বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৪

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৪
শারমিন আক্তার বর্ষা

রুহানিকে জ্বালানোর জন্য কোনো সুযোগ হাত ছাড়া করছে না এ.স। যখনই সুযোগ পাচ্ছে ইচ্ছে মত জ্বালিয়ে মা’র’ছে মেয়েটাকে। এটা দেখে রুহানির বন্ধুরা বেশ মজা লুটছে কিন্তু রুহানি বিরক্ত বোধ করছে। রুহানির পাশাপাশি চেয়ারে এ.স বসছে, দেখে বেশ হিংসে হচ্ছে রাইসার। ও’ ভ্রু কিঞ্চিত উঁচু করে বার বার ওদের দু’জনকে পর্যবেক্ষণ করছে।

স্টেজে পারফরম্যান্স হচ্ছে এক মনে দেখছে রুহানি। দু’জন কাঁপল নিজেদের পারফরম্যান্স শেষ করে স্টেজ থেকে নেমে পরল। রুহানি বেশ ভালো ডান্স জানে, সে জন্য ওর বন্ধুরা ও’কে অনুরোধ করে বলল, একটা পারফরম্যান্স দেওয়ার জন্য। রুহানি ও’র ডান্স পার্টনার হিসেবে বাছাই করল, আদনান কে। পাঞ্জাবির হাতা কিছুটা ফোল্ড করে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল আদনান। বাম হাতের শাহাদাত আঙুল দিয়ে ঘাড় চুলকে, আদনান অ্যাটিটিউট দেখিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— স্যরি দোস্ত। আমার শরীরটা বেশি ভালো না। আমাকে আজ ডান্সফান্সের জন্য ফোর্স করিস না।
আদনান প্রস্তাবে নাকচ করায় ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে রুহানি ও’র অন্য বন্ধু নিশান,আরিফ ও সাইফ এর দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু কেউ ডান্স পার্টনার হওয়ার জন্য রাজি হচ্ছে না। রুহানি রাগে ফুঁসতে লাগল। রুহানি রাগে ফুসফুস করছে দেখে, ঠোঁট জোড়া একত্র করে পিটপিট করে হাসছে এ.স। পাশ থেকে হাসির শব্দ শুনে রাগী চোখে এ.স এর দিকে তাকাল রুহানি। রুহানির মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে সশব্দে হাসি হেসে ওঠল এ.স। রুহানির বিরক্তির শেষ নেই, বিরক্ত হয়ে ওঠে চলে যেতে নেয়।

এ.স এর দিকে তাকাতে কেউ ডান্সের জন্য সম্মতি দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় একজন ছেলে পিছন থেকে রুহানির সামনে এসে দাঁড়াল। এবং রুহানির দিকে একহাত বাড়িয়ে বলল,
— আপনি চাহিলে আপনার ডান্স পার্টনার হতে চাই।
কেউ তো আসল দেখে রুহানি মলিন হাসি হাসল, নাই মামার থেকে কানা মামা থাকা ঢের ভালো। মনে মনে ভেবে হাত খানা বাড়িয়ে দিতে যাবে, তারপূর্বে এ.স ওঠে দাঁড়াল। লোকটার গলা জড়িয়ে ধরে অন্য দিকে নিয়ে গিয়ে বলল,

— আরে ভাই আপনি এখানে কি করছেন? উনার জন্য আমি আছি। আপনাকে প্রয়োজন নেই, আপনি বরং অন্য কোথাও চলে যান।
লোকটা ” ইট’স ওকে ম্যান” বলে অন্য দিকে চলে যায়। রুহানি চট করে এ.স এর সামনে তেড়ে আসল। তিক্ত ভরা কণ্ঠে বলল,

— আপনি কি বললেন ওই লোকটাকে? উনি এভাবে চলে গেলেন কেন?
এ.স একটু অ্যাটিটিউট দেখালো ভারী গলায় বলল,
— আমি উনাকে বলছি, আপনার মাথায় সমস্যা আছে। ডান্সের কথা বলে, আপনি উনাকে স্টেজে নিয়ে ল্যাং মে’রে ফেলে দিবেন। এটা শুনেই লোকটা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলো।
রুহানি শাহাদাত আঙুল তাক করে রাগান্বিত হয়ে এ.স এর উদ্দেশ্য কিছু বলতে যাবে তার আগে এ.স রুহানির হাত ধরে টেনে স্টেজে নিয়ে আসে। রুহানি আশেপাশে তাকিয়ে মলিন কণ্ঠে বলল,

— আমাকে এখানে কেন নিয়ে আসছেন?
অন্য দিকে ওদের স্টেজে ওঠতে দেখে, ডিজে একটা রোমান্টিক গান বাজিয়ে দিল। গানের সুরে রুহানিকে কাছাকাছি নিয়ে আসে এ.স। সকলে মুগ্ধ হয়ে ওদের কাঁপল ডান্স দেখছে। এ.স রুহানির কোমড় চেপে ধরে বলল,

— ডান্সের জন্য আমার থেকে পারফেক্ট কাঁপল আপনি কোথাও পাবেন না মিস রুহানি।
এ.স এর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে নেয় রুহানি। পিছন থেকে রুহানির একহাত ধরে হিচকা টানে একদম নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসল এ.স। রুহানির খোলা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
— যেদিকেই যাবেন শুধু আমাকেই পাবেন।

হলুদের ফাংশন রাত বারোটা অব্ধি চলল। সন্ধ্যার দিকে ছেলের বাড়ির লোকেরা এসে শ্যামার গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পর, শ্যামাদের বাড়ি থেকে লোকজন গিয়ে শ্যামার হবু বরকে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে আসে। রুহানি ও আয়রা বাদে সবাই চলে গিয়েছিল। ওদের দু’জনকে শ্যামা যেতে দেয়নি। ওরা দুজন চলে গেলে শ্যামা একা হয়ে যেতো সেজন্য জোর করে নিজের কাছে রেখে দেয়। ছেলের বাড়ি থেকে রাত এগারোটার দিকে সকলে চলে আসে। তারপর গার্ডেনে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নাচ গান হয়।

রাত আটটার দিকে শ্যামার বাবা মি.মাহিনের থেকে বিদায় নিয়ে এ.স চলে যায় ওর তখন ইমার্জেন্সি একটা কল আসে। এ.স থাকা কালীন ও’কে বিরক্তিকর লাগছিল রুহানির কাছে কিন্তু রুহানি যখন জানতে পারল, এ.স চলে গেছে। তখন থেকে সে অসম্ভব মিস করছে এ.স কে। এককাপ কফি হাতে ছাঁদে এসে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল রুহানি। দূর আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে আনমনে বলে ওঠল,
— আমি কি অসভ্য লোকটাকে মিস করছি?
___
ইন্সপেক্টর নিহান কর্ণ, ডেস্কের ওপর কয়েকটা দরকারি ফাইল রেখে তাতে গম্ভীর হয়ে চোখ বুলাচ্ছে। কিছু তেই একটার সাথে আরেকটার হিসাব মিলাতে পারছে না। পরপর দুই দুইটা কেস তার আন্ডারে। প্রথম কেস পুকুরের জলে দুজনার লা’শ তাদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেয়েছে। অধিক মাত্রায় সালফিউরিক এসিড খাওয়ায় দুজনের মৃ’ত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর দু’জনের মৃত’দেহ পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

একটা কেস সল্ভ না করতে আরও একটা জটিল কেস হাতে এসে পরেছে।
রাত বারোটার নাগাদ হাইওয়ে রোডের থেকে বেশ অনেকটা দূরে একটা কার এক্সিডেন্ট করে। গাড়িটি হঠাৎ ব্রেক ফেইল করে। গাড়ির মধ্যে চারজনের মৃ’ত্যু। আশ্চর্যজনক হচ্ছে, গাড়ির মধ্যে চারজনই গলা পর্যন্ত ড্রিংকস করে ছিল।

পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট এখনও আসেনি। এই সময়ে অন্য এক অংক কষতে ব্যস্ত নিহান। দুই’য়ে দুই’য়ে কেন জেনো চার হয়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে হুট করে নিহানের হাতের বাম পাশে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করে হ্যালো বলতে অপরপ্রান্ত হতে ডাক্তার সায়মন বলেন। ডাক্তারের কথা শুনে অবাক হল না নিহান। মূহুর্তে তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি৷ মনে হচ্ছে সে ডাক্তারের এই কথাটাই শোনার জন্য অপেক্ষারত ছিল। কান থেকে ফোনটা ডেস্কের ওপর রেখে মৃদু সহাস্যে নিহান বলল,

— বুঝছো আদ্রিক? আসামী নিজেকে বেশ চালাকচতুর মনে করে। কিন্তু সে যে মস্ত বড় ভুল করে গেছে ওটা ও’ বুঝতেই পারেনি। দু’টো হচ্ছে প্লানিং কৃত মা’র্ডা’র। প্রথমে দু’জনকে সালফিউরিক এসিড খাইয়ে মে’রে জলে ফেলে দেয়। তারপর ওই চারজনকে নাইট ক্লাবে ড্রিংকসের সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ সালফিউরিক এসিড মিশিয়ে দেয়। এবং ওদের মৃত্যু ও পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ওদের গাড়ির ব্রেক ফেল করা হয়। দূর্ভাগ্যবশত এসিডে কাজ না হলে এক্সি’ডেন্টে মৃ’ত্যু হয়।

নিহানের সামনে বসে আছে আদ্রিক আহির মির্জা। দু’জনে একই কেস নিয়ে স্টাডি করছে। দু’জনের ওপর কেস সল্ভ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বেশ গম্ভীর কণ্ঠে আদ্রিক আহির মির্জা, নিহান কর্ণর কথায় সম্মতি জানালেন। এবং বিষয়টাকে আরও খুঁটিয়ে তদন্ত করার জন্য বললেন। এমতাবস্থায় দরজায় কারো টোকা পরল, ঘাড় কাত করে দরজার দিকে দৃষ্টি স্থির করে, তাকে ভেতরে আসার পারমিশন দেয় নিহান। দরজা ঠেলে ভেতরে আসে কবির। হন্তদন্ত হয়ে বলে,

— স্যার। শাফায়ার গ্রামের গহীন জঙ্গলের সামনে একজনের ডে’ড’বডি পাওয়া গেছে।
সকাল সকাল আরও একটি মৃত্যুর খবর শুনে জিপ নিয়ে সেথায় পৌঁছে যায় নিহান ও তার পুলিশ ফোর্স। ডে’ড’বডি টা দেখে বুঝা যাচ্ছে এটা একটা মেয়ের মৃতদের। কিন্তু বোঝার উপায় নেই, শরীরের কোনো অংশ আস্তো নেই। একদম থিতলে গেছে। ডে’ডব’ডি থেকে দুর্গন্ধ ছুটছে। শক্ত হাতে রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও জেনো গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। নিহান হেঁটে জিপটার কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শালিন কণ্ঠে বলল,

— এই ব’ডি টাকে ডাক্তার সায়মনের ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আর আশপাশটা ভালো করে সার্চ করো। সব কিছু এক জায়গায় জোট পাকিয়ে যাচ্ছে। কথাটি বলে, জিপটায় সর্বশক্তি দিয়ে পাঞ্চ মারল নিহান। যতই কেস টাকে সল্ভ করতে চাচ্ছি, ততই আরও জটিল হচ্ছে। পরপর সাতজনের ‘মৃত্যু এক সপ্তাহে।

ফজরের নামাজ পড়ে, কাউকে কিছু না বলে মর্নিং ওয়ার্কে বের হয় রুহানি। কেনো জেনো বাড়িতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল, ধম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাহিরের স্নিগ্ধ আবহাওয়া গায়ে মাখতে সাদা জার্সি ও কালো ট্রাউজার পরে বেরিয়েছে সে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বেশ অনেকটা দূরে চলে আসছে।

ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বেঞ্চ গুলোর মধ্য হতে একটার ওপরে বসে রুহানি। রুহানির থেকে কিছু টা দূরত্বে কালো একটা গাড়ির মধ্যে কয়েকজন লোক বসে আছে। জানালার গ্লাস দিয়ে দেখে ও’র ওপরে নজর রাখছে। কিছুটা সময় রুহানিকে দেখে সে ফোন হাতে একজনকে কল দিল। ওপাশ থেকে কেউ একজন গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কি অবস্থা?”
লোকটা শুঁকনো ঢোক গিলে বলে,

— মেয়েটাকে একা পাচ্ছি না। চারপাশে মানুষের সমাগম। সবার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া রিস্কি হয়ে যাবে বস৷
লোকটা রাগী ও শক্ত গলায় বলল,
— আরও নজর রাখ৷ সুযোগ পেলেই চিলের মতো থাবা মেরে তুলে নিবি।

অন্য দিকে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রুহানিকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছে চার থেকে পাঁচ জন লোক। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে ফোনের মেসেজ অপশনে গিয়ে কিছু টাইপ করল, কিছুক্ষণ পর টাইপ করা মেসেজ কেটে নাম্বার টিতে কল লাগাল। কল রিসিভ করে হ্যালো বলতে এপাশের লোকটি কান্নারত কণ্ঠে বলল,

— বস৷ মেয়েটা একদম সুস্থ সুন্দর আছে। তার আশপাশে কোনো বিপদ আছে বলে মনে হচ্ছে না৷ মর্নিং ওয়ার্ক করতে এসে লেকে বসে হাওয়া খাচ্ছে। শুধু দৌঁড়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে রেস লাগছে। কি বলবো, বস এত দৌঁড়ানি আমরা লাস্ট কবে দৌঁড়াইছি জানি না। আমাদের সবার পা ব্যাথা হয়ে গেছে।
বস লোকটি ধমকের স্বরে বলল,

— জাস্ট শাটআপ। তোমাদের যতটা বলা হয়েছে ঠিক ততটাই করো। মেয়ে টাকে এক পলকের জন্য ও চোখের আড়াল করবে না। তোমাদের কেয়ারলেসের জন্য যদি মেয়েটার গায়ে কিঞ্চিত পরিমাণ আঘাত আসে। তোমাদের একটা কেও আমি জী’বিত রাখবো না।
বস নামক ব্যাক্তিটা কল কেটে দেয়। এপাশের লোকগুলো ভয়ে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে আবার রুহানির দিকে তাকাল। কিন্তু দূর্ভাগ্য রুহানি বসা থেকে ওঠে কোথায় জেনো চলে গেছে। হন্ন হয়ে চারজন চারদিকে রুহানিকে খুঁজতে লাগল।

বেঞ্চ থেকে ওঠে অপজিট সাইডে দৌঁড়ে যায় রুহানি। কানে হেডফোনে গান শুনছে। হঠাৎ কারো সাথে জোরে ধাক্কা লাগায়, রুহানি থতমত খেয়ে যায়। কান থেকে হেডফোন ছিটকে রাস্তায় পরে। রুহানি স্তব্ধ, নির্বিকার দৃষ্টিতে হেডফোনটার দিকে তাকাই। কি করুণ অবস্থা ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে। অভিমানে ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে সামনে থাকা লোকটার দিকে তাকাল রুহানি। মধ্যবয়স্ক লোক অপরাধীর মতো রুহানির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি তাকে কিছু বলতে যাবে তার আগে লোকটা বলে ওঠল,

— আমি ক্ষমা চাচ্ছি মেয়ে তোমাকে আসতে আমি দেখিনি৷ আমার ভুল হয়েছে। দাঁড়াও আমি তোমার হেডফোন টা এখনই ঠিক করে দিচ্ছি।
কথাটি বলে মাটিতে পরে থাকা হেডফোন টা হাতে তুলে নিয়ে রুহানির সামনে ধরলেন লোকটা। রুহানি মারাত্মক রেগে ছিল। কিন্তু লোকটার দিকে তাকিয়ে, ও লোকটার মুখের কথা শুনে রুহানির রাগ একদম গলে পানি হয়ে যায়। অষ্টদ্বয় মলিন করে রুহানি বলল,

— এটা ভেঙে গেছে আঙ্কেল আর জুড়ো লাগবে না।
কথাটি বলে লোকটার হাত থেকে হেডফোনের ভাঙা টুকরো দু’টো নিয়ে পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। তারপর লোকটার সামনে এসে দাঁড়ালো রুহানি। এক চিলতে হাসি হেসে বলল,
— স্যরি তো আমার আপনাকে বলা উচিত। কেননা আমিই আপনার সামনে চলে আসছিলাম।

রুহানির নেতিবাচক কথা শুনে লোকটা মুচকি হাসল। এবং রুহানির সাথে কোনো এক বেঞ্চে বসে গল্প করার জন্য বলল। রুহানি ও দ্বিধা করে না। মন থেকে একটা আওয়াজ আসছে, রুহানি কান পেতে শোনে সে আওয়াজ টা। ভেতর থেকে কেউ হয়তো বলছে, সে এই লোকটার সাথে কথা বলবে।

এই লোকটার পাশে দুদণ্ড বসলে মনে শান্তি পাবে। মনের কথা শুনে লোকটার সাথে পাশাপাশি বেঞ্চে বসে রুহানি। কথায় কথায় সময় যে পাড় হয়ে যাচ্ছি সেদিকে দু’জনার একজনের ও কোনো হুদিশ নেই। লোকটার কথার পিঠে রুহানি খিলখিল করে হেসে উঠছে। লোকটা অপলক দৃষ্টিতে রুহানির ওই ভুবন ভুলানো হাসি দেখছে। বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসল লোকটার। সে তার ডান হাত রুহানির মাথার ওপরে রেখে নির্মূল স্বরে বলল,

— জানো তো মেয়ে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছি।
ইয়াসিরের কথার পিঠে অস্ফুটে আওয়াজে রুহানি বলে উঠল, “মানে?”
রুহানির বাচ্চাদের মত কথা বলা আর কথার পিঠে তার অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি। পুরাই ইনোসেন্ট, সারপ্রাইসড করে দিচ্ছে ইয়াসির রেদোয়ান কে। দুই আঙুল মুখের সামনে ধরে রুহানির দিকে তাকিয়ে তৃপ্তি ময় হাসছেন ইয়াসির।
রুহানি ইয়াসিরের মুখোমুখি তাকিয়ে বলল,

— আপনাকে দেখে আমার ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে, আপনি আমার ভীষণ আপন কেউ।
ইয়াসিরের মনে সুপ্ত এক অনূভুতির সঞ্চরণ হচ্ছে। এই অনূভুতি এত বছরে আগে একটিবারও হয়নি। রুহানির মাথায় হাত রেখেই ইয়াসির। ক্ষীণকণ্ঠে বলে,
— তুমি বড্ড ভালো মেয়ে। একদম আমার স্ত্রী’র মতো।

কথাটি বলে ইয়াসিরের চোখের কোণে জল ছলছল করে উঠল। রুহানি শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিল, কি হয়েছে আপনার স্ত্রীর? কিন্তু ইয়াসির রেদোয়ান রুহানির প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর দেননি। ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— অনেকটা সময় পাড় হয়ে গেছে। আমাকে এখন উঠতে হবে। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে অনেক ভালো লাগলো।
কথাটুকু বলে ইয়াসির চলে যাচ্ছে। ও’র যাওয়ার দিকে তাকাতে হতাশাজনক শ্বাস ফেলল রুহানি। মন বলছে, কোনো এক অমূল্য কিছু রুহানির কাছ থেকে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। মন কে পাত্তা না দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয় রুহানি।

মি.মাহিনের বাড়িতে উল্লাসের কোনো কমতি নেই। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় কতশত মানুষের আনন্দ। একা হাতে সামলাচ্ছে সুমাইয়া চৌধুরী। উনার ননদ দু’জন পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। একটু এগিয়ে এসে সুমাইয়া চৌধুরীর সাথে কাজে হাত লাগাবেন সেদিকে কোনো হুঁশশ নেই। সুমাইয়া চৌধুরী ক্লান্ত হলেও বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাচ্ছেন না।

রুমের মধ্যে দরজা বন্ধ করে সকলে বসে গল্প করছে। অন্যদিকে রুহানির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে হাত গুঁজে গম্ভীর চিন্তায় মগ্ন হয়েছে সে। চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে ইয়াসির রেদোয়ান এর মুখখানি। কানে বারি খাচ্ছে ইয়াসির রেদোয়ান এর কণ্ঠস্বর ও হাসির শব্দ।
শ্যামা রুহানির পাশে এসে দাঁড়ালো। দুষ্টু হাসি হেসে ঠেস মে’রে বলল,

— কিহহ! নিশ্চয়ই এ.স স্যারের কথা চিন্তা করছিস?
রুহানি ঘুরে তীক্ষ্ণ চোখে শ্যামার দিকে তাকালো। কিছু বলতে যাবে তার পূর্বে বারান্দার দরজার সামনে থেকে রাইসা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল,
— রুহানি! ও’ কেন আমার বেবস কে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে যাবে?
রাইসার কথা কর্ণকুহরে আসতে বিরক্তিকর মনোভাব পোষণ করে শ্যামা রাইসার দিকে তাকাল। কর্কশকণ্ঠে শুধালো,

— এ.স স্যার তোর বেবস কিভাবে হলো? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এ জেনো মাথার ওপর প্লেন যাওয়ার মতো উড়ে চলে গেলো।
রাইসা মুখ ফসকে একটি কথা বলে ফেলল এতে শ্যামা বিরক্ত হয়ে রাইসার কপালে টুকো দিয়ে আরও বলল, তোর সব কিছু তে বাড়াবাড়ি না করলে হয় না? যা গিয়ে রুমে বসে থাক।
রুহানি ত্রস্ত কণ্ঠে বলল,

— ছাড়তো ও’র কথা। তুই এখন আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে। তোকে রেডি করতে মেক-আপ আর্টিস্ট কি বাড়িতে আসবে, নাকি পার্লারে যাওয়ার কোনো উপ্রে ঝামেলা আছে?
শ্যামা বারান্দার গ্রিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে শানিতকণ্ঠে বলল,
— বাবা তো তখন বলল, উনি সব ঠিক করে রাখছেন। মেক-আপ আর্টিস্ট বাড়িতে আসবেন। কথাটি বলে শ্যামা চলে যেতে নিলে রুহানি ও’কে উদ্দেশ্য করে আরও বলে,

— আরও একটা প্রশ্ন বাকি রয়ে গেছে।
শ্যামা হেঁটে রুহানির সামনে দাঁড়িয়ে, নেত্র যুগল কুঁচকে বলল,
— কি প্রশ্ন?
রুহানি ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে, বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক, নির্বাক্য দাঁড়িয়ে রইল। শ্যামা রুহানির কাঁধে হাত রেখে ও’কে ঝাঁকিয়ে বলল,

— কি রে কি হয়েছে বল।
রুহানি আঁড় দৃষ্টিতে শ্যামাকে দেখে নেয়। জড়ানো কণ্ঠে বলে,
— এ.স নামক ব্যাক্তিকে কাল হলুদের ফাংশনে দেখলাম।
শ্যামা নির্নিমেষ উত্তর দেয়,

— হ্যাঁ ওইযে ওইদিন রাতে উনি তোকে আমাদের বাসায় ড্রপ করতে আসলেন। তারপর বাবার সাথে অনেকক্ষণ বসে গল্প করেন। তখনই বাবা বিয়ের কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করেন। উনি বলেন, আসবে না কিংবা আসতে পারবেন না৷ উনার বিজনেস তো উনাকে দেখতে হয়। পরেও বাবা উনার হাতে ধরে অনেকক্ষণ রিকুয়েষ্ট করার পর উনি রাজি হন আসবেন। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না।
শ্যামা চলে যেতে রুহানি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— আচ্ছা জ্বালা হয়েছে আমার কেন আসতে হবে? অসভ্য একটা।

কেউ একজন দরজায় নক করল, দরজা খুলে দিতে মিসেস সুমাইয়া রুমে আসলেন। বারান্দায় রুহানির কাছে গিয়ে তার হাতের পার্সেলটা উনি রুহানির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— এটা তোমার। সুমাইয়া আরও কিছু বলতে যাবেন। তার পূর্বে মি.মাহিনের ডাক পরল। উনি তারাহুরো করে চলে গেলেন। রুহানি রুমে এসে পার্সেলের প্যাকিং খুলল।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৩

অবাক চোখে ওর বন্ধু বান্ধবীদের দিকে তাকাচ্ছে। তাত্ক্ষণিক পার্সেলটাতে কড়া দৃষ্টিতে তাকাই নীল’ এর মাঝে শুভ্র সাদা রঙের শাড়ি। চেরি কাপড়ের অসম্ভব সুন্দর ডিজাইনার জর্জেট শাড়ি। শাড়ির ওপরে একটা চিরকুট। চিরকুটটা হাতে নিয়ে মলাট খুলে পড়তে লাগল রুহানি। চিরকুটে লিখা-
— ” ঔই শুনো ভালোবেসে খানিকটা নীল ছুঁয়ে দিও,
আমি নীল’এর মাঝে শুভ্র মেঘের মত করবো বিচরণ।”

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৫