এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৪০

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৪০
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

দুই পক্ষে সম্মতি নিয়ে বিয়ে পড়ানোর শেষে তিতিরকে মাথার উপর ওড়না ঝুলিয়ে ড্রয়িং রুমে নেওয়া হচ্ছে দোয়া পড়ানোর জন্য। তিতির চাইছিল দোয়া পড়ানোর সময় সে তার নিজের রুমেই থাকুক, তারপর যাবে। কিন্তু রণক ও বাকিরা বলছে বর-কনের সামনে ফুলের পর্দা দিয়ে দোয়া পড়ানো হবে। দোয়া পড়ানোর পরে মাশরিফ সেই পর্দা সরিয়ে তার বধূর মুখদর্শন করবে। ব্যাপারটা তিতির এর কাছে অনেকটা সিনেমাটিক মনে হল কিন্তু বন্ধু-বান্ধবীর জোড়ে তাকে এই সিনেমাটিক কাজটাই করতে বাধ্য করল। এদিকে মহিমা বেগম ও নাজমা বেগমেরও একটা বড়োসড়ো ইন্ধন কাজ করছে! নিজেদের ছেলে-মেয়ের বিয়েটা খুব সুন্দর হোক সেটা তো প্রত্যেক বাবা-মা চায়।

দোয়া পড়ানোর শেষে মাশরিফ ফুলের পর্দা সরালো। অতঃপর তিতিরের মুখের উপর আচ্ছাদিত ঘোমটা দেওয়া ওড়নাটা সরিয়ে কিয়ৎ মূহুর্ত অপলক চেয়ে থেকে মুগ্ধ চিত্তে অস্ফুট স্বরে বলল,
“মাশাআল্লাহ!”
অস্ফুট স্বর হলেও তিতির শুনেছে। সে তো লাজুকলতার ন্যায় তন্ময় হয়ে ছিল সদ্য বিয়ে করা স্বামীর মুখনিঃসৃত প্রশংসা শুনতে! মাশরিফ তিতিরের লাজুক হাসি দেখে হালকা হেসে ঘোমটা নামিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পর খাওয়া-দাওয়া শেষে ওদের ফ্রেন্ডরা আবার আয়নায় মুখ দেখা নিয়ে জোড়াজুড়ি শুরু করেছে। মাশরিফ বাঁধা দিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“পরেরবার যখন অনুষ্ঠান হবে তখন। এখন দরকার নাই।”
“কোনো পরেরবার না। যা হবে এখনি। কতো শখ করে আমরা আয়োজন করেছি। আজ তো আপনার কোনো বাঁধাই শুনব না।”
ইনায়ার হু*মকিস্বরূপ কথায় ঘরসুদ্ধ লোক হেসে ওঠল। তারপর শুরু হলো আয়নায় মুখ দেখার পালা।
তিতির বুঝতে পারছে না সে কী বলবে! তার তো মুখ থেকে রাও বের হচ্ছে না। মাশরিফ আয়নার ভেতর দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে প্রেয়সী প্রিয়তমার মুখচ্ছবি দেখে বলে,

“আমার প্রতিটা সায়াহ্ন যার প্রেমছন্দে রাঙানোর অভিলাষ!”
সবাই হৈ হৈ করে উঠলেও তিতিরের কান লাল হয়ে গেছে। গায়ের পশমে যেন শীতল হাওয়া বয়ে গেছে। গ্রীষ্মের এই তাপদাহে এ যেন বৈপরীত্য সংযোজন! তিতিরের পালা এলে সে বলল,
“এমন একজন আমার যেকোনো প্রয়োজনে সে প্রিয়জনের ভূমিকা রেখেছে। তারর প্রেমছন্দে আমায় রাঙিয়েছে।”
কথাতে খাঁপছাড়া ভাব থাকলেও তিতিরের এই এলোমেলো সম্বোধনে মাশরিফ মুগ্ধ হয়ে চাইল।

রাতের দ্বিতীয় প্রহর। তিতির গুঁটিশুটি হয়ে আড়ষ্টভাবে বিছানার মধ্যিখানে বসে আছে। সামান্য ফুলের সমরোহে বাসারের সাঁজ আছে রুমটাতে। দরজার বাহির থেকে বখশিশ নিয়ে বাকবি*তাণ্ডা চলছে। কিছুক্ষণ পরেও দরজা লাগানোর শব্দে ধড়ফড়িয়ে ওঠল তিতির। মাশরিফ সেটা লক্ষ্য করে এগুতে এগুতে বলল,
“রিল্যাক্স। আই নো, ইউ নিড টাইম। টায়ার্ড লাগলে তুমি ঘুমিয়ে পরতে পারো নয়তো আমরা কিছু সময় গল্প করে ঘুমাতে পারি।”
তিতির গল্প করতেই রাজি হলো।

দুইদিন পর। মাশরিফ মিশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। গতকালকেই সে সেনানিবাসে ফিরে এসেছে। আসার সময় মা ও স্ত্রীর হাস্যজ্জল মুখের আড়ালে শঙ্কিত প্রতিচ্ছবি তার আড়াল হয় না। কিন্তু কী করার! একজন আর্মি অফিসারের দায়িত্ব এটা। এবার দুইটা সূত্রে আগাচ্ছে সে। কাশফাকে আটক করেই সূত্র আগাবে আরেকটা সিলেট! তোর সূত্র যখন একই মালয় গাথিত হবে তখনই তো সবকিছুর পরিপূর্ণতা হবে! তবে খবর এসেছে কাশফা আজ প্রায় তিনদিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে। তাকে অনুসরণ করছে একজন সিভিল ড্রেসে জুনিয়র আর্মি অফিসার ও একজন সিভিল ড্রেসে পু*লিশ অফিসার। যেকোনো মূহুর্তেই কাশফাকে আটক করা হবে। স্বার্থপর কাশফা যে নিচে বাঁচতে কিছু লুকাবে না তা মাশরিফের জানা।

“মাশরিফ তুমি তৈরি?”
“জি স্যার।”
“তোমার দেওয়া ওই ভিডিও ক্লিপটা সা*ইবার টিমে পাঠানো হয়েছে। তারা অনেকটা ক্লিয়ার করে বোঝার চেষ্টা করেছে। অন্ধকারে খাটো ব্যাক্তিটা তোমার দুই বাড়ি পরে একটা বাড়িতে ঢুকেছে।”
মাশরিফ বাঁকা হাসে।

“আমারও সন্দেহ হচ্ছিল। আপনাকে তো সেইদিনের ঘটনাটা বলেছি। তাছাড়া ওই গ্যাসের উৎসটাও পরীক্ষা করা হয়েছে। সাধারণ কা*র্বন ম*নোক্সা-ইড গ্যাস খুব ফোর্সে বের হচ্ছিল। যা অনেকটা সময় শোষিত হলে মানুষের মৃ*ত্যুও ঘটে। সাথে কিছু ভারী ধাতুর গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে যা মানুষের ফুসফুসের অ্যালভিওলাইকে ড্যামেজ করে দিতে পারে। আজকেই মেয়েটাকে আ*টক করা হবে। আমরা এবার টে*রো*রি-স্ট চক্রটাকে ধরতে পারব।”
“হ্যাঁ। যেই চক্রটা এখন আমাদের দেশে আছে সেটার মূল উপড়ে ফেলতে পারলে নতুনভাবে ওরা আসতে ভয় পাবে। ওয়েল ডান মাই বয়।”

সেনাবাহিনীর হেড মাশরিফের কাঁধ চাঁ*পড়ে চলে যান। মাশরিফ মুচকি হেসে ফোন লাগায়।
“জানতে পারলে কোথায় গিয়েছে?”
“একটা দোকানে এসেছে। মেয়েটা বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। দোকানের জিনিসপাতি শুধু ধরে ধরে দেখছে কিন্তু কিনছে না।”

“ভালো করে নজর রাখো। ওই দোকানেই কেউ আসবে হয়তো। এক কাজ করো, তোমরা দুইজন দুইদিকে যাও। পু*লিশ অফিসার নাদিমকে বলো সে যেনো কিছুটা দূরে যায়। তারপর তুমি দোকানে যাও। ওখানে কী সিগেরেট বিক্রি হয়?”
মাশরিফের জুনিয়র অফিসার বলল,
“হয় তো স্যার। কিন্তু আমি তো খাই না।”
মাশরিফ বিপাকে পরে গেল। বলল,
“তাহলে কোনো কোল্ড ড্রিংকস কিনে দাঁড়িয়ে খেতে থাকবে। আর বারবার ঘড়ি দেখবে আর ফোন দেখবে। এমন ভাব যেন কেউ আসবে।”

“ওকে স্যার।”
এই বলে ফোন ডিসকানেক্ট করে জুনিয়র অফিসার কবির সেটাই করল। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর সে কাশফার পাশে একজনকে প্রায় গা ঘেষে দাঁড়াতে দেখল। লোকটা মাস্ক পড়া। কবির নেটওয়ার্কের বাহানায় ছবি তুলে নিয়েছে। ওদের কথা বলার মাঝেই পুলিশ অফিসার নাদিম কবিরের কাছে এমন ভাবে এসেছে যেন এতোসময় তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

তারপর ওরা একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, কাশফা ও সেই লোকটা এখনও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর লোকটা চলে গেলে কাশফাও চলে যেতে উদ্ধত হয়। তখনি পু*লিশ অফিসার নাদিম কাশফাকে সেন্সলেস করতে প্রস্তুত হয়। ওদের মাইক্রোটাও কাছে। কাশফা রাস্তার কাছে রিকশার জন্য এসে দাঁড়ালেই মাইক্রোটা ওর সামনে থামে তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে ওর মুখে রুমাল চেপে গাড়িতে তুলে ফেলে। কাশফাকে মুখ খোলারও সময় দেয় না।

জ্ঞান ফেরার পর কাশফা নিজেকে ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করে। এখন কতো সময় সে বুঝতে পারছে না। পিপাসায় কাতর সে। পানির জন্য ডাকতে থাকে।
“কেউ আছেন? এটা কোথায়? আমার হাত-পা বাঁধা কেন? আমি পানি খাব।”
তখনি কাশফার মাথার উপর তীক্ষ্ম রশ্নিযুক্ত হলুদ লাইট জ্ব*লে ওঠে। তার উজ্জ্বলতায় চোখ-মুখ খিঁচে নেয় কাশফা। তার সামনের চেয়ারটাতে মাশরিফ এসে বসে। কাশফা সামনে কারো উপস্থিতি অনুভব করে পিটপিট করে চোখ খুলে। অতঃপর মাশরিফকে দেখে হতবাক হয়ে বলে,

“তুমি? আমি কোথায় নিয়ে এসেছ? আমার হাত-পা বাঁধা কেন? কী করেছি আমি? হাত খুলো আমার।”
কাশফাকে উত্তেজিত হতে দেখে মাশরিফ হেসে হাতের কাছে পেপারওয়েটটা ঘুরিয়ে বলে,
“তুমি কী করেছ তা তো তুমি বলবে। অবশ্য ইতোমধ্যে তোমার ফোনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক খুলে তোমার সহকর্মীদের আমি তোমার টোনেই রিপ্লাই করে ফেলেছি। তাও তুমি যদি নিজের মুখে বলো তবে তোমার নিজেরই ভালো।”
কাশফার অক্ষিদ্বয় বৃহতাকার ধারণ করল। হতচকিত কণ্ঠে তুঁতলিয়ে বলল,

“মানে? কী বলছ তুমি?”
“ওহ বুঝতে পারছ না? আচ্ছা তোমাকে কিছু দেখাই।”
এই বলে মাশরিফ সেদিনকার ক্লিয়ার করা ভিডিও ক্লিপটা দেখাল। কাশফা তা দেখে ভয় পেয়ে গেছে। মাশরিফ বলে,
“তোমাকে তো এই কারণে শাস্তি হবেই সাথে ফাঁ*সিও হতে পারে। যদি সত্যিটা বলো তবে শাস্তি অনেকটাই কমবে। সুপারিশের উপর নির্ভর করে।”
কাশফা ভীত কণ্ঠে বলে ওঠে,

“বিশ্বাস করো, আমি কিছু করিনি। আমি তো তাদের চিনতাম না। আমি কিছু করিনি।”
“সত্যটা বলো। তারা কোথায় আছে। কী প্ল্যান সব। যে দেখা করতে এসেছে সে কে?”
“আমি জানিনা সত্যি।”
মাশরিফ টেবিলে সজোড়ে শব্দ করলে কাশফা উত্তেজিত ও ভীত হয়ে পরে। তার হঠাৎ মৃদু ইলে*ক্ট্রিক শ*ক লাগে। কাশফা দুর্বল গলায় হড়বড়িয়ে বলে,

” বলছি বলছি। প্লিজ শ*ক দিও না। তারা কী করছে বা করবে তা জানিনা। আমাকে বলেছে তাদের টার্গেট তুমি। আর কিছু না। আমার সাথে যেই লোকটা দেখা করতে এসেছে সে মূল দলের না। সেও আমার মতো তাদের সাথে কিছু উদ্দেশ্যে যুক্ত হয়েছে।”

“নাম কী তার?”
“পলাশ বলল।”
“পলাশ! কোন পলাশ?”
মাশরিফ সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল। কাশফা জবাবে বলল,
“সে তোমার বউয়ের সাথে সম্পর্কিত।”
মাশরিফের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো।
“সুজন, পলাশ?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। ওরাই।”

মাশরিফ ব্যাপারটাতে চিন্তায় পরে যায়। সুজন-পলাশই কী তবে তিতিরের জন্য ওর ক্ষতি করতে চায়? টে*রো*রি*স্টদের কী কোনো সংযোগ নেই? ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে মাশরিফ আত্মবিশ্বাসী ভাবে প্রশ্ন করে,
“টে*রো*রি*স্ট দলের সাথে ওরা কতো বছর? আর তুমি জানো এটা কতো বড়ো অপরাধ?”
“জানি। কিন্তু ওরা আমাকে অভয় দিয়েছে। আমি তোমাকে পাব না জেনে রাগে-দুঃখে ওদের কথায় এসে গেছিলাম। আর সুজন-পলাশরা নাকি প্রায় দুই বছরের বেশি সময় যাবত আছে।”

কথাগুলো বলতে বলতে কাশফা কাঁদছে। মাশরিফ বিরক্ত হয়ে বলে,
“মূল চক্র এখন কোথায় আছে বলো। কোনো জায়গার নাম যা শুনেছ। সত্য না বললে এবার হাই ভোল্টেজের শ*ক দেওয়া হবে।”
কাশফা দ্রুত বলে ওঠে,

“না না না। বলছি। শ্রীমঙ্গল ও জাফলংয়ের ইন্ডিয়ার বর্ডারের ওই পাশের কথা শুনেছি।”
“সত্যি বলছ? ওদের না ধরা অবধি তুমি এখানেই থাকবে। ট*র্চার বাড়ানো হবে।”
“সত্যি বলছি আমি। বিশ্বাস করো সত্যি বলছি।”
কাশফাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে মাশরিফ বেরিয়ে যায়। কাশফার ফোনের মাধ্যমে সুজন ও পলাশের সাথে কাশফার মতো অভিনয় করে টুকটাক অনেক কিছু জেনেও নিয়েছে। সুজন-পলাশ বুঝতেও পারেনি যে ফোনের অপরপাশের মেসেজ কর্তা কাশফা না!

সুযোগ বুঝে সুজন-পলাশকে কাশফার ফোন থেকে মেসেজ করে আর্জেন্ট আসতে বলে ফাঁদে ফেলে আটক করে। ওদেরও ফোন ছিনিয়ে নিয়ে এবার সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা করে। এবার ফোর্স বেশি সাথে।
অভি মাশরিফকে বলে,
“ওখানে সাধারণ মানুষের সাথে ওরা মিশে থাকলে চেনাটা মুশকিল হবে। প্রতিবারের মতো আমাদের উপস্থিতিতে পালিয়ে যাবে।”
মেজর সাদ বলে,

“একজেক্টলি। তবে যদি আমরা সরকারি চাল-ডাল দেওয়ার কথা বলে সবার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আসতে বলি তবে হয়তো সহজ হবে।”
“ঠিক বলেছেন মেজর সাদ। আমরা সেটাই করব। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য ব্যাপারটা সহজ হবে। সেইসাথে আশেপাশের আরও কয়েকটা উপজেলাতেও একই কাজ করতে হবে। এতে পু*লিশ ফোর্সও আমাদের সাহায্য করবে। তারপর আমরা নীরবে আ*ক্রম-ণ করব। আমার ধীর বিশ্বাস ওরা ত্রাণ নিতে আসবে না।”
“তাই হোক। তবে।”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৯

ভেবেছিলাম আজকেই শেষ করব। কিন্তু হলো না। কাহিনী শর্ট করতে সময় লেগে গেল।
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৪১