এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৫

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৫
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

দরজা খুলে রাহানের বোন রুমি। রুমি দরজা খুলে তিতিরকে দেখে ভারি অবাক হলো। রুমি অবাক কণ্ঠে শুধায়,
“তুমি? তুমি এখানে?”
রুমি এহেনো প্রতিক্রিয়ায় তিতির অস্বস্থিতে পরে যায়। সে এক পলক মাশরিফের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“মাকে দেখতে এসেছি আপু। মা আমাকে দেখতে চেয়েছেন। ”
কথাটা শুনে রুমি মুখ বাঁকালো। কেমন তাচ্ছিল্য ভাব এনে বলল,

“বাহ! মায়ের খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে! তা উদ্দেশ্যটা কি?”
রুমির কথার ধরনে তিতির বেশ বিরক্ত হয়। সে রুক্ষ কণ্ঠে বলে,
“আমি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি কিছুদিন আগে মাহাদ আমাকে মায়ের অসুস্থতার খবর জানিয়েছিল এবং মাও আমাকে খুব করে অনুরোধ করেছিল একবার এসে তাকে দেখে যেতে। মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারিনি বলেই আজকে এসেছি। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুমি তিক্ত কিছু বলতে নিবে তার আগেই একটা মেয়ে এসে তিতিরের হাত ধরে বেশ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে,
” ভাবি আপনি এসেছেন? আসেন ভাবি আপনাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাই।”
মেয়েটাকে তিতির চিনতে পারে। জিজ্ঞাসা করে,
” আরে তিহু, কেমন আছ?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভাবী। আপনি কেমন আছেন?”
” এইতো আলহামদুলিল্লাহ। মাহাদের মুখে তোমার কথা শুনে খুব ভালো লেগছিল। যে তোমরা বিয়েতে দেরি করোনি।”
” মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরেন। তাই মাহাদ বলল বিয়েটা দ্রুত করে ফেলতে। এইতো দুই মাস হলো বিয়েটা হয়েছে।”
তিতির এবার খুশি হয়ে বলে,

” মায়ের দেখভালের জন্য কেউ তো আছে! শুনে মনে শান্তি পেলাম।”
তিতিরের এই সাধারণ কথাটা রুমির কাছে যেন তীরের মতো বিঁধল! সে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
” তুমি কি বলতে চাইছ? আমি মায়ের খেয়াল রাখি না?”
রুমির এহেনও প্রশ্নের তিতির হতবাক হয়ে গেল! সে তো এরকম কিছু বলেনি।
“আপু, আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলিনি। আপনি তো শ্বশুর বাড়িতে থাকেন। এখানে মায়ের খেয়াল রাখার জন্য কেউ তো থাকা উচিত। তাই জন্য বলেছি।”

রুমি এর কোন প্রত্যুত্তর না করে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। তিহু রুমির কথা পাত্তা না দিয়ে বলে,
” বাদ দিন ভাবী! রুমি আপুর কথায় কিছু মনে করবেন না। আসেন ভিতরে আসেন। আর ভাইয়া, আপনিও ভিতরে আসেন।”

মাশরিফ এতটা সময় গম্ভীর মুখ করে সবার ব্যবহার দেখছিল। তিহুর আতিথ্যতায় সে হালকা হেসে ভিতরে গেল। তিহু তিতির ও মাশরিফকে নিয়ে রোকেয়া বেগমের ঘরের দিকে গেল। রোকেয়া বেগমের ঘরে তার পাশে মাহাদ বসে আছে। মাহাদ তার মায়ের পায়ে তেল মালিশ করছে। রোকেয়া বেগমের মুখশ্রী এতটা শুকনো ও রুগ্ন দেখাচ্ছে যে তিতির প্রথম দেখায় চিনতে পারেনি। হতবাক হয়ে যায় সে। মাহাদকে তিতির ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, রোকেয়া বেগম জেগে আছেন না ঘুমিয়ে আছেন? মাহাদ যখন ইশারায় বুঝালো রোকেয়া বেগম জেগে আছেন তখন তিতির দৃঢ় পায়ে রোকেয়া বেগমের পাশে গিয়ে বসে। অতঃপর তার হাতটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে বলে,

“আসসালামু আলাইকুম মা। এখন কেমন আছেন?”
তিতিরের কণ্ঠস্বর শুনে রোকেয়া বেগম চোখ খুলে তাকালেন। চোখ ভর্তি জল আর মুখে লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। তিনি জড়ানো কণ্ঠস্বরে বললেন,
“তুই আসছিস মা? কতদিন পর তোরে দেখলাম। আমি না হয় তোর উপর একটু বেশি রাগ করে ফেলছি, তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করছি। তাই জন্য তুই আমারে ভুলে যাবি? শুধু এই মায়ের খারাপ দিকগুলাই দেখলি? ”

বলতে বলতে রোকেয়া বেগম হু হু করে কেঁদে ওঠেন। তিতিরও চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা। আবেগময় মূহুর্তে উপস্থিত সকলের নেত্রকোণে নোনাজল ভীড় করেছে। মাশরিফের হঠাৎ ফোন আসাতে মাশরিফ একটু ঘর থেকে বের হয়ে কথা বলতে যায়। তখনি রুমি রোকেয়া বেগমের রুমে প্রবেশ করে আচমকা বলে,
“নতুন আশিক পেয়েছ নাকি তিতির? সাথের লোকটা কে?”
কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো পতিত হলো। তিতির হতচকিত হয়ে তাকায়। অবাকের রেশে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে। মাহাদ বিস্মিত কণ্ঠে বলে,

“এসব কী বলছ আপু?”
রুমি আরও তেজী কণ্ঠে বলে,
“ভুল কী বললাম? ঠিকই তো বললাম। ময়মনসিংহতে গিয়েছে কেন তবে? আবার আজকে আসল তো সাথে করে এক অচেনা ছেলেকে নিয়ে! ওর ভাই তো বেঁচে নাই। তাহলে আর কে? নতুন আশিকই তো হবে!”
মাহাদ জোরালো কণ্ঠে বলে,
“থাম আপু। যা মুখে আসছে বলে চলেছ। একটু বুঝে তো বলো।”
“এই তুই চুপ কর। যা বুঝিস না বলবি না। তোরা সব দেখেও চুপ করে থাকলে কী আমিও চুপ করে থাকব? সত্য দেখেও চুপ থাকব নাকি?”

তিতির চোখ বন্ধ করে একটা হতাশার ঢোক গিলে। অতঃপর বলে,
“সব না জেনে একটা মন্তব্য করে ফেললেই বোধহয় নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবা যায়! কিন্তু ভুলে যাবেন না, এসব হীন মানসিকতার মহাজ্ঞানী সম্মানের যোগ্য না।”
তিতিরের কথায় ফুঁসে উঠল রুমি। রুমির স্বামি সাদিক ইশারায় বারবার রুমিকে থামতে বলছে কিন্তু রুমি তো নাছোড়বান্দা! তেজী কণ্ঠে বলে,

“কী জানব হ্যাঁ? তোমার পরিবারে পুরুষ মানুষ আর আছেই বা কে? তোমার চাচাতো ভাই তো ছোটো। তাহলে আর কী বুঝব? আমি নাহয় বেশি বুঝি, তবে তুমিই বলো লোকটা কে?”
তিতির লম্বাশ্বাস নিয়ে অকপটে হড়হড়িয়ে বলতে থাকে,
“উনি আমার কাজিন। খালাতো ভাই। উনি আমাদের পাশে ছিলেন বলেই এখনও সমাজের চি*ল-শ*কু*নেরা আমাদের তিন জন মেয়ে লোককে ছিঁড়ে খেতে পারেনি। বিপদের বন্ধু চিনেন? মেজর মাশরিফ ইকবাল আমাদের মা-মেয়েদের বিপদের বন্ধু। উনি সুসময়ের মাছি না। তাই আপনি বাহিরের লোক হয়ে না জেনেই উলটা-পাল্টা মন্তব্য করে ফেলবেন না।”

রুমির শেষের কথা গুলো মাশরিফ ঘরের দরজার কাছে এসে শুনেছে। তখন তার যতোটা রাগ হচ্ছিল, এখন তার থেকে বেশি প্রশান্তি কাজ করছে। এবার মাশরিফ দরজার কাছ থেকে বলে ওঠে,
“আপনার বুঝি পরচর্চার খুব শখ মিসেস রুমি? আসার পর থেকে দেখছি আপনি তিতিরের পেছনেই পরে আছেন? তিতিরকে নিয়ে তো এখানের আর কারোর কোনো সমস্যা আমার নজরে আসছে না, কিন্তু আপনার একার দিক থেকেই দশ জনের সমান সমস্যা নজরে আসছে।

আপনি আপনার বাবার বাড়িতে এসেছেন ভালো কথা, সবার সাথে হাসি-খুশি থাকবেন। কিন্তু আপনি দেখছি বাড়ির পরিবেশ খারাপ করার জন্য উঠে পরে লেগেছেন। তাছাড়া তিতির তো বলেছে সে শুধু মেজর রাহানের মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে তাও উনার রিকুয়েস্টে। তবে কী জানেন মিসেস রুমি, আমি শুনেছি, আপনি নাকি বছরের ৮-৯ মাসই এই বাড়িতে পরে থাকেন! তাতেই বোঝা যায় আপনার আগ্রহ! বিয়ের পর এতো সময় বাপের বাড়ি পরে থাকলে আপনার সংসারের হাল কী?”

রুমি ক্ষেপে ওঠল। রুক্ষ কণ্ঠে শা*সা*ল,
“আপনি কিন্তু বেশি কথা বলছেন। আমার বাবার বাড়ি, আমি যখন খুশি আসব।”
“তাহলে তিতিরের শ্বশুর বাড়ি! ওর স্বামী জীবিত না থাকলেও স্বামীর পক্ষের হকের অধিকারে ও যখন খুশি এই বাড়িতে আসতে পারবে। এখন আপনার কাছে কোনটা বেশি এপ্রোপ্রিয়েট মনে হয়? আপনি সারা বছর এই বাড়িতে পরে থাকেন, তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা সমস্যা নাই। কিন্তু অন্যের ব্যাপারের নিজের খাঁড়া নাকটাকে ঢোকানোর চেষ্টা করবেন না।”
কথাগুলো বলে মাশরিফ এবার রুমির স্বামীর দিকে তাকায়। রুমির স্বামী সাদিক মাথা নিচু করে রেখেছে। মাশরিফ তাকে জিজ্ঞেসা করে,

“ভাই, আপনি যদি এভাবে মাথা নিচু করে রাখেন, তাহলে কীভাবে হবে? আপনার স্ত্রীকে আপনি নরম ভাবে ইশারা করে যে থামাতে পারবেন না, তা আপনিও জানেন। অন্যায় কথা শুনলে রুখে দাঁড়াতে হয়।”
রুমির স্বামী সাদিক বলে,

“ভাই, ওরে আমি অনেক বুঝাইছি কিন্তু সে বুঝে তো নাই, উলটো রাগ করে এখানে এসে মাসের পর মাস থাকে। ওর জন্য আমাকেও এখানে থাকতে হয়। আমার মাকে তো ওর জন্য আমার ভাইয়ের কাছে রাখি, এখন ও নিজেও বাসায় থাকে না। তখন আমি তো একা হয়ে যাই।”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৪

রুমি রেগে বো*ম হয়ে কিছু বলতে নিবে তখন রোকেয়া বেগম রুগ্ন কণ্ঠে বলে ওঠেন,
“তুই আজকে এখনি চলে যা রুমি। আমার সংসারে আর ঝামেলা বাঁধাস না। নিজের সংসারটা মন দিয়ে কর।”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৬