এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৭

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৭
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

একটা ছেলে দৌঁড়ে যায় একটা মেয়েদের গ্রুপের কাছে। গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
“ইনায়া আপু, শোনো।”
ইনায়া তাকালে ছেলেটা দ্রুত বলে,
“তাজা খবর আছে আপু।”

ইনায়া তখন চকোলেট খাচ্ছে। মুখ ভর্তি চকোলেট নিয়ে ভ্রুঁ কুঞ্চন করে হাত দিয়ে ইশারা করে বলতে বলে। ছেলেটা অতি উৎসাহী হয়ে বলল,
“কয়েকদিন ধরে দেখছি, রাফি ভাইদের একটা মেয়ের সাথে খুব ভাব!”
ইনায়া এবার আচমকা দাঁড়িয়ে যায়। সরাসরি প্রশ্ন করে,
“কার সাথে? কোন ব্যাচের? মেয়ের নাম কি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ছেলেটা ভড়কে যায়। আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে আপু, মেয়েটাকে চিনি না। কয়েকদিন ধরে দেখছি।”
ইনায়ার বান্ধবী আরভি বলে,
“নতুন ব্যাচ তো এখনও আসে নাই। তাহলে নতুন কে আসলো?”
ছেলেটা বলে,

“রণক, ইমরান ভাইদের সাথে দেখেছি দুইদিন। মনে হয় মাইগ্রেশন করে এসেছে।”
ইনায়া কিছু চিন্তা করে বলে,
“মেয়েটার নাম কিরে অনিক? দেখতে কি খুব সুন্দরী?”
অনিক নামের ছেলেটা থতমত খেয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কি যে বলেন না আপু! আপনার থেকে সুন্দর হয় নাকি? আপনি তো হচ্ছেন ক্যাম্পাসের মিস ইউনিভার্স!”
ইনায়া বিরক্ত হয়ে বলে,

“অনিক, তোকে মানা করেছি না? অতিরিক্ত পাম দেওয়ার চেষ্টা করবি না। তুই একই পাম রিনি আপুকেও দেস। কয়দিন পর যদি জানতে পারিস, যেই মেয়েটার সম্পর্কে বলতে আসছিস, সেও তোর সিনিয়র! তখন তো তাকেও পাম দিবি। ”
অনিক মাথা চুলকে দাঁত দিযে জিভ কা*টে। তারপর বলে,

“ওই মেয়েটার জন্য রাফি ভাই তার ফ্রেন্ডদের সাথেও কাল ক্যান্টিনে ঝ*গড়া করেছে।”
ইনায়া এবার রেগে চকোলেটটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে যেতে যেতে বলল,
“বিকেলে ওই মেয়েকে আমার সামনে হাজির করবি। আমিও দেখব রাফির চয়েজ।”
ইনায়াকে চলে যেতে দেখে আরভি, দিয়া, তাইজুল, তাওহীদ এসে অনিককে ঘিরে ধরে। তাইজুল অনিকের মা*থায় চা*টা মে*রে বলে,

“তুই সব ক্লিয়ার না হয়ে এসে বলিস কেন? যদি খবর মিথ্যা হয় তাহলে তুই রাফি ভাইদের ও আমাদের দুই গ্রুপের কাছেই কে*লানি খাবি। যদি সত্যি হয় তবে আমাদের হাত থেকে বেঁচে যাবি কিন্তু..!”
রহস্য রেখে তাইজুল, তাওহীদরা চলে যায়। ওরাও চলে গেলে অনিক মা*থায় হাত দিয়ে বসে পরে।

আজকে মাশরিফ ময়মনসিংহতে যাবে না। আজ ঢাকায় হেডকোয়াটারে যেতে হয়েছে কিছু কাজের জন্য। বিকেলের মধ্যে ফিরতে পারলেও আজ যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আগামীকাল ৪ অক্টোবর, নিজের ছাব্বিশ তম জন্মদিন। তাই আগামীকাল যাবে ময়মনসিংহতে। কাল আবার অভী, রাতুল, রণিতরাও আসবে। সাত বন্ধু একসাথে হবে।
ভোরে বাসা থেকে বেরিয়েছিল। এখন বারোটার বেশি বাজে।

ভাবলো বোনের বাসায় যাবে একটু। বোনের ছেলেটা ফোন করলেই আসার জন্য বায়না ধরে। বোনের ছেলের জন্য একটা ভিডিও গেম কিনতে একটা শপিংমলের টয় শপে যায়। সেখান থেকে পছন্দ মতো ভিডিও গেম কিনে শপিংমল থেকে বেরিয়ে আসবে তখন একটা লেডিস শপে ঢুকলো। দোকানটা নরমাল স্টোন জুয়েলারি ও হিজাবের। চুড়ি ও দুলগুলো তার নজর কেড়েছে। নিজের পছন্দের লাল রঙের এক জোড়া ডিজাইনার রেশমি চুড়ি ও তিতিরের পছন্দের সাদা ডিজাইনার রেশমি চুড়ি নিয়ে নেয়। পাশেই হিজাবের কালেকশনে একটা সুন্দর হিজাবও পছন্দ হয়েছে। এগুলো নিয়ে নিজেই মুচকি হেসে বলে,

“জন্মদিন আমার কিন্তু গিফট পাবে তুমি। সাঁজবে তুমি। আমি নাহয় এখন দূর হতেই দেখব। তিতিরপাখির হাতে শোভা পাওয়া চুড়ির খনখন ঝংকারে আমি বারেবারে আ*হ*ত হবো। প্রাণে মা*রা যে দায়।”
সবকিছুকে সুন্দর করে রেপিং করে নেয়। গিফট বক্সের ভিতরে একটা ছোটো চিরকুট থাকবে যা সে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে লিখে দিয়েছে। এরপর শপিংমল থেকে বেরিয়ে বোনের বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা করে।

বোনের বাসায় যেতে যেতে বেলা দেড়টা বেজে গেছে। কলিংবেল চাপলে রিতিকা দরজা খুলে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“এখন সময় হলো তোর আসার? সেই কখন বলেছিস আসবি। এতক্ষণ কই ছিলি?”
মাশরিফ বোনের গাল টেনে হেসে বলে,

“জানিস আপু? তোকে রাগলে খুব কিউট লাগে। গা*ল গুলো টমেটোর মত লাল লাল হয়ে যায়। দুলাভাই তো তোকে কখন জানি ভুল করে টমেটো ভেবে না খে*য়ে ফেলে!”
রিতিকা মাশরিফের ফা*জলা*মিতে আরও রেগে যায়। বাহুতে মে*রে বলে,
“আমাকে না রাগালে তোদের হয় না তাই না? দুই বাপ-ছেলেতে তো সারাদিন জ্বা*লায়। এখন তুইও এসে হাজির।”
মাশরিফ মুচকি হেসে গম্ভীর হওয়ার ভাণ করে বলে,

“তাহলে চলে যাই?”
রিতিকা কপাল কুঁচকে মাশরিফকে টেনে বাসার ভেতরে আনে। মাশরিফ হাসতে থাকে। রিতিকার ছেলে রিয়ান ‘মামা’ বলে দৌঁড়ে আসে। মাশরিফ ওর হাতে ভিডিও গেমটা দিয়ে কোলে তুলে নেয়। বলে,
“কেমন আছে মেজর রিয়ান কবির?”
“গুড স্যার।”
রিয়ান নিজের হাত স্যালুটের মতো করে বলাতে মাশরিফ আবারও হাসে। রিতিকা ওদের দুষ্টুমি দেখে তাড়া দিয়ে বলে,

“রিয়ান, মামার কোল থেকে নামো। মাশরিফ যা ফ্রেশ হ। তোর দুলাভাই একটু পরেই চলে আসবে।”
এই বলে রিতিকা রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। মাশরিফ রিয়ানকে নিয়ে সোফায় বসে খেলতে থাকে। এই ফাঁকে রিতিকা জুস দিয়ে গেছে। মামা-ভাগ্নে মিলে গল্প করতে করতে আবার কলিংবেল বেজে উঠলে মাশরিফ গিয়ে দরজা খুলে দেখে তার দুলাভাই সায়ান এসেছে। সায়ান ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

“কেমন আছো মাশরিফ? তোমার বোন আমাকে ফোন করে করে পুরো পা*গ*ল করে ফেলছিল, তাড়াতাড়ি আসার জন্য। এখন তুমিই বলো, ক্লাস শেষ না হলে কিভাবে আসি?
রিতিকা রান্নাঘর থেকে ডাইনিং টেবিলে খাবার আনতে আনতে বলল,
“তোমার শুধু আছেই ক্লাস। আর কিছু না। যাও ঝটপট গোসল সেড়ে আসো আর মাশরিফ হাত-মুখ ধুঁয়ে আয়।”

“দেখলে? তোমার বোনের খালি তাড়া।”
“এই তুমি যাবে? গুনে গুনে পাঁচ মিনিটে টেবিলে এসে বসবে। তোমার দেরি করে আসার শাস্তি এটা। এখন যদি দেরি হয় তো দেখো শুধু।”
রিতিকার হু*ম*কিতে সায়ান দ্রুত চলে যায়।

খাবার টেবিলে খেতে খেতে সায়ান জিজ্ঞেসা করে,
“মাশরিফ, বিয়ে করছ কবে?”
“পরে দুলাভাই। এখনি না।”
রিতিকা বলে ওঠে,
“কাশফা তো বিয়ের জন্য উতলা হয়ে আছে।”
মাশরিফ বিরক্ত হয়। বিরক্তি নিয়ে বলে,
“তো তাকে বলো বিয়ে করে নিতে।”
“আরে ও তো তোকে বিয়ে করতে চায়।”
মাশরিফ ঘন নিঃশ্বাস ফেলে সরাসরি বলে,

“সরি আপু। তোমার সাথে যদি কাশফার কথা হয় তবে বলে দিও, ‘মাশরিফকে বিয়ে করার স্বপ্ন যেন বাদ দেয়।'”
রিতিকা অবাক হয়ে বলে,
“এভাবে বলছিস কেনো? মেয়েটা কতো ভালো জানিস। সবসময় নিজে থেকে খোঁজখবর নেয়।”

“যেমনি হোক। তাকে আমার পছন্দ না।”
সায়ান এই দুই ভাই-বোনকে থামাতে বলে,
“থামো তো তোমরা। আর রিতি, মাশরিফ পছন্দ করে না তাও কেনো তুমি ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখছ? মাশরিফের যাকে ভালো লাগে তাকে বিয়ে করবে। এই নিয়ে আর একটা কথাও বলবে না।”
“হ্যাঁ! তোমরা তো নিজেদের দিকটাই ভাবো। ওদিকে কাশফা মেয়েটা কতো কাঁদে তা তো দেখো না।”

রিতিকার কথাগুলো মাশরিফের ভালো লাগছে না। দ্রুত খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যায়। পেছোনে রিতিকা, সায়ান অনেকবার ডেকেও থামাতে পারে না। সায়ান বিরক্ত হয়ে বলল,
“কেনো রিতি? তোমার কিছু না বললে ভালো লাগে না নাকি? আজব তুমি!”
সায়ানও রাগ করে নিজের ঘরে চলে যায়। রিতিকা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় বসে থাকে।

তিতির, জারিনরা বিকেলে সবে ক্লাস শেষে বের হয়ে ক্যান্টিন থেকে ওয়ান টাইম কাপে চা নিয়ে ক্যাম্পাসে এসে বসেছে। গল্প করছে আর চা খাচ্ছে। তিতির বলল,
“বাসা ভাড়া পেয়েছি এইটা মাকে জানানো মাত্রই মা ব্যাগ গুছানো শুরু করে দিয়েছে। মনে হয় কালকেই চলে আসবে।”
কথাটা বলেই তিতির হেসে ফেলে। লিরা জিজ্ঞেসা করে,
“টুমি হোস্টেল ছেড়ে দিবে?”

“না। আসলে বুঝতে পারছি না। যখন রাতেও ফরেনসিকের কাজ থাকবে তখন তো লাগবে। দেখি সামনে কী হয়।”
অনিক নামের জুনিয়র ছেলেটা তিতিরদের আড্ডার মাঝে এসে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আপুরা, ভাইয়ারা।”
ইমরান বলে,

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস?”
“জি ভাই ভালো। আপনারা কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। তো হঠাৎ এখানে?”
অনিক বুকে সাহস সঞ্চার করে বলে,
“এই আপুটাকে(তিতিরকে দেখিয়ে) ইনায়া আপু ডাকছে।”
জারিন, নাদিয়া, ফাইজা, লিরা, জুলিয়া সবাই অবাক হয়ে গেছে। রণক কপাল কুঁচকে শুধায়,

“ইনায়া আপু হঠাৎ তিতিরকে কেনো ডাকবে?”
জারিন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেসা করে,
“ইনু আপুকে তুমি কিছু বলেছ অনিক? ইনু আপু তিতিরকে ডাকবেই বা কেনো?”
অনিক পরেছে মহা ফাঁসাদে। সব সিনিয়াররা এবার তার ব্যান্ড বাজাবে। সারাজীবন সে এভাবেই ধো*লা-ই খেয়ে খেয়ে এসেছে। অনিক ক্যাবলার মতো হেসে বলল,
“হে হে। আমি আবার কী বলব? না তো। আমি তো কিছু বলিনি। আমি তো এই আপুকে(তিতিরকে উদ্দেশ্য করে) চিনিই না। আপু কি নতুন?”

ইমরান ধরে ফেলেছে অনিকের কাজ। তাই হাসার ভাণ করে বলল,
“না বাছা। সেও তোমার সিনিয়র। মাইগ্রেশনে এসেছে তো। তুমি বুঝতে পারোনি। তাই না?”
অনিক আমতা আমতা করছে দেখে রণক উঠে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“সবাই তোর সিনিয়র। তুই কেনো এই ঝামেলাতে যাস?
“সরি ভাই। আমি বুঝি নাই এই আপুও আমার সিনিয়র। আর হবে না। মাফ করে দেন।”
অনিকের কাকুতি-মিনতিতে ইমরান হাই তুলে বলল,

“তোর যে আরও হবে সে জানি। যা এখান থেকে। তিতিরের সাথে আমরাও যাব।”
অনিক দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। তিতির এবার জিজ্ঞেসা করে,
“ইমরান, ও কে?”
“আর বলিস না! এই ছেলের স্বভাবই এমন। জুনিয়র।রইনায়া আপুরা যা করতে বলে সব করে। এতো বাঁ*শ খায় তারপরেও শুধরায় না। এতো ব*ল*দ যে মানুষ কেমনে হয় তাই বুঝি না। অবশ্য সে নজর রাখে রাফি ভাইয়ের দিকে। আর কারও দিকে নজর রাখে না। ইনায়া আপুই রাখতে বলেছে।”
তিতির অবাক হয়ে শুধায়,

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৬

“তাহলে আমায় কেনো ডাকছে? আমি কী করলাম?”
জারিন গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“সেটা গেলেই দেখতে পারবি। চল এবার। ভয় পাস না। ইনু আপু একটু রাগী কিন্তু এমনিতে ভালোই।”
ওরা ইনায়াদের কাছে যাওয়ার জন্য ওঠে।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৮