এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৮

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৮
ইফা আমহৃদ

ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ধীরে ধীরে বৃষ্টির মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। কচু শাক দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়েছি। অপূর্ব ভাইয়ের হাতে জাদু আছে বলতে হবে। বউ রান্না জানে না, অথচ স্বামী রান্না করে খাওয়ায়। আমার খাওয়া শেষ করে অপূর্ব ভাইয়ের জন্য খাবার সাজিয়ে রেখেছি।

তার আসার নাম নেই, বেশিক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে। তাছাড়া না খেয়ে বেশিক্ষণ থাকার অভ্যাস তার নেই। অপূর্ব ভাইয়ের কাছে যাওয়া উচিত। খাবারগুলো একটা ঢাকনা যুক্ত বাটিতে নিলাম। গামছায় প্যাঁচিয়ে নিলাম বাটিটা। আশেপাশে ছাতা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কৃষকদের ঘর ছাতা পাওয়া দুষ্কর। বেড়ার ফাঁকে দুটি টুপি নজর হলো, যা বৃষ্টির দিনে মাথায় নিয়ে কৃষকেরা ধান রোপন ও বপন করে থাকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মনে মনে তৃপ্তি কর হাসি হাসলাম। চুপি দুটি মাথায় নিয়ে চললাম ধান ক্ষেতের দিকে। সাথে নিয়ে নিলাম ভাতের বাটি। খেতে কৃষকদের দেখা নেই। আশেপাশে কাক পক্ষীও দেখা যাচ্ছে না। এক মনে আইল কে/টে যাচ্ছেন অপূর্ব ভাই। ভিজে জবুথবু অবস্থা তার। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে টুপিটা তার মাথায় পরিয়ে দিলাম। আইল কা/টায় বিরতি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন তিনি। ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান গলায় বলেন, “বৃষ্টির ভেতর এখানে আসতে কে বলেছে তোকে? এমনিতেই জ্বর পিছু ছাড়ে না, এবার তো চিরস্থায়ী বাঁধিয়ে ফেলবি তুই।”

“বলেছে আপনাকে? ভালো করতে এলাম, উল্টো আমাকে বকছে। এজন্যই কারো ভালো করতে নেই। বুঝেছেন?” ভেংচি দিয়ে বললাম। টুপিটা মাথায় নিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলেন। বলতে ইচ্ছে করলো, না নিয়ে আসলে মাথায় দেন কিভাবে? মনে মনে উচ্চারণ করে বললাম, “আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। চলুন, খাবেন।”
“তুই চোখে দেখতে পারিস না? ক্ষেতের মাঝখানে খাবো কীভাবে? বাড়িতে যা।”

“ঐ গাছের নিচে আসুন। খেতে না পারলে আমি খাইয়ে দেবো। চলুন।” বলে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলাম কড়াই গাছের নিচে। অনেক বড়ো গাছটা। তার ডালপালা দিয়ে ঘেরা। বৃষ্টি তেমন পরে না। অপূর্ব ভাইয়ের হাতে কাঁদা মেখে আছে। তাই নিজের হাতে খাবার মেখে তার মুখে তুলে দিলাম। খাবার চিবুতে চিবুতে আমাকে দেখলেন। মুচকি হেসে বললেন, “তুই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস আরু। আমাদের সেই ছোট্ট আরু নেই। স্বামী সোহাগী হ।”

“বড়ো হবোই তো, স্বামী আছে। দুদিন পর সংসার হবে। আপনি চাইলে আমাদের ছোটো একটা বাচ্চা..
বাক্য শেষ করলাম না। মাথাটা নিচু করে নিলাম। গলা আপনাআপনি থেমে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে লোকমা তুলে দিলাম। টুপ করে কামড় দিলেন হাতে। আহ্! করে উঠলাম। অপূর্ব ভাই পুনরায় বললেন, “তুই নাকি বড়ো হয়ে গেছিস? কই একই তো আছিস। সামান্য একটু কা/ম/ড় সহ্য করতে পারিস না তাহলে ভালোবাসার তীক্ষ্ণ স্পর্শ অনুভব করবি কীভাবে?”

তার চোখের দিকে তাকালাম। দুটি চোখ নিরবে দৃষ্টি আদান প্রদান করে চলেছে। তার ভেজা চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সেই মাতাল দৃষ্টিতে এড়িয়ে গেলাম। ক্ষেতের মাঝে জমে থাকা পানিতে হাত চুবিয়ে ধুয়ে নিলাম। বাটিগুলো পরপর গুছিয়ে গামছায় প্যাঁচিয়ে নিলাম। মৃদু গলায় বললাম, “আসি!”

পা বাড়ালাম। পেছন থেকে টেনে ধরলেন কাপড়। থমকে গেলাম আমি। হাতটা ধরে টান দিতেই হুরমুরিয়ে পড়লাম তার বুকে। তার চুল বেয়ে পানিগুলো আমার মুখশ্রীতে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে। অস্ফুট স্বরে বললাম, “আমি বাড়িতে যাবো।”

“আমি আসতে বলেছি? এসেছিস নিজের ইচ্ছাতে, যাবি আমার ইচ্ছাতে। আমার কাছে আসতে চেয়েছিস বলেই এসেছিস। ‘আমি তো চাইবোই, এ শহরে তুমি নেমে এসো💚!’ একবার যখন তোমার চরণের আবির্ভাব ঘটেছে। আর ফিরতে দিচ্ছি না।”

“মানে?” মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে।
“মানে? খাবার তো নিয়ে এসেছিস? কিন্তু আমার তৃষ্ণা? গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণা মেটাবো কীভাবে?”
“বাড়ি থেকে পানি নিয়ে আসবো?”

অপূর্ব ভাই নেশালো দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো। একত্রিত হলো দু জোড়া তৃষ্ণার্ত অধর। চলল জল পানের সেই মধুর মুহুর্ত। অদূরে দুটো চড়ুই পাখি গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির করে চলেছে। বর্ষার ধাঁচ বাড়ছে। অপূর্ব ভাই সরে গেলেন। আঁচল টেনে খুলে ফেললেন। তার ভিজে উঠা ঠোঁট জোড়া মুছে উঠলেন জায়গা ছেড়ে। গামছায় প্যাঁচানো বাটি আর কো/দা/ল লুকিয়ে রাখলেন ঘাসের আড়ালে। আমি পথ ধরলাম। পেছন থেকে হুট করে এসে কোলে তুলে নিলেন আমায়। ভয় পেয়ে চমকে উঠলাম। আঁকড়ে ধরলাম তার পাঞ্জাবি। অপ্রস্তুত গলায় বললাম, “ছাড়ুন। কেউ দেখবে?”

“কেউ বলতে? গাছের ডালে চড়ুই পাখি ছাড়া কেউ দেখবে না। এই বৃষ্টিতে ঘর থেকে বের হওয়ার সম্ভবনা নেই।”
“তবুও ছাড়ুন। আমার লজ্জা করে।”
“লজ্জার ‘লজ্জা’ করতে ইচ্ছে করছে, করুক। বাধা দিয়েছি না-কি? একটা কথা শোন, বলতে গেলে তোর চেয়ে দ্বিগুণ বয়স আমার। ঠিকঠাক বয়সে বিয়ে করলে দুই বাচ্চার বাবা হয়ে যেতাম। তোর পরিবর্তে তাদের একজনকে কোলে একজনকে পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম।” অপূর্ব ভাইয়ের কথায় নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। বৃষ্টির ফোঁটা পানির মাঝে পড়ে ছিটে যাচ্ছে। সেই অসাধারণ মুহুর্তের সাক্ষী হলাম।

এই মেঘলা দিনে
একলা ঘরে
থাকে না-তো মন
কাছে যাবো, কবে পাবো।
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।

পনেরো দিন হয়েছে এখানে এসেছি। কীভাবে পেরিয়ে গেল? বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা বসে আসছেন হোগলা বিছিয়ে।
কুঁড়ের ঘরের বেড়া ঘেঁষে শুয়ে আছি। ফাঁক দিয়ে দেখে যাচ্ছি সবকিছু। অপূর্ব ভাই পায়চারি করতে করতে কল করছেন তিস্তা আপুকে। বৃষ্টি নেই কাঠ ফাটা রোদ। তিস্তা আপু রিসিভ করছে না। এমন সময়ে পরপর কয়েকটা লোক ঘরে ঢুকে এলো।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৭

কিছু বুঝে উঠার আগেই অপূর্ব ভাইয়ের মাথায় চারবার আ/ঘা/ত করল। অপূর্ব ভাই মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। অপূর্ব ভাইয়ের চিৎকার শুনে কাঁথা থেকে বেরিয়ে এলাম। মিহির ভাই, বড়ো চাচা, বাবা, ছোটো চাচা। অপূর্ব ভাই মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। রক্ত ভিজে যাচ্ছে মাটি। উঠতে গিয়ে চৌকির সাথে হোঁচট খেয়ে অপূর্ব ভাইয়ের গায়ে পড়লাম। জড়িয়ে ধরলাম তাকে। বড়ো চাচার হাত থেকে একটি আ/ঘা/ত আমার মাথায় এসে লাগল। পৃথিবীটা যেন ঘুরে উঠল।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৯