কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৩৮

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৩৮
লাবন্য ইয়াসমিন

সাদা টাইলসের উপরে ছোটখাট একটা র/ক্তের স্রোত বয়ে চলেছে দরজার দিকে। পাথরের হাতের খাবার গুলো পাশে পড়ে আছে। কাচের প্লেট আর গ্লাসের টুকরো পাশে ছড়িয়ে আছে র/ক্তের উপরে। পাথর দ্রুত গিয়ে কহিনুরের পাশে হাটু ভেঙে বসে পড়লো। কাঁপা কাঁপা হাতে আলগোছে মেয়েটার মাথাটা তুলে নিয়ে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বাম হাতে কহিনুরের মুখটা ধরে ভেজা কন্ঠে বলল,

নূর তুমি ঠিক আছো? প্লিজ অভিমান করে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করো না। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমি আর কখনও তোমাকে আটকে রাখবো না। তোমার যা মন চাই করবে তবুও প্লিজ এমন করোনা। আমার কি হয়েছিল জানিনা এরকম ভাবে তোমাকে কেনো আটকে রাখতে গেলাম? বর্বর হয়ে গেছি। নিষ্ঠুর তুমি নও আমি। কিভাবে পারলাম তোমাকে কষ্ট দিতে? আমি পাপি আমি সত্যি মানুষ না। নরাধম পাপি আমার শাস্তি হওয়া উচিত। আমার অভিশাপে তোমার ক্ষতি হয়ে গেলো। কিভাবে তোমাকে বাঁচাবো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পাথর অনবরত বকবক করে চলেছে। চোখের পানি বাঁধ ভেঙেছে থামছে না। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। কি করবে মাথায় আসছে না। ম্যা\র্ডার কেস হাসপাতালে নিলে ওরা চিকিৎসার আগে ঝামেলা করবে। পাথর দ্রুত কহিনুরকে কোলে তুলে নিলো। একবার ভাবলো খঞ্জ/রটা পেট থেকে বের করবে আবার ভাবলো যদি আরও কিছু হয়ে যায় তখন? সুলতান পরিবারের একমাত্র প্রদীপ এই মেয়েটা। পাথর নিজেকে দোষারোপ করছে। কহিনুরকে নিয়ে ও দরজার কাছে আসতেই সেখানে হাঈদ এসে হাজির হলো। পাথর এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। বলল,

দেখোনা সাঈদ আমি ওকে মে/রে ফেললাম। আমি খুব খারাপ পাপিষ্ঠ আর নিকৃষ্ট জঘন্য একজন মানুষ। কিভাবে পারলাম বলোতো?
পাথরের কথা শুনে সাঈদ মলিস হাসলো। কিছু একটা ভেবে বলল,
চিন্তা করবেন না জনাব। নূরকে বিছানায় রাখুন আমি দেখছি।
পাথর ভ্রু কুচকে কান্না আটকে বলল,
কি দেখবে তুমি? পারবে না। হাসপাতালে নিতে হবে।
জনাব আপনি হয়তো জানেন না কহিনুর সাধারণ কোনো মানবি না। সে কহিনুর ধারণ করেছে। উনার মধ্যে বেশ কিছু শক্তির সংমিশ্রণ আছে। পরে বলছি আগে ওকে রাখুন।

পাথর আর ঝামেলা করলো না। দ্রুত কহিনুরকে বিছানায় রেখে পাশে বসে পড়লো। মেয়েটার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। নিশ্বাস উঠানামা করছে দ্রুতগতিতে। সাঈদ এসেই আলগোছে খঞ্জ/রটা তুলে নিয়ে কাটা স্থানে নিজের তৈরী ঔষুধ লাগিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়লো। পাথর চোখ বন্ধ করে পিটপিট করে তাঁকিয়ে দেখলো ক্ষতচিহ্ন একদম ঠিক হয়ে গেছে তবে কহিনুরের জ্ঞান ফিরেনি। পাথর ভ্রু কুচকে অবাক হয়ে জিঞ্জাসা করলো,

সাঈদ এসবের মানে কি? কহিনুরের এই শক্তির উৎস কি? ওর বাবা মা তো সাধারণ মানুষ তবে ওর মধ্যে এসব কিভাবে এসেছে? মেয়েটা এই অল্প বয়সে এতো বুঝদার কিভাবে সম্ভব?
পাথরের এতো এতো প্রশ্ন শুনে সাঈদ হাসলো। কহিনুরকে নিয়ে সকলের এতো কৌতূহল ওর ভালো লাগে। মেয়েটা সত্যিই অসাধারণ। কি নেই ওর ঠিক যেনো রূপকথার রাজকুমারী। সুলতান পরিবারের বিশাল ঐশ্বর্যের মালকিন। সঙ্গে অতুলনীয় রূপ। সাঈদ কথাগুলো ভেবে বলল,

আমাদের কহিনুর হচ্ছে একটা পবিত্র আত্মা যার আগমন ঘটেছে কালো শক্তির বি/নাশের জন্য। ওর মধ্যে ছয়টা পবিত্র আত্মা আর জ্বীনের শক্তি আছে। কহিনুর একটা মহামূল্যবান পাথর যেটা এই দুই শক্তি দিয়ে তৈরী হয়েছিল। মানুষের ভালোর জন্য কাজ করতো এই পাথর।কিন্তু বহূকাল পূর্বে এক শয়/তান এই পাথরটাকে বশবর্তী করে নিয়েছিল। মানুষকে লোভ দেখিয়ে নিজের উপাসনার কাজে লাগিয়ে পাথরটাকে ব্যবহার করতো।

শেষে পর্যায়ে একজন মানুষ যিনি পথরটাকে কোনো পাপ কাজে ব্যবহার না করে ভালো কাছে ব্যবহার করেন আর যার ফলে অধরা মালকিনের জন্ম হয়। ততদিনে কহিনুর পাথরটা নির্জীব হয়ে যায় শক্তি সব পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ে। তখন কালো শক্তির শয়/তান ভবিষ্যৎ বাণী করেন অধরা মালকিনকে বিবাহ করলে তাঁর যে কন্যা সন্তান হবে সেই হবে এই শক্তির অধিকারী। তখন সেই বাচ্চা কে হ/ত্যা করলে কহিনুর পাথরটা আবারও নিজের শক্তি ফিরে পূনরায় শয়/তানের কাজে ব্যবহার করা যাবে। যার কাছে ওই পাথরটা থাকবে সে যা চাইবে তাই পাবে।

এই শক্তির কে কি কাজে লাগাবে আর একে ঘিরে আছে হাজারো রহস্য। আপনার জন্ম কেনো হলো জানেন? আপনার বংশের ছেলেরা তো কোনো নারীর স্পর্শে আসলে সেই নারীর তৎক্ষণাত মৃ/ত্যু হয় তবে আপনার মায়ের মৃ/ত্যু হলো না কেনো? আপনার বাবা কোথায় গেলেন? তারপর ধরুন আপনার বংশে কোনো মেয়ে নেই তবে তফসিল মেরিন কে?

এবং আপনি আপনার জ্ঞাতিদের ন্যায় নারী আসক্ত নয় কেনো?খোঁজ করুন। আপনার বংশের এই অভিশাপ কিভাবে এসেছে কার জন্য এসেছে এসব তো এখনো ধোয়াসা। নিজের পরিবারের এতো এতো ঝামেলা রেখে আপনি নূরকে এভাবে বন্দী করেছেন। মেয়েটাকে বাঁচতে দিন প্লিজ। একবার যদি ও কারো বশে চলে যায় তবে খারাপ হবে। বুঝতে পারছেন কি বলেছি?

সাঈদ সংক্ষেপে সব ঘটনা বলতে না পারলেও কিছুটা বুঝিয়ে বলল। পাথর চুপচাপ বসে আছে। কিছু একটা ভাবছে। সাঈদ ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ছেলেটার জন্য ওর মায়া হচ্ছে। কহিনুর ছোট থেকেই নিজের শক্তি সম্পর্কে অবগত আছে। কিন্তু এই ছেলেটা মোটেও তেমন ছিল না। খুব সাধারণভাবে জীবন যাপন করেছে তার মধ্যে হঠাৎ জেনেছে ও মানুষ না। আবার পুরোপুরি অন্য কিছুও না অর্ধমানব। নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে স্বাভাবিক। নীরবতা ভেঙে পাথর বিড়বিড় করে বলল,

তুমি এইটুকু বলো আমি কহিনুরের জন্য কি ক্ষতি/কর? আমার অভি/শপ্ত জীবন কোনোভাবেই কি ওর ক্ষতির কারণ হবে? আমার পাপিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া পেয়ে ও কি ঝরে যাবে? আমি খারাপ সাঈদ?
সাঈদ কি বলবে বুঝতে পারলো না। তাছাড়া সবটা ওর জানা নেই। কিছু ঘটনা জেনেছে কহিনুরের থেকে আর কিছু নিজেই সন্ধান করেছে। তবে যার শুরু আছে তার অন্ত যেমন থাকে তেমনিভাবে রোগ থাকলে নিরাময়ের উপাই নিশ্চয়ই থাকবে। সাঈদ মিনমিনে কণ্ঠে বলল,

জনাব আমি খুব বেশি কিছু জানিনা আপনার বিষয়ে। যেটুকু জেনেছি বলেছি বাকীটা আপনি নিজেই খুঁজে নিন। নয়তো নূরকে সুস্থ হতে দিন সে নিজে সব জেনে নিবে। আপনাকে কোনো না কোনোভাবে সে অভিয/শাপ মুক্ত করবে। ভরসা রাখুন আর বিশ্বাস করুণ।

পাথর উত্তর করলো না। প্রচণ্ড খারাপ লাগা ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। কিভাবে নূরের প্রতি এরকম নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারলো মাথায় আসছে না। ওতো চেয়েছিল মেয়েটাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে রাখতে তবে এখানে কেনো এনেছিল মাথায় আসছে না।

ওকে আনার সময় কিছু একটা হয়েছিল। কি হয়েছিল মনে পড়ছে না। পাথর পাশে রাখা পানির গ্লাস থেকে পানি নিয়ে কহিনুরের চোখেমুখে ছিটিয়ে দিয়ে কাপড় ভিজিয়ে মুখটা মুছে দিলো। সাঈদ ফ্লর পরিস্কার করতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটার জ্ঞান ফিরে আসবে। এতোকিছুর মধ্যে পাথর ভূলে গেলো এই ঘটনার পেছনে আসল দোষী কে?

জঙ্গল থেকে ফিরে অধরা কক্ষে এসে দরজা বন্ধ করার কিছুক্ষণ পরেই কেউ একজন দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করলো। অধরা বারবার প্রশ্ন করেও যখন উত্তর পেলো না তখন নিজে গেলো দরজা খুঁলতে। বাইরে হঠাৎ করেই তুষারপাত হচ্ছে। শীতে জমে যাওয়ার অবস্থা। ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারদিক। বাল্বের আলোটা কেমন নির্জীব হয়ে আছে। অধরা দরজা খুলে উঁকি দিতেই জুবায়ের ওকে টেনে নিলো বাইরে।

তারপর টুপ করে কোলে তুলে নিয়ে হাটা ধরলো নিজের কক্ষের দিকে। অনেক সহ্য করেছে আর পারছে না। বিরহের চাইতে মৃ/ত্যু ভালো। এভাবে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব না। অধরা ওর অভ্যাসের নাম। সকালে যার মুখ দেখে দিন শুরু হয় আর রাতে যার মুখ দেখে স্বপ্নের দুনিয়ায় প্রবেশ ঘটে সে ছাড়া জীবন অর্থহীন। কিভাবে এই সীমাহীন সুখ থেকে নিজেকে আটকে রাখবে? কখনও পারবে না।

ভালোবাসার চাদরে না হলে ক্ষমতা দৈহিক বল দিয়ে বাঁধা দিবে বলে জুবায়ের আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অধরা বাঁধা দিতে চাইছে কিন্তু শক্তির কাছে ব্যার্থ। জুবায়ের ওকে ঝাপটে ধরে রেখেছে। ছাড়ার নাম নেই। একবারে কক্ষে ফিরে ওকে বিছানায় ফেলে দিয়ে জুবায়ের দরজা লক করে পেছনে ফিরলো। অধরার চোখে আগুন জ্বলছে। জুবায়ের সেই আগুনে খানিকটা পেট্রোল দেওয়ার মতো চওড়া হাসি দিয়ে বলল,

বউ হচ্ছে ঘুমের মেডিসিনের ন্যায় শক্তিশালী একটা মা/দক/দ্রব্যের নাম। ঘুম হচ্ছে না। প্লিজ রাগ করোনা। পাক্কা প্রমিজ তোমাকে বিরক্ত করবো না। কাছে থাকো এতেই শান্তি শান্তি অনুভব হয়। বুঝোনা কেনো? বয়স হয়েছে দুদিন পরে তো ময/রেই যাবো। তোমার থেকে বয়সে একে তো আমি বেশ বড়। তোমার আগেই আমি মর/বো তখন যতটা পারো একা থেকো আমি বাঁধা দিতে আসবো না কিন্তু এখন না।। আচ্ছা দোয়া করো যেনো আমি খুব তাড়াতাড়ি মা/রা যায়। এই ধরো আজকের মধ্যেই। তাহলে তুমি ফ্রি হয়ে যাবে বলো?

জুবায়ের জানতো এমনি হবে। মেয়েদের মন বাইরে থেকে যতই কঠিন হোক স্বামী সন্তানের খারাপ কিছু শুনলে সে দুর্বল হবেই। সেটাই হলো। অধরা মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠলো। জুবায়ের দ্রুত গিয়ে ওকে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
খুব সরি আর কিছুই বলবো না প্লিজ কেঁদো না। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে কিছু বলিনি বিশ্বাস করো। আগেকার পচা পচা কথাগুলো আর কখনও বলব না। আমার মনে শুধুমাত্র তোমার বসবাস। জুহি আমার মোহ ছিল। অল্প বয়সের ভিমরতি বলতে পারো। প্লিজ ক্ষমা করো। জীবনে আর সেসব কথা তুলবো না।
অধরা ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকে জড়ানো কণ্ঠে বলল,

আপনি ভীষণ খারাপ মানুষ। শুধু আমাকে কষ্ট দেওয়ার তালে থাকেন। একটুও ক্ষমা করবো না আপনাকে। কিভাবে পারলেন বলতে আপনি শুধুমাত্র নিজের পাপ বোধ থেকে বাঁচতে আমাকে মেনে নিয়েছেন? কিভাবে পারলেন?
জুবায়ের ওর মুখটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,

আমার মুখের কথায় কি সব? আমার বুকে এতোটা দিন ঘুমিয়ে কাটালে একটুও বুঝতে পারোনি কতটা চাই তোমাকে? সামান্য দুরুত্বেও আমার দম বন্ধ লাগে তবে আর কিভাবে প্রমাণ করবো যে আমি তোমাকে মন থেকে মেনেছি? প্লিজ বিশ্বাস করো।
জুবায়েরের মুখটা মলিন হয়ে উঠেছে। না চাইতেও মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছে অপরাধী লাগছে নিজেকে। কথাটা ভেবে ও দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। অধরা ফুপিয়ে উঠে বলল,

আপনাকে অবিশ্বাস করিনি তবে আমি কষ্ট পেয়েছি। আপনারা বুঝবেন না একজন স্ত্রীর কাছে এটা কতটা লজ্জার। যে স্বামী তাকে মন থেকে মানতে পারেনি। কষ্ট কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ে না। মৃ/ত্যু ছাড়া হয়তো ছাড়বেও না।
অধরার কথা শুনে জুবায়ের ওকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

আজেবাজে কথা বলবে না। এসব কি ধরণের কথা শুনি? আমি আছি তো কিছু হবে না। আগলে রাখবো তোমাকে আর আমাদের মেয়েটাকে। আচ্ছা বলোতো জঙ্গলের ওদিকে কেনো গিয়েছিলে? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
অধরা নাক টেনে জুবায়েরের পিঠে আঁকিবুকি করতে করতে উত্তর দিলো,

আপনার দাদু বুড়ো বয়সে কোন পেত্মির সঙ্গে প্রেম করছে। হাতেনাতে ধরতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনার জন্য হলো না। স্টোর রুমে নিয়ে যাবেন একবার?
জুবায়ের কিছুক্ষণ ভেবে অধরাকে ছেড়ে দিলো। ওর মুখের উপরে আছড়ে পড়া চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে বলল,

আজকের দিনটা বিশ্রাম করো। চাবির খোঁজ করে তোমাকে নিয়ে যাবো। রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে।সারাদিন তোমার চিন্তাই আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আগামীকাল ঐশ্বর্য ফিরছে। আদির সঙ্গে ঝামেলা কমছে না মেয়েটার বাড়তেই আছে। সবটা আগামীকাল থেকে শুরু করবো। এখন ঘুমাও
অধরা ওর কথার উত্তর দিলো না। কোম্বল টেনে শুয়ে পড়লো। মুখে মুখে ক্ষমা করলেও এটা নিয়ে জুবায়েরকে ও ঠিকই খোচাবে। বুঝবে বউয়ের সঙ্গে বেফাঁস কথাবার্তা বললে কি কি হয়।

তফসিল মেরিনকে নিয়ে বসে আছে শামির তালুকদার। উনার মিসেস আর একমাত্র মেয়েটাও পাশে আছে। তফসিলের পাশে বড় একটা লাগেজ পড়ে আছে। মেয়েটা চোখের পানি মুছে নিয়ে বলল,
আঙ্কেল আমি খুব বিপদে পড়েছি আসলে রাজধানীতে আমার চেনাজানা কেউ নেই। একমাত্র পাথর ছাড়া। এখনের একটা অফিসে আমার চাকরি হয়েছে। মাস খানেক পর কোম্পানি থেকে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হবে ততদিন আমি কোথায় যাবো বলুন? তাছাড়া বাইরের খাবার আমার সহ্য হয়না। অসুস্থ শরীর। আমাকে কিছুদিন থাকতে দিবেন প্লিজ?

শামির তালুকদার অমায়িক হাসলেন। এই মেয়েটার জন্য পাথর জীবন ফিরে পেয়েছে কথাটা উনি স্ত্রীর থেকে শুনেছেন। সেই মেয়েটার বিপদে পাশে থাকতে পেরে উনি খুশী। তাছাড়া মেয়েটার মধ্যে কেমন মায়া মায়া ভাব আছে। আগে দেখা হলে ঠিকই ছেলের জন্য প্রস্তাব দিতেন। লোভে অন্ধ হয়ে সুলতান পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে কি লাভ হলো? কিছুই হলো না। খোঁজ পযর্ন্ত রাখেনা। তাছাড়া সুলতানারা কারো পরোয়া করে না। নিজেদের মতোই চলে। কথাগুলো ভেবে উনি আফসোস করলেন। লোকে বলে চোর গেলে বুদ্ধি খোলে তাই হয়েছে। নীরবতা ভেঙে উনি বলে উঠলেন,

তোমার যতদিন ইচ্ছে এখনে থাকতে পারো। সমস্যা হবে না। তোমার আন্টি আছেন তোমার দেখাশোনা উনি করবেন।
তফসিল মনে মনে লাফিয়ে উঠলো। এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল এতোক্ষন। তাইতো নিজের পোশাক পরিচ্ছেদ আর লুক পরিবর্তন করে নিয়েছে। মার্জিত পোশাকে যদিও খারাপ লাগছে না তবে অভ্যাস নেই তাই কেমন অস্বস্তি লাগছে। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়।
হঠাৎ পাশ থেকে মিসেস তালুকদারের কথা শুনে ওর ধ্যান ভাঙলো,

এখানে থাকলে তোমার পরিবারের লোকজন কিছু বলবে না? তোমার বাবা মা কি করেন?
আমি এতিম। দাদু চাচি আম্মা আর ভাইয়া আছেন।বাবা মা নেই। তাছাড়া পাথরকে সবাই চিনে। ওকে বিশ্বাস করে। ছেলেটা এত ভালো কি বলবো। দাদুতো বলেছেন এতো ভালো ছেলে সে তো এমনি এমনি হননি। নিশ্চয়ই তাঁর বাবা মা খুব ভালো। ছেলেকে যত্ন নিয়ে মানুষ করেছেন।
তফসিলের কথায় তালুকদার সাহেব খুশীতে আটখানা। আর কোনো প্রশ্নই করলেন না। মেয়েকে দিয়ে সোজা ওকে কক্ষে পাঠিয়ে দিলেন।

আপেলে কামড় লাগিয়ে পিটপিট করে চোখের পলক ফেলে হেসে উঠলো কহিনুর। সাঈদের মেজাজ চরম খারাপ। এই প্রথমবার ও কহিনুরের উনরে বিরক্ত।পাথর ডাইনিং রুমে বেলালের সঙ্গে বসে আছে মিটিং করছে। আজ অফিসে যাবে না তাই সব কিছু ফার্ম হাউজে নিয়ে এসেছে। কহিনুরকে একা রাখা বিপদের। বেলাল সবটা জানেনা। শুধুমাত্র জানে হঠাৎ স্যারের মাথার তার ছিড়ে গেছে উল্টোপাল্টা আচরণ করছে। ফার্ম হাউজে বসে অফিসে কাজকর্ম করতে হচ্ছে এটাই তাঁর উদাহরণ। পাথর মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে ফাইল তৈরী করছে। বেলাল বলে উঠলো

স্যার অবস্থা খারাপ হলে বলুন ডাক্তার ডাকি। শহরের বেষ্ট ডাক্তারকে ডাকবো প্রমিজ। প্লিজ স্যার এভাবে থাকবেন না।
বেলালের কথা শুনে পাথর ভ্রু কুচকে বলল,
ফাজলামি করছো কেনো বেলাল? দেখছো কাজ করছি সেটাকে তুমি এলোমেলো করার তালে আছো? ঘরে অসুস্থ বউ রেখে কিভাবে মন স্থির করে আছি সে শুধুমাত্র আমি জানি।
বেলালের চোখ কপালে। খুব করে মনে আছে সুলতান জুবায়ের ফারুকী মেয়ের বিয়ের আগে কি কি শর্ত দিয়েছিলেন। উনি কখনও নিজের মেয়েকে এখানে পাঠাবেন না সিউর।প্রশ্ন জাগলো তাহলে স্যার বউ কোথায় পেলেন? আবারও বিয়ে করেছেন নাকি? কথাটা ভেবেই ও চমকে উঠে ঢোক গিলে বলল,

স্যার আপনি এটা কিভাবে করলেন? সুলতান জুবায়ের ফারুকীকে চিনেন? যদি একবার জানে আপনি দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন তবে যুদ্ধ লাগিয়ে দিবেন। উনি কাউকে পরোয়া করেন না। ঝড় হয়ে আসবেন।
পাথর ল্যাপটপ থেকে মুখ তুললো। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। চাপা কন্ঠে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল,
আমি কোন দুঃখে দ্বিতীয় বিয়ে করবো বেলাল? আমার একটাই মাত্র বউ। যাইহোক কহিনুর অসুস্থ আছে। বেলাল তুমি ওদেরকে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। মিটিং আছে আমি একাই সামলে নিবো।

কহিনুরের জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু পাথর ওর সঙ্গে আর দেখা করেনি। ভেবে নিয়েছে মেয়েটার থেকে দূরে থাকবে। কিছুতেই নিজের অভিশাপ ওর উপরে পড়তে দিবে না। সাঈদ এসেছিল ও যায়নি। দরকারি জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে। বেলালকে দিয়ে ওকে পৌঁছে দিতে পারলেই শান্তি। কথাটা ভেবে ও মলিন হাসলো। মানুষ যা চাই তা কখনও পাইনা। আবার যা চাইনা তাই অনাকাঙ্খিতভাবে বারবার পেয়ে যায়।

কহিনুর সাঈদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেঁসে বলল,
ফল খাবে সাঈদ? খুবই সুস্বাদু খেতে পারো। হাড্ডির মতো শক্ত না।
সাঈদ ওর কথার উত্তর দিলো না। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
আমরা আজ ফিরে যাচ্ছি নূর। কতকিছু জানার ছিল। জনাব আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। তফসিল উনার বাড়িতে উঠেছেন। পরিকল্পনার প্রথম ধাপে পৌঁছে গেছেন খান সাহেব।
সাঈদের কথা শুনে কহিনুর হাসলো। চোখ বন্ধ করে বলল,

করতে দাও সাঈদ। কহিনুর কাউকে ছাড়বে না। কাউকে না। চলো যাওয়া যাক?
কহিনুর উত্তরের আশা করলো না। কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসলো। বাইরে পাথর বসে আছে। ও সোজাসাপ্টা গিয়ে বলল,
আপনি সিউর আমাদেরকে আপনার বাড়িতে নিবেন না?
পাথর মুখ তুললো না। নিচু হয়েই শুধুমাত্র হুম বলল। তাতেই কহিনুর রেগে আগুন। সাঈদকে আসতে বলে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি নিজের সুরক্ষা নিজেই করবো।
পাথর রেগে গিয়ে দৌড়ে গেলো ওর পিছু পিছু কিন্তু পেলো না। নিমিষে মিলিয়ে গেছে। বেলাল খানিকটা বুঝতে পারলো কাহিনীটা। মনে হাজারো প্রশ্ন তবে আপাতত মাটি চাপা দিয়ে স্যারের হুকুমের অপেক্ষা করলো।

বহুদিন পর এক নারীর সঙ্গ পেয়ে মহাখুশি আধার। শরীর মনে কহিনুর বিরাজ করলেও এটা থেকে নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখার সাধ্য ওর নেই। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদ হয়ে উঠে। আজ সমুদ্রের তীরে একাকী বসে ছিল হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে ও পিছনে ফিরে তাঁকালো। আকাশে চাঁদ উঠেছে পূর্ণিমা চলছে। জোয়ারের পানি ফেপে উঠেছে। পাশের মেয়েটার শরীরে লাল পেড়ে সাদা রঙের শাড়ি।

আধার বাংলাদেশ থাকতে শাড়ি পরিহিত বহু মেয়ের সঙ্গে রাত্রিকালীন সময় কাটিয়েছে তাই এটা ওর চেনা। কিন্তু জার্মানিতে কোনো অবাঙ্গালী তো ছাড় বাঙ্গালীও তেমন শাড়ি পরে না। খুব সখের বসে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে। তবুও সবাই না। মেয়েটার গা ভর্তি দামি দামি অলঙ্কার চকচক করছে। উপছে পড়া রূপ। লিপস্টিক রাঙা ঠোঁটের নিচে কালো তিল জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আধার খানিকটা বিমোহিত হয়ে গেলো মেয়েটাকে দেখে। ও মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়লো। দুজনের চোখাচোখি হলো। মেয়েটা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে রিনরিনে কণ্ঠে বলে উঠল,

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৩৭

চন্দ্রের উপছে পড়া জোছনা গায়ে মেখে চলোনা প্রিয় হৃদয় বিনিময় করি।
পাথর উত্তর করলো না। মাথা শূন্য। ওর নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে মেয়েটা ওকে জড়িয়ে ধরলো। পাথরের শরীর বেঁয়ে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেলো। আগে কখনও এমন অনুভব হয়নি। চোখ বন্ধ করে ফেলল ঠিক তখনই মেয়েটার ওষ্ঠে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ঠোঁটে ওর তৃপ্তির হাসি। প্রশ্ন মেয়েটা কে আর ওর উদ্দেশ্য কি?মেয়েটার মধ্যে মর/ণের ভয় নেই কেনো?

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৩৯