এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৩

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৩
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

দেখতে দেখতে আরো অনেকগুলো দিন কে’টে গেল। ইতোমধ্যে হিয়ার ওই ছেলে সংক্রান্ত সমস্যাটাও সমাধান হয়েছে। তবে এতে তার কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি! ছেলেটা ভীষণ একগুঁয়েমি করছিল। ছেলের মাকে আনতে বললেও আনছিল না কিন্তু হিয়ার পিছুও ছাড়ছিল না। অবশেষে হিয়া বাধ্য হয়ে প্রক্টরকে জানায়। অতঃপর সব সমস্যার সমাধান হয়েছে।
চৈত্রের প্রখর দা*বদাহে প্রকৃতিতে বসন্তের ইতি ঘটতে চলেছে।

মার্চ থেকে এপ্রিলের প্রথমার্ধকে কিভাবে যে বসন্ত ঋতু বলা হয় তাই বুঝে আসে না তিতিরের। ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরল তিতির। বাসায় এসে মায়ের বানানো শরবতটা খেয়ে বিছানায় গা এলানো মাত্রই অক্ষিপল্লব ভারী হয়ে আসছে। কিন্তু আজ শারীরিক ক্লান্তি থেকে মানসিক ক্লান্তি কিছুটা বেশি। সকালেই রোকেয়া বেগমের নাম্বার থেকে কল এসেছিল। রাহানের ছোট ভাই মাহাদই মায়ের নাম্বার থেকে কল করে রোকেয়া বেগমের অসুস্থতার খবর জানিয়েছিল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তিনি নাকি বারবার তিতিরকে একনজর দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অস্থির হয়ে আছেন। ফোনের ওপার থেকে রোকেয়া বেগমের কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছিল। তিনি মাহাদের হাত থেকে ফোন নিয়ে কান্না করছিলেন আর বলছিলেন, তিতির যেন একবার তাকে দেখতে আসে। এমতাবস্থায় তিতিরের পক্ষে সম্ভব হয়নি মুখের উপর না করে দেওয়া। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুক্রবার গিয়ে দেখে আসবে।
এদিকে নাজমা বেগম যে কখন এসে তিতিরের পাশে বসেছেন, সেটা ও বুঝতে পারেনি। নাজমা বেগম মেয়ের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করেন,

“কীরে? কই হারালি? কী এতো ভাবছিস?”
মায়ের আচমকা ডাকে হকচকিয়ে উঠল তিতির। নিজেকে ধাতস্থ করে স্থীর হয়ে বসল। তারপর বলল,
“মা শোনো, সামনের শুক্রবার আমার একবার ফরিদপুর যেতে হবে। ”
মেয়ের এমন প্রস্তাবে নাজমা বেগম ভীষণ অবাক হন। তিনি অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,
“হঠাৎ ফরিদপুরে যাওয়ার ইচ্ছা হলো কেন তোর? ওই শহরে আবার তোর কী?”
তিতির হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

“এক সময় তো ওই শহরটাই আমার সবকিছু ছিল। আজ আমি এই শহরে এসেছি তার কারণও ওই শহরের কিছু মানুষজনের অবদান। একটা সময় পর তারা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও এক সময় কিন্তু আমি তাদের নয়নের মনি ছিলাম। আমার সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন তারা। আজ সেখানে এমন একজন মানুষের অসুস্থতার খবর শুনে যদি আমি না যাই আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে যাব। তিনি তো তার ছেলে হারিয়েছেন। একজন মায়ের কাছে ছেলে হারানোর দুঃখটা কেমন তুমি তো জানোই। আমি ভুলে যেতে চাই তার করা খারাপ ব্যবহার গুলো। একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের উপর নিজের আক্ষেপ ও দুঃখ এসব পুষে রেখে তার গুনাহ বাড়াতে চাই না।”

“তোর শাশুড়ি অসুস্থ?”
“হ্যাঁ। হুট করে শয্যাশায়ী! ডাক্তাররা কিছু বলতে পারছেন না। মাহাদ বলল, মা নাকি বারবার নিজের মৃত্যুর কথা বলতে থাকেন। আমাকে খুব করে দেখতে চাইছেন।”
রোকেয়া বেগমের খবরটা শুনে নাজমা বেগম ভীষণ ব্যথিত হলেন, সেই সাথে চিন্তায় পরে গেলেন। তিতির মাকে দেখে বলল,

“তুমি চিন্তা করো না। তুমি আর হিয়া এখানেই থাক। আমি গিয়ে দেখে আসব।”
তিতিরের কথা শুনে নাজমা বেগম আঁতকে ওঠলেন। দ্রুত হড়বড়িয়ে বললেন,
“কী বললি? কখোনোই না। তোকে আমি একা ছাড়ব তা তুই ভাবলি কী করে! ওইখানে সুজন ও পলাশরা আছে। যখন তখন অ্যা*টাক করে বসবে। ”
তিতির মাকে আশ্বাস দিতে চাইল। বলল,

“কিছু হবে না। আমি যে ফরিদপুরে যাব সেটা সুজন ও পলাশ কেউ জানতেই পারবে না। হাসিব ও সাইফ এসে আমাকে বাস স্টেশন থেকে সরাসরি রাহানের বাড়িতে নিয়ে যাবে। মৃদুলা, রিক্তারা আগে থেকেই ওখানে থাকবে।”
“বাহ! তুই তবে সব ভেবেই রেখেছিস।”
“মা, রাগ করো না। আমি একা গেলে কোনো সমস্যায় পরলেও ফাঁকফোকর দিয়ে ফিরতে পারব কিন্তু তোমরা সাথে গেলে তখন বিষয়টা চিন্তার হবে। তাছাড়া আমি জাস্ট দেখা করব আর চলে আসব। থাকব না তো।”
“যা ভালো বুঝিস কর।”
এই বলে নাজমা বেগম গোমড়া মুখে তিতিরের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখে তিতির ফুঁস করে দীর্ঘশ্বাস গুলো ঝেড়ে ফেলতে চাইল।

দুই দিন পর ক্যাম্পাসের একটা ছায়ার মধ্যে তিতির, জারিন, নাদিয়া, লিরা ওরা বসে আছে। থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। নাদিয়ার পকেট ফ্যানটা নিয়ে ইতিমধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে। নাদিয়া ও জারিনের এই ফ্যান নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখে তিতির হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে সম্মুখে তার দৃষ্টি গেল। দেখতে পেল শুভ একটা ছেলেকে হাসতে হাসতে ভাতৃত্বপূর্ণ আলিঙ্গন করল।

অতঃপর ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্যান্টিনের দিকে যাওয়া ধরল। তিতিরের কাছে মনে হল, ছেলেটাকে সে চেনে! অবশ্য না চেনার অবকাশ নাই। ক্যাম্পাসের যেকোনো ছাত্রের সাথেই শুভর ভালো সম্পর্ক। কিন্তু ছেলেটা ক্যাম্পাসের কেউ না। তিতির মস্তিষ্ক সিংগনাল দিচ্ছে ছেলেটা শুভ, মাশরিফদের বন্ধুমহলের কেউ! নামটা ঠিক মনে পরছে না ওর। কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে তিতির, নাদিয়া ও জারিনের ঝ*গড়া থামাতে ওদের হাত থেকে ফ্যানটা কেড়ে নিল। তারপর বলল,

“বাতাস পরে খা*স। এখন চল ক্যান্টিন থেকে ঠান্ডা কিছু খেয়ে আসি।”
লিরা ও জুলিয়ার কাছে প্রস্তাবটা ভালো লাগল। জুলিয়া উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
“আইসক্রিম? আমি চকবার খাব। ইটস টু মাচ ইয়াম।”
লিরা বলে ওঠল,
“কোনো কাপ আইসক্রিম খাই? গরমে চকবার গলে গলে হাতে পরলে?”
“কিছু হবে না। খুব খুব জলদি খেয়ে ফেলব।”
“ওখেই। লেটস গো। গরমে আইসক্রিমে হেইড্যাক হয় বাট আজ মাস্ট খাব।”
তিতির বলে,

“আচ্ছা বাবা! তোরা যা খুশি খাস। এখন চল তো।”
ওরা পাঁচ জন চলতে থাকে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে। ক্যান্টিনে ঢুকে কিছু কিনবে কী! তিতিরের নজর তো শুভ ও শুভর বন্ধুকে খুঁজছে। জারিন তিতিরকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কী হলো? দাঁড়িয়ে পরলি কেন? চল।”
তিতির নিজেকে সামলে বলে,
“হ্যাঁ হ্যাঁ চল।”
আইসক্রিম কিনে ওরা কোনার দিকে একটা টেবিলে বসল। তখনি একটু দূরে শুভদের দেখতে পেয়ে তিতির জারিনকে ডেকে দেখাল।

“এই! শুভ ভাইয়ার সাথের ছেলেটা তার বন্ধু না?”
জারিন দিক না বুঝে কা*নার মতো এদিক ওদিক তাকাতাকি করে কিছুটা জোড়েই বলে ফেলল,
“কই শুভ ভাইরে দেখিস তুই?”
জারিনের গলার স্বর শুনে তিতির চোখ-মুখ খিঁচে ওর হাত খা*মচে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আস্তে বল! এতো জোড়ে চিল্লানোর কী আছে?”
নাদিয়া পাশ থেকে বলে ওঠে,

“কী হইছে? শুভ ভাইরে খুঁজিস কেন? ওই তো শুভ ভাই বসা। দাঁড়া ডাক দেই।”
এই বলে নাদিয়ে তিতিরের মুখের ভাবের তোয়াক্কা না করেই শুভকে ডেকে ওঠল। নাদিয়ার ডাক শুনে শুভ ও শুভর বন্ধু তাকাল। নাদিয়া ইশারায় আসতে বললে ওরা সেই টেবিল ছেড়ে ওদের টেবিলে আসে।
লিরা হাসি মুখে বলে ওঠ,
“হাই! হাউ আর ইউ অভী ভাই?”
অভী হালকা হেসে বলে,

“খুব ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ্‌। তোমরা কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাইয়া।”
এবার জারিন জিজ্ঞেসা করে,
“এতোদিন পর আমাদের কথা মনে পরল?”
অভী জবাবে হাসে। নাদিয়া বলে,
“তাও তো উনার আমাদের কথা মনে পরেছে! কিন্তু অর্ক ও রাফি ভাইয়াকে দেখ, এই পর্যন্ত আর এলোই না। সেই যে গেল!”
শুভ হেসে বলে,

“বৃহস্পতিবারে আসবে। মানে পরশুদিন। তখন আমরা সাত বন্ধু আবার একত্রিত হব।”
তিতির মনে মনে ছটফট করছে কিছু জানার জন্য। তিতির জানে যে অভী ও মাশরিফের কর্মক্ষেত্র এক। এখন অভী আসল আর মাশরিফ এলো না!
তিতিরের মনের কথাটা জারিনই বলে দিল,
“অভী ভাই, আপনার বন্ধু মাশরিফ ভাই যে এলো না?”
“বৃহস্পতিবার আসবে। ওর মাও আসবে তো। আজকে আমি ওকে অনেকবার আসতে রিকোয়েস্ট করেছিলাম কিন্তু রাজী হয়নি।”
শেষোক্ত কথাটা বলতে বলতে অভী তিতিরের দিকে তাকাল। তিতির অভির তাকানো দেখে মাথা নিচু করে ফেলল। কথার বা*ণ যে তার দিকে তা তার বুঝতে বাকি নেই। এবার আসলে সে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবল।

বৃহস্পতিবার, তিতির সকালে ক্লাসের জন্য বেরোনোর আগে নাজমা বেগম তিতিরকে বললেন,
“শোন, আজকে টিউশনিতে যাওয়ার আগে বিকেলে বাসায় আসিস। তোর মহিমা খালা ও মাশরিফ আসবে। ওরা তো সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে। রাতে থাকতে বলতাম কিন্তু থাকতে দিব কই বল? অন্তত একটা রুম তো লাগবেই। বোনকে রাতে রেখে দেওয়ার ইচ্ছে আছে।”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩২

তিতির প্রথমে অবাক ও খুশি হলেও শেষে বিমর্ষ হয়ে যায়। বলে,
“কী করব এখন? তুমি থাকতে বলো, তাছাড়া মেজর মাশরিফের বন্ধুরা তো আছেই!”
“তাহলে বলে দেখব, কী বলিস?”
“বলো।”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৪