এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৩

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৩
ইফা আমহৃদ

বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। অপূর্ব ভাই বসে আছেন শিউরে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “কেমন লাগছে এখন?”
হাতটা খপ করে ধরে ফেললাম। ঠোঁট উল্টে কেঁদে বললাম, “আপনি এসেছেন অপূর্ব ভাই। আমি আপনার সাথে থাকব‌। কোথাও যাবো না। প্লীজ আমাকে নিয়ে যান। ঐ ঘরের সেঁজুতি আপু আমাকে কাঁপা ঘরে আটকে রেখেছিল।”
অপূর্ব ভাই মাথায় হাত দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। অধৈর্য স্বরে বললেন, “ওটা লিফট। যাতায়াতের বাহন। একটু কাঁপুনি দেয়।”

“জানালা নেই কেন?”
অপূর্ব ভাই আমাকে ব্যঙ্গ করে বললেন, “কারণ তোর মতো পা/গ/ল যদি একবার লিফটে উঠে। কাঁপা ঘর মনে করে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে উপরে চলে যাবে। তাই জানালা নেই।”
বিছানার পাশে কিছু ব্যাগ দেখতে পেলাম। শফিক ফ্যাশন। ব্যাগগুলো নিয়ে বের করলেন জামা কাপড়। নতুন কিছু জামা কাপড়। নেড়েচেড়ে বললাম, “কার এগুলো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

একটা লাল রঙের থ্রি পিস বের করে বলেন, “তোর। যা লালটা পরে আয়।”
থ্রি পিসের চেয়ে টি শার্টে আরাম লাগছে। মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “না! এটাই থাকি। পারলে আপনার টি শার্ট গুলো দিয়ে দিয়েন। বাড়িতে গিয়ে পরব।”
ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বললাম, ” সেঁজুতি আপুও পরে। তাই বললাম।”

হাতা‌ গুলো বেশ বড়ো। অপূর্ব ভাই ফোল্ড করে দিলেন। সন্দিহান গলায় বলেন, “ব্যথা কমেছে?”
“না, দহলি হয়ে গেছে। আমাদের গ্ৰামে যেমন কোনো কিছু এক যুগ না ধরলে দহলি হয়ে যায়। তেমন হয়েছে।”
“ওষুধ খেয়েছিলি?” ছোটো করে প্রশ্ন করেন। আমতা আমতা করে বললাম, “আসলে হয়েছে কী, ঐ ট্যাবলেট গুলো গলা দিয়ে নিচে নামে না। দহলি হয়ে গেছে। হ্যাঁ সত্যি বলছি।” অপূর্ব ভাই তাকাতেই শেষ বাক্যটি করলাম দুহাত তুলে।”

টিভিতে টম এন্ড জেরি কার্টুন চলছে। মনযোগী হয়ে দেখছি বিড়াল ইঁদুরের শ/ত্রুতা। হাতে চিপসের প্যাকেট। খাচ্ছি আর হাসছি। অপূর্ব ভাই রান্নাঘরে খাবার তৈরি করছেন। আমার হাসির শব্দ শুনে বললেন, “যত হাসি তত কান্না। তাই চুপচাপ থাক। কখন জানি তোকে কাঁদিয়ে দেই।”

আমি দরজাটা ভিড়িয়ে দিলাম। যাতে শব্দগুলো অপূর্ব ভাইয়ের কানে না পৌঁছায়। ফোন চার্জে দেওয়া। আড়চোখে তাকিয়ে টিভিতে মনযোগী হলাম। পুনরায় বেজে উঠল। ফোনের কাছে গেলাম। ‘জাহাঙ্গীর সাহেব’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। চ্যাঁচিয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই আপনার ফোন এসেছে। জাইঙ্গা ফোন করেছে।”
অবিলম্বে উপস্থিত হলেন অপূর্ব ভাই। হাতে দুধের গ্লাস। গ্লাসটা টেবিলে রেখে অন্যহাতে ফোন নিলেন। একটু দূরে গিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এলেন। চার্জে দিতে দিতে বলেন, “তোকে পড়াশোনা করাই শুধুই। ক্লাস টেনের ছাত্রী জাহাঙ্গীর নামটা জাঙ্গিয়া উচ্চারণ করে।”

ভেংচি দিয়ে বললাম, “আমাদের ওখানে সবাই জাহাঙ্গীরকে জাইঙ্গা বলে ডাকে। সামনে থেকে সরুন। কার্টুন দেখতে দিন।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পূর্বে দুধ পানের আদেশ করলেন। এক ঢোক পান করে চিনির সাদ পেলাম। সবাই আমাকে বলে আমার বুদ্ধি বেশি। আরও বুদ্ধি বাড়াতে চিনি দিয়েছেন। উপরে তুলে পর্যবেক্ষণ করলাম। নিচে চিনি জমে আছে। উপর থেকে পান করে বিছানার উপর রেখে দিলাম। রিমোট হাতে নিতে গেলেই অসাবধানতায় হাত লাগল গ্লাসে। অবশিষ্ট দুধ টুকু বিছানায় পড়ল। জিভ ভিজিয়ে বললাম, ” অপূর্ব ভাই..

অতঃপর কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখলাম জায়গা। অপূর্ব ভাই জানতে পারলেন না তার শখের বিছানার বারোটা করেছি।
খাবার টেবিলে সাজিয়ে ডাকলেন। আদেশ মেনে আমি গেলাম। নুডুলস বানিয়েছে। আমার দিকে এক বাটি দিয়ে বললেন, “এটা খেয়ে কোক খেয়ে নিস। আধ ঘণ্টা পর ডিনার করবি।”
নিজের অংশের নুডুলস টুকু খেতে লাগলেন। কাঁটা চামচ দিয়ে নুডুলস তুলে বললাম, “এগুলো কী? কেঁচো..
অপূর্ব ভাই শব্দ করে কাঁটা চামচ রাখলেন টেবিলে। থেমে গেলাম আমি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, “কেঁচো হোক আর যাই হোক। চুপচাপ খেয়ে ফেল। এমন কিছু বলিস না, যাতে জীবনের মতো আমার নুডুলস খাওয়া শেষ হয়ে যায় লাল শাক ও ঢেড়সের মতো। কারণ সারাদিনের কাজ শেষে এক বাটি নুডুলস খেয়ে দিন পার করি আমি।”

অপূর্ব ভাই তৃপ্তি সহকারে খেলেন। আমিও খেলাম।‌ খাওয়া শেষে বাসন ধুতে গেলেন অপূর্ব ভাই। আমিও কাজে হাত দিলাম। ঘর ঝাড়ু দিলাম।
রান্নাঘর থেকে বের হয়ে মুচকি হেসে বলেন, “পাকা বুড়ি একটা। যা ঘুমিয়ে পড়। দেখছি ছুটি নিতে পারি কি-না। একদিনের ছুটি নিয়ে গ্ৰামে তোকে রেখে আসব।”
“আপনি আমায় ট্রেনে তুলে দিন। আমি নিজেই চলে যেতে পারব।”

“জানি‌। এতদূর যে বিনা টিকেটে আসতে পারে, সে যেতেও পারবে।” বলেই অন্য ঘরে চলে গেলেন। আমিও গেলাম পাশের ঘরে। বিছানায় শুয়ে মনটা খা/রা/প হয়ে গেল। তুর ও শেফালীকে দেখতে মন চাইছে। তিনজনে শুয়ে কী আনন্দটাই না করতাম। দু’দিনে কত মিস্ করছি। বালিশ মাথায় ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাম চোখ থেকে একফোঁটা জল পড়ল। চোখের পাতাটা প্রচুর জ্বলছে। পাশের ঘরের বারান্দা থেকে পাখির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

আমার পোষা ময়না পাখিটার কথা খুব মনে হচ্ছে। অপূর্ব ভাই তাকে ফিরত দেয়নি। হয়তো সে নেই। ভাঁজ করা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে চোখ বুজে নিলাম। ঘুমটা যখন গভীর হলো মশার দল জড়িয়ে ধরল আমায়। রক্ত চুসে খাচ্ছে। এতটা উঁচুতে উঠতে মশার ডানা ব্যথা করে না। ধৈর্য আছে বলতে হবে। গালে দু’টো চ/ড় দিলাম। মশার রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। এটা মোটেও মশার রক্ত নয়। এটা আমাদের রক্ত। মশার সন্তানও আমাদের। কারণ আমাদের ডিএনএ ও তাদের ডিএনএ একই।

মাথার ভেতরেও চুলকাচ্ছে। অপূর্ব ভাইয়ের ঘরে গেলাম। তিনি ঘুমিয়ে আছেন কম্বল মুড়ি দিয়ে। মশার চিহ্ন নেই। সব মশা আমার ঘরে। আশেপাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। ছোটো একটা ব্যাগ নজরে এলো। নাম ‘ম্যাজিক মশারি’। ব্যাগটা নিয়ে মশারি বের করলাম। আমার পুরনো জামাটা ছিঁড়ে কয়েক টুকরো করলাম। মশারির কোণায় কোণায় গিট দিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে নিলাম।

‘আরু পাখি’ নামটা শুনতে পেলাম। ময়না পাখি আমায় আরু পাখি বলে ডাকে। দরজা খুলে বারান্দায় গেলাম। খাঁচার ভেতরে ময়না পাখি বসে আছে। চোখ জোড়া ছলছলিয়ে উঠল। ছোটো দরজাটা খুলে দিলাম। ময়না পাখি সামনে ডানা ঝাপটাতে লাগল। দু’হাতে ধরে চুমু খেলাম ডানায়। গালের সাথে পাখিটে লেপ্টে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলাম।
“ময়না তুই বেঁচে আছিস?

“আরু পাখি, আরু পাখি। আমি বেঁচে আছি। আমি বেঁচে আছি।”
বারান্দায় মশার উপদ্রব। পাখিকে মশায় কামড়াবে। ঘরে এলাম। মশারির ভেতরে ঢুকে গেলাম। বালিশ মাঝখানে রেখে অন্যপাশে শুয়ে পড়লাম। পাখিটা কম্বলের ভেতরে নিয়ে দিলাম ঘুম।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১২

মনে মনে বললাম, “শোন ময়না। অপূর্ব ভাইয়ের কাছে আমি দুই লক্ষ টাকার বেশি পাই। যখনই দুই টাকা চাইতায় তখনই বলে, পরে দিবো, পরে দিবো‌। এমন বাকি রাখতে রাখতে দুই লক্ষের বেশি জমেছে। কবে যে পরিশোধ করবে। তখন তোকে একটা মশারি কিনে দিবো।”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৪