বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৩২

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৩২
শারমিন আক্তার বর্ষা

তীক্ষ্ণ চোখে তাকাই আছে আরিশ গাড়ির সাইড মিরর দিয়ে। হিংসে হচ্ছে ভীষণ হিংসে হচ্ছে। তাজ দ্রুত পায়ে ব্রেক কষলো। বা’হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে নাকের ডগায় চুলকে গাড়ি থেকে নামে আরিশ। দ্রুতগামীর মতো ছুটে যায় রুহানির কাছে। একহাত ধরে টেনে তুলে ফেলল। পরণে জামা কাপড়ে ধুলো লেগে আছে। রুহানি কে আচমকা টান মারায় কিছুটা হকচকিয়ে ওঠে ডাক্তার শীষ। শীষ ওঠে দাঁড়াল। রুহানির একহাত ধরে টানতে লাগল। একপাশে শীষ ও অন্য পাশে আরিশ। দু’জনে দু হাত ধরে টানছে। শীষ শক্ত হাতে রুহানির হাত ধরে বলল, ‘ওহ হ্যালো। হাত ছাড়ুন।’

আরিশ হুংকার দিয়ে বলল, ‘তুই ওর হাত ছাড়।’
কেউ কারো কথা কানে নিচ্ছে না। দু’জনে দু’জন কে হুম-কি দিচ্ছে। হাত না ছাড়লে এটা করবে সেটা করবে। বেঞ্চে বসেই উৎসুক ভাবে ওদের দুজনকে দেখছে ওরা। শীষ বলল,
‘আপনি কে এটা বলার আমি ওর হাত ছাড়বো কি ছাড়বো না?’
আরিশ গলা খাঁকারি দিলো, শান্ত গলায় বলল, ‘আমি ওর ভাই। মামাতো ভাই।’
আরিশের কথা কর্ণপাত হতে রুহানি সহ ওর বন্ধুদের মুখ হা হয়ে গেছে। শীষ রাগী গলায় বলল, ‘আপন ভাই তো নন। এখন যান এখান থেকে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দাত চিবিয়ে বলল, ‘আমি ওর বয়ফ্রেন্ড।’
‘দেখে তো মনে হচ্ছে না। তাছাড়া রুহানি আমাকে বলেনি ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে বলে। যান তো আপনি এখান থেকে তাছাড়া আমি এখানে রুহানি কে প্রপোজ করতে আসছি। শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে।’
আরিশ রেগে শাসিতকণ্ঠে বলল, ‘রুহানি শুধু আমার। ও-কে টাচ্ করার অধিকার আমার। ও আমার না হলে অন্য কারো হবে না। বিয়ে করলে আমাকেই করবে।’
‘হইছে হইছে যান এন্তে।’

রাগী চোখে রুহানি ও শীষের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে নেয় আরিশ। আরিশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কাটে শীষ। রুহানির হাত ছাড়তে সে একটু ধম নেয়। শীষ বলে ওদিক টায় বলো। গিয়ে বসি। আরিশ কিছুটা পথ হেঁটে চলে যায়। আবার হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো পিছনে ঘুরে ওদের যেতে দেখে এক প্রকার দৌঁড়ে আসল। আরিশ চট করে রুহানির হাত ধরে টান মারে। রুহানি অবাক চোখে তাকায়। আরিশ দ্রুত হাত ধরে টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শীষ মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলে হেঁটে যাচ্ছে। পাশে যে মানুষ টা নেই। সেদিকে খেয়াল নাই। মুখ বড়সড় করে আরিশের কান্ড গিলছে রুহানির বন্ধুরা ও মিটমিট করে হাসছে। প্রবীর কে গাড়ির পেছন থেকে সামনে পাঠিয়ে দেয়। ও নিজে পেছনে রুহানি কে নিয়ে বসে। তাজকে সোজা বাড়ি যাওয়ার জন্য বলে। রাস্তা থেকে একজন কাজী কে তুলে নেয়। ইয়ানা বাড়ি নেই, ওর বাবা মা চলে যাবে বলে এয়ারপোর্টে গেছে।

বাড়ি তে ইয়াসির একা ছিল। কাজী সমেত হাজির হল। ইয়াসির কে এনিয়ে বিনিয়ে বিয়ে তো রাজি করায়। শেষ মূহুর্তে বেঁকে বসে রুহানি। সে তাকে বিয়ে করবে না কেননা সে তাকে কষ্ট দিয়েছে। রাগে ফুঁসছে আরিশ। ভয়ে রেজিস্ট্রি কাগজে সাইন করলো। কাজীর যেতে উপস্থিত হল ইয়ানা। সে আরিশের দিকে তেড়ে আসল। কিন্তু কিছু বলল না।
রুহানি দ্রুত তার রুমে চলে যায়। ইয়াসির আরিশের কাঁধে হাত রাখে আর বলে, দেখলে তোমার ইচ্ছে পূরণ হল। আরিশ ই হয়েছে তোমার মেয়ের জামাই। মৃদু হেসে চলে গেলো ইয়াসির।
ইয়ানা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে, তুমি রুহানির থেকে দূরে থাকবে। রুহানি তোমার কাছে ফিরতে চাইলে ও-কে দূরে সরিয়ে দিবা। কিন্তু তুমি তোমার কথা রাখোনি।’
আরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘মামণি। ওইদিনের রাতের ঘটনা আমারও মনে আছে। আমি কত বার তোমার কাছে মিনতি করেছি। মামুর কাছে ফিরে আসো। রুহানি কে আমায় দান করো। কিন্তু তুমি কি শর্ত দিয়েছিলে, তোমার জীবনের ভুল তুমি দ্বিতীয় বার করতে চাও না। অনেক বুঝানোর পর শর্ত দিয়েছিলে, তুমি ফিরবে না। তবে তোমার মেয়ে তার বাবার পরিচয় ভালোবাসা পাবে। যদি আমি তাকে প্রত্যাখান করি ও নিজে তোমাদের থেকে দূরে সরে যাই। বিশ্বাস করো মামণি আমিও সেটাই করছিলাম। কিন্তু কি জানো? রুহানির ধারেকাছেও আমি কোনো ছেলেকে সহ্য করতে পারিনা। তোমাকে দেওয়া শর্তের জন্য আমি রুহানি কে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আর পারবো না। শুনেছি ছোট বেলায় তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসতে তবে এখন কি হয়েছে মামণি৷ কেনো শর্ত দিয়ে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছো?’

আরিশের কথার প্রতিত্ত্যর করল না ইয়ানা। মাথা নিচু করে চলে যায়। মনে মনে বলল, ‘তোকে আপন করতে না পারার কারণ হচ্ছে তোর বাবা। তখন তো আমি জানতাম না তোর বাবা কে। জেনেছি তো কানাডা খালার থেকে। তোর বাবার জন্য আমার বড় বোন।’

চোখের কোণে জল মুছে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলো ইয়ানা। সন্ধ্যার পর পর বাড়ি ফিরে আসলো ওর বন্ধুরা। আগামীকাল ভোরের ফ্লাইটে সবাই কানাডা ব্যাক করবে। রুহানির বিয়ের খবর শুনে সবাই চমকে ওঠে। এবং খুশি হয়। শুধু নারাজ নাজিন। নাজিন বলল ‘ও’ কাল যাবে না। ওর শরীর খারাপ এক সপ্তাহ পর যাবে। কেউ আপত্তি করল না। পরে নাজিনের সাথে রুহানিও চলে যাবে। রাতে এই নিয়ে আর কেউ কোনো কথা বলেনি।

আকাশে হাতে গোনা কয়েকটি তারা ও একটা বড় চাঁদ। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল রুহানি। পেছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল আরিশ। আরিশের স্পর্শে কেঁপে উঠল রুহানি।
নির্ঘুম রাত কাটছে নাজিনের সে কোনো ভাবে বিয়ে টা মানতে পারছে না। পুলিশের সাহায্য চেয়েছে। মোবাইল বের করার জন্য জিটি করেছে।

তিন ধরে বিয়ে হয়েছে। ভালোবাসা ও আনন্দে দিন কাটছে রুহানির। আল্লাহ জেনো সব খুশি তার আঁচলে ঢেলে দিয়েছে। রুহানির বিয়ের খবর শোনে তার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি শীষ। চার দিন পর বিয়ে বৈকি বড় করে আয়োজন করবেন ইয়াসির। আরিশ অফিসে গেছে। কিছুক্ষণ পর ফিরবে কল দিয়ে বলেছে। আজ ইচ্ছে করে সাজছে রুহানি। শাড়ি পরেছে কপালে টিপ, লিপস্টিক।

সন্ধ্যা ছয়টা দ্রুত ছুটে রুহানির রুমে ঢুকে নাজিন। হাঁপাচ্ছে মেয়েটা কপাল ভেজা। ঘামে জামা ভিজে পিঠের সাথে চিপকে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ ও-কে তারা করেছিল। কি হয়েছে জানতে চাইলো রুহানি।
নাজিন দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলল,
‘আমার হারানো ফোনটা পেয়েছি। একজন মধ্য বয়স্ক লোক ফোন টা বিক্রি করার জন্য নিয়ে ঘুরছিল। তার থেকে আমি আবারও টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে আসছি।’

‘ওহ এই ব্যাপার। সাধারণ একটা ফোনের জন্য এত প্যারা নিতে গেলি কেন? নতুন ফোন তো কিনেছিস। যাজ্ঞে যেভাবে হাঁপাচ্ছিস আমি ভাবলাম কি না কি আমান ভাইয়া তোকে দৌঁড়ানি দিয়েছে।’ বলে হাসতে লাগল রুহানি। রাগে দাঁত চেপে ধরে নাজিন। রুহানির হাত ধরে টেনে বিছানায় বসালো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘হাসপাতালে তো আমার কথা বিশ্বাস করিসনি। নে এখন শোন।’

রুহানির ফোনের সব গুলো সফটওয়্যার লক করা। তাই ভেতরের ছবি ভিডিও রেকর্ড কোনো কিছু কেউ ডিলিট করতে পারেনি। প্রথমে ফোন পরেছিলো একটা নেশাখোর ফট্টোলের কাছে তারপর সে একজন বোকাসোকা মানুষের কাছে মাত্র পাঁচশ টাকায় বিক্রি করে মদ খেতে চলে যায়। লোকটাও ফোনের কিছু বুঝতে পারছিল না। ফোন নিয়েও বিপদে পরেছিল বলে ঘুরছিল যদি কেউ কিনে নেয়। নাজিন পুলিশ স্টেশন থেকে ফেরার পথে রাস্তায় লোকটা কে দেখে। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফোনটা বিক্রি করার চেষ্টা করছে। রিক্সা থেকে নেমে ফোনটা হাতিয়ে দেখে। ওরই ফোন ওয়ালপেপারে ওরই পিক দেওয়া। লোকটার থেকে নিজেরই ফোন কিনে রিক্সায় বসে সব চেক দেয়। রেকর্ডিং টা এখনও সেভ আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

নাজিনের কাছ থেকে ভয়েস রেকর্ডিং শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় রুহানি। চোখের কার্নিশ বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে। আরিশের আড়ালে ওর ফোনে লোকেশন অন করে কানেক্ট করে নিয়েছিল। ওর জানতে হবে? ওর মনে যত প্রশ্ন ঘুরছে সব কিছুর উত্তর আরিশ কে দিতে হবে। নাজিন কে রুমে রেখে ফোন হাতে বেরিয়ে গেলো রুহানি। কান্না করছে কেনো ঠকালো কেন যেদিন নাজিনের কথা বিশ্বাস করল না?

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৩১

আরিশের ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে একটা জঙ্গলের মাঝামাঝি এসে গাড়ি থামালো রুহানি। চারিদিকে শুধু অন্ধকার বড় বড় গাছ সাথে অদ্ভুত পশুপাখির ডাক। ভয়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রুহানি বুঝতে পারছে না এই সন্ধ্যা বেলা এই জঙ্গলে কেনো আরিশের ফোনের লোকেশন দেখাচ্ছে? এখানে কেন আসছে আরিশ? ফোনের টর্চলাইট অন করে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো।
মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে,
‘তাহলে কি আরিশ কাউকে খু/ন করবে বলে এখানে আসছে?’

বিষাক্ত ভালোবাসা শেষ পর্ব