এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১১

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১১
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

ময়মনসিংহতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। তিনটা লাগেজ অতি সাবধানে নামিয়ে এখন সিএনজি খুঁজছে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। একা মেয়ে দেখে সিএনজি ড্রাইভাররা অধিক ভাড়া দাবি করছে। প্রায় দশ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

অচেনা শহর, অচেনা রাস্তা। কোনদিকে কই যাবে কিচ্ছু বোধগম্য হচ্ছে না তিতিরের। সিএনজি ড্রাইভাররাও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে মেয়েটা এই শহরের কিছু চিনে না। সিএনজি ড্রাইভাররা যতো ভাড়া চাচ্ছে ততোটা তার বাস ভাড়ার থেকেও অনেকটা বেশি। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর এক বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এসে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মা, কই যাইবা?”
তিতির হকচকিয়ে তাকায়। এই অচেনা শহরে এতো কোমল স্বরে তাকে ডাকার মানুষটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। রাস্তার স্বল্প আলোতে যেটুকু দেখা সম্ভব হলো তাতে তিতির বুঝল লোকটা অধীর আগ্রহে তিতিরের দিকে চেয়ে আছে। তিতির হালকা হেসে বলল,
“মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে যাব চাচা।”

“তয় লও আমার গাড়িতে। ভাড়া লইয়া চিন্তা কইরো না। মেডিকেল কলেজের ওইহানেই আমি থাকি। ন্যায্য ভাড়াই রাখমু। অনেকক্ষণ ধইরা খাড়ায় আছো। লও আমি পৌঁছায় দেই।”
তিতিরেরও আর দামাদামি করতে ইচ্ছে হলো না। লোকটাকে বিশ্বাস করতে মন সায় দিলো। লাগেজ গুলো বৃদ্ধ ড্রাইভারের সাহায্যে গাড়িতে তুলে নিলো। তারপর তিতির গাড়িতে বসলে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। ড্রাইভার বলতে লাগে,

“আমি মেডিকেল কলেজের ওখানেই থাকি। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা আমারে খুব ভালো পায়। কিছু হইলেই আমারে ফোন কইরা কইব, ‘চাচা জলদি আসেন। এক জায়গায় যাইতে হইব।’ আমিও আর কী! যাই। সন্তান থাকতেও নিঃসন্তান আমি। ওরা পাশে আছে বইলা শান্তি লাগে। আমার ও আমার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচও ওরাই চালায়। এতো মানা করি শোনেই না।”

বৃদ্ধ ড্রাইভার চাচার কথা শুনে তিতিরের মুখে হাসি ফুটল। তিতির বলল,
“আজ থেকে তবে আপনি আরেকটা মেয়ে পেলেন। আমাকেও ওদের মতো রাখবেন?”
“রাখমু না ক্যান? অবশ্যই রাখমু।”
তিতির মুচকি হাসল। ক্লান্তিতে চুপ করে রইল। কিছু সময় পর গন্তব্যে পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে বলে,

“ধন্যবাদ চাচা। ভালো থাকবেন। আমার জন্যও দোয়া করবেন।”
“তুমিও ভালা থাইকো মা।”
তিতির লাগেজগুলো নিয়ে হোস্টেলের ভিতরে গেলো। তিতিরের প্রস্থানের পর বৃদ্ধ ড্রাইভার চাচার ফোনে কল আসে। তিনি ফোন রিসিভ করে সালামের জবাব দিয়ে বলে,

“হ বাবা। নামাইয়া দিয়া গেছি। মাইয়াটা একলা খাড়ায় আছিল। মাইয়াডা তোমার কিছু হয়?”
“আরে না চাচা। ফ্রেন্ডের কথায় এসব করছি।”
“ওহ। আমি ভাবলাম তোমার কিছু হয়। সমস্যা নাই।”
“আচ্ছা চাচা।”
অর্ক ফোন রেখে বলে,

“এই রাফি, মাশরিফরে মেসেজ করে জানা। আমি ওয়াশরুমে গেলাম।”
এই বলে অর্ক ওয়াশরুমে দৌঁড় দেয়। শুভ বলে,
” রাফি ফোন দে। নেটে নাই দেখলাম।”
“তুই দে। আমার ফোনে টাকা থাকলে তো চাচারে আমিই ফোন দিতাম। ব্যালেন্সের মেয়াদ শেষ। কালকে সকালে ব্যালেন্স নিতে হবে।”
রাফির কথায় শুভ মাশরিফকে ফোন লাগায়। মাশরিফ যেনো ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ফোন রিসিভ করে সরাসরি বলে,

“তিতির এসে পৌঁছেছে?”
শুভ বিরস কণ্ঠে বলে,
“ফোনটা ধরেই আমাদের কোনো খোঁজ-খবর না নিয়েই সরাসরি প্রেমিকার খবর জিগাস। যা তোরে কমু না।”
শুভ সাথে সাথে কল ডিসকানেক্ট করে দিল। রাফি অবাক হয়ে বলল,
“ফোন যখন দিছিস তো কথাটা বলেই কা’টতি।”
শুভ দাঁত বের করে হেসে বলে,

“এখন ও ফোন দিবে। দেখ খালি।”
সত্যি সত্যি মাশরিফ ফোন দিল। খুব আয়োজন করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেসা করে,
“কেমন আছিস তোরা? বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নাই।”
“হইছে থাম। আমরা সবাই ভালো আছি। তোর তিতিরপাখিও হোস্টেলে এসে পৌঁছে গেছে। শান্তি?”
মাশরিফ স্বস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

“থ্যাংকিউ রে। আমি আর দুইদিন পর টাংগাইল আসব। তারপর আম্মুকে মির্জাপুর থেকে বাসায় নিয়ে আসব। তোদের সাথেও দেখা করব।”
শুভ রম্যস্বরে বলে,
“আমাদের সাথে? নাকি…!”
মাশরিফ হালকা হেসে বলে,
“তোদের সাথেই দেখা করতে আসব যতোদিন থাকব। তার মধ্যে একটুখানি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম আরকি!”
“তুই মিয়া বহুত চালাক। তা আন্টিকে বলছিস?”

শুভর প্রশ্নের জবাবে মাশরিফ ঘন নিঃশ্বাস ফেলে। হতাশ স্বরে বলে,
“নাহ্! অনেক কিছু মাকে জানানোর আছে। আগের হৃদপ্রিয়া তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করুক।”
রাফি, শুভ, অর্ক সমস্বরে বলে ওঠে,
“কবুল হোক।”
মাশরিফের সাথে বসে অভীও বলে,
“কবুল হোক।”
মাশরিফ হেসে ফেলে। বলে,

“একদিন রাতুল, রণিতকেও বল না রাজশাহী থেকে আসতে। সাত বন্ধুর একটা ছোটোখাটো গেট-টুগেদার হয়ে যাক।”
“হ্যাঁ বলব। ওরাও বলছিল।”
রাফির জবাবে মাশরিফ বলে,
“আচ্ছা থাক তবে। নামাজ পড়ে নেই।”
“বায়।”
বন্ধুদের কথা শেষ হলে মাশরিফ ও অভী নামাজ পড়তে যায়। নামাজের পর ডাইনিংয়ে যাবে ডিনারের জন্য।

হোস্টেল সুপার তিতিরকে তিতিরের রুম দেখিয়ে দিল। রুমে আরও দুইজন আছে। হোস্টেল সুপার বললেন,
“শুনো তিতির, এখানে এরা ফরেন স্টুডেন্ট। অন্য রুমে তোমাকে দেওয়া হয়নি। মেয়েরা খুব ভালো। আশা করি মিলে চলতে পারবে।”
তিতির কৃতঙ্গতা প্রকাশ করে বলে,
“ধন্যবাদ মেম। আমি চেষ্টা করব ওদের সাথে বন্ধুত্ব করার।”
হোস্টেল সুপার চলে গেলে তিতির ব্যাগগুলো নিয়ে নিজের বেডে বসে। পাশের বেড থেকে এক মেয়ে বলল,
“হ্যালো। মাইসেল্ফ লিরা।”

“হ্যালো। মাইসেল্ফ তাহিয়া নূর তিতির।”
তিতিরের প্রত্যুত্তরে লিরা বলে,
“টোমার নামটা খুব বড়ো। ক্যান অ্যাই কল ইউ টিটির?”
তিতিরের বিষম লেগে যায়। তিতির বলে,
“টিটির না। তিতির। ইংলিশে টি হলেও বাংলাতে ত উচ্চারণ হয়।”
লিরা মিষ্টি হেসে বলে,
“সরি টিটির। অ্যাই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড বাংলা বাট সাম ওয়ার্ড..!”
তিতির হেসে বলে,

“ইটস অকে। ইউ ক্যান কল মি টিটির।”
“থ্যাংকস। ইট উইল টেক সাম টাইম টু প্রনাউন্স। ফার্স্ট টাইম বাঙালি রুমমেট। হেই টিটির, মিট মাই ফ্রেন্ড জুলিয়া। আমাদের বাংলাদেশ অনেক ভালো লাগে। দ্যাটস হোয়াই উই আর হেয়ার। ইউ নো? বোথ অফ আওয়ার প্যারেন্টস আর বাংলাদেশী। বাট দে আর নো মোর।”
তিতির মলিন হাসলো। এতো সুন্দর প্রাণোচ্ছল মেয়েগুলোকে দেখে মনেই হয় না ওরা পরিবারহীন। তিতির বলল,
“সরি।”
“নো নো। ইটস অকে। টুমি রেস্ট নাও।”

নতুন ভোর। স্নিগ্ধতায় ভরপুর। নতুন শহরে প্রথম সকালটাতেই মন ভালো হয়ে গেলো তিতিরের। আজকে এখানে প্রথম ক্লাস করতে যাবে। একটু ভয় ভয় করলেও অন্যরকম উৎসাহ কাজ করছে। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ কফির মগ এগিয়ে দিলে তিতিরের ভ্রুঁ কুঁচকে আসে। পাশ ফিরে চাইলে দেখে লিরা। লিরা চমৎকার হেসে বলে,
“গুড মর্নিং।
তিতিরও হেসে বলে,
“গুড মর্নিং।”
কফি?”
তিতির লিরার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে বলল,
“থ্যাংকিউ।”

লিরা নিজে নিজেই তিতিরকে অনেক কিছু জিজ্ঞেসা করা শুরু করে। তিতিরও ওর সাথে তাল মিলাচ্ছে। রুমমেট নিয়ে তিতির দারুণ খুশি কিন্তু বেশিদিন তো থাকতে পারবে না।
কফি শেষ করে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। তিতির জানতে পারে লিরা ও জুলিয়া তিতিরের ব্যাচমেট। তিনজন একসাথে ক্লাসে যায়। প্রথমদিন হিসেবে দুইজন নতুন ফ্রেন্ড পেয়ে ভালোই লাগছে। ক্লাসে গিয়ে লিরা ওর অন্য ফ্রেন্ডদের সাথে তিতিরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

ক্লাস শেষে লিরা ও জুলিয়া তিতিরকে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাতে থাকে। পথে ইন্টার্নের শেষের দিকে থাকা রাফি, অর্ক, শুভদের সাথেও দেখা হয়ে যায়। অর্ক নিজ থেকে এগিয়ে এসে একটু না জানার ভান করে তিতিরকে বলে,
“তুমি কে? নতুন দেখছি আজ। ফ্রেশারদের তো আসার এখনও সময় হয়নি।”
তিতির ভয়ে কাঁচুমাচু অবস্থা। র‍্যা*গিং এর শি*কার হবে কী-না ভয়ে আছে। স্বল্প শব্দে বলে,
“ভাইয়া আমি মাইগ্রেশন করে ফরিদপুর থেকে এখানে এসেছি।”
“ওহ আচ্ছা। তা লিরা, জুলিয়ার সাথে উঠেছ নাকি?”

লিরা অর্কের এমন অভিনয় দেখে মুখ কুঁচকে নেয়। পরশুদিনেই তো অর্ক ও শুভ এসে লিরা ও জুলিয়াকে তাদের নতুন রুমমেটের কথা জানিয়েছিল। অর্কের এই প্রশ্নের জবাব লিরা মুচকি হেসে দেয়,
“ইয়েস ব্রো। উই আর রুমমেট!”
অর্ক জোরপূর্বক হেসে বলে,
“আচ্ছা থাক তবে। পরে কথা হবে।”
জুলিয়া মুখে হাত দিয়ে হাসছে। অর্ক, রাফি, শুভ চলে গেলে ওরাও তিতিরকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। পরবর্তী ক্লাস শুরু হতে এখনও সময় বাকি।

সুজন, পলাশরা এলাকায় এসেছে ভোরে। এসেই তিতিরদের বাড়ির কাছে গেছে। উুঁকিঝুঁকি দিয়ে নিজেদের বাড়িতে চলে গেছে। ওরা তো বুঝতেও পারল না। তিতিররা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে!

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১০

শীতকালে সত্যি হাত চলে না। আর ঘারব্যাথা তো কাল সারাদিন ছিল। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১২