এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১২

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১২
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

সুজনরা এলাকায় আসা মাত্রই পু*লি*শের কানে খবর চলে গেছে। সুজন ও পলাশরা দুপুরের দিকে ঘুম থেকে উঠে মোড়ের দেকানে এসে বসে চা-পানি খাচ্ছে সাথে হাসি-তামাশা করছে তখনি ওদের সুখের অন্তরায় হয়ে পুলিশ হাজির হয়। আচমকা ঘটনায় সুজন, পলাশ ও তাদের সঙ্গীদের বিষম খাওয়া অবস্থা। ওরা পালানোর জন্য দৌড় দিবে তার আগেই পু*লিশ ওদের ঘেরাও করে ফেলে। পুলিশের একজন অফিসার সুজনের কলার ধরে বলে,

“চল এবার। অনেক ঘুরাইছিস।”
সুজন এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমারে ধইরা নিবি অফিসার? তোর বড়ো অফিসারও আমার কথায় উডে বহে।”
পলাশ বলে,
“অতো সোজা নিহি? দুইদিনও রাখতে পারবি না। এই অফিসার মনে হয় নতুন। আমরা এলাকায় আছিলাম না তাই পকেট ভরতে পারে নাই।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পুলিশ অফিসার নাদিম মুচকি হেসে বলল,
“ঠিক বলেছিস, পকেট ফাঁকা আমার। যার পকেট ভরেছিস তাকে বান্দারবান ট্রান্সফার করা হয়েছে। তাই তোদের জে*লে ভরতে এসেছি।
সুজনের এবার মাথায় হাত। কীভাবে বাঁচবে উপায় খুঁজছে। পু*লি*শের পায়ে পা*রা দিয়ে পালাতে চাইলে অফিসার হ্যা*ন্ডগা*নের পশ্চাৎ দিয়ে সুজনের মা*থায় আঘা*ত করে। আ*ঘা*তে সুজন ব্যাথায় কাঁকিয়ে উঠে যা দেখে পলাশ চুপসে যায়। তারপর পু*লিশ হাতে হ্যা*ন্ডকাফ পড়িয়ে সুজন ও পলাশকে গাড়িতে তোলে থানায় নিয়ে যায়।

ময়মনসিংহ আসার দুইদিন পেরিয়ে গেছে। আজ বিকেলে ক্লাস শেষ করে তিতির বাসা খোঁজার জন্য একটু বেরিয়েছে। দুইদিনে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে লিরা ও জুলিয়া তিতিরকে পুরো ক্যাম্পাস দেখিয়েছে। সেই সাথে আরও দুয়েকজন বন্ধুও হয়েছে। তিতিরের সাথে বাসা খোঁজার জন্য লিরা ও জুলিয়াও আসতে চেয়েছিল কিন্তু জুলিয়ার হঠাৎ অসুস্থতা ও লিরার জুয়েলারির কালেকশন ও মেইকওভার প্রডাক্ট, কসমেটিকস নিয়ে লাইভে যেতে হবে বলে আসা হয়নি। বলা বাহুল্য যে, লিরা ও জুলিয়া অনলাইনে বিজনেস করে নিজেদের খরচ চালায়। তাছাড়া সরকারি মেডিকেল তাই এতেই ভালো করে চলতে পারে।

তিতির যেটুকু চিনে আবার হোস্টেলে ফিরতে পারবে অতোটুকুই খুঁজতে গিয়েছে। একটা বাসা পেয়েছে কিন্তু রুমও বেশি এমনকি ভাড়াও বেশি। রুম তিনটা সাথে ডাইনিং আলাদা। ভাড়া চেয়েছে নয় হাজার। এতো বড়ো ফ্যামিলি বাসা তো ওদের দরকার নেই। হিয়া বাচ্চা নিয়ে নাজমা বেগমের সাথেই থাকবে বলেছে। তাছাড়া এতো টাকা ভাড়াতে দিতেও কষ্ট হয়ে যাবে। তাই সেটা আর নিল না। আজকের মতো খোঁজা এখানেই ইতি টানল।

সামনে একটা কদম গাছ। গাছের নিচে ঝড়ে পরা কদম ফুলের চিহ্ন পরিলক্ষিত। বর্ষাকালের প্রমাণ এখনও প্রকৃতিতে দৃশ্যমান। অথচ শরতের আগমন ঘটে গেছে। তিতির দেখল এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি খুব একটা চলাচল করে না। সিএনজি, প্রাইভেটকার ক্ষণে ক্ষণে আসে আর রিকশা। ফুটপাতে মানুষজন হাঁটছে। তাই সেখানে বসল। একটা পরে থাকা অর্ধ কদমফুল তুলে নিলো।

কদমফুল তার প্রিয়দের তালিকাভুক্ত। কোন ফুল যে তার প্রিয়র তালিকায় নেই তা সে নিজেও জানে না। আকাশপানে চেয়ে আঁখিজোড়া মুদিত করে নিলো পরক্ষণেই চোখ মেলে আকাশপানে তাকালো। গোধূলির রক্তিম আভা যেনো পশ্চিম আকাশে রঙতুলিতে ছিঁটে দেওয়ার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। মৃদু-মন্দ সুনীলে মন প্রশান্তিতে ভরপুর। বহুদিন পর এভাবে ফুটপাতে একা বসল। শেষ বার কবে বসেছিল মনে করতে পারছে না। খানিকদূরেই তিতির দেখল এক আইসক্রিম ওয়ালা যাচ্ছে। লোকটা বরফ মালাই আইসক্রিম বিক্রি করে। তিতিরের ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা ফুটল। আইসক্রিম বিক্রেতার কাছে গিয়ে বলল,

“চাচা, দুইটা আইসক্রিম দেন তো।”
আইসক্রিম ওয়ালার ফোঁকলা মুখে হাসি ফুটল। জিজ্ঞেসা করল,
“কয় টাকা কইরা দিমু মা?”
“আপনি বলেন আগে।”
তিতিরের জবাবে আইসক্রিম বিক্রেতা প্রত্যুত্তর করল,

“পাঁচ টাকা কইরা নিলে পাত্রটাও খাইতে পারবা। আর দশ টাকা কইরা নিলে প্লাস্টিকের কৌটাতে দিমু।”
তিতির গালে হাত দিয়ে কিয়ৎ ভাবল। অতঃপর বলল,
“পাঁচ টাকা করে দেন চাচা। আমার রা*ক্ষ*সী মন পাত্র সহ খে’য়ে নিতে চাইছে।”
বলেই তিতির হেসে ফেলল। তিতিরের এই মুগ্ধ করা হাসি কারও ক্যামেরায় ফোকাস হলো। আড়াল থেকে হৃদপ্রিয়ার প্রাণোচ্ছলতা উপভোগ করার মাঝে দারুণ এক আনন্দ আছে।

আইসক্রিম ওয়ালার পাওনা মিটিয়ে দুই হাতে দুইটা আইসক্রিম নিয়ে ভাবল একটা ছবি তুলবে। হাতে থাকা কদম ফুলটার নষ্ট হওয়া সাদা পাঁপড়িগুলোকে তুলে ফেলে দিল। তারপর শুধু সূর্যের ন্যায় হলুদ অংশটা রাখল। বাম হাতে কদম ফুল ও দুইটা বরফ মালাই আইসক্রিম নিয়ে চটজলদি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে পশ্চিম কোণে ডুবন্ত রক্তিম সূর্য অভিমুখে আকাশপানে হাত উুঁচাল।

অতঃপর দুই ক্লিকে দুইটা ছবি তুলে নিয়ে আবারও ফুটপাতের ওই জায়গাটাতে বসল। আইসক্রিম গলে যাওয়ার দরুণ হাত বেয়ে বরফ গলা পানি পরা শুরু করেছে। অতিসত্তর যদি না খায় তবে আর খাওয়াই হবে না। তাড়াহুড়ো করে একটা আইসক্রিম পুরোটা মুখের ভিতর পু*ড়ে দেওয়া মাত্রই ঠান্ডায় নাক, কান, দাঁত শিরশির করে ওঠল। চোখ-মুখ খিঁচে পরেরবার এই বোকামি না করার মনস্থির করে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। এবার যে ফিরতে হবে। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে এখনও সন্ধ্যা নামার ঢের সময় বাকি কিন্তু প্রভাকর যে আজকের মতো নিদ্রাতে চলে গেছে!

কিছু পথ হাঁটতেই আজান পরলো। তিতির একটু থেমে দাঁড়াল। এক মসজিদে আজান শেষ হলে আবার হাঁটা ধরল। পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে মেডিকেল কলেজ এড়িয়াতে এসে পড়েছে। এবার দেখা মিলে সেই বৃদ্ধ ড্রাইভার চাচার সাথে। তিতির ভাবল, রাতে পড়ার সময় খিদে পেলে খাওয়ার জন্য বিস্কিট, চকলেট কিনে নিয়ে চাচার সাথে একটু সালাম বিনিময় করবে। দোকান থেকে জিনিসপাতি কিনে সেখানে এসে দেখে ড্রাইভার চাচা নেই। তিতির এবার হোস্টেলে ফিরতে উদ্ধত হলে একজন ডাক দেয়,

“এই মেয়ে!”
তিতির ঘাবড়ে তাকাল। দেখল তার সিনিয়র। সেদিন যেই ছেলেটা লিরা, জুলিয়াদের সাথে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার সময় এসেছিল সেই ছেলেটা। সাথে আরও তিনজনকে দেখা যাচ্ছে। একজনের চেহারা স্পষ্ট কিন্তু বাকি দুইজনের চেহারা অস্পষ্ট। ছেলেটা বলে,

“এদিকে আসো।”
তিতির খানিক আগায়। ভাবতে থাকে কোনো ভুল করেছে কী-না!
“তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি অর্ক। ওইদিন যে কথা হলো।”
অর্কর পরিচিতি পর্বে তিতির হাসার চেষ্টা করে বলল,
“জি চিনেছি ভাইয়া।”
অর্ক আবার জিজ্ঞেসা করে,

“কোথায় গিয়েছিলে? সিনিয়রদের সালাম দিতে হয় জানো না?”
তিতির থতমত খেয়ে সালাম দেয়। পাশ থেকে এক পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
“অর্ক, ওকে যেতে দে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিছু বলার হলে বল নয়তো শুধু শুধু সময় নষ্ট করছিস।”
তিতিরের কাছে কণ্ঠস্বর কিঞ্চিত পরিচিত ঠেকল কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না। লোকটার মুখশ্রীও দৃশ্যমান না।

এবার শুভ নামের ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল,
“তোমাকে বিকেলে ক্যাম্পাস থেকে একা বের হতে দেখেছিলাম। তুমি তো মাইগ্রেশন করে এসেছ। এই শহর চেনো?”
“না। মানে এমনি বেরিয়েছিলাম।”
তিতিরের জবাবে শুভ বলে,

“ওহ আচ্ছা। কোনো হেল্প লাগলে বলতে পারো। আমাকে না পেলেও রাফি ও অর্ককে পাবেই।”
শুভর কথায় ওর বন্ধুরা বিরক্ত হলোম রাফি শুভর মাথায় চা*টা মে*রে তিতিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি যাও এখন। কোনো হেল্প লাগলে জানাবে।”
তিতির মাথা নাড়িয়ে আবার সালাম দিয়ে চলে আসে।
তিতির চলে গেলে মাশরিফ এবার ঘুরে তাকায়। সে আজই এসেছে। প্রথমে টাঙাইল যাওয়ার বদলে এখানে এসেছে। বিকেলে এসেই তিতিরকে বের হতে দেখে পিছু নিয়েছিল। শুভ ও রাফি মাশরিফের কাঁধে হাত রাখে। রাফি বলল,

“তুই কি খুব আয়োজন করে নিজের মুখ দর্শন করাবি? নাকি ভয় পাচ্ছিস?”
শুভ মজার ছলে বলে,
“সুদর্শন পুরুষদের একটু বেশিই ঢঙ থাকে। আমি তো বুঝি না তুই রোদের মধ্যে সারাদিন দৌঁড়-ঝাঁপ করে রাফির মতো ফর্সা কি করে আছিস? রাফি হচ্ছে জুনিয়রদের ক্রাশ। আমি আর অর্ক একটু কম আরকি।
রাফি শুভকে আবারও মাথায় একটা লাগিয়ে বলে,

“তাই জন্যই তো আমি এখনও সিংগেল আর তুই চুটিয়ে প্রেম করছিস। খুব ভালো তো।”
“তুই মেয়েদের পাত্তা দেস না তো ওরা সুযোগ পাবে কেমনে? অর্ককে দেখ। জুনিয়র একটা ওর পিছে ঘুরে আর ও সেটারেই বারবার ‘আপু আপু’ বলে!
অর্ক ভাব নিয়ে বলে,

“আমার দরকার নাই ডাক্তার গার্লফ্রেন্ড বা বউ। আমি সাধারণ মেয়ে বিয়ে করমু। এদিকে বাসায় আম্মা বলতেছে, বিয়ে ঠিক করে রাখছে। বারবার বলতাছে ঢাকা ফিরতে।”
মাশরিফ হেসে বলে,
“করে ফেল তবে। সবার আগে তুই বিয়ে করে অভিঙ্গতা জানা। সবার শেষে মনে হয় আমার বিয়ে দিবে।”
হঠাৎ শুভ বলে,

“এই মাশরিফ, তোর পিছে যে ঘুরে ওই মেয়েটার কী খবর? কী যেনো ক দিয়া নাম।”
রাফি ব্যাঙ্গ করে বলে,
“মাশু বেবি আমাকে কাশু বলবা হ্যাঁ?”
মাশরিফ রাফির কথায় চটে গিয়ে দু-য়েক ঘা লাগিয়ে বলে,
“ভাবতেছি এবার মাকে বলব, চলো তোমার কোয়াটারেই থেকে যাই। কয়দিনের জন্য আবার বাড়িতে যাওয়ার দরকার কী?”

“এতো বিরক্ত লাগলে কা’নের নিচে দুইটা লাগাবি। দেখবি সোজা হয়ে গেছে।”
রাফির বুদ্ধিতে মাশরিফ হতাশ হলো। ওই মেয়ের ন্যাকমির জন্য সত্যি বিরক্ত সে। ফোনের রিংটোনে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে মা কল করেছে। মাশরিফ বলল,
“আচ্ছা থাক তবে। আবার কাল আসব। আজ যাই। মা এবার রেগেই যাবে।”
মাশরিফ নিজের জিপে উঠে সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।

হোস্টেলের ভিতর ফিরে তিতির দেখে লিরা ও জুলিয়া দুজনেই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। তিতির জলদি করে ওজু করে নামাজটা পড়ে নেয়। তারপর জুলিয়াকে জিজ্ঞেসা করে,
“হাউ ইউ ফিলিং নাউ?
“ইয়াহ ফাইন। থ্যাংকিউ ফর আস্কিং। রেন্ট পেলে?”

জুলিয়াকে তিতির জবাব দেয়,
“না। কাল আবার বেরোব।”
“ওখেই। ডোন্ট ওয়ারি। পড়টে বসো এখন।”
তিতিরও বই নিয়ে বসলো।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১১

মোটামুটি বড়ো পর্ব। গতকাল লিখতে পারছিলাম না। সরি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৩