এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩১

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩১
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

সন্ধ্যার চা-নাস্তা ও আড্ডা শেষে মহিমা বেগম বিশ্রামের জন্য নিজের ঘরে গিয়ে সবে বিছানায় কাত হয়েছেন তখনি রিতিকা হাজির। রিতিকা এসে মহিমা বেগমের পাশে বসে। মহিমা বেগম জিজ্ঞেসা করেন,
“কিছু বলবি?”
রিতিকা কিভাবে শুরু করবে তাই ভাবছে। মেয়ের থেকে কোন জবাব না পেয়ে মহিমা বেগম বলেন,

“হাঁটুতে খুব ব্যথা করছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্না করতে হয়েছে যে। সাথে কোমর ব্যথাতো আছেই!”
রিতিকা এবার বলে,
“মা আমি তোমাকে মুভ লাগিয়ে দেই? ”
“দিবি? দে তাহলে।”
রিতিকার ওয়ার্ড্রপের ড্রয়ার থেকে মুভ মলম বের করে মায়ের হাঁটুতে ও কোমরে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মা, ভাইয়ের বিয়ের জন্য কিছু ভাবলে?”
মহিমা বেগম একটু আরাম পেয়ে চোখ বুজেই জবাব দেন,
“এখনো ভাবিনি। ওর যখন বিয়ে করার হবে তখন তো বলবেই। ”
“তা বললে কি হয় মা! ও তো এখন ভালো চাকরি করে। সেখানে পদোন্নতিও হয়েছে। এখন তো তার বিয়ে করার দরকার। তাছাড়া তোমার বয়স হয়েছে, আমিও দূরে থাকি। তুমি কোয়াটারে একা একাই থাকো। সাথে যদি ছেলের বউ থাকে তাহলে তো আর সমস্যা হয় না। ওদিকে মাশরিফেরও তো টেনশন হয়। বিয়ে করে বউ এখানে রেখে গেল, তারপর ওরও ওইখানে টেনশন কমলো আর তুমিও একজন সঙ্গী পেলে।”

“কথাটা মন্দ বলিসনি। কিন্তু ওরও তো একটা প্রিপারেশন আছে। যখন মনে হবে বলবে। আমার চাকুরি যতোদিন আছে ততোদিন আমি একাই সামলে নিব।”
রিতিকা তার মায়ের কথা শুনতে নারাজ। সে নাছোড়বান্দার মতো বলে,
“আমারও তো চিন্তা হয়। তোমার জামাইয়ের চাকুরির জন্য এসে থাকতেও পারিনা, আবার তোমার চাকুরির জন্য তোমাকেও নিতে পারিনা। মাশরিফের বিয়েটা এবার এলে দিয়ে দিলে ভালো হয়। আর মেয়ে তো আমাদের কাছেই আছে! চেনা জানার মধ্যে!”

রিতিকার প্রস্তাব শুনে মহিমা বেগম ভ্রুঁ কুঁচকালেন। অতঃপর চোখ খুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“বুঝলাম না! তুই কি তিতিরের কথা বললি?”
মায়ের হঠাৎ করে তিতিরের প্রসঙ্গ তোলাতে রিতিকা অবাক হয়। সে উত্তরে বলে,
“তিতিরের কথা কেন বলতে যাব? আমি তো কাশফার কথা বলছিলাম।”
“কাশফা!”

মহিমা বেগমের হতচকিত পতিক্রিয়াতে রিতিকা সন্দিহান কণ্ঠে শুধায়,
“তুমি হঠাৎ তিতিরের কথা কেন বলছ? ও তো বিবাহিতা। আবার বিধবাও! একজন বিধবার সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ের কথা কেন বলব?”
মেয়ের প্রত্যুত্তরে মহিমা বেগম মোটেও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন,
“কেন? বিধবা হয়েছে তো কি হয়েছে?”
রিতিকার যেন কৌতুক পেল! সে হাস্যরসে বলল,

“বিধবা হয়েছে তাতে তো কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আমার ভাইয়ের জন্য বিধবা মেয়ের কথা আমি কেনই বা বলব? আমার ভাই কি কোনো দিক দিয়ে কম? রাজপুত্রের মতো ভাই আমার। ওর জন্য তো রাজকন্যাই খুঁজব।”
“রাজকন্যা বলতে কাশফা?”
“হ্যাঁ।”
মেয়ের কথায় মহিমা বেগম তাচ্ছিল্য হাসলেন। অতঃপর বললেন,

“তোমার ভাই মেজর, তাই নাহয় রাজপুত্র বলছ। তবে কাশফা কী করে? সে কী এমন করেছে যার কারণে তাকে রাজকন্যা বলছ? প্রতিটা মেয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে রাজকন্যা কিন্তু অন্য কারও কাছে রাজকন্যা মানে সে বিশেষ কিছু তো অবশ্যই! বলো? সে কী কোনো মহৎ কার্যসাধন করে ফেলেছে? যার দরুণ তুমি তাকে রাজকন্যা বলছ!”
রিতিকা থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
“আমি সেটা বোঝাইনি তো মা! আসলে…”
“আসলে কী? তোমার কথার ধরণ আমি বুঝতে পারছি না। যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে। ঘোরপ্যাঁচ লাগানো কথা আমি বুঝি না।”

রিতিকা অবাক হচ্ছে। তার মায়ের কথার ধাঁচ হঠাৎ বদলে গেল কেন? তা সে বুঝতে পারছে না।
“মা, তুমি এভাবে বলছ কেন? কী হয়েছে তোমার? তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছ? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? ”
“তোমার কী মনে হয়?”
রিতিকা কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে,
“আমি যদি ভুল কিছু বলি তাহলে বলো।”
“সে নাহয় পরে বলব। আগে তুমি তোমার কথা শেষ করো। যা বলতে এসেছ শুধু সেটুকুই বলো।”
রিতিকা লম্বাশ্বাস ফেলে বলে,

“তুমি তো জানো মা, কাশফা ভাইকে পছন্দ করে। তাছাড়া ও চেনা-জানার মধ্যে ভালো মেয়ে। আর পরিবারও ভালো। তাই বলছিলাম কি, ভাই ও কাশফার বিয়ের কথা যদি আগানো যায়!”
এবার মহিমা বেগম বললেন,
“এইতো, সরাসরি বলেছ।”

মায়ের প্রত্যুত্তরে রিতিকা কিঞ্চিত খুশিও হয় কিন্তু পরক্ষণেই তার হাসি মিলিয়ে যায়। মহিমা বেগম বলেন,
“আমার জবাব হচ্ছে, না! কাশফা তোমার কাছে ভালো মেয়ে মনে হয় কিন্তু আমার ও মাশরিফের কাছে ভালো মেয়ে কিনা তা তো তুমি জানো না। তাছাড়া তোমার পছন্দ হলেই তো হবে না! যে বিয়ে করবে তারও তো পছন্দ হতে হবে। তার পছন্দই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। মাশরিফ সাফ সাফ মানা করে দিয়েছে সে কাশফাকে বিয়ে করতে চায় না। কাশফাকে ওর পছন্দ না। ওর অন্য কোথাও পছন্দ আছে। তাই তুমি কাশফার কথা কখোনো না তুললেই আমি খুশি হব।”

রিতিকা হতবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে আছে। তার মা এই মুহূর্তে কী বলল তা সে বুঝতে পারলেও মেনে নিতে পারছে না। সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
“তুমি সত্যি বলছ মা? মাশরিফের সত্যিই কি অন্য কোথাও পছন্দ আছে?”
“হ্যাঁ। আমি তোমাকে মিথ্যে বলতে যাব কেন? তোমাকে মিথ্যে বলে আমার কি লাভ ! ”
রিতিকা চুপ হয়ে কিছুটা সময় বসে রইল। মহিমা বেগম মেয়ের মুখচ্ছবির প্রতিক্রিয়া দেখে আর কিছু বললেন না। ক্লান্তিতে তার ঘুমে ধরে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন মেয়ের কথাতেই ঘুম উড়ে গেছে। আজানের ধ্বনি ধরণীতে প্রতিফলিত হচ্ছে। মহিমা বেগম শোয়া থেকে উঠে অর্ধশোয়া হয়ে বসলেন।
আজান শেষ হলে রিতিকা হুট করে জিজ্ঞেসা করে,

“যদি ভাইয়ের অন্য কোথাও পছন্দ থেকেই থাকে, তাহলে তুমি একটু আগে তিতিরের কথা কেন বললে?”
মহিমা বেগম আর কথার ঘোরপ্যাঁচ চাইলেন না। তিনি এবার সরাসরি জবাব দিলেন,
“তিতিরকেই মাশরিফ পছন্দ করে। আমাকে সেটা ও জানিয়েছেও।”
রিতিকা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মহিমা বেগম আবার বললেন,

“তিতির বিধবা এটা জেনেই আমার ছেলে ওকে ভালোবেসেছে। তাই তিতিরকে কোনো রাজকন্যা না হলেও চলবে। তিতির যেমন, ওকে আমার ছেলে তেমনি ভালোবেসেছে। তোমার এতে আপত্তি থাকলেও কিছু করার নাই। আমারও তিতিরকে বেশ পছন্দ হয়েছে। তোমার যদি আর কিছু বলার থাকে তবে বলতে পারো তবে কাশফার ব্যাপারে না এবং তিতিরকে কেনো পছন্দ করল সেটার ব্যাপারেও না। সারাদিনে আমি অনেক ক্লান্ত।”

মায়ের কথার ধাঁচ বুঝে রিতিকা চুপচাপ উঠে আসল। নিজের ঘরে এসে বিছানায় মাথা নিচু করে বসল। সায়ান চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়েছিল আর রিয়ান ড্রয়িংরুমে কার্টুন দেখছে।
রিতিকার উপস্থিতি টের পেয়ে সায়ান ওই অবস্থাতেই জিজ্ঞেসা করে,
“কী বলল মা?”

রিতিকা শুনেও কোনো জবাব দেয় না। প্রায় মিনিট খানেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সায়ান জবাব না পেয়ে উঠে বসে। তারপর স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে শুধায়,
“কী হলো? এমন থম মে*রে বসে আছ কেনো? মা কী বললেন? রাজী না?”
রিতিকা সায়ানের দিকে ঘুরে তাকালো। রিতিকার চোখের ভাষাতে সায়ান হতাশা দেখতে পেল। সায়ান উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেসা করে,

“বলো না? কী বলেছে মা?”
“কাশফাকে মায়ের ও ভাইয়ের পছন্দ না। তাদের ওই বিধবা তিতিরকে পছন্দ!”
সায়ান কিঞ্চিত অবাক হয় কিন্তু রিতিকার কণ্ঠে হতাশার সম্পূরক তাচ্ছিল্যতাও প্রতিয়মান।
“আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। কাশফার কথা বলো না। কিন্তু তিতিরকে পছন্দ শুনে অবাক হলেও ভালো লাগছে। মেয়েটাকে দেখে ও জীবনে ঘটে যাওয়া সব শুনে মনে হলো, মেয়েটার সহ্যশক্তি মাশাআল্লাহ। ওর সাথে ভালো কিছু হোক তা আমি মন থেকে চাই। মাশরিফও যে ওকে পছন্দ করে তাতে গর্ববোধ হচ্ছে যে আমার শ্যালকের চিন্তাধারা গতানুগতিক ধারার থেকে ভিন্ন।”

রিতিকা তার স্বামীর থেকে এরূপ জবাব আশা করেনি। আজ সবাই তাকে হতাশ করছে। রিতিকা এবার রূঢ় স্বরে বলল,
“ওই মেয়েটার বিয়ের পরপরই স্বামী নিঃখোঁজ হয়ে মা*রা গেছে। তারপর বাবা, ভাই, শ্বশুর সবাই একে একে অল্প সময়ের ব্যাবধানে পরলোকগমন করেছে। তাহলে বুঝতে পারছ?”
সায়ান ভ্রুঁকুটি করে বলে,
“কী বুঝব?”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩০

“ওই তিতির নামক মেয়েটা একটা অল*ক্ষী! আমার ভাইয়ের জীবনে আসলে ওর জীবনটাও ধ্বং*স করে দিবে!”
রিতিকার এমন আকস্মিক উদ্ভট কথায় সায়ান কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে! এতো আধুনিক চিন্তাধারার রিতিকাও এসব বলছে! তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩২