ব্যবহারে উনি হতবাক। আসলে ডাইনিং রুমে তখনকার সবার কথাগুলো মনে পড়াতেই হয়তো আমি কোনো কথা বাড়াচ্ছি না উনার সাথে। আনভীর সেদিকে পরোয়া না করে ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। আমি বিব্রত হয়ে বললাম,
-‘ক-কি ক-করছেন?’
উনি হঠাৎ থেমে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
-‘সিটবেল্টটা…………!’

আমি এবার মিহিয়ে গেলাম। আনমনে সিটবেল্টটা লাগানোর চেষ্টা করতেই উনি খপ করে আমার হাত সরিয়ে লাগিয়ে দিলেন সিটবেল্টটা। একবার জিজ্ঞেসও করেননি যে আমি লাগাতে পারবো কি-না। আমি পাথর হয়ে বসে আছি তখন। উনি তারপর আমার ওপর থেকে সরে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিয়ে গেলেন গন্তব্যপথে। জায়গামতো আসতেই আনভীর আমার সিটবেল্টটা খুলে দিলেন। আমি নেমে পড়লাম এবার। মেডিক্যালের ভর্তি কোচিংয়ে বরাবরই অনেক মানুষের সমাগম থাকে। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটি নতুন না। আনভীর এবার কোচিংয়ের ভেতরে ঢুকতেই পিছু পিছু গেলাম আমি। অফিসরুমে গিয়ে যাকে দেখলাম সে হলো আনভীরের কলেজ লাইফের ক্লাসমেট তুহিন। উনিই মূলত এই কোচিংটা চালাচ্ছেন মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের জন্য। আনভীর আমাকে উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতৈই আমি বিনয়ী স্বরে বললাম,

-‘আসসালামু আলাইকুম।’
তুহিন স্যার মিহি হাসি হাসলন এবার। প্রতিউত্তরে বললাম,
-‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?’
-‘জ্বি ভালো।’
আনভীর এবার তুহিন স্যারকে বললেন, ‘ও এখানে নরমাল স্টুডেন্টসদের মতোই আসবে। আহি যে আমার আমার ওয়াইফ এ বিষয়ে কোনো আদিক্ষেত্যার দরকার নেই। ওকে?’
-‘ওকে প্রফেসর। তাহলে ওকে ওর ক্লাসে নিয়ে যাও। ওখানে বাকি স্যাররা আছে।’
আনভীর কিছু না বলে ক্লাস রুমে নিয়ে গেলেন আমায়। আমি সেখানে ঢুকছিলাম তখনই উনি ডাক দিলেন,
-‘আহি!’

পেছনে ফিরলাম আমি। আনভীর শীতল কন্ঠে বললেন,
-‘তুমি যে আমার ওয়াইফ এ বিষয় নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করবে না।’
উনার এই কথাটি একেবারে বুকে গিয়ে বিঁধলো আমার। মানে , আমার উনার ওয়াইফ হওয়ার বিষয়টা বাড়াবাড়ি?আমি শান্ত করলাম নিজেকে। অপ্রস্তুত কন্ঠে বললাম,
-‘এ ব্যাপারে চিন্তা করবেন না।’
আনভীর কোনো কথা না বলে প্রস্থান করলো জায়গাটি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম এবার। মনে হয় না যে ছুটি হওয়ার পর উনি আমাকে নিতে আসবেন। তাহলে এতক্ষণ মনে যে ধারনাগুলো পুষে গিয়েছিলাম ওগুলো কি আসলেই আমার ভুল ধারনা? আমি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করলাম। উনার ব্যাপারে যতই ভাববো তথই মরীচিকার মায়াজালে হারিয়ে যাবো। আমার দরকার নেই এত মায়ার,,যেটা প্রবেশ করলেই থাকবে শুধু তিক্ততা আর অবহেলা।

দেড় ঘন্টার কোচিং শেষ করে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি এবার। যেমনটা হয়েছে ঠিক তাই। আনভীর আসেননি। হয়তো বরাবরের মতোই ভার্সিটিতে ক্লাস নিতে ব্যস্ত। আমি এবার রিকশার জন্য উদগ্রীব হয়ে আশপাশে তাকালাম। রিকশা পেলেও যেই আকাশ ছোয়া ভাড়া চাচ্ছে। আর যাই হোক এত টাকা আমি খরচ করবো না।
তাপদাহ দুপুর। সেই সাথে রয়েছে উত্যপ্ত বাতাস। আমি রীতিমতো ঘেমে যাচ্ছি ক্লান্তিবেশে। তার ওপর রিক্সাওয়ালাদের আকাশকুসুম ভাড়ার জন্য বিরক্তি রাজত্ব করছে মনে। এমন সময় হঠাৎ কেউ পেছন থেকে হিসহিসানি কন্ঠে বলে ওঠলো,

-‘এখানে একা দাঁড়িয়ে আছো কেনো আহি বেবি? তোমার বর এখনও আসেনি?’
খুবই পরিচিত একটি স্বর পেয়ে হঠাৎ আমার সর্বত্র কাপাকাপি শুরু হয়ে গেলো এবার। লোকটাকে আমি হয়তো চিনি,হ্যাঁ খুব ভালোমতই চিনি। কিন্ত আমার পেছনে তাকানোর মতো সাহস নেই। এই ভরা রাস্তায় এত মানুষের সমাগমেও আমি ভয় পাচ্ছি বারবার। আমি কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পা চালিয়ে হেঁটেই বাড়ির দিকে রওনা হলাম। পেছনে তাকাইনি একবারও। আমি অনুভব করতে পারছি কেউ ঠিক আমার পিছে পিছেই পা চালিয়ে আসছে। আমি অস্থির হয়ে এদিক সেদিক তাকালাম রিক্সার জন্য। এতক্ষণ রিক্সা থাকলেও এখন খালি রিক্সা পাচ্ছিনা একটাও। আমি পেছনে তাকাবো না এখন। পেছনে তাকালে আমার জমানো সাহস নিমিষেই উড়ে যাবে।

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৬+৭

আমি আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম মনে মনে। যেন আমায় এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে। আমি আবারও শুনতে পেলাম,
-‘থামো আহি। আমি তোমায় থামতে বলেছি।’
কিন্ত আমি থামি নি। এক পর্যায়ে ছুটে দৌঁড় দিলাম আমি। কে কি ভাবছে এগুলো ভাবার বিষয় আমার এখন মাথায় নেই। আমার এখন একটা কথা, ‘ওই মানুষটা থেকে আমায় ছুটে পালাতে হবে।’

আচমকাই, আমার সামনে একটা গাড়ি থামলো এবার। দৌড়ানো অবস্থায় হঠাৎ গাড়ির মুখোমুখি হওয়াতে অবাক হয়েছি বেশ। তবে এর থেকেই অবাক হয়েছি আমার কাছের সেই ব্যাক্তিটিকে দেখে। গাড়িটি আনভীরের। উনাকে হঠাৎ দেখে আমার মনে আশার আলো জাগলো। আনভীর নেমে এলেন গাড়ি থেকে। আমি তখনও হাপাচ্ছি। নিঃশ্বাস ফেলছি বারবার। আনভীর আমার গালে হাত দিয়ে অস্থির কন্ঠে বললেন,

-‘হোয়াট হ্যাপেন্ড আহি? এভাবে দৌড়াচ্ছো কেনো? ইজ এভরিথিং ফাইন?’
আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি এবার। হাতেপায়ে শক্তি নেই। আনভীর আমায় নিজের বুকে এলিয়ে গালে হাত দিয়ে ডেকে চলছেন বারবার। আমি এবার জড়ানো কন্ঠে বললাম,
-‘অ-অ-অপূর্বকে ফিরে যেতে বলুন আনভীর।’

এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৯