এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩০

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩০
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

বাসস্ট্যান্ড থেকে তিতিরদের বাড়িতে আনতে মহিমা বেগম করিম চাচাকে পাঠিয়েছেন। করিম চাচার কাছে তিতিরের মায়ের নাম্বারটাও তিনি দিয়ে দিয়েছেন, যাতে দরকার পড়লে বা চিনতে না পারলে যেন ফোন করতে পারে।
করিম চাচা বাসস্টপে যাওয়ার আধাঘণ্টা পর নাজমা বেগম ও তিতিরদের নিয়ে বাড়িতে ফিরেন। মহিমা বেগম বোনকে দেখে আবেগে জড়িয়ে ধরেন। তিনি জিজ্ঞেসা করেন,

“আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
নাজমা বেগম হাস্যজ্জল জবাব দেন,
“আরে না। বাস থেকে নামার আগেই করিম ভাইয়ের ফোন পেয়ে আর কোনো অসুবিধাই হয়নি।”
মহিমা বেগম স্বস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে হিয়ার কোল থেকে হায়াতকে নিয়ে তার মেয়ে ও মেয়ে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“রিতি, সায়ান। দেখো, নাজমা হচ্ছে আমার চাচাতো বোন। মানে আমার আপন বোনের মতোই। এরা( তিতির ও হিয়াকে দেখিয়ে) হচ্ছে নাজমার মেয়ে ও ছেলের বউ। আমার কোলের এই ছোট্ট বাচ্চাটা হিয়ার চার মাসের মেয়েটা হায়াত।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বাচ্চাটার কথা শুনে রিতিকা বাচ্চাটার কাছে গিয়ে হাত ধরে আদর করলেও কোলে নিল না! ব্যাপারটা সায়ানের কাছে ভালো লাগল না। দিন দিন রিতিকার ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সায়ান। তার স্ত্রী তো এতটাও হৃদয়হীনা কখনো ছিল না! সায়ন এবার নিজে গিয়ে হায়াতকে কোলে নিল। বাবাহীন মেয়েটা সায়ানের কোলে গিয়ে একদম বুকের সাথে মিশে আছে। সায়ান ও রিতিকার ছেলে রিয়ানও ছোটো বাচ্চা দেখে বারবার কোলে নিতে চাইছে।
পরিচয় পর্ব ও কুশলাদি শেষে মহিমা বেগম তিতিরদের রেস্ট নেওয়ার জন্য গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়। একটু পরেই দুপুরের খাবারের জন্য সবাই একত্রিত হবে। গেস্টরুমটা মাশরিফের রুমের পাশেই। নাজমা বেগম ভুল করে মাশরাফির রুমের দরজায় হাত দিলে রিতিকা পেছন থেকে এসে বলে,

” ওটা গেস্ট রুম না আন্টি। ওটা আমার ভাইয়ের রুম। পাশেরটা গেস্ট রুম।”
নাজমা বেগম রিতিকার কথায় পেছনে ঘুরে তাকিয়ে হালকা হেসে বলেন,
” পাশাপাশি রুম তো, তাই বুঝতে পারিনি।”
প্রত্যুত্তরে রিতিকা জোরপূর্বক হাসে। নাজমা বেগম রিতিকার মনোভাব বুঝতে না পারলেও তিতির ঠিকই বুঝতে পেরেছে। রিতিকা যে তাদেরকে ভালোভাবে নিচ্ছে না, তা তার কথার ধাঁচে পরিলক্ষিত। তিতির মা ও হিয়াকে নিয়ে গেস্ট রুমের ভিতরে চলে গেল। দরজা লাগিয়ে তিতির বলে,

“সবাই যে আমাদের ভালোভাবে গ্রহণ করছে না তা লক্ষ্য করেছ?”
নাজমা বেগম ভ্রুঁ কুঁচকালেন।
“কই? কে ভালোভাবে গ্রহণ করছে না?”
“কেনো? মহিমা আন্টির মেয়ে। কথা তো একটু সুন্দর করেও বলা যায়।”
“বাদ দে তো। আমরা এসেছি কিছু সময়ে জন্য। হঠাৎ করে মায়ের বাপের বাড়ির আত্মীয় দেখলে অন্যরকম লাগবেই। তাছাড়া মহিমা আপাকে তো বাবা-চাচারা মেনে নেয়নি। মেয়েটার মনে হয়তো তা নিয়ে কোনো তিক্ততা আছে।”
মায়ের অকাট্য যুক্তিতে তিতিরের আর যুক্তি উপস্থাপন করতে ইচ্ছে হলো না। হাত-মুখ ধুঁয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

খাবার টেবিলে ওরা সবাই খেতে বসেছে। নাজমা বেগম মাশরিফকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেসা করেন,
“আপা, মাশরিফ কই? ওকে তো দেখছি না।”
মাশরিফের কথা উঠতেই তিতিরের হাত থেমে গেল আর রিতিকার কপাল কুঁচকে গেল। মহিমা বেগম জবাবে বলেন,
“ওর তো ছুটি পরেনি। ছুটি পরলেই আসে।”
এবার রিতিকা প্রশ্ন করে,
“আন্টি, আপনি আমার ভাইকে চিনেন?”

রিতিকার সন্ধিহান প্রশ্নের মানে নাজমা বেগম ধরতে পারলেন না। তিনি সরল মনে বলতে থাকেন,
“মাশরিফের মাধ্যমেই তো এতো বছর পর আমাদের সাক্ষাৎ হলো। ছেলেটা আমাদের কত সাহায্য করেছে জানো? ফরিদপুরে আমাদের বাড়ি বিক্রি করতেও মাশরিফ অনেক সাহায্য করেছে। তিতিরকে ময়মনসিংহতে ট্রান্সফার হতেও সাহায্য করেছে।”

রিতিকা আবারো প্রশ্ন করে,
“ওহ আচ্ছা! কিন্তু ভাই আপনাদের চিনল কিভাবে?”
“এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে মাশরিফ আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাছাড়া আমার মেয়ের জামাইও তো আর্মিতে ছিল। ওভাবেই।”
“আর্মিতে ছিল মানে? এখন নেই?”
রিতিকার পাল্টা প্রশ্নে নাজমা বেগম চুপসে যান। তিনি বুঝতে পারলেন তার এখন রাহানের ব্যাপারটা উল্লেখ করা করা উচিত হয়নি। এদিকে তিতির মায়ের এই সবাইকে আপন ভাবার স্বভাবটার জন্য মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। রিতিকার প্রশ্নের জবাবে তিতির বলে,

” না আপু। আমার হাজব্যান্ড আর এই দুনিয়াতে নেই।”
কথাটা শোনার জন্য রিতিকা ও সায়ান কেউই প্রস্তুত ছিল না। রিতিকা চুপ করে যায়। টেবিলের মহল অনুকূল করতে মহিমা বেগম বলেন,
“বাদ দাও তো সব। খাওয়ার সময় খাও। এতো কথা কিসের? আর তুইও রিতি! এতো প্রশ্ন কেন করতে হবে তোর?”
রিতিকা মায়ের বিরক্তি দেখে আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ খেতে থাকে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে প্রায় অনেকটা সময় গল্প গুজবেই চলে যায়। ঘড়ির কাঁটা যখন পাঁচটার ঘরের কাছাকাছি তখন নাজমা বেগম বলেন,

“আপা, আজকে আমাদের যেতে হবে। সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে।”
মহিমা বেগম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিয়ে বলেন,
“না। আজ কোথাও যাওয়া চলবে না। আজকে তোরা থেকে যা। কালকে যাস। আগামীকাল সায়ান তোদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
এরইমধ্যে তিতির ইতস্তত করে বলে,

“আন্টি, আমার সকালে ক্লাস আছে। আমরা আজই একা একা যেতে পারব। সমস্যা হবে না। তাছাড়া বেশি সময় তো লাগবে না। আড়াই-তিন ঘন্টা লাগবে।”
কিন্তু মহিমা বেগম একদম নারাজ। তিনি তার কথায় অটল।
“না বাবা! একদিন ক্লাস মিস দিলে কিছু হবে না। বন্ধুদের থেকে নোটস নিয়ে নিবে। এই সন্ধ্যা করে করে তোদের আমি ছাড়ছি না।”

তিতির কয়েকবার বুঝিয়েও সুবিধা করতে পারল না। মহিমা বেগম বাধ্য করলেন আজ থেকে যেতে। এদিকে রিতিকার ভালো লাগছে না। সে মায়ের সাথে কথা বলার পরিবেশ খুঁজছে কিন্তু মনে হচ্ছে আজও হবে না। রিতিকার অস্থীরতা সায়ান বেশ অনেকটক সময় ধরে লক্ষ্য করছে। সায়ান কাজের বাহানায় রিতিকাকে একটু ঘরে আসতে বলে আসর ছেড়ে উঠে গেল। রিতিকা পিছু গেলে সায়ান দরজা লক করে রিতিকাকে জিজ্ঞেসা করে,

“কী হয়েছে তোমার? সকাল থেকে তোমাকে কেমন অস্থীর লাগছে।”
রিতিকা আমতা আমতা করে বলল,
“কই কিছু নাতো। কী হবে আবার?”
“তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ কেনো? মনে কিছু থাকলে বলো তো।”
রিতিকা কিয়ৎ মৌন রয়। নিজের মস্তিষ্কের শব্দগুচ্ছ একটু গুছিয়ে নিয়ে বলে,
“আসলে আমি মায়ের সাথে কাশফার সম্পর্কে কথা বলতে চাইছিলাম।”
কাশফার নামটা শুনেই তৎক্ষণাৎ সায়ানের কপাল কুঁচকে গেল।
“কাশফার সম্পর্কে? কী কথা?”

“কাশফা ও মাশরিফের বিয়ে নিয়ে।”
কথাটা শোনামাত্রই সায়ান উত্তেজিত হয়ে খানিক উুঁচু স্বরে বলে ওঠে,
“হোয়াট! কাশফা ও মাশরিফের বিয়ে! সেদিন না মাশরিফ তোমাকে ক্লিয়ারলি বলে দিয়েছিল, সে কাশফাকে পছন্দ করেনা এবং বিয়েও করবে না।”
সায়ানের উচ্চস্বর শুনে রিতিকা ইশারায় সায়ানকে শান্ত হতে বলে। অতঃপর বলে,

“এখন ভালো না বাসলে যে বিয়ে করতে পারবে না! এমন তো কোন কারণ নেই। সবাই কি লাভ ম্যারেজ করে নাকি? পারিবারিক পছন্দেও তো বিয়ে করে। তাছাড়া কাশফা যেহেতু মাশরিফকে পছন্দ করে তাহলে বিয়ে করতে সমস্যাটা কোথায়?”
“সমস্যাটা কোথায় তুমি জানো না? মাশরিফ চায় না কাশফাকে বিয়ে করতে। তারপরেও তুমি জোর করছ। তোমাকে বারবার মানা করি, ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ না করতে। তাও তুমি কথা শোনো না। মেয়েটা যে প্রতিনিয়ত তোমাকে বোকা বানাচ্ছে ও ব্রেণ ওয়াশ করছে তা তো তুমি বুঝতেও পারছ না।”
রিতিকা বিরক্ত হয়ে বলল,

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ২৯

“আমি ছোটো বাচ্চা না যে বুঝব না। বরং তোমরা বুঝো না। বাদ দাও। আমি মায়ের সাথে কথা বলব।”
“যা খুশি করো। আমার মনে হয় না, মা রাজি হবেন!”
“দেখা যাক।”
এই বলে রিতিকা দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পেছোনে সায়ান হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ে।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩১