এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৯

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৯
ইফা আমহৃদ

বৃদ্ধ -বৃদ্ধা পালিয়েছেন ইতোমধ্যে। তারা যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে। আমি অপূর্ব ভাইকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছি। তিনি মাথায় হাত দিয়ে আমার দেহে ভর ছেড়ে দিয়েছেন। বাবা চাচারা আমাকে বাঁচিয়ে অপূর্ব ভাইকে আ/ঘা/ত করছেন। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “প্লীজ, অপূর্ব ভাইকে ছেড়ে দিন। ওনাকে আর মা/র/বে/ন না।”

বাবা আমার হাত ধরে টান দিয়ে বললেন, “আরু সরে আয় বলছি। ওই ছেলেকে আজ জানে শেষ করে ফেলবো। কতবড় কলিজা, আমার বাড়ির মেয়ে নিয়ে পালিয়েছিল। কলিজা বের করে দেখব, কতখানি সাহস নিয়ে তোর দিকে হাত বাড়িয়েছিল।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারা বিরতিহীন ভাবে আ/ঘা/ত করে যাচ্ছেন। রক্তে আমার জামা ভিজে গেছে। চাচার পা জড়িয়ে ধরে বললাম, “চাচা জান, দোহায় লাগে উনাকে ছেড়ে নিন। উনি আর সহ্য করতে পারছেন না। প্লীজ চাচা।”
আঘা/তে আ/ঘা/তে জ-র্জরিত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন অপূর্ব ভাই। আমি সামলাতে পারছি না। সবকিছু রেখে ছুটে গেলাম বাইরে। চিৎকার করে বললাম, “কেউ আছেন? আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমার স্বামীকে ওরা মে/রে ফেলবে। প্লীজ বাঁচান।”

আশেপাশে কাক পক্ষীর দেখা নেই। আজকের দিনটা আমার জন্য অভিশপ্ত। কীভাবে বাঁচবা তার ঠিক নেই। বিরতি হীন ধারায় অশ্রু ঝরছে। চিৎকার করেও কারো দেখা মিলছে না। পুনরায় অপূর্ব ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললাম, “উনাকে প্লীজ ছেড়ে দিন। ছেলেটা বাঁচবে না। আমার উপরে একটু দয়া করুন।”
বাবা চ্যাঁচিয়ে বললেন, “কতবড় সাহস আমাদের বাড়ি থেকে আমাদের মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছে। ইচ্ছে করছে, কুঁ/চি কুঁ/চি করে শেয়াল কুকুরকে খেতে দেই।”

হাত জোর করে মাটির কাছে মিনতি করলাম, মাটি ফাঁক হয়ে যাক। আমরা দুজনে সেই ফাঁকে ঢুকে যায়। অপূর্ব ভাইয়ের জীবনটা বেঁচে যাক।
মিহির ভাই বাবা আর চাচাকে সামলে বললেন, “হয়েছে। এবার আরুকে নিয়ে আমরা চলে যাই। বুড়া বুড়ি অনেক আগে ঘর থেকে বের হয়েছে। যদি পুলিশে খবর দেয়, এতক্ষণে চলে আসার কথা।”
চাচা বললেন, “তাহলে এই হা/রা/মি/র বাচ্চাকে জ্যন্ত ছেড়ে দিবো?”

“আপনাদের মনে হয়, অপূর্ব জ্যন্ত আছে? বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলেও হাসপাতালে নিতে নিতে মৃ/ত্যু নিশ্চিত। চলুন আমরা চলে যাই।” মিহির ভাইয়ের কথাতে শান্ত হলেন তাঁরা। আমি যেন জীবন্ত পাথর হয়ে গেলাম। আমার চোখের সামনে প্রিয় মানুষটি হারিয়ে যাবেন ভেবেই আধমরা আমি। বাবা হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অসাড় হয়ে যাওয়া শরীর চলছে না। বাবা চিৎকার করে বললেন, “আরু, অপূর্ব-র ভালো চাইলে চলে আয়।”

“আমি যাবো না, অপূর্ব ভাইকে রেখে কোথায় যাবো না।” সাহসে কুলায় না সেই কথাটি বলতে। বাবা হাত ধরে টানতেই তার সাথে সাথে দেহটি চলল ধীর গতিতে। অপূর্ব ভাইয়ের হাতটা তখন দৃঢ় করে ধরা। ধীরে ধীরে বন্ধন আলগা হয়ে গেল। বাবা টানতে টানতে তাদের নিয়ে আসা গাড়িতে তুললেন আমায়। চলতে শুরু করল গাড়ি। ঠিক সময়ে তাকে হাসপাতালে না নিলে বাঁচানো সম্ভব নয়।

মামা বাড়ির কেউ অপূর্ব ভাইয়ের কথা জানে না, জানে না তার অবস্থান, বাড়ি ঘর। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠল। গায়ের ওড়নাটা দুই অংশ করলাম। অপূর্ব ভাইয়ের রক্ত দিয়ে লিখতে বসলাম তার বাড়ির ঠিকানা, ফোন নাম্বার। একটা হারিয়ে গেলে অন্যটা পাবেন। এই আশাতে দুই খণ্ডতে লিখলাম। জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম বাইরে। চোখ জোড়া নিভে গেল। তলিয়ে গেল আঁধারে। অল্প আঘাতে আমি কাতর হয়ে গেছি, আমার অপূর্ব ভাই..

মনে মনে নিজের মৃত্যু কামনা করলাম। মামি যখন জিজ্ঞেস করবেন, তার ভালোবাসার কী প্রতিদান দিলাম। তখন উত্তর দেওয়ার জন্য যাতে এই শ্বাসনালীতে অক্সিজেন না থাকে। তলিয়ে যায় যেন মাটির তলদেশে।
সাথী ভালোবাসা মন ভোলে না
কখনো চলার পথে দুটি পথ মিলে যায়, কখনো এভাবে তারা দুটি দিকে চলে যায়।
মন তাদের সাথে চলে না
ও ভালোবাসা মন ভোলে না।

চাঁদ মামা আকাশ থেকে নিরুদ্দেশ। মিটিমিটি করে জ্বলে থাকা তাঁরারা আজ গম্ভীর হয়ে আছে। ডান হাতে স্যালাইনের ক্যানেল ঝুলছে। আমাকে ঘিরে রয়েছে বাড়ির সবাই। কারো মুখে বলি নেই। ডাক্তার সাহেব শিউরে বসে আছেন। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখছি সবটা। চাচা উত্তেজিত হয়ে বলেন, “আরু কেমন আছে এখন?”

“ভালো নেই, মেন্টালি ডিপ্রেশড। ট্রমের ভেতরে আটকে আছে। নিজে থেকে বাঁচতে চাইছে না।” ডাক্তার সাহেব ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দাদি জান বিচলিত হয়ে বললেন, “তাহলে এখন করণীয় কী? আমাদের সোনামণিকে এভাবে ফেলে রাখতে পারি না।”

“আমার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব। ততটুকু করেছি। এরচেয়ে বেশি করা সম্ভব নয়। আজ তাহলে উঠি। অন্য কোনো প্রয়োজনে আবার ডাকবেন। আসি।” ডাক্তার সাহেব প্রস্থান করলেন। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি হাতের দিকে। মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ। দাদি যাওয়ার পূর্বে বলে গেলেন, “স্যালাইন স্টপ করে কিছু খাওয়াও নয়না। তারপরে একটু ঘুমালেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা আসো, ভিড় করো না।”

চোখের সামনে সেই ভয়ংকর দৃশ্য গুলো ভেসে উঠছে। অপূর্ব ভাই কাতরাচ্ছেন। কাতরাতে কাতরাতে বলছেন, “আরু বাঁচা আমাকে। তোর বাবা চাচারা আমাদের সুখে শান্তিতে থাকতে দিবে না। আমাকে বাঁচতে দিবে না। তোকে বিধবা করে দিবে।”
মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রনা করছে। ছিঁড়ে যাচ্ছে সবকিছু। দু’হাতে মাথা চেপে চিৎকার করে উঠলাম, “আহ্! তাকে বাঁচাও। তাকে বাঁচাও। ওরা শেষ করে ফেলবে। আমি বিধবা হবো না, অপূর্ব ভাই আপনার কিছু হবে না।”
নয়না চাচি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “কাকে বাঁচাবো? আরু চোখ মেলে দেখো। এখানে কেউ নেই।”

“মিথ্যা বলছো তোমরা, ঐ তো তাকে মা/র/ছে। আমার শরীর তার রক্তে মেখে আছে। আমি অপূর্ব ভাইকে ভালোবাসি। তোমরা প্লীজ তাকে কিছু করো না।” চোখ বন্ধ করে কথা গুলো বললাম। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু ধারা। আমাকে সামলানোর জন্য সবাই আছে। কিন্তু অপূর্ব ভাইকে কেউ ধরছে না। সবকিছু অগোছালো রেখে দাদি জান চিৎকার করে বললেন, “যা আবুল। মিজান সাহেব এখনো বেশিদূর যেতে পারে নি। ওনাকে নিয়ে আয়। (নয়নাকে উদ্দেশ্য করে) ওর মাথার নিচে হাত দাও। মাথা সেনসিটিভ ইস্যু। আঘা/ত লাগলে মারাত্মক আকার ধারণ করবে।”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৮

ডাক্তার ফিরে এলেন। সবাই চেপে ধরেছে আমায়। হঠাৎ করেই শক্তি বেড়ে গেছে। সূচের ফোটানোর মতো ব্যথা অনুভব করলাম। ইনজেকশন পুশ করলেন। মিনিট দুই লাগল শরীর অসাড় হতে। অতঃপর জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম বিছানায়। অন্ধকারে আবৃত হলো চোখজোড়া। অপূর্ব ভাই চিৎকার করে বলছেন না, আমাকে বাঁচা আরু। কোথায় গেল তার কণ্ঠস্বর।
তবুও ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে উচ্চারণ করছি, “অপূর্ব ভাই আপনার আরু, আপনার কিছু হতে দিবে না। একটু ভরসা করুন তাকে।’

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৪০