খড়কুটোর বাসা পর্ব ৩৩

খড়কুটোর বাসা পর্ব ৩৩
Jhorna Islam

প্রবাস জীবন আমরা মনে করি খুব সহজ তাই না? শুধু টাকা আর টাকা। একটা মানুষ তার সব ছেড়ে পরিবার, আত্নীয় স্বজন নিজের জন্মভূমি চেনা সব কিছু ছেড়ে অন্য অচেনা দেশে পাড়ি জমায়।যেখানে তার নিজের বলতে কেউ নেই। শুধুমাত্র পরিবারের সুখের কথা ভেবে।নিজেদের আর্থিক ভাবে সফল করতে। আপনজনদের চা’হিদা পূরণ করতে।
কোনো উৎসবে নিজের আপনজনদের পাশে পায় না। না পায় কোন আনন্দের মুহূর্তে।

উৎসব মুখর দিন গুলোতেও মাঝে মাঝে কেউ নিজের জন্য আলাদা করে কিছু কিনে না বা কেনার প্রয়োজন মনে করে না।ভাবে যেই টাকা দিয়ে আমি আলাদা করে এসব করবো ঐ টাকা গুলো আমার পরিবার তাদের প্রয়োজনে খরচ করবে। তারা অনেক অনেক ত্যা’গ করে তবুও সবাই তাদের বুঝতে পারে না। খুব কম সংখ্যক মানুষ ই আছে যারা তাদের ত্যা’গটা বুঝতে পারে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আর সব থেকে বড় ত্যা’গটা স্বী’কার করে প্রবাসীদের বউরা।কোনো আনন্দের দিনেও নিজের একান্ত প্রিয় মানুষ টা কে কাছে পায় না। কাঁধে মাথা রেখে দুইটা সুখেের দুঃখের কথা বলতে পারে না। কোনো বি’পদে আ’পদে হাতে হাত রেখে ভরসা দিতে পারে না। সেই দূর থেকে দেখেই চোখ মন জুড়াতে হয়। পাশে পাওয়া যে বড় দু’স্ক’র।
একা একটা পরিবার কে সামলাতে হয়।নিজেকে ঠিক রাখতে হয়। একটা মেয়ের সবচাইতে আনন্দের প্লাস কষ্টের মুহূর্ত হলো প্রে’গ’ন্যা’ন্সি’র সময় যেই সময় টা তে নিজের একান্ত মানুষ টা কে কাছে দরকার সবচেয়ে বেশি তখন তাকে কাছে পায় না। ভ’য় পেলেও মানুষ টা কাঁধে হাত রেখে ভরসা দেওয়ার জন্য থাকে না। এই কঠিন মুহূর্ত টা তাকে সেই মানুষ টা ছাড়াই পাড় করতে হয়। একা একা সব করতে হয়।নিজের সন্তান কে মানুষ করতে হয়।
একজন প্রবাসী আর তার বউ জীবন যুদ্ধে তারাও যুদ্ধা।

যুথির এখন নয় মাস চলে। ভরা পেট নিয়ে হাটা চলা করতে পারে না। হাতে পায়ে পানি নেমে গেছে। কিছু খেতে পারে না এখন আগের মতো। প্রথম যেরকম খাওয়ার প্রতি আগ্রহ ছিলো এখন একটা দা’না কাটতে ও ইচ্ছে করে না দাঁত দিয়ে। সারাক্ষণ ছ’ট’ফ’ট ছ’ট’ফ’ট করে। কি যে অ’সহ্য য’ন্ত্র’না। দ’ম ব’ন্ধ লাগে। তার বোকা পুরুষ কে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। ভিতরে তার ভ’য় ঢুকে গেছে।

যদি কিছু হয়ে যায়। ঐ মানুষটা কে যদি আর না দেখতে পায় কখনো।সারাক্ষণ আজে বাজে চিন্তা মাথায় আসে।
তার কিছু হয়ে গেলে ঐ মানুষ টার কি হবে? কি করবে মানুষ টা। হয়তো ম’রেই যাবে।
এখন মাথায় একটা কথাই ঘুরছে সে হয়তো বাঁচবে না।লোকটার কি হবে এটা ভেবে কান্না জুড়ে দেয়। যে সে কান্না না হি’চ’কি তুলে কাঁদতে থাকে। নাকের জলে চোখের জলে এক করছে।

অমন সময় ইরহান কল করছে।যুথি বালিশের নিচে থেকে ফোনটা নিয়ে দেখে ইরহান কল করেছে। যুথি কাঁদতে কাঁদতে ফোনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এক হাতে ফোন আরেক হাত দিয়ে গলায় থাকা মোটা চেইন টা পেঁচাচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার চোখের পানি ও মুছে নিচ্ছে। ইরহান যুথির জন্য স্বর্নের চেইন পাঠিয়েছে। আরো কতো কি পাঠিয়েছে। এই কয়েকমাসে নিজেদের আর্থিক স্বচ্ছলতা অনেকটাই লা’ঘব হয়েছে।
যুথি ম’রে গেলে ইরহানের কি হবে সেইটা ভেবে কাঁদছে মেয়েটা।অথচ লোকটা যে ফোন দিচ্ছে সেই দিকে তার খেয়াল নেই। সে তো দুঃখ বিলাস করতে ব্যস্ত।

ইরহান বার কয়েক কল দিয়েও সাড়া পেলো না। তখন মাথায় চিন্তা ঢুকে যায়। এমনিতেই শান্তিতে থাকতে পারে না এখন ইরহান।যতদিন ঘনিয়ে আসছে ততো চিন্তা বাড়ছে।
মেয়েটা ফোন না তোলায় কয়েকমাস আগের সেই সন্ধার কথা মনে পরে গেলো।বুকে অজান্তেই বুঝি হালকা ব্যাথা অনুভব হলো।

ঐদিন কি হয়েছিল যুথি ইরহানকে জানায় নি।শুধু এটুকুই বলেছিলো ইরহান কে যে বলেছে সীমার সাথে গল্প করেছিলো সেটা মিথ্যা। ইরহান আর জোর করেনি।পরে অবশ্য ইরহান দাদিকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো। উনিও কিছু বলতে পারেনি।বলবে কি করে উনি শত চেষ্টা করেও বলাতে পারেনি।তাই ইরহান ই বারণ করেছে জোর না করতে।
ঐ ঘটনার পর যুথি রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারতো না। মাঝরাতে হুট করেই স্বপ্নে এসে দৃ’শ্য গুলো হানা দিতো।ভাবতেই শরীর শি’উ’রে উঠতো।
যুথি কে আর কল দিলো না ইরহান।

তারাতাড়ি কল লাগালো দাদি কে দাদি তখন রান্না ঘরে বসে তরকারি কাটছে।রাতের রান্নার জন্য।
যুথির ফোন সাইলেন্ট হলেও ওর দাদির বাটন ফোন টা সাইলেন্ট না।ইরহান কল দেওয়া মাত্র তা বি’কট শব্দে বেজে উঠে। এর এতোই তীব্রতা একজনের কান আর মাথা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এতক্ষনে যুথি তার কান্না থামিয়ে ফেলেছে।এখন শুধু মাঝে মাঝে হিচকি তুলছে।
দাদির ফোনের আওয়াজে বেশ বিরক্ত হয়ে যায়। চোখ মুখ কোঁচকায়। আস্তে করে বলে,, এই বুড়িকে কতোবার বলছি এই সাউন্ড বক্স টা সাইলেন্ট রাখতে কিন্তু শুনে না একটা কথাও।

দাদি এই দাদি তোমার ফোন বাজতাছে ঐ রুমে ধরো গিয়ে। আমার মাথা ধরছে।
যুথির দাদি তরকারি কাটা রেখে তারাতাড়ি ঘরে ঢুকে ফোন হাতে নিয়ে দেখে ইরহান কল করেছে। কল রিসিভ করতেই বলে,,দাদি সব ঠিক আছে? যুথি ঠিক আছেতো? ফোন কেন ধরছে না।
দাদি যুথির কাছে এসে যুথির দিকে ব্রু কোচকে তাকিয়ে বলে,, সবই তো ঠিক আছে নাত জামাই। তোমার বউ ও ঠিক আছে। এই নাও কথা কও বলেই যুথির দিকে ফোন টা দিয়ে তরকারি কাটতে চলে যায়। চলে যেতে যেতে বলে,,, এই মেয়েটা কি যে করে না।শুধু শুধু আমার চান্দের লাহান নাত জামাই কে চিন্তায় রাখে।
যুথি ফোন হাতে নিয়ে কানে ধরে।
ঐপাশ থেকে ইরহানের কন্ঠ স্বর ভেসে আসে। আমার যুথি রানী কি আমার উপর কোনো কারণে রে’গে আছে?

কথা বলবে না? সেকি জানে না তার কন্ঠ স্বর না শুনলে তার বোকা পুরুষ কতোটা কষ্ট পায়।
আমি কারো উপর রে’গে নেই।
অভিমান করেছো?
উহুু।
তাহলে শরীর খারাপ লাগছে?
আমি ঠিক আছি।
কান্না কেন করেছো তুমি?
ক-কই নাতো।কান্না করবো কেন?
আমি আমার বউয়ের গলার স্বর ভালো করে চিনি।তোমার কান্নার স্বর, আমি খুব ভালো করেই চিনি।
কি হয়েছে যুথি রানী আমাকে বলবানা?

আমার কিছু ভালো লাগে না।শুধু মনে হয় আমি হয়তো আর বা-,,,,,,
খবরদা’র মুখ দিয়ে উচ্চারণ ও করবানা।এখানেই থেমে যাও।ঐ ফোনে ভিডিও কল দিতেছি রিসিভ করো।
কল কেটে ইরহান আবার যুথির ফোনে ভিডিও কল দেয়।
এতো টেনশন করো কেন তুমি? আ’জে বা’জে চিন্তা মাথায় আনবানা একদম।তোমাকে বা’চতে হবে।আমার জন্য তোমাকে বাঁ’চতে হবে। মনে সাহস রাখো।যখন তোমার বেশি চিন্তা হয় তখন আমার কথা মনে করবে।আমার এই দুনিয়ায় তুমি ছাড়া কেউ আপন না। তুমি ছাড়া আমি কিছুই না। অন্তত আমার জন্য নিজেকে ঠিক রাখো খাওয়া দাওয়া করো। কোনো দুশ্চিন্তা করো না।

আমার কথা রাখবে তো?
হুম।
ইরহান আরো নানান ধরনের কথা বলতে থাকে। যুথির মন ভালো হয়ে যায় কথা বলতে বলতে।
ইরহানের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হাসে।ইরহান অপলক দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে তার যুথি রানীর সেই হাসি উপভোগ করে।

ইশান কে ঐদিন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর অনেক হ’য়রানি তে পরতে হয়েছিলো। কিছুতেই ডাক্তার রাখতে চাইছিল না। বেঁচে থাকার কোনো আশাই ছিল না।মাথায় খুবই বা’জে ভাবে আ’ঘাত পেয়েছে।
ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিলো চিকিৎসা করেও কোনো লাভ নেই। কোনো আশাই দিতে পারবে না। তাছলিমা বানু অনেক বলে কয়ে হাতে পায়ে ধরে ডাক্তারদের রাজি করিয়েছে।যতো টাকা লাগে তার ছেলেটা কে যেনো বাচিয়ে দেয়।

ইশানের অপারেশন হয়।কিন্তু কোনো আশাই দেয়নি ডাক্তার রা। ইশান কো’মা’য় চলে যায়। হাসপাতালে রাখতে অনেক টাকা। তাছলিমা বানু কি করবে বুঝতে পারছিলো না। এর মধ্যে ইমনের পা ঠিক হয়নি।একবার ও ইশান কে লিমা ও দেখতে আসেনি। ইশানের বন্ধুরাও ইশান কে সেই যে হাসপাতালে দিয়ে গেছে আর আসেনি।
এই বয়সে এসে তাছলিমা বানু হা’পিয়ে উঠেছে।ছেলেটা ম’রার মতো পরে আছে। ইশান একটা খোঁজ খবর ও নেয় না ভাইটা কেমন আছে।

এর মধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে ইশানের বউ ইশান কে মে’রেছে।পুলিশ খুঁজেও দিনা কে কোথাও পায়নি। ইরহান আর যুথির দাদি এসব শুনে বেশ অবাক হয়ে ছিলো।ইরহান অনেক কষ্ট ও পেয়েছে।তবে কারো কাছে সেটা স্বীকার করে নি।

খড়কুটোর বাসা পর্ব ৩২

আশ্চর্যের বিষয় হলো ইশানের সাথে এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরও যুথি ছিলো নির্বাক।ভালো মন্দ কিছুই বলেনি।যুথির এমন ব্যবহারে দাদি বেশ অবাক হয়। কারণ যতই ওদের সাথে খারাপ করুক না কেন ধোকা দিয়ে সব নিয়ে যাক না কেন।যুথি মুখে হলেও অসুস্থ মানুষের প্রতি কিছু টা দুঃখ প্রকাশ করতো।
কিন্তু কেউতো জানে না যুথির সাথে ইশান কি করতে চেয়েছিল।

খড়কুটোর বাসা পর্ব ৩৪