অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২২

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২২
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বাতাসের ঝাপটায় অবিন্যস্তভাবে দুলে উঠলো দুজনের চুল। নীল আকাশে শুভ্র মেঘের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য। তরী ভালোলাগা আর লজ্জার সংমিশ্রণে মাথা নিচু করে নিলো। গাল দুটো ক্রমশ ফুলে উঠছে। কান গরম হয়ে এলো তার। পলক ঝাপটাবার সাথে সাথে কেঁপে উঠছে কালো পাপড়ি। মাহমুদ তন্ময় হয়ে দেখলো। তার চোখদুটোতে তরীকে বুকে টে*নে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় মাহমুদ।

এই চাওয়াটা পূরণ হয়ে গেলে তার মনে লো*ভ জন্মাবে। তরীকে সম্পূর্ণভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠবে। সে চায় সব সুষ্ঠুভাবে হোক। তরীর পরিবার তাদের মেনে নিক। বিনা বাঁধায় তরীকে বাহুডোরে বেঁধে নিতে চায়। মাহমুদ জানে তাদের প্রচুর কাঠখড় পোহাতে হবে তরীর পরিবারকে মানাতে। তবুও সে চায় এই যুদ্ধের সৈনিক হতে। যে জিনিস পেতে ভীষণ কষ্ট পোহাতে হয়, তার মূল্য তত বেশি হয়। তরী তার কাছে অমূল্য। তাকে পেতে এইটুকু কষ্ট অনায়াসে করে নিতে পারবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তরীর বাঁ হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজলো মাহমুদ। হাত দুটো লুকিয়ে পড়লো শাড়ির আঁচলের নিচে। তরীর ঠোঁটের কোনে লেপ্টে আছে নিটোল হাসি। স্টপেজ এ এসে হাতে হাত রেখে আগেপিছে বাসে চড়লো। জানালার পাশটা বরাদ্দ হলো তরীর জন্য। চলমান গাড়ি আর বাতাসের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে তরীর ঢিলে হয়ে যাওয়া চুল দোল খাচ্ছে মাহমুদের চোখেমুখে। সে পরম আবেশে চোখ দু’টো বুজে আছে। মুখের কোথাও বিরক্তি বা ক্লান্তির চিহ্ন টুকু নেই। তরী নিজেই চুল টেনে শক্ত করে বেঁধে নিলো। মাহমুদ ভুরু কুঁচকে ফেললো। ঝট করেই চোখের পাতা খুলে ফেললো। মৃদুস্বরে শুধালো,

-“চুল বাঁধলে কেন?”
তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কিছু শব্দ বের করার জন্য উদ্ধত হওয়ার পূর্বেই চুলে টান পড়লো। ঝরঝরে করে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো কেশরাশি। তরী হতভম্ব হয়ে রইলো। মাহমুদ তরীর চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে নির্লিপ্ত রইলো। বাসের জানালায় মুখ আড়াল করার চেষ্টা করলো তরী। ঠোঁট টিপে হাসছে সে। মাহমুদের নজর এড়ালোনা। সেও হাসলো নিঃশব্দে।

তরী আড়চোখে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেল। মাহমুদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তরীর মিটিমিটি হাসি রূপ নিলো প্রাণখোলা হাসিতে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে হাসির দমকে। তবে শব্দ হচ্ছে না। বাতাসের দাপটে এলো চুলের ঝাপটা মাহমুদের চোখেমুখে বাড়ি খাচ্ছে। প্রাণভরে শ্বাস নিলো সে। চুলের ভাঁজে ভাঁজে কি যেন এক সুগন্ধি খুঁজে পেল। অনায়াসে টে*নে নিলো সেই ঘ্রাণ।

তরীর গন্তব্য আসার পূর্ব স্টপেজ এ বাস থামলো। মাহমুদ তার হাত টে*নে নামিয়ে নিলো। তরীর চোখেমুখে প্রশ্ন জমা হলো। কৌতুহলী মন জিজ্ঞেস করলো,
-“এখানে কেন নামলাম, আমরা?”
মাহমুদ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,
-“আসো তো!”

হুট করে আজ এই তুমি তুমি ডাকটা কেমন চমকে দিল তরীকে। মায়া মায়া ডাক। এতে জমে আছে ভীষণ যত্নে গড়া ভালোবাসা। তরীর ভালোলাগছে আবার কেমন লজ্জাও লাগছে। মাহমুদের সাথেই সিএনজিতে উঠলো। মাঝে মাহমুদ তাকে সাবধান করে দিল,
-“শাড়ি টে*নে বসো। চাকায় লেগে দু*র্ঘ*ট*না হতে পারে!”

তরী আঁচল গুটিয়ে বসলো। মাথা রাখলো মাহমুদের ঘাড়ে। আজ কেমন নির্লজ্জ হয়ে উঠলো তরী। বন্দী খাঁচার পাখি যেমন মুক্ত হয়ে গেলে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়! ঠিক তেমন। নিজের ইচ্ছেকে আজ প্রাধান্য দিল। জলে যাক জড়তা, লজ্জা। তাদের আজ ছুটি দেওয়া হলো। মাহমুদ একবার তাকালো। সামনে দৃষ্টি রেখে হাত নিয়ে রাখলো তরীর পিঠ ছুঁইয়ে বাহুতে। আগলে রাখলো নিজের সাথে। নরম স্বরে ডাকলো,

-“তরী।”
-“হু।”
-“ভয় করছে না?”
-“উঁহু।”
তরীর এই সরল জবাব টুকু যেন প্রশান্তি দিল মাহমুদকে। বুক ভরে শ্বাস নিলো। এই মেয়েটাকে আর দূরে দূরে রাখা যাচ্ছে না। দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। কেন এত আদুরে আদুরে লাগছে তাকে?
তরী ঘাড়ে মাথা রেখেই প্রশ্ন করলো,

-“আমরা বাস থেকে কেন নামলাম? আর বললেন না তো কোথায় যাচ্ছি?”
-“নতুন বাসায়।”
দ্বিরুক্তি করলোনা তরী। মাহমুদের সাথে ওভাবেই মিশে রইলো। পূর্ব স্টপেজ এ নেমে পড়ার কারণ আছে অবশ্য। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে সোজা মাহমুদের বাসায় গিয়ে নামতে পারবে। কেউ দেখবেনা। কিন্তু তরীদের এলাকায় এসে নামলে দুজনকে একইসাথে তরীর বাবা হয়তো দেখে ফেলতে পারেন। আগে ভয় ছিলনা। কিন্তু এখন তিনি মাহমুদের ব্যাপারটা জানেন। দুজন এসে নামলো মাহমুদের নতুন বাসার সামনে। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেল। মাহমুদ সামনে, তরী তার পেছনে। দুতলায় এসে বেল দিল মাহমুদ। তরী মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদের বাহুতে হাত রেখে ভয়কাতুরে চেহারায় জিজ্ঞেস করলো,

-“আন্টি কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবো?”
মাহমুদ চাপা হেসে বলল,
-“সেটা আমি কী জানি?”

ততক্ষণে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছেন আয়েশা সুলতানা। তরী ঝট করে মাহমুদের বাহু থেকে হাত ছাড়িয়ে মিষ্টি হেসে সালাম দিল আয়েশা সুলতানাকে। তিনি অবাক হয়েছেন তরীকে দেখে। হেসে সালামের জবাব দিয়ে তাকে টে*নে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মাহমুদ ধীরেসুস্থে ভেতরে ঢুকলো। সোজা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে পড়লো। নতুন বাসায় চোখ বুলিয়ে দেখছে তরী। আয়েশা সুলতানা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন,

-“তুমি যে এখনাে এসেছো, বাসায় সমস্যা হবে না?”
তরী মাথানিচু করে বলল,
-“বাসায় কেউ জানেনা।”
চমকালেন আয়েশা সুলতানা। আতঙ্কিত স্বরে বললেন
-“তোমার বাবা জানলে সমস্যা হয়ে যাবে। কেন আসতে গেলে এভাবে?”
নিচু স্বরে জবাব দিল তরী,

-“আপনাদের দেখতে ইচ্ছে করছিল।”
-“মাহমুদের দেখা কোথায় পেলে?”
-“উনিই আমাকে ভার্সিটির সামনে থেকে নিয়ে এসেছেন।”
বলেই থতমত খেয়ে গেল তরী।
আয়েশা সুলতানা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। উনার খানিকটা সন্দেহ হলো।
-“তোমার বাবা আমাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। তাহলে তুমি মাহমুদের সাথেই বা কেন এলে? তুমি ও কি মাহমুদকে পছন্দ কর?”

আয়েশা সুলতানার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কবলে পড়ে সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। ঢোক গিললো তরী। ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে। তবুও তার গরম লাগছে। কেমন হাঁসফাঁস করে উঠছে। তরীর অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে আয়েশা সুলতানার সন্দেহ গাঢ় হলো। তিনি আরেকটু চেপে বসলেন৷ ফের জিজ্ঞেস করলেন,
-“বলো, তুমিও কি পছন্দ করো?”
তরী হ্যাঁ, না কি বলবে বুঝতে পারছেনা। হুট করেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,

-“আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।”
আয়েশা সুলতানা বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। অস্ফুট স্বরে শুধালেন,
-“কী?”
এভাবে বিয়ে করাকে তিনি কিছুতেই সমর্থন করেন না। আয়েশা সুলতানার মুখের দিকে তাকিয়ে তরীর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল। গলা কাঁপছে তার। ঢোক গিলে বলল,

-“আন্টি প্লিজ আপনি
কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলোনা তরী। হাত উঠিয়ে বাঁধা দিলেন আয়েশা সুলতানা। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি প্রচুর অসন্তুষ্ট। হাঁক ছেড়ে মাহমুদকে ডাকলেন। সে মাত্রই গায়ের ঘর্মাক্ত শার্ট ঝেড়ে ওয়াশরুমে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মায়ের ডাক পড়ায় তার কাজে বাঁধা পড়লো। দ্বিতীয়বার গলা চড়িয়ে ডাকলেন মা। মাহমুদ লম্বা কদম ফেলে বেরিয়ে এলো। রামি স্কুল থেকে ফিরে ঘুমিয়েছিল। সেও চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো। তরীকে দেখে ঈষৎ চমকালো। মাহমুদ নিচু গলায় শুধালো,

-“কী হয়েছে মা?”
আয়েশা সুলতানা চোয়াল শক্ত করে নিলেন। কঠিন গলায় বললেন,
-“তরী এসব কী বলছে? বিয়ে করেছিস তোরা?”
মাহমুদ একবার তরীর দিকে তাকালো। মাথা নিচু করে আছে সে। বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট ভয় পেয়েছে মেয়েটা। মায়ের দিকে ফিরে শান্ত গলায় জবাব দিলো মাহমুদ,
-“হ্যাঁ।”

মাহমুদের স্বীকারোক্তি যথেষ্ট ছিল রামিকে চমকে দেওয়ার জন্য। চমকালেও মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে বলা চলে। আয়েশা সুলতানা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন। রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কবে বিয়ে করলি? আজই? কে কে জানে?”
মাহমুদ একইভাবে শান্ত গলায় জবাব দিল,

-“তরীর বাসায় থাকাকালীন বিয়ে করেছি। যেদিন ওকে রিং পরিয়ে গিয়েছিল, সেদিন। বিয়ের ব্যাপারে আমার কয়েকজন বন্ধু জানে।”
আয়েশা সুলতানা কঠিন হয়ে বললেন,
-“তরীকে বাসায় দিয়ে আয়।”
-“কিছুক্ষণ থাকুক। তারপর দিয়ে আসছি।”
-“এক্ষুণি দিয়ে আসবি। আর তরীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবিনা।”
তরীর ভেতরটা তড়াক করে উঠলো। মাথা তুলে টলমল চোখে তাকালো। কপোল ঘেঁষে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মাহমুদের চোখমুখ শক্ত। কন্ঠের ভীত দৃঢ়। অনড় গলায় বলল,

-“তরী আমার স্ত্রী, মা।”
-“তো? কেউ তো জানেনা। কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের মেয়েকে এভাবে বিয়ে করার মতো বে*হা*য়া*প*না*র শিক্ষা তো আমি তোকে দেইনি!”
-“আমরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক।”
-“আমি এতকিছু শুনতে চাইনা। এক্ষুণি তরীকে বাসায় দিয়ে আসবি।”
মাহমুদ গটগট পা ফেলে একটা শার্ট জড়িয়ে বোতাম আটকাতে আটকাতে বেরিয়ে এলো। শার্টের হাতা গুটিয়ে তরীর হাত চেপে ধরে বলল,

-“চল।”
রামি মায়ের হাত ধরে অনুনয় করলো,
-“মা প্লিজ এমন করো না! তুমি তো তরী আপুকে পছন্দ কর।”
আয়েশা সুলতানা নির্লিপ্ত রইলেন।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২১

তরীর হাত চেপে ধরায় সে মাহমুদের দিকে আশাহত চোখে তাকালো। মানুষটা কি সত্যিই তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে? এটাই বুঝি বিশ্বাস? এই ঠু*ন*কো বিশ্বাসের বলে মানুষটার হাত ধরেছিলো? অঝোর ধারায় জল গড়ালো দু-চোখ ভরে। মাহমুদ তরীর অশ্রুমাখা চোখে তাকালো। মজবুত কন্ঠে বলল,
-“যত ঝড় ঝাপটা আসুক না কেন! আমি তোমার হাত ছাড়ছিনা, তরী। এই হাত ধরেছি ছাড়ার জন্য নয়।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৩

1 COMMENT

Comments are closed.