এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৭

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৭
ইফা আমহৃদ

দমকা হাওয়া থেমে গেছে। কিন্তু ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তখনও বিরাজমান। ঘরের মাঝ বরাবর একটি ল্যাম্প ধরানো, যা হলদেটে আলো ছড়াচ্ছে। নীরবতা পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ। অপূর্ব ভাই পাশে বসে ছিলেন। আমি শুয়ে আছি। হঠাৎ বেশ করে আমার ইচ্ছে জাগলো তার কোলে মাথা রাখার। মৃদু মাথা উঁচু করে তার কোলে মাথা রাখলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “এত রাতে বৃষ্টিতে কোনো দোকান খোলা নেই। কালকে সকালে বৃষ্টির পর ওষুধ না এ আসবো।”

“ঠিক আছে। আপনিও ঘুমান।”
দরজায় করাঘাত পড়ল। বৃদ্ধ খাবার নিয়ে এসেছে। অপূর্ব ভাই একটু সরে গেছেন আমার থেকে। নম্র গলায় বৃদ্ধকে আসতে বললেন। একহাতে খাবার অন্য হাতে জরিবুটি। অপূর্ব ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এটা খাইয়ে দেবে আর এটা পায়ে ম্যাসাজ করে দিবে। কাল সকালের ভিতরে অসুস্থ হয়ে যাবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ধন্যবাদ” শুকনো কণ্ঠে বললেন তিনি। বৃদ্ধ চলে গেলেন। পুনরায় ঘরে নীরবতা বিরাজ করে উঠলো।
ভাতের সাথে দুটো শুকনো মরিচ। তরকারি বলতে কিছু নেই। শুকনো মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার অভ্যাস আমার থাকলে অপূর্ব ভাইয়ের নেই। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এক লোকমা পান্তা ভাত আমার মুখে তুলে দিলেন। চিবুতে চিবুতে বললাম, “আপনি কি তাদের আগে থেকেই চিনতেন? তাদের ব্যবহার দেখে মনে হয় পরিচিত।”

“হ্যাঁ, চিনতাম। তিনি এখানকার ডাক্তার। বন্যলতা সংরক্ষণ করে গ্ৰামের মানুষের চিকিৎসা করেন। আমার সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচয়।”
আচ্ছা!” সংক্ষিপ্ত জবাব আমার। অপূর্ব ভাই খাওয়ানো শেষ করে বন্যলতা দিয়ে তৈরি ওষুধ আমাকে খাইয়ে দিলেন। পায়ে আলতো করে ম্যাসাজ করে দিতে লাগলেন। খাওয়া সম্পূর্ণ হতেই আমার চোখে ঘুমেরা রাজত্ব শুরু করে দিল। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

আকাশটা বড্ড মেঘলা। বৃষ্টি থেমে গেছে। সূর্য্যি মামা নেই। লুকিয়ে আছেন মেঘের আড়ালে। পাখিরা ভরসা পায়নি, বাইরে বের হওয়ার। তবে আমি শরীরে শক্তি ফিরে পেলাম। বিছানা থেকে উঠে গেলাম। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে। চোখ জোড়া উন্মোচন করতেই হতবাক হলাম। নিত্যদিনের মতো আমার পা অপূর্ব ভাইয়ের পেটের উপরে রয়েছে। এটা নতুন নয়। তবে ব্যতিক্রম, অপূর্ব আমার অতি নিকটে।

তার মুখশ্রী আমার কাঁধে। নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে আমার কাঁধে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছি। তার একহাত কাপড় ভেদ করে আমার কোমর আঁকড়ে ধরে রয়েছে। আমার নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে তিনি এমন করেছেন। কারণ দুজনার উপযোগী চৌকি। একটু নড়াচড়া করলে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। অসুস্থ অবস্থায় পড়ে গেলে আরও ব্যথা পাবো। পোশাক ঠিক করে নিজের পা সরিয়ে নিলাম।

ঘুমন্ত ললাটে অধর স্পর্শ করে লজ্জায় রাঙা হলাম। তড়িগড়ি করে চৌকি ছেড়ে নেমে গেলাম। বাইরে গিয়ে বসলাম। বৃষ্টির পর আকাশটা আজ বেশ লাগছে। বাড়ির সামনে একটা আম গাছ। নিচে কতগুলো আম পড়ে আছে। দু’হাতে আম কুড়িয়ে একপাশে রাখলাম। লাফ দিয়ে আম গাছের পাতা ছিঁড়ে নিলাম। গ্ৰামে থাকতে প্রায়ই আম গাছের পাতা দিয়ে দাঁত মাজতাম। আজও তাই করলাম। বৃদ্ধা সকাল সকাল নামলেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। তিনি সাঁই দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করছেন। আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “ক্ষেতে যাবা? সামনেই আমাদের সবজির ক্ষেত। কচু শাক নিয়ে আসবো। সকালে গরম ভাত দিয়ে কচু শাক খেতে অনেক ভালো লাগে।”

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তিনি বাঁশের তৈরি ঝুড়ি নিয়ে নিলেন সাথে। একটু উঁচু গলায় বললেন, “আমি ক্ষেতে গেলাম। চা করে রেখেছি। ঠান্ডা হলে আবার গরম করে নিও।”
কাপড় উঁচু করে পরিয়ে দিয়েছিলেন যার দরুন কাঁদা লাগছে না। মাটির রাস্তা দিয়ে ক্ষেতে চলে গেলাম। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। মুলা দেখে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম, “জানেন দাদি, আমি আগে ভাবতাম মুলা পেকে গাজর হয়।”

তিনি আমার মাথায় আস্তে একটা চপল দিয়ে বললেন, “তুমি ডাকো দাদি, তোমার স্বামী ডাকে চাচি। কেমন লাগে বলো। যেকোনো একটা ডাকো, নাহলে সম্পর্কের অন্য মানে দাঁড়ায়।”

জবাব দিলাম না। প্রয়োজনীয় কাচা বাজার নিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। উঠানে বসে বৃদ্ধ আর অপূর্ব ভাই চা খাচ্ছেন। আমি টুলে বসলাম। বৃদ্ধা রান্নাঘরে গিয়ে চা গরম করে নিয়ে এলেন। চারজনে বসে খেতে লাগলাম। খেতে খেতে বৃদ্ধা বললেন, “ধান ক্ষেতে পানি জমেছে। আরেকটু বৃষ্টি হলেই ক্ষেত তলিয়ে যাবে। তার আগেই আমাদের আ/ই/ল কা/ট/তে হবে।”
“তাহলে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ব।”

“এখনো তো আকাশ পরিষ্কার দেখছি। বৃষ্টি আসতে দেরি হবে। ভাত বসিয়ে দিয়েছি, হলে খেয়ে যেও।” বলেই বৃদ্ধা রান্নাঘরে গেলেন। বৃদ্ধ আর অপূর্ব ভাই কথা বলছেন। আমি আম ফাটিয়ে খাচ্ছি। আম ছিলে খাওয়ার চেয়ে ফাটিয়ে খেতে অনেক মজা। তুর আর আমি কত খেয়েছি। চোখের কোণে পানি চলে এলো। কতদিন হয়েছে পরিবার থেকে দূরে। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। নিজের মাঝে আগের মতো সেই প্রাণোচ্ছল আরুকে খুঁজে পাই না। পরিস্থিতি তাকে অসহায় করে দিয়েছে। অপূর্ব ভাইয়ের কথাতে ধ্যান ভাঙল।

“সকাল সকাল খালি পেটে আম নিয়ে বসেছিস। এখন নিশ্চয় পেটে লাড়া দিয়েছে।”
“না।”
“তাহলে কাঁদছিস কেন?”
“এমনিই।”

“ঢং করিস না। এই মুড়িগুলো খেয়ে এক গ্লাস পানি খা। ভাত হলে ভাত খেয়ে শুয়ে থাকবি। ছোটাছুটির দরকার নেই।” এক মুঠো মুড়ি এড়িয়ে দিয়ে বললেন। আমি মুড়ি খেতে লাগলাম। এমন সময়ে দু’জন ছেলে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “রহিম দাদু, সুমি আপার ঘরের খুঁটি বাতাসে পড়ে গেছে। দুলাভাই বাড়িতে নেই। গঞ্জে গেছে। বাড়িতে আপা ছাড়া কেউ নেই। তোমাদের যাইবে কইছে। তাড়াতাড়ি চলো।”

“আমি আসছি, তোরা যা।” বলেই বৃদ্ধ উঠে গেলেন। কোমরে গামছা বেঁধে ঘরে গেলেন। বৃদ্ধা ছুটে এলেন। রান্নাঘর থেকে তিনি সব শুনেছেন। বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমি যাবো। নাতি নাতনিদের নিয়ে না জানি কেমন আছে ওরা?”
“তুমি গেলে ঘর দেখবে কে? ওদের খাওয়াবে কে? তাছাড়া আইল কা/ট/বে কে?” বৃদ্ধর কথাতে বৃদ্ধার মন খা/রা/প হল। দ্বিমত পোষণ করলেন না। অপূর্ব ভাই এগিয়ে গিয়ে বলেন, “আমাদের চিন্তা আপনাদের করতে হবে না। বৃষ্টি নামার আগেই আমি ক্ষেতে যাবো। আপনারা দুজনেই যান। সুমি আপা বাচ্চাদের নিয়ে ভয় পাবে।”

“কিন্তু তোমাদের রান্না?” বৃদ্ধার প্রশ্নে অপূর্ব ভাই বলেন, “আমি সামলে নিবো। আমি রান্না করতে পারি। নিশ্চিতে যেতে পারেন।”
তারা দুজনে ব্যাগপত্র গুছিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। বাড়িতে পড়ে রইলাম আমি আর অপূর্ব ভাই।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৬

অপূর্ব ভাই মাটির চুলোতে বাকি রান্না করতে বসলেন। রান্না শেষ হওয়ার পূর্বেই আকাশ কালো করে এলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। অপূর্ব ভাই কো/দা/ল হাতে নিয়ে মাঠের উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেলেন। আইল কে/টে বাড়িতে ফিরবেন।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৮