এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৮

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৮
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

ইনায়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিতির। ইনায়ার দুর্বোধ্য দৃষ্টি তাকে বারেবারে অপ্রস্তুত করে তুলছে। বুঝতে পারছে না তাকে এভাবে ঘুরে ঘুরে দেখার কারণটা কী! তিতির নিজের একপাশে জারিন ও নাদিয়ার দিকে তাকালো তো আরেকপাশে ফাইজা, ইমরান, রণকের দিকে। ওরে কেউ দাঁত দিয়ে নখ কা*টছে তো কেউ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় তিন-চার মিনিট হলো এভাবে নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবার তিতিরের বিরক্ত লাগছে। ইদানীং তার বিরক্তি যেনো ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। অল্পতেই মাথা গরম হচ্ছে। নিজের এই স্বভাবে সে নিজেও বিরক্ত। কিছুটা রুষ্টভাবাপন্ন হয়েই বলল,

“আপু, আপনি কি কিছু বলবেন? না বললে আমি হোস্টেলে যেতাম। শরীরটা ভালো লাগছে না।”
ইনায়ার বান্ধবী আরভি তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“কেনো হোস্টেলে তোমার কী কাজ? সিনিয়ররা ডেকেছে, কিছু তো নিশ্চয়ই বলবে। এতো অধৈর্য কেনো তুমি? রাফি ভাইরা ডাকলেও কি এমন করো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তিতির চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজের ফুসফুসকে স্বস্থি দিলো। বলল,
“না আপু। প্রায় অনেকক্ষণ হলো কিছু বলছেন না। তাই ভাবলাম হয়তো আমাকে দেখতে ডেকেছেন। আর আমাকে এভাবে সামনে দাঁড়া করিয়ে দেখাটা আমার কাছে একটু অস্বস্থিকর। শুধু আমি কেনো! যেকোনো মেয়ের কাছেই।”
তিতিরের কথায় ইনায়া মাথা নিচু করে হাসল। অতঃপর শুধায়,
“তোমার চুলের লেন্থ কতো?”

হঠাৎ এহেনো প্রশ্নে অবাকই হলো তিতির। জবাবে প্রশ্ন করল,
“বুঝলাম না আপু।”
“তোমার হিজাবের কারণে চুল দেখতে পাচ্ছি না। রাফির তো লং হেয়ার পছন্দ। লাইক দিস (নিজের চুল দেখিয়ে)! মানে হাঁটু ছুঁইছুঁই লম্বা চুল।”
তিতির হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“কার কেমন চুল পছন্দ তা জেনে আমি কী করব? তাছাড়া রাফি ভাইয়ার কেমন চুল পছন্দ তা যেনে তো আমার কোন কাজ নেই।”

“এতো ভাব নিয়ো না বুঝছ। রাফির সাথে তোমার এতো কিসের খাতির? এখন যদি কমন ডায়লগ দাও যে, সিনিয়র হয়। তাহলে বলব, সিনিয়র কি আর নাই? এই তাইজুল, আসফি, তাওহীদরাও তোমার সিনিয়র হয়। আর ছেলে সিনিয়র ছাড়া মেয়ে সিনিয়রও আছে।”
তিতির জবাব কী দিবে বুঝতে পারছে না। কী এক ঝামেলায় পরেছে। মেয়েটা যে জে*লাস তা সে বুঝে গেছে। নিজের কপালে নিজেরই বা*ড়ি দিতে মন চাইল। সে নিজের বক্তব্য রাখল,

“আপু, আপনি যা মিন করছেন তার কিছুই না। উনারা আমাকে হেল্প করেছেন। চাইলে আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ওয়েট,”
এই বলে তিতির হুট করে হাঁটা ধরল। হেঁটে কই যেনো যেতে লাগল। ইনায়া তিতিরের আকস্মিক চলে যাওয়াতে যারপরনাই অবাক হলো। ইনায়া বলল,
“ও এভাবে চলে গেল কেনো? আমি কি ওকে যেতে বলেছি?”
লিরা হাসি চেপে বলল,

“সি উইল বি ব্যাক। মেইবি, রাফি ভাইকে বলটে গিয়েছে।”
ইনায়ার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। হড়বড়িয়ে বলল,
“আজব! আমি কি ওকে বলেছি রাফিকে ডাকতে? আমাকে না বলে চলে গেল কেনো?”
ইনায়ার এবার টেনশন হচ্ছে। রাফি ওকে সহ্য করতে পারে না। এতোবার নিজে বে”হায়া সেঁজে প্রপোজ করল কিন্তু তাও লোকটার ভাব কমে না! বারবার নিরবে পাত্তা না দিয়ে চলে যায়। ইনায়ার এখন নিজের চুলই নিজের ছিঁ*ড়তে মন চাচ্ছে। আরভি এসে কানে কানে বলে,

“দোস্ত ভয় পাস না। কিচ্ছু হবে না। রাফি ভাইকে বলবি যে…”
“কী বলব?”
“এইযে কী..!”
“কী?”
আরভি নিজেও মাথা চুলকে বোকার মতো বলল,
“কী বলবি? কিছুই বলবি না।”
ইনায়া এবার আরভির দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আরভি হাসার চেষ্টা করে বলল,

“আই লাভ ইউ বলে দিবি। ব্যাস! তারপর যা হয় হোক। দেখবি সে এবারও কিছু না বলে চলে যাবে।”
ইনায়ার দুঃশ্চিন্তা থামছে না। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তিতির রাফি, শুভ, অর্ককে নিয়ে এসেছে। আসলে ক্যান্টিন থেকে বের হওয়ার সময় এদেরকে ক্যান্টিনের দিকে আসতে দেখেছিল। তারপর তিতিররা রাস্তা পরিবর্তন করায় আর দেখা হয়নি। এবার ইনায়ার সামনে দাঁড়িয়ে তিতির রাফিকে বলল,

“ভাইয়া আমি এই মেডিকেলে এসেছি বেশিদিন হয়নি। শুরু থেকে আপনারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। তার জন্য আপনাদের সাথে টুকটাক কথা বলি। আমি অনেক কৃতজ্ঞ আপনাদের প্রতি। এখন ইনায়া আপু ভাবছেন, আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক আছে! আপনি একটু আপুকে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে দেন যে আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”

রাফি ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে ইনায়ার দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“ইনায়া, তুমি…”
রাফিকে বলতে না দিয়ে ইনায়া হুট করে বলে ওঠল,
“আই লাভ ইউ!”
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল রাফি! এক হাত নিজের কোমড়ে রেখে আরেক হাতে মুখ চেপে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তিতিরেরও চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। এতো সাবলিল প্রপোজাল! উপস্থিত বাকিরা মুখ চেপে হাসছে। ইনায়াও মাথা নিচু করে ঠোঁট কা*ম*ড়ে হাসছে।

রাফি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে,
“দেখো ইনু! উফ সরি ইনায়া, তিতির আমার বোনের মতো। আমি ওকে বোনের নজরে দেখি। এখন তুমি প্লিজ সবসময় এসব ইউজলেস সন্দেহ করাটা বাদ দাও। তাছাড়া তোমার সাথে আমার এমন কোন সম্পর্ক নেই যার দরুণ তুমি কোন জুনিয়রকে এসব প্রশ্ন করতে পারো!”
ইনায়া নিজের মুখশ্রীতে সরল ভাব এনে বলে,

“আমি কিভাবে বুঝব? ও আপনার বোনের মতো। আমার কি জানার কথা বলেন? তাছাড়া ও আপনার বোন সেটাও বা আমি প্রথমে কেনো ধরে নিব?”
রাফি বুকে দুইহাত গুঁজে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বলে,
“কী করতে হবে বলো?”
ইনায়া এবার লাজুক হেসে বলে,
“বেশি কিছু না। আমাকে আই লাভ ইউ বলেন!”

এতক্ষণ অর্ক, শুভ হাসি চেপে রেখেছিল। এবার আর কন্ট্রোল হলো না। দুটোয় হাসতে হাসতে ঘাসের উপর বসে পরেছে। ওদিকে আসফি, তাইজুল, তাওহীদেরও একই অবস্থা। তিতিরেরও এবার হাসি পাচ্ছে। বা*ঘ যখন বি*ড়া*লের মতো আচরণ করে!
রাফি কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলো। এবার বাকি যারা মুখ চেপে হাসছিল তারাও আর নিজেদের হাসি চেপে রাখতে পারল না। জায়গাটাতে মনে হচ্ছে কেউ লাফিং গ্যাস ছেড়ে দিয়েছে।

সুজনের দিন-রাত কাটছে মেডিকেলের গেইটের দুয়ারে! সন্ধ্যাবেলাতে ম*শার কা*ম*ড় খেয়েও অপেক্ষা করছে। হাসিব ও সাইফ এসব দেখে রিক্তা, ইতি, মৃদুলাকে বলে। রিক্তা কিছু একটা ভেবে বলল,
“শোন, দোস্ত আমি একটা প্ল্যান ভেবেছি।”
সাইফ জিজ্ঞেসা করে,
“কী প্ল্যান?”
“আমি এখন গেইটের বাহিরে যাব। তারপর..”

রিক্তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মৃদুলা রিক্তাকে একটা থা*প্প*ড় দিয়ে বলে,
“মা*থার কয়টা তাড় ছিঁ*ড়ছে? এখন সে গেইটের বাহিরে যাবে! ব*ল*দি জানি কোথাকার!”
রিক্তাও বিরক্ত হয়ে একটা লাগায়। তারপর বলে,
“কথা পুরোটা শোন। আগে থেকে মা*থা খাবি না।”
হাসিব তাড়া দিয়ে বলল,
“তুই বল তো। আমরা শুনতেছি।”
রিক্তা বলতে শুরু করে,

“আমি গেইটের বাহিরে গিয়ে রিকশা খুঁজতে থাকব। আমি মাস্ট শিউর সুজন ও পলাশ আমার কাছে আসবে। ভয় দেখাবে। তিতিরের লোকেশন বলতে।”
ইতি ভীত কন্ঠে বলল,
“তোর যদি কোনো ক্ষতি করে দেয়? এই রিস্ক নিস না।”
“আরে শোন তো! তারপর বলিস।”

রিক্তার হতাশ স্বর শোনে ইতি মাথা নাড়ায়।
“আমি ওদেরকে ভুল ইনফরমেশন দিবো আর তিতিরের পুরান সিম তো ফেলে গেছে। তাহলে তো ওরা বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আমি বলব, সঠিক ঠিকানা জানিনা।”
হাসিব কিছু একটা চিন্তা করে বলল,
“উমম! আইডিয়া মন্দ না। কাজ করতে পারে। তবে তুই একা যাবি না। আমি ও সাইফ আড়ালে থাকব। উঁচনিচ কিছু দেখলেই খবর করে ছাড়ব।”
রিক্তা বলে,

“আচ্ছা ডান। চল এবার। দুই আপদ বিদায় করে আসি।”
রিক্তা, হাসিব, সাইফ চলল সেদিকে। ইতি ও মৃদুলাও ভাবল যাবে তাই ওরাও চলল।

পরিকল্পনা মতো রিক্তা মেডিকেল কলেজের গেটের সামনে এসে রিকশা খোঁজার ভান করছে। তখনই সুজন ও পলাশের নজর যায় রিক্তার দিকে। সুজনের মনে পরে, এই মেয়েকেতো তিতিরের সাথে দেখেছিল। পলাশকে বললে পলাশও সায় দেয়। ওরা দুইজনে এগিয়ে এসে রিক্তার দুইপাশে দাঁড়ায়। রিক্তা ভয়ের ভাণ করে বলল,
“এই আপনারা কারা? আপনারা এভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন কেন?”
সুজন দাঁত কে*লিয়ে বলল,

“আমরে তুমি চিনবা না গো। আমি সুজন। তয় আমি তোমারে চিনি। এখন কিছু জিগামু। সুন্দর কইরা কইয়া ফেলবা তারপর তুমি তোমার রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়।”
রিক্তার হাসি পাচ্ছে তাও ভয় ভয় ভাব করে তোঁতলানো স্বরে বলে,
“কী..কী বলবেন?”
“আমার ময়নাপাখিডা মানে তোমার বান্ধবী তিতির কই? কই গেছে?”
“আমি জানিনা বিশ্বাস করেন। আমি জানিনা।”

রিক্তার জবাবে সুজন রেগে গেলো। পলাশ এবার বলল,
“তুই মা* সব জানোস। ভালোয় ভালোয় বল। নয়তো..”
এসব অশ্রাব্য ভাষায় রিক্তার ঘৃণা চলে এসেছে। আড়াল থেকে হাসিব ও সাইফ রেগে বের হতে নিলে ইতি ও মৃদুলা আটকিয়ে ইশারায় থামতে বলে। সাইফ ও হাসিব দেয়ালের উপর রাগ ঝাড়ে।
রিক্তা এবার কাঁদো কাঁদো ভাবে বলে,

“আমার কোনো ক্ষতি করবেন না প্লিজ। তিতির ঢাকা গেছে জানি। মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ি-ঘর সব বিক্রি করে রাতারাতি চলে গেছে। সিম কার্ডটাও বন্ধ। আপনি চাইলে আমি ওর নাম্বার দিতে পারি। বিশ্বাস করুন, আমাদের জানায়নি।”
সুজনের বিশ্বাস হয় না।
“সত্যি কইরা ক। তুই মিছা কথা কইবি না।”
রিক্তা কাকুতি-মিনতি করে বলে,

“আপনিই বলুন, ও নিশ্চয়ই চাইবে না, আপনারা ওর পর্যন্ত পৌঁছান! তাই না? আর আমরা তো এই শহরেব আছি। আপনারাও আছেন। তাহলে আপনারা যে আমাদের থেকে খবর নিবে তা কি বুঝবে না? তাহলে? ও আমাদেরই বা কিভাবে বিশ্বাস করবে? দুই বছরের পরিচয় মাত্র। আমরা তো আর ওর আপনজন না। আপনজন হলে কি আমাদের রেখে যেতো? আপনারা হিয়ার সাথে যা করতে চেয়েছিলেন! আর এলাকাবাসী কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসে নাই। তাহলে কোন হিসাবে থাকবে? তাই কাউকে না জানিয়ে নিরুদ্দেশ।”

সুজন ও পলাশ ভাবতে থাকে। ওদেরকে ভাবতে দেখে রিক্তা বোঝার চেষ্টা করল যে ওরা কি বিশ্বাস করছে কী-না? এবার মৃদু স্বরে বলল,
“ভাইয়ারা প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমি যা জানি সব আপনাদের বলেছি। ও মেডিকেল ছেড়েছে আর আমাদেরও ছেড়েছে। বাবা, ভাই, স্বামী হারা মেয়ে কী-না! ওর আর বাহিরের সম্পর্কের প্রতি মায়া নাই।”
পলাশ ধ*ম*কে বলে,

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৭

“তোরে কি আমরা ধইরা রাখছি শা*? যা ভাগ। নাইলে তোরেই তুইল্লা লইয়া যামু।”
রিক্তা মানে মানে করে কিছুটা দূরের একটা দোকানের দিকে চলে গেল। কিছু সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে সুজন ও পলাশও চলে যায়।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৯