এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৬

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৬
ইফা আমহৃদ

দুহাতে আগলে রয়েছি অপূর্ব ভাইয়ের বুকে। হাঁটার ক্ষমতা নেই। পায়ের ব্যথায় হাঁটতে ব্যর্থ আমি। মাথা ভার হয়ে আছে। কোলে নিয়ে হাঁটছেন তিনি। অস্ফুট স্বরে স্বরে বললাম, “আর কতদূর? হাত ব্যথা করছে।”

“এইতো চলে এসেছি।” দৃঢ় কণ্ঠে বলতে বলতে অপূর্ব ভাই এগিয়ে চলেছেন। মনের ভেতরটা খচখচ করছে। কোথায় যাচ্ছি আমরা? একটু আগে আমাকে গাড়িতে একা রেখে হোটেলের সন্ধানে গেছেন তিনি। এই অজপাড়া গাঁয়ে হোটেল পাওয়া দুষ্কর, তবে রাত্রি যাপন করার উপযোগী আশ্রয়স্থলের যোগার নিশ্চিত তিনি করেছেন। মনের কোণে দোটানা নিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের কোলে করে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। একটা ছোটো কুঁড়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে ডাকলেন, “চাচা আছেন? আমরা এসেছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তখনও ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি পতিত হচ্ছে। শুকনো জামাতে পুনরায় বৃষ্টির ফোঁটা রাজত্ব করছে। টিনের ঘর হলে ঝমঝম করে রাজত্ব করতো বৃষ্টিরা, খড়কুটো হওয়ার কারণে শব্দ নেই। দরজা খুলে উঁকি দিয়ে এক বৃদ্ধ বলেন, “দাঁড়াইয়া রইছো কেন বাবা? জলদি ভিতরে আহো। ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

অপূর্ব ভাই দ্রুত পা চালালেন। ঘরের সামনে পানি জমে আছে। অপূর্ব ভাই দ্রুত করতে গিয়ে পা ফেললেন কাঁদার ভেতরে। পা পিছলে উভয়ে পড়লাম পানির ভেতরে।আমি নিচে, তিনি উপরে। অবিলম্বে অধরে অধরের স্পর্শ পেল। চোখে চোখে বিনিময় হলো দৃষ্টি। দু সেকেন্ড স্থির থেকে মাথা তুলে নিলেন তিনি। দৃষ্টি সরিয়ে ফেললাম। লজ্জায় প্রাণ মিলিয়ে যায়। অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সরে আসার প্রচেষ্টা করতেই কোমরে আঘাত অনুভব করলাম ।দু’হাতে অপূর্ব ভাইয়ের চুল খামচে ধরে মৃদু আর্তনাদ করলাম, ‘আহ’।

“লেগেছে?” অপূর্ব ভাই উঠে যেতে যেতে বললেন। আমি অনড় রইলাম‌। মাথা ভার যেন রাগে পরিণত হয়েছে। রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম, “মহিষ মতো একটা গণ্ডার যদি আমার শরীরের উপর পড়ে। লাগবে না-তো কি আদর করবে?”
“মহিষের মতো গণ্ডার- নতুন শুনলাম। তুই সকালে আমার উপরে পড়েছিলিস। তার বেলায়?”
“আমি আর আপনি কি এক? ওজন দেখেছেন?”

জবাবে অপূর্ব ভাই কিছু বলতেও চেয়ে পারলেন না, তার পূর্বে বৃদ্ধ ছুটে এলেন তাল পাতা নিয়ে। মাথায় তাল পাতা ধরে আছেন। অধৈর্য হয়ে বলেন, “ওমা! তোমরা একটু দেখে আসবে না। এভাবে পড়ে না থেকে দ্রুত ঘরে এসো। আকাশ অন্ধকার করে এসেছে। যখন তখন বৃষ্টি আসবে।”

অপূর্ব ভাই উঠে বসলেন। আমাকে কোলে নিয়ে ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। অনুভব করলাম, এক দমকা হাওয়া আমার পিঠ ছুঁয়ে চলেছে। জামার অনেকটা ছিঁড়ে গেছে। ডান হাত অপূর্ব ভাইয়ের কাঁধে রেখে বাম হাত পিঠে রাখতেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু সংস্পর্শে এলো। জামা ভেদ করে অপ্রত্যাশিত কিছু প্রকট হয়েছে। অপূর্ব ভাই দেখতে না পেলেও বৃদ্ধর দৃষ্টি থেকে এড়িয়ে যায়নি। মৃদু স্বরে বললাম, “নামিয়ে দিন, আমি একাই যেতে পারব।”

“পারলে তো নামিয়ে দিতাম।”
“প্লীজ, জামা ছিঁড়ে গেছে। ওটা দেখা যাচ্ছে।”
অপূর্ব ভাই বুঝলেন কি-না জানা নেই। বাঁকা করে তাড়াতাড়ি হেঁটে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। ছোটো একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে ওড়না জড়িয়ে দিলেন গায়ে। বৃদ্ধা ভেতরেই ছিলেন। তাকে দেখে লজ্জায় কাবু হলাম। ব্লাউজ বিহীন কাপড় পড়েছেন। আমি মাথাটা আলতো নিচু করে রাখলাম।

অপূর্ব ভাইকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন বৃদ্ধ। আমাকে উদ্দেশ্য করে বৃদ্ধা বললেন, “ডাক্তার সাহেব বলছে, তার বউ নিয়ে কিছু দিন এখানে থাকবে। তুমিই কি ডাক্তার সাহেবের বউ?”
সংশয়ে পড়লাম আমি। অপূর্ব ভাই আমাকে তার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। মৃদু স্বরে বললাম, “হম। কেন?”

“ছোডো ছোডো লাগে। আমাদের গ্রামে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয় বয়স্ক ছেলে দেখে। শহরেও বয়স্ক ছেলের কাছে বিয়ে দেয়।” আমি মুচকি হাসলাম। মাথা ভার হয়ে আছে। বৃদ্ধা সন্দিহান গলায় বলেন, “তা জামা কাপড় আছে কিছু? থাকলে গোসল সেরে নেও। কলসে পানি ভর্তি করে রাখছি।”

“এখান থেকে কল তো অনেক দূরে? কলসের পানি খরচ করলে খাবেন কী?”
“এগুলো বৃষ্টির পানি। বৃষ্টির সময় সংরক্ষণ করে রাখি। এই বয়সে কলস নিয়ে কল তলাতে যেতে পারি না।”
পাশেই ছোটো একটা বারান্দা। দুই মগ পানি ঢেলে পড়লাম বিপত্তিতে। জামা কাপড় নিয়ে আসা হয়নি। পড়ার মতো কোনো পোশাক নেই। বৃদ্ধা মহিলা আমাকে তার একটি কাপড় দিলেন। কাপড়টি এপিঠ ওপিঠ দেখে বললাম, “আমি কাপড় পড়তে পারি না।”

“আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”
“ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি কীভাবে পরে? আপনার লজ্জা করেনা?
“সোয়ামীর সামনে আবার কীসের লজ্জা? আমাদের গ্রামে সবাই এমনেই শাড়ি পরে।”
“পরব না।”
বৃদ্ধা আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না। আমিও তেমন বাঁধা দিলাম না। তিনি গুছিয়ে কাপড় পরানো শেষ করে বলেন,

“কিছু খেয়েছো?”
“হম। চা খেয়েছি।”
“শুধু চা? ভাত খাও নাই?”
“না।”
“তুমি বরং তোমার স্বামীর কাছে যাও। ঘরে পান্তা ভাত আছে। চুলাতে পানি ঢুকে ভিজে আছে। রান্না করা যাবে না। পান্তা ভাত দিয়ে রাতটা পার করে দাও। কাল সকালে গরম ভাত করে দিবো।” পরের বাক্য আমি শুনতে পেলাম না। ‘তুমি বরং তোমার স্বামীর কাছে যাও’ – প্রথম বাক্যটা শুনেই কান থেকে ধোঁয়া উঠছে। জ্বরের মাঝেও শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

ল্যাম্প জ্বলছে কাঠের তক্তার উপর। হলদে আলো ছড়াচ্ছে। রেডিও বা টেলিভিশন নেই যে, আবহাওয়া শুনবো। বৃষ্টি থামার নাম নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। কুঁড়ে ঘরের ভেতরে হাওয়া ঢুকে যাচ্ছে। বৃদ্ধ ঘরে ঢুকলেন এমন সময়ে। তার পেছনে পেছনে অপূর্ব ভাই। একপাশে জড়োসড়ো শুয়ে আছি। অপূর্ব ভাই আমার পাশে বসে ধীর গলায় ডাক দিলেন, “আরু, জ্বর কমেছে?”

“হেচ্চু! মাথা ভার হয়ে আছে। হেচ্চু!”
হাতের এপিঠ ওপিঠ দিয়ে জ্বর দেখে নিলেন। অবিলম্বে কোলে তুলে নিলেন আমায়। এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “চাচা কাঁথা থাকলে একটা কাঁথা দিয়েন। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৫

“হেচ্চু! আমি ঘরে যাবো না, হেচ্চু!” আমার কথায় কর্ণপাত না করে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। বিছানায় রেখে কাঁধ মুছতে লাগলেন। সর্দিতে তার কাঁধ ভিজে গেছে। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, তাকে আজ বুড়ো বুড়ো লাগছে। তারমানে বৃদ্ধা ঠিকই বলেছেন, তিনি বয়স্ক। কিন্তু আমার মতে তিনি বুড়ো বাম। কপাল আমার ভিজিয়া গেল চোখেরই জলে।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৩৭