এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৪

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৪
ইফা আমহৃদ

“অপূর্ব ভাই আপনার ওয়াশরুমের ভেতরে একটা বড়ো ব্রাশ। ওটা দিয়ে কি দাঁত ব্রাশ করেন? আমিও করব। দাঁতগুলো মোটা হয়ে আছে। দুদিন ধরে ব্রাশ করা হয়না।”
বলেই অপূর্ব ভাইয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি রান্না ঘরে ডিমের অমলেট করতে ব্যস্ত। খুন্তিটা নিয়ে বলে, “কর। পারলে নিচ থেকে বালু এনে ঘসে ঘসে পরিষ্কার কর। বিরক্তকর!”

পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমিও কাঁচুমাচু করে অপূর্ব ভাইয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি এবার শান্ত কণ্ঠে বললেন, “ওটা ওয়াশরুম পরিষ্কার করার জন্য বরাদ্দ। ওটা দিয়ে তুই দাঁত মাজতে চাইছিস। ওয়াক থু থু!”
বমি পেল আমার। দু’হাতে মুখ চেপে বললাম, “আগে বললেন না। ছিঃ ছিঃ! একটু হলে আমি মেজেই ফেলতাম। এখন আমি দাঁত মাজব কীভাবে?”
“যা। ব্রাশদানিতে এক্সট্রা ব্রাশ আছে। ওটা দিয়ে ব্রাশ কর।”
আমি চললাম ওয়াশরুমে। ব্রাশদানিতে কত ব্রাশ। খোলা একটা ব্রাশ নিলাম। টুথপেস্ট দিয়ে ঘসতে ঘসতে আয়নাতে নিজেকে দেখছি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ডান হাতটা অপূর্বর ভাইয়ের আয়ত্বে। কুঁজো হয়ে হাঁটছি আমি। অপূর্ব ভাই স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটছেন। উঁচু উঁচু বিল্ডিং দেখলে এমনিতেই মাথা নিচু হয়ে আসে। হাতের ইশারায় একটা রিকশা থামালেন।
আমি উঠে বসেই হুড টেনে নিলাম। তাড়াহুড়োয় অপূর্ব ভাইয়ের চোখে লাগল। চোখ ধরে বসলেন পাশে। ওড়না নিয়ে ভাব দিলেন। অতঃপর বজ্রকণ্ঠে বলেন, “ইচ্ছে করছে ঠাস করে একটা লাগিয়ে দিতে। বিল্ডিং ভেঙে যদি পড়েই যায়। রিকশার এই হুড ধরে রাখতে পারবে?”

কাঁচুমাচু মুখে করে অন্যদিকে ফিরে রইলাম। জ্যাম রাস্তাঘাট। বড়ো বড়ো রাস্তাঘাট। অথচ গ্ৰামে সরু রাস্তায় জ্যাম হয়না। রিকশা এসে থামল পার্কের সামনে।
আমি নেমেই পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।‌ অপূর্ব ভাই ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টারে গেলেন টিকেট কা/টতে। ভিড় ঠেলে আমরা ঢুকে গেলাম পার্কের ভেতরে। কত সরঞ্জাম। কত খাবার।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে জোড়ায় জোড়ায় সবাই। আড়ালে আবডালে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমিও এক বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। অপূর্ব ভাই হাতের ইশারায় ডেকে বললেন, “পরেরবার যখন আসবি, তখন ঘুরে দেখাব। আজ নয়।”
আজ রাতের ট্রেনে গ্ৰামে ফিরছি। আবদার রাখতে পার্কে এনেছেন তিনি। হঠাৎ না করে দেওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ খুঁজে পেলাম না।‌ হাতটা ধরে আদুরে গলায় বললাম, “প্লীজ থাকি না। থাকি। একটু থাকি। আমার ময়না পাখিকে বলে এসেছি, অনেক অনেক ছবি তুলে তাকে দেখাবো।”

প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, “আজ কত তারিখে আরু?”
আঙুলের কড় মেপে বললাম, “আজ তেরো তারিখ। আগামীকাল ভ্যালেন্টাইন ডে। আজ ওম্মা দিবস।”
“তোকে এখানে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।” হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। অপূর্ব ভাইয়ের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “কালকে তো লাভ হওয়ার দরকার ছিল। ভ্যালেন্টাইন ডে কেন? লাভ অর্থ ভালোবাসা।”
“একজন অসৎ লোকের নাম ছিল ভ্যালেন্টাইন এবং তাকে ১৪ তারিখ ফাঁ/সি দেওয়া হয়েছিল। তার নাম স্মরণার্থে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস পালিত হয়।”

“কী অসৎ কাজ?” বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম।‌ অপূর্ব ভাই রিকশা ডেকে নিলেন। একই রিকশায় পুনরায় চড়ে চেম্বারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম। একই প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, “কী উদ্দেশ্য বললেন না কিন্তু?”
“আমার মনে হয় না তুই সাইন্সের স্টুডেন্ট। জীব বিজ্ঞান ভালো ভাবে পড়লে জানতে পারতি।” বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভেবে বুঝতে সক্ষম হলাম। ভেংচি দিয়ে বললাম, “আপনি এটা বুঝাতে চাইলেন? মুখ ফুটে বললে কী হতো? শিউলি আছেন না আমার বান্ধুবী? ওর তো আরও আগে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর প্রতিদিন গোসল করে স্কুলে আসতো। আমরা তো বুঝতাম না। আমাদের বলতো, ওর স্বামীর কথা। ওকে না-কি অনেক ভালোবাসে। আমরা সবাই মিলে একদিন বুদ্ধি করে ওদের বাড়িতে গেলাম রাতে। টিনের ঘর। টিন ফাটা। সেই ছিদ্র দিয়ে সব দেখে এসেছি।”

রিকশা চালাক হেসে ফেললেন। মৃদু স্বরে বললেন, “আজকালকার মেয়েরা যা পাকা। একবার কৌতুহল জাগলে না মেটানো পর্যন্ত শান্তি পায় না।”
অপূর্ব ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। হুড টেনে খুলে ফেললেন। ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে বললেন, “মামা এখানেই থামান। আরু নাম।”
টাকাটা এগিয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে নামলেন। ফুটপাত ধরে এগিয়ে গেলাম। একটা কথাও বলেন নি। পৌঁছে গেলাম অপূর্ব ভাইয়ের চেম্বারে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম শাপলা চত্বর। সেদিনের ঠিকানা। একই চেম্বার। দেখতে দেখতে অপূর্ব ভাই ঢুকে গেলেন। আমিও এগিয়ে গেলাম। পথ আটকে দাঁড়াল এসিস্ট্যান্ট। বললেন, “বের হ। তোকে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ।”

অপূর্ব ভাই ফিরে এসে বললেন, “জাহাঙ্গীর সাহেব। ওকে আসতে দিন।”
“স্যার এই তো সেই মেয়েটা।”
“জানি। আয়।”
মনে মনে উচ্চারণ করলাম, “তাহলে আপনিই জাইঙ্গা। কয়েকদিন এখানে থাকলে আপনার জাইঙ্গা ফুটপাতে বিক্রি করতাম। বাইচ্ছা লন ১০ টাকা, কিন্না লন ১০ টাকা। মাইপা লন ১০ টাকা।

অপূর্ব ভাইয়ের থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে আছি।‌ একজনের পর একজনের আগমন ঘটছে। বিশ্রাম নেই বললেই চলে। দৃষ্টি সরিয়ে টেবিলের দিকে তাকালাম। আমার সামনে ফুচকা রাখা। আগে কখনো খাইনি। এই প্রথমবার স্বাদ নিবো। একটা ফুচকায় টক নিয়ে উপরে মশলা দিয়ে মুখে নিলাম। চোখ মুখ কুঁচকে গেল।

পানি পান করে বললাম, “অপূর্ব ভাই, দেখুন তো কী পরিমাণ চুকা হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কালকে রেখে দিয়েছিল।”
“ফুচকার টক এমনই হয়। তাড়াতাড়ি খা।” বলেই অপূর্ব ভাই হেলান দিয়ে বসলেন। রোগী দেখার ভিজিটিং আওয়ার শেষ।
পরপর তিনটা ফুচকা মুখে নিলাম। আর নিতে পারলাম না। চোখ মুখ কুঁচকে আসে। গালে হাত দিয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই। আমারও মনের অসুখ করেছে। একটু সারিয়ে দিবেন?”

“কাজে আয়।”
ছোটো ছোটো পা ফেলে কাছে গেলাম। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাকে তার চেয়ারে বসার নির্দেশ দিলেন। একটা যন্ত্র হাতে দিয়ে বললেন, “এটা বুকে চেপে ধর।”
আমি চেপে ধরলাম। তার নাল অপূর্ব ভাইয়ের কানে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের মতো বলেন, “হার্টবিট ঠিকই আছে। তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়?”

“ডাক্তার সাহেব আপনি আমার সমস্যা জানেন না? আমার সমস্যা গোটা আপনিটাই। আপনি কাছে থাকলে আমার হার্ট দ্রুত গতিতে ছুটে যায়। মনে হয় ওরা মিছিল করছে।”
“আচ্ছা তাই? আমি তো সেই মিছিল শুনতে পারছি না।”
অপূর্ব ভাইয়ের ডান হাতটা ছুঁয়ে দিলাম। এবার সেই মিছিল অনুভব করছি। ভ্রু কুঁচকে বললাম, “দেখেছেন?”

“হম। শুনেছি মিছিল। আল্ট্রাসাউন্ড করেছেন? রিপোর্ট দেখব। সংক্ষেপে লক্ষণ বলেন তারপরে সমাধান দিবো।”
আমার দৃষ্টি গেল অদূরে তাকের ভাঁজে। হাজারো বইয়ের ভাঁজে আদর্শলিপি বইটা। ছোটো ছোটো পা ফেলে বইয়ের কাছে গিয়ে আয়ত্বে নিয়ে এলাম। বড়ো হাতের ABCD বের করে এগিয়ে দিয়ে বললাম, এটাই আমার আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট।
A-তে আস্তে আস্তে ব্যথা করে, B-তে বুকের ভিতরে, C-তে কইতে পারি না কাউরে, D-তে ডর যে করে, E-তে একটু হলে, E-তে একটু হলে, F-এ ফুইলা উঠে পেটের ভিতরে। আমার পেটের ভেতরে।”

“পাকা বুড়ি একটা।”
পেরিয়ে গেল‌‌ কিছু মুহুর্ত। ইতস্তত করে বললাম, “অপূর্ব ভাই সেদিন যখন আমি এই চেম্বারে ঢুকেছিলাম, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? দেখি নি তো।”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৩

“আমার বন্ধু তৌফিক ছিল। আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। তোর কথা শুনে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাই। তোকে পাই না। দাড়োয়ানের‌ কাছে শুনেছি তুই উত্তর দিকের রাস্তার ধরে নদীর পাড়ের দিকে গিয়েছিলি। ব্যাস আমিও গেলাম।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৫