এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩২

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩২
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

রাতের খাবারের শেষে তিতির গেস্টরুমে যাওয়ার সময় দেখল পাশের ঘরটা মানে মাশরিফের ঘরটা খোলা। উত্তেজিক সমীরণে রূপালি রঙের পর্দাগুলো উড়ছে। আজ অনিল যেনো একটু বেশিই আন্দোলিত! ঘরের ভেতর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। তা শুনে তিতিরের মনে কৌতুহল জন্ম নিলো। কৌতুহল বশত সে সেদিকেই অগ্রসর হলো। ঘরের ভেতরে গিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে যেখান থেকে শব্দের উৎস সেদিকে গিয়ে দেখে রিতিকার ছেলে রিয়ান আলমারির পেছনে উুঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তিতির সামান্য ভ্রুঁকুটি করে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞাসা করে,

“কি করছো তুমি বাবু? ”
কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে রিয়ান হকচকিয়ে পেছনে ঘুরে তাকায়।
“আমার রিমোট কন্ট্রোল আর্মি ট্র্যাকটা মামার আলমারির নিচে চলে গেছে। ওটার এন্টেনার সাথে কিছু একটা বেজে গেছে। আসছে না।”
“আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এই বলে তিতির রিয়ানকে সাইড করে নিজেই মেঝেতে বসে আলমারির নিচে হাত দিয়ে উঁকিঝুুঁকি দিয়ে অনেক কষ্ট করে রিয়ানের আর্মি ট্রাকটা আনতে সমর্থ হয়। ট্রাকটা হাতে পেয়ে রিয়ান তো বেজায় খুশি। সে উৎফুল্ল চিত্তে লাফিয়ে বলে উঠল,
“থ্যাংকিউ আন্টি। তুমি খুব খুব ভালো আন্টি। ”
তিতির মুচকি হাসি দিয়ে রিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“যাও এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। অনেক রাত হয়েছে। এখন আর খেলতে হবে না। ”
রিয়ান অবাক হয়ে বলল,

“মাত্রই তো সাড়ে নয়টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি কে ঘুমায়? আম্মু এখন সিরিয়াল দেখছে তাই ঘুমাতে ঘুমাতে এগারোটা তো বাজবেই।”
“তোমার আম্মু সিরিয়াল দেখছে, তুমি তো আর দেখছো না। তুমি গিয়ে ঘুমাও।”
“না বাবা আম্মু যখন সিরিয়াল দেখে তখন আমি আর বাবা আম্মুর সামনে থাকি না আম্মু এক এক সময় এক এক রিয়েক্ট করে। ”
রিয়ানের অভিযোগের স্বর শুনে তিতির হেসে ফেলল। অতঃপর বলল,

“বাচ্চাদের বেশি রাত জাগতে হয় না। জলদি ঘুমিও পরো কেমন?”
রিয়ান মাথা দুলিয়ে হাসে। তিতিরও মুচকি হেসে চলে যেতে ধরলে ওয়ারড্রবের উপরে একটা মিডিয়াম সাইজের ডুয়েল ছবির ফ্রেম দেখে। ফ্রেমটাতে দুইজনকে আর্মি পোশাকে দেখা যাচ্ছে। তিতির হাত বাড়িয়ে ছবির ফ্রেমটা নিলো। একটাতে মাশরিফ আরেকটা ছবি একটু পুরোনো, কিন্তু ছবির লোকটাতে তিতির চিনতে পারছে না। দুইটা ছবির স্টাইল একই। দুইজনেই স্যালুটের ভঙ্গীতে দাঁড়ানো। ছবি দুটো দেখেই হঠাৎ কেনো জানি তার হৃদমাঝারে সূক্ষ্ম কম্পনের সৃষ্টি হয়। এক ধ্যানে ছবি দুটোর দিকে কিছুসময় নেত্র স্থির রাখে। এতো মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধ যেনো শিরায় শিরায় অনুভূত হচ্ছে।
রিয়ান রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পাশে তাকিয়ে তিতিরকে ছবির ফ্রেম হাতে দেখে বলে ওঠে,

“আন্টি, ওটা নানাভাই ও মামার ছবি। মামা খুব শখ করে ফ্রেম করে রেখেছে।”
রিয়ান বলাতে তিতির মুচকি হেসে ফ্রেমটা রেখে রিয়ানের কাছে এসে ঘরটা থেকে বের হতে নিবে তখনি রিতিকা আসে। রিতিকা গম্ভীর স্বরে রিয়ানকে বলে,
“তুমি এখানে কেন এসেছ? মানা করেছি না? যাও ড্রয়িংরুমে খেল গিয়ে।”
“আম্মু আমার গাড়িটা..”
“যাই হোক। যাও বলছি।”
শেষোক্ত কথায় ধ*মকে উঠলে তিতিরের কাছে খারাপ লাগে। রিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বের হয়ে গেস্টরুমে চলে যায়।

সকালবেলা খুব তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষে ওরা বেরোনোর জন্য প্রস্তুতি নেয়। মহিমা বেগম, রিতিকারাও ফিরে যাবে। ওদের বেরোনোর আগে সেখানে কাশফা এসে হাজির। কাশফা সবাইকে বের হওয়ার প্রস্তুতিতে দেখে অবাক হয়ে বলে,
“তোমরা চলে যাচ্ছ?”
কাশফাকে দেখে রিতিকা মাথা নিচু করে রাখে। মহিমা বেগম জবাব দেন,

“হ্যাঁ। এখনি চলে যাব।”
কাশফা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলে,
“আমি ভাবলাম তোমরা আজও থাকবে।”
এরপর মহিমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আন্টি, তোমার তো আজকে ছুটি। তবে আজ চলে যাচ্ছ কেন?”
“রিয়ানের স্কুল আছে তাছাড়া আমরা এখানে একটা কারণেই এসেছিলাম।”
তারপর ওরা বেরিয়ে পরে। সারা পথ রিতিকা চুপ করে ছিল এবং তিতিরদের বিদায় দেওয়ার সময়ও কেমন গম্ভীর ও মৌন ছিল।

সুজন, পলাশরা আজ টে*রো*রি*স্টদের ক্যাম্পে গিয়েছে আজ। টে*রো*রি*স্টদের একজন বলে ওঠে,
“কোনো খবর পেলে? আমাদের গু*প্তচ*র তো কিছু বলছে!”
“কী কইতাছে স্যার? আমরা ঢাকা থিকা কাইলই আইলাম তারপর আপনাগো খবর পাইয়া এহানে আইলাম। ওই আমার ময়নাপাখিডা যে কই গেছে খুঁইজাই পাইলাম না। তারপরে আবার পু*লিশের দৌঁ*ড়ানিও খাইছি।”
সুজনের কথা শুনে একজন বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,

“তোমার ওই ময়নাপাখি না কোকিল পাখি যাই থাকুক ওইসব ভুলে যাও। কাজের কথায় আসো। একবার যখন আমাদের সাথে ইনভলভ হয়েছ, তখন আর নিস্তার নাই। মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সাথে কাজ করতে হবে। সামনে মৃত্যু দেখলেও গা*দ্দা*রি করা যাবে না। কিন্তু তোমাদের স্বভাবে এখনও লয়ালিটি দেখা যায় না। নিজেদের নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে পরে আছ! কাজের কথা ভাব! মোটা অঙ্কের টাকা তো ঠিকই নিচ্ছই। কাজের কাজ তো কিছু করো! তোমাদের বলা হয়েছিল, মেজর মাশরিফের পরিবারের খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু তোমরা নিবে নিবে বলে আর নিলে না। তাই বাধ্য হয়ে আমরাই খোঁজ নিয়েছি। অনেক কিছুই জানলাম, এখন বোঝার বাকি।”

সুজন ও পলাশ আমতা আমতা করে মাথা নিচু করে নিল। ওরা নিজেদের গাফিলতির ব্যাপারে তো জানেই। তখন আরেকজন বলে,
“আরেকটা কাজ দিব। করতে পারবে?”
“জি স্যার পারুম। কন খালি।”
“টাঙাইলে দুইজন মেজরের বাড়ি। মেজর মাশরিফ ও মেজর অভী। শুনেছি ওরা বন্ধু। মেজর মাশরিফের পরিবার গতকালকে টাঙাইলে এসেছিল। তারপর আবার চলে গেছে। শুনেছি মেজর মাশরিফের মা মির্জাপুর থাকে আর বোন ঢাকায় থাকে। শুনেছি বনানীতে। এখন তোমাদের মির্জাপুর যেতে হবে।”

“স্যার মির্জাপুরের কোথায়?”
“ক্যাডেট কলেজের ভেতর।”
“কলেজের ভিতর কি ঢুকতে দিব?”
“ওখানে ঢোকা কষ্টকর তবে পেছনের দিকে একটা গেইট আছে যা দিয়ে লোকাল মানুষজন মাঝেমধ্যে যাওয়া আসা করে। পেছনের দিকেও দারোয়ান থাকে। জিজ্ঞেসা করে যেতে দেয়।”
“আচ্ছা স্যার। আপনেরা চিন্তা কইরেন না। আমরা এবার ঠিক মতো কাম করমু। এহন করতে হইব কি? মা*ই*রা লামু না-কি?”
টে*রো*রি*স্ট লোকটা দ্রুত বলে ওঠে,

“না না। একদম না। নজর রাখবে। মিনিটে মিনিটে খবর দিয়ে মেজর মাশরিফকে হাতের মুঠোয় আনতে হবে। আর হ্যাঁ। মেজর মাশরিফদের বাড়িতে কাল কয়েকজন গেস্ট এসেছিল। গুপ্তচর বলল, ওরা নাকি আগে কখোনো আসেনি। বাকি খোঁজ খবর নিতে হবে। দুইদিন আগেও আমাদের এক মেম্বার আর্মিদের গু*লি*তে নিহত হয়েছে। ওরা এখন সাইলেন্টলি অ্যাটাক করছে। তাই আমরা সিলেটের দিকে শিফট হতে চাইছি। চট্টগ্রাম, বান্দারবান, খাগড়াছড়িতে এখন ওদের টহল বেড়ে গেছে। ওখানে অপারেশন বেড়ে গেছে। তিন মাসে আমাদের তিন জন মেম্বার কমে গেছে। এসবের হিসাব তো আমাদেরই দিতে হবে। তাই নেক্সট টার্গেট সাধারণ মানুষদের সাথে মিলেমিশে চলা। সাধারণ ঘরে বিয়ে করা। আমাদের ন*কল জা*তীয় পরিচয়পত্র তো আছেই।”

পলাশ জবাব দেয়,
“চিন্তা কইরেন না স্যার। মনে করেন আপনাগো কাজ হইয়া গেছে।”

সপ্তাহ খানেক পর। কাশফা এতোদিন রিতিকার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। ফোন বন্ধ পায় বারবার। আজ কল ঢুকেছে। সে অপেক্ষা করছে কখন রিতিকা ফোন রিসিভ করবে।
এদিকে রিতিকা এতোদিন পর নিজের সিমকার্ড লাগিয়ে কাশফাকেই ফোন করতে দেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। অতঃপর বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করল।

“এই রিতি আপু! কী হয়েছে তোমার? সেইদিনের পর থেকে ফোন বন্ধ কেন? কতোবার কল করেছি জানো? তোমাকে মেসেঞ্জারেও পাচ্ছি না।
রিতিকা আমতা আমতা করে মিথ্যে বলে,
“ফোন নষ্ট হয়েছিল। তাই আরকি!”
“ওহ আচ্ছা। শোনো, আন্টিকে বলেছিলে? কী বলল? কবে প্রস্তাব পাঠাবে? কয়েকদিন পর সেকেন্ড ইয়ারে উঠব, বাড়িতে বিয়ের কথা বলছে। আমি তোমার ভাইয়ের কথা বলে রেখেছি। এখন তোমরা প্রস্তাব পাঠালেই হলো।”
রিতিকা এবার গভীর শ্বাস ফেলে বলল,

“সরি কাশফা, মা রাজি না আর ভাইও না। মায়ের ও ভাইয়ের দুজনেরই তিতির মেয়েটাকে পছন্দ। ভাই মেয়েটাকে ভালোবাসে।”
কাশফা হতভম্ব হয়ে বলে,
“তিতির! মানে ওই দিন আসলো ওই মেয়েটা?”
“হ্যাঁ। বিধবা মেয়েটা। অবশ্য যেই দুটো মেয়ে এসেছিল মানে ননদ-ভাবী, দুটোই বিধবা। ননদটাই তিতির। ওকেই ভাইয়ের পছন্দ।”

“এজন্য বিধবা! তোমার ভাইয়ের পছন্দ এতো নিচে কেন? বিধবা মেয়েকে ভালোবেসে বসেছে! এই মেয়ের সাথে পরিচয় হলো কিভাবে? আর এতো বছর পর আন্টির বোনকে খুঁজে পাওয়া! তোমার ভাইকে সামলাও আপু!”
“কী করব বোন! শুনেছি তিতিরকে মাশরিফ চিনে মাশরিফের সিনিয়র মেজর রায়ান না রিহান যেন! সে নিঃখোঁজ হওয়ার পর তার বাসায় গিয়েছিল তখন থেকে।”

“নিঃখোঁজ মেজর! খবরের কাগজে পড়েছিলাম মনে হয়। যাই হোক, তোমার ভাইকে ওই মেয়ের থেকে দূরে করো। নয়তো আমিই করব। মাশরিফের জীবনটা নষ্ট করে দিবে মেয়েটা।”
কাশফার সাথে রিতিকাও একমত পোষণ করে। তারপর কথা বলা শেষে ফোন কে*টে দিলে কাশফা রেগে ব্যালকনির রেলিংয়ে থাকা কফির মগটা ফেলে দেয়। মেঝেতে পরে মগটা কয়েক টুকরোকে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটা টুকরো হাতের মুঠোয় চেপে রেগে হিসহিসিয়ে সর বলে ওঠে,”মাশরিফ আমার, নয়তো কারও না!”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩১

পিকনিকের কারণে ও ফ্রেন্ডের হলুদের কারণে অর্ধেকের মতো লেখা থাকলেও আর লেখা হয়নি। পিকনিকে থেকেই একটু দলছুট হয়ে লিখলাম।
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৩