এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৪

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৪
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

বিকেলে কিছু সময়ের জন্য বাড়িতে আসলো তিতির। বাড়িতে এসেই মহিমা বেগমকে সালাম দিয়ে মায়ের পাশে বসল। মহিমা বেগম সালামের জবাব দিয়ে হাস্যজ্জল কণ্ঠে তিতিরকে জিজ্ঞাসা করেন,
“কেমন আছো তিতির? দিনকাল কেমন কাটছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি। আপনারা কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। এখন ছেলের বউ দেখতে পারলে মনটা শান্ত হতো।”
মহিমা বেগম অবশ্য কথাটা তিতিরকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন। যদিও এখন তার ছেলের বিয়ে নিয়ে তেমন মা*থাব্যথা নেই।

মহিমা বেগমের কথা শুনে তিতির আড় নজরে মাশরিফের দিকে তাকায়। মাশরিফ এক ধ্যানে ফোন স্ক্রল করছে। তিতির না এই মাশরিফের সাথে আগের মাশরিফ যে তাকে ভালোবাসে বলে দাবি করে! তার মিল পাচ্ছে না। তিতির ভাবে, হয়তো তার কারণেই এমনটা পরিবর্তণ। নিজের মন-মস্তিষ্কে আর চাপ নিতে চাইল না সে। মাকে বলে টিউশনে যাবে।
“মা, আমি যাই তবে।”
নাজমা বেগম জিজ্ঞেসা করেন,
“খেয়ে যাবি না?”
“না। দুপুরে ক্যান্টিনে খেয়েছি। এখন যাই তবে।”
“আচ্ছা সাবধানে যাস।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে তিতির বেরিয়ে আসছিলই তখন আরেকবার পাশ ফিরে মাশরিফের দিকে তাকায়। নাহ্! মাশরিফ একবারও নিজের নজর হটায়নি। দৃষ্টি এখনো তার ফোনের স্ক্রিনেই নিবদ্ধ! তিতির ঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে।
তিতির যাওয়া মাত্রই মাশরিফ স্ক্রিন থেকে নিজের দৃষ্টি হটায়। অতঃপর চোখে হেসে মনে মনে স্বগতোক্তি করে,
“বলেছিলাম তো! তুমি না ডাকলে ভালোবাসব না! ভালোবাসি বলব না। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করব না। আর এখন তোমারই কষ্ট হচ্ছে?”

মাশরিফ এরপর তার মাকে বলে,
“মা, আমি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেলাম। সন্ধ্যার দিকে এসে তোমাকে পিক করে নিব।”
মহিমা বেগম হাস্যজ্জল মুখে জবাব দেন,
“আচ্ছা যা। দ্রুত আসিস।”
বোনের কথা শুনে নাজমা বেগম ভ্রু কুঁচকালেন। তিনি বললেন,
“আপা, তোমরা কিন্তু আজকে কোথাও যেতে পারবে না। আজকে তোমাদের এখানেই থাকতে হবে। জানি রুমের একটু কষ্ট হবে কিন্তু তাও। একদিন এতটুকু সহ্য করাই যায়।”
চায়ের ট্রে হাতে হিয়া এসে বলে,

“জি আন্টি। আজকে কিন্তু আপনারা থেকে যাবেন। আমি আর তিতির ফ্লোরে মোটা তোষক বিছিয়ে সামলে নিতে পারব। আপনি আর মা বিছানায় ঘুমালেন আর মাশরিফ ভাইয়া পাশের রুমে।”
মহিমা বেগম চটজলদি বলে ওঠলেন,
“আরে না! কীসব বল? আমরা আজকে থাকব না।”
“উহুম আন্টি। আপনাদের তো আজকে থাকতেই হবে। আর মাশরিফ ভাইয়া, প্লিজ, আজকে থেকে যান। আমাদের ছোটো বাসা বলে আপনারা থাকবেন না?”

মহিমা বেগম এক পলক মাশরিফের দিকে তাকায়। মাশরিফ দ্বিধায় পড়ে যায় কী বলবে! সে হাসার চেষ্টা করে বলে,
“আসলে সেজন্য না। মানে… ”
“কোন মানে-টানে শুনব না ভাইয়া। আপনারা আজকে থাকছেন। আমি সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছি। ”
মহিমা বেগম বলতে চাইলেন,
“তোমাদের কষ্ট হয়ে যাবে মা! ”
“কোন কষ্ট হবেনা আন্টি। চাচারা যখন শহর থেকে বেড়াতে আসে তখন আমরা এই দুই রুমই এডজাস্ট হয়ে যাই। কোন সমস্যা হয় না। আর একসাথে বেশি মানুষ থাকলে বরং ভালোই লাগে। হায়াতও বেশি মানুষ দেখলে আমাকে জ্বালায় কম।
শেষোক্ত কথাটা হিয়া একটু মজার ছলে বলে। হিয়ার রমনাত্মক কথা শুনে ওরা হেসে ওঠে। নাজমা বেগম ও হিয়ার এতো অনুরোধে মহিমা বেগম আর আপত্তি করতে পারলেন না। মাশরিক চা পান করে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে যায়।

টিউশনি করিয়ে তিতির বাসায় ফিরে নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগটা রেখে একটু বিছানায় গায়ে লাগানোর প্রস্তুতি নিতেই মনে হল সে ছাড়াও রুমে আর অন্য কারো উপস্থিতি বিদ্যমান। হকচকিয়ে উঠল তিতির। পাশ ফিরে দেখল মাশরিফ তার দিকে শান্ত, নিশ্চল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত না তিতির ঘাবড়ে যায়। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বলে,

“সরি, একচুয়েলি অ্যাই ডিডিন্ট নোটিস ইউ। ইটস মাই রুম, দ্যাটস হোয়াই! আমি চলে যাচ্ছি।”
তিতিরের এই হুলস্থুল কাণ্ড দেখে মাশরিফ শান্ত কণ্ঠে বলে,
“রিল্যাক্স। পানি খাও (পাশের পড়ার টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে) তারপর শান্ত হয়ে বসো। এতো হা*ইপার হওয়ার কিছু হয়নি।”

মাশরিফের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে তিতির ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি সাবাড় করে ফেলল। অতঃপর বলল,
“আসলে আমার মা*থা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল যে, আপনার আজকে থাকবেন। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে সরি।”
“আপনি রেস্ট করুন। আমি বরং ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি।”
তিতির নিষেধ করতে চাইলো কিন্তু মাশরিফ ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তিতির কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে,

“এই লোকটা কি সব সময় এতো গম্ভীর? নাকি আমার সাথেই এতো গম্ভীর্যতা প্রদর্শন করছে? কই? আমাদের প্রথম সাক্ষাতের সময় তো উনি এত গম্ভীর্যতা আমার সাথে দেখায় নি! তখন তো খুব ক্যাজুয়াল ছিল। এমনকি নিজেই আমার সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজত! এতো পরিবর্তণ?”
কথা গুলো বলতে বলতে তিতিরের মনে পরল তাকে তো ফ্রেশ হয়ে প্রয়োজনীয় সব নিয়ে মায়ের রুসে যেতে হবে।জলদি করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় ও এপ্রোনটা ভিজিয়ে বালতি নিয়ে বেরিয়ে আসে।
রাতের খাবার খেতে বসার পর খাওয়া চলাকালীন সময়ে মহিমা বেগম তিতিরকে জিজ্ঞেসা করেন,

“তিতির, তোমার প্রফ কবে?”
প্রশ্ন শুনে তিতির তাকায়। অতঃপর বলে,
“এই তো জুনে শুরু হবে।”
“সেকেন্ড প্রফ?”
“জি।”
“এমবিবিএস ও ইন্টার্নি শেষ হওয়ার পর কি ময়মনসিংহতেই থাকবে?”
প্রশ্নটা শুনে তিতির চুপসে যায়। তার ভবিষ্যৎ গন্তব্য তার জানা নেই। তাই জবাবে বলে,
“জানিনা আন্টি। ভাগ্য যেখানে আছে সেখানেই যাব।”

“এখন থেকে লক্ষ্য ঠিক করে রাখা ভালো। ফরিদপুরে তো আর ফিরবে না।”
“না আন্টি। ওখানে আর ফেরার ইচ্ছে নাই। ওই শহরটাকে একেবারে ছেড়ে চলে এসেছি। যেখানেই যাই না কেন, ওখানে আর ফিরতে চাই না। অনেক কিছু হারিয়েছি ওই শহরে।”
কথা গুলো বলতে বলতে তিতির ভাতের প্লেটে ভাত নাড়াচাড়া করছে। মহিমা বেগমও আর কিছু বললেন না। মাশরিফও মাথা নিচু করে প্লেটে ভাত নাড়াচাড়া করছে। তখন নাজমা বেগম বলে ওঠেন,
“কালকে তো তুই ফরিদপুরে একবার যাবি। ভোর সকালেই কি বের হবি? দেরি করে বের হলে ফিরতে ফিরতেও তো দেরি হয়ে যাবে। ”

তিতিরের ফরিদপুরে যাওয়ার কথা শুনে মহিমা বেগম সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,
“হঠাৎ ফরিদপুরে কেন যাবে? ”
নাজমা বেগম মলিন কন্ঠে জবাব দিলেন,
“ওর শাশুড়ি মানে রাহানের মা রোকেয়া বেগম খুব অসুস্থ। শয্যাশায়ী। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। তিনি একবার তিতিরকে দেখতে চেয়েছেন। রাহানের ছোট ভাই মাহাদ ফোন করেছিল। তাই কালকে তিতির দেখতে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ”
মহিমা বেগম অবাক কণ্ঠে বলেন,

“একা একা যাবে নাকি? ওখানে তো ওর শত্রুর অভাব নেই! এখন একা একা একটা মেয়ে গেলে কিনা কি হয়! তার চেয়ে ভালো কালকে তিতিরের সাথে মাশরিফও যাক। গেল আর নিয়ে আসল।”
মহিমা বেগমের প্রস্তাব শুনে তিতির হতচকিত হয়ে তাকায়। মাশরিফও চোখ তুলে তাকিয়েছে, যার দরুন তিতির ও মাশরিফের নেত্র যুগলের সাক্ষাৎ ঘটে। তিতির হড়বড়িয়ে বলে,

“না আন্টি। তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি একা যেতে পারব। আর বাসস্ট্যান্ডে আমার দুই বন্ধু আমাকে এসে রিসিভ করবে। এরপর ওরাই আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে যাবে। কোন সমস্যা হবে না এতে।”
“চুপ করো মেয়ে। আমি যা বলছি তাই হবে। তুমি একা তো ফরিদপুরে যাবেই না। মাশরিফ তোমাকে নিয়ে যাবে ও নিয়ে আসবে। তুমি একা গেলে তো তোমার মা চিন্তায় চিন্তায় স্ট্রো*ক করে ফেলবে! তাছাড়া আমরা সবাই টেনশনে থাকব। তার থেকে ভালো আমার ছেলে তোমাকে নিয়ে গেল। ও সাথে গেলে আমাদের টেনশন অনেকটাই কমে যাবে।
মহিমা বেগম ধমকে তিতির চুপ করে যায়। সে মাশরিফের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছে। মহিমা বেগম এবার মাশরিফকে বলেন,

“তুই নিয়ে যেতে পারবি না তিতিরকে? তুই তো সবই জানিস। যদি কোনো বিপদ-আপদ হয়?”
মাশরিফ এক পলক তিতিরের দিকে তাকায়। তিতির মস্তক নত করে রেখেছে। অতঃপর মাশরিফ বলে,
“উনার যদি কোন প্রবলেম না থাকে তাহলে আমি নিয়ে যেতে পারি। আমার কোন প্রবলেম নেই।”
নাজমা বেগম ও মহিমা বেগম দুজনই খুব খুশি হন। মহিমা বেগম সহাস্যে বলেন,
“ওর আবার কী-সের প্রবলেম! তিতির? তোমার কোনো প্রবলেম আছে?”

তিতির থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই নাজমা বেগম বলে ওঠেন,
“ওর কোনো সমস্যা নাই। একা যাবে ভেবেই আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম। এখন সাথে যদি মাশরিফ বাবা যায় তবে ভয়টা কমবে।”
নাজমা বেগমের সাথে হিয়াও তাল মেলায়। অগ্যতা তিতির বাধ্য হয়ে যেতে রাজী হয়।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৩

পরেরদিন খুব সকালে তিতির ও মাশরিফ সবার থেকে বলে বাসে উঠে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা করে। সকালে রওনা করায় তাড়াতাড়িই ফরিদপুরে পৌঁছে গেছে। ঘড়ির কাটায় এগারোটা ছুঁইছুঁই। রাহানদের বাড়িতে কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। প্রায় এক মিনিট হলো। এখনও দরজা না খোলাতে তিতিরের কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ করে জার্নি করে এসে কোন জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা খারাপ লাগে। তিতির ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে আবার কলিংবেল চাপা মাত্রই দরজা খোলা হয়।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৫