এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৬

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৬
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

তিতির তাও খাচ্ছে না দেখে মাশরিফ হুট করে এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসলো। এক পিস চিকেন কাটলেট তিতিরের মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে চাইল। আচানক কান্ডে তিতির হতবাক, হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল সেই সাথে টেবিলের বাকি সদস্যরাও। অর্কর কাশি উঠে গেছে। এখন শুভ তড়িঘড়ি করে ওর সামনে পানির গ্লাস ধরে। বেচারা দ্রুত গ্লাস নিয়ে পানিটুকু খেয়ে নেয়। মাশরিফ সবার অবাক দৃষ্টি দেখে চিকেন কাটলেটটা এবার নিজের মুখে পুরে নেয়! সে হাসার চেষ্টা করে বলল,

“সরি। উনি খাচ্ছিলেন না তাই।”
রাফি এবার শা*সানোর ভান করে বলে,
“এসব কী ধরনের ব্যাবহার মাশরিফ। তুই এভাবে একটা স্বল্প পরিচিত মেয়ের মুখের সামনে খাবার ধরতে পারিস না। ভদ্র হ।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাফির কণ্ঠস্বর কিছুটা জোড়েই হয়েছিল, যার দরুন আশেপাশের টেবিলের স্টুডেন্টরাও ফিরে তাকিয়েছে। ওদের তাকানো দেখে এবার রাফি আবার প্রায় ধ*ম*কে বলে,
“কী? কী দেখছ সবাই? নিজেদের খাবার খেয়ে বের হও। তিতির, তুমি খাচ্ছ না কেনো? কোনো সমস্যা?”
মাশরিফ রাফির দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে আছে। রাফি ইশারায় সামনে দেখতে বললে মাশরিফ ভ্রুঁ কুঁচকে সামনে তাকিয়ে দেখে তিতির খাচ্ছে। এবার তার মুখে হাসি ফোটে। রাফির দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলে ভাব নিয়ে বসেছে! মুচকি হেসে নিজেও খেতে থাকে।

বিকেলের সময়টাতে আজ রাফি, অর্ক, শুভর ডিউটি পরাতে ওরা ডিউটিতে যায়। মাশরিফ কি করবে! সেও সাথে গিয়ে ওয়ার্ডে ঘুরতে থাকে। ফাঁকে ফাঁকে বৃদ্ধ রোগীদের সাথে কথা বলা ও হাসানো শুরু করে।
তিতিরকে, ফাইজা, নাদিয়া ও জারিন জোর করে ওয়ার্ড এড়িয়াতে নিয়ে এসেছে। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আজান পরবে। ফাইজা একটু বেশি চঞ্চল। হাঁটতে হাঁটতে সে লাফাচ্ছে। বলছে,

“আমাদের যখন ওয়ার্ড ডিউটি শুরু হবে তখন আমি শিশু ওয়ার্ডেই ডিউটি নিব। যদি দেয় আরকি। এতো ভালো লাগে ইশ! বাচ্চারা কতো কিউট হয়।”
“আমি তো রোগীদের মাঝে বয়ফ্রেন্ড খুঁজব। রণকটা আমাকে একটুও পাত্তা দেয় না।”
ফাইজা ও জারিনের কথা শুনে তিতির মুখে হাত দিয়ে হাসছে। করিডোরে রোগীদের পরিবারের লোকজন ও ওয়ার্ড বয়, নার্সরা চলাফেরা করছে। নাদিয়া বলে ওঠে,

“শাফকাত বলল, সারাদিনে নাকি ওয়ার্ডে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পা ব্যাথা হয়ে যায়। আমার তো ভয়ই করছে।”
জারিন রম্যস্বরে বলল,
“শাফকাত! উপস! ডাঃ শাফকাতকে এখন নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। কতো ভালোবাসা আহা!”

ওদের ফা*জলামি দেখে তিতির হাসছে এরই মাঝে নজর যায় একটা ওয়ার্ডে। মাশরিফকে দেখা যাচ্ছে এক বৃদ্ধার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। বৃদ্ধা মহিলার সামনের পাটির একটা দাঁতও নেই। তার ফোঁকলা হাসিতে মাশরিফও হাসছে। তিতির কয়েক মূহুর্ত স্থির হয়ে দৃশ্যটা দেখল। কিছু সময় আগে ছেলেটার কর্মকাণ্ডে সে বড্ড বিরক্ত হয়েছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছেলেটা খুব প্রাণোচ্ছল। নিজের আশেপাশের মানুষকে হাসি-খুশি রাখতে ভালোবাসে। এটা দেখে তিতিরও হালকা হেসে আবার বান্ধবীদের সাথে চলতে থাকে। তার মস্তিস্কে চলছে কিছু একটা।

সুজন ও পলাশ লোকমুখে জানতে পেরেছে তিতিররা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে এবং সেই বাড়ি এক আর্মির লোক কিনেছে। আজ তাই তিতিরকে খুুঁজতে ফরিদপুর মেডিকেলে গিয়েছে। খুঁজে খুঁজে তিতিরের দুই বন্ধু হাসিব ও সাইফকে দেখল। কিভাবে এদের জিজ্ঞেসা করবে ভাবতে ভাবতে দেখে হাসিব মেডিকেল কলেজের বাহিরে যাচ্ছে। এই তো সুযোগ।

হাসিব টিউশনে যাবে বলে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে তখনি পলাশ ও সুজন পিছন থেকে হাসিবের কাঁধে হাত রাখে। হঠাৎ এমন হওয়াতে হাসিব ভড়কে ওঠে। সুজন পানের পিক ফেলে জিজ্ঞেসা করে,
“কী-রে কেমন আছোস?”
হাসিব হকচকিয়ে তাকায়। এদেরকে সে চিনে। তাই ওদের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়। পলাশ খিকখিক করে হেসে বলে,

“কী হইলো তোর? এমন করোস কেন?”
“আপনারা এখানে কেনো এসেছেন?”
“পাখির টানে আইয়া পরছিরে। এখন ভালো পোলার মতো কইয়া ফালাও তো, আমার পাখিডা কই?”
হাসিব এবার রেগে বলল,
“লজ্জা নেই আপনাদের? মানুষের পিছনে এভাবে হাত ধুঁয়ে পরেছেন কেনো?”
পলাশ বলে,

“শোনো, পুরুষ মানুষের লাজ-সরম থাকে না। লাজ-সরম তো মাইয়াগো ভূষণ! আমরা পুরুষ মানুষ। আমরা হমু লজ্জাহীন। লজ্জা পাইয়া মাইয়াগো মতন লুকায় থাকুম নাহি?”
হাসিবের মেজাজ তুঙ্গে। সে বলে,
“বে*হায়াদেরও লজ্জা থাকে না। জানেন? আপনার ওই ক্যাটাগরির। পথ ছাড়ুন।”
ওদেরকে ছাড়িয়ে হাসিব সামনে একটা রিকশা পেয়ে তাতে চ’ড়ে বসে।
হাসিবকে চলে যেতে দেখে সুজন বলে,

“এই শা* কইতো না। ধরতে হইবো ময়নাপাখির মাইয়া সই গুলারে। পোলাগুলা ডরায় কম। মাইয়াগুলায়তো ডরে সব কইয়া দিবো।”
“ঠিক কইছোস।”

সকালে একটা ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরীতে বসে তিতির ও ওর বান্ধবীরা পরের ক্লাসের পড়া পড়ছে। তখন লিরার ফোনে মেসেজ আসে,
“হোয়ার আর ইউ গাইজ? তিতির কোথায়?”
শুভর মেসেজ দেখে লিরা নিজেদের লোকেশন মেসেজ করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে রাফি, শুভ লাইব্রেরীতে হাজির হয়। প্রথমে একটু অবাক হওয়ার ভাণ করে বলে,
“ও তোমরা এখানে? আমি ও রাফি তোমাদের মনে মনে খুঁজছিলাম।”
জারিন জিজ্ঞেসা করে,

“কেনো ভাইয়া? আগে তো আমাদের এতো খুঁজতেন না। বরং আমরাই আপনাদের খুঁজে খুঁজে বের করতাম। তাও ঠিক মতো খুঁজে পেতাম না। কিন্তু ইদানীং পা*শা পালটে গেছে দেখা যাচ্ছে।”

জারিন কিছুটা জোড়েই কথা বলে ফেলেছে। যেহেতু লাইব্রেরী তাই সব সাইলেন্ট থাকে। যার ফলপ্রসূ বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা ঘুরে তাকিয়েছে। রাফি হালকা কেঁশে বলে,
“কাজের জন্য খুঁজছিলাম। যাইহোক তিতির, তোমার জন্য বাসা ভাড়া পেয়ে গেছি।”
তিতির অবাক ও খুশি দুটোই হয়।

“সত্যি ভাইয়া? কী বলে যে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না।”
“আরে ধন্যবাদ দিতে হবে না। আমরা সিনিয়র জুনিয়র। শোনো, বাসাটাতে দুইটা বেডরুম, ওয়াশরুমও দুইটা। কিচেন ও একটা ডাইনিং। ভাড়া সাত হাজার। কারেন্ট বিল নিজেদের আর সিলিন্ডার গ্যাস ব্যাবহার করতে হবে। এর নিচে পাইনি। রুমগুলো ছোটোই। ছোটো রুম ও জায়গাটা মফস্বল বলে ভাড়া তুলনামূলক কম।”
নাদিয়া বলে ওঠে,

“এরকম বাসার ভাড়া ঢাকা শহরে ১৩-১৫ হাজারের কম পাবোই না। মানে আমাদের এলাকায়। জায়গা অনুসারে সবকিছুরই মূল্য নির্ধারিত হয়।”
তিতির বলে,
“কারেন্ট বিল ও গ্যাস মিলিয়ে আট হাজারে হয়ে যাবে তবে।”
“হ্যাঁ এমনই। তোমার ভাইয়া তো নেই তাই না?”
শুভর প্রশ্নের জবাবে তিতির প্রথমে না ভেবেই বলে,
“হ্যাঁ। ভাইয়া নেই। ওয়েট, আপনি কিভাবে জানেন?”

শেষে তিতিরের সন্দিহান প্রশ্নে শুভ থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে কিছু বলবে তার আগেই রাফি চট করে বলে ওঠে,
“তুমি বলেছিলে, তোমার মা, ভাবী, ভাতিজি সহ ওঠবে। কিন্তু ভাইয়ের কথা বলোনি। তাই হয়তো শুভ জিজ্ঞেসা করেছে।”
“ওহ। আসলে ভাইয়া মা*রা গেছেন। ভাতিজির জন্মের আগেই। তাই এই তিনজনই আমার পরিবার।”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৫

“সরি। আমার প্রশ্ন করাটা ঠিক হয়নি।”
“ইটস অকে ভাইয়া। আপনারা আমার জন্য এতোকিছু করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”
রাফি ও শুভ হালকা হেসে সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু কেউ একজন যে এসব দেখে কথা লাগাতে চলে গেছে তা ওদের ধারণাও নাই।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৭