কাঞ্চাসোনা শেষ পর্ব 

কাঞ্চাসোনা শেষ পর্ব 
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

রাত বাড়ছে মিতু ধ্রুবর কাছে আসে,ধ্রুব পাগলের মতো এখানে সেখানে ফোন দিচ্ছে ডোনারের আশায় কিন্তু সবাই নাকি ব্যস্ত!কই ধ্রুবকে যখন কেউ বলে রক্ত লাগবে তখন তো ধ্রুব সবকিছুর আগে হসপিটালে আসাটাই গুরুত্ব দেয়।এখন তার দরকারের সময় কেউ নেই।এই রক্তের জন্য কিনা তার বউ মারা যাবে?চোখে দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে।মিতু ভাইয়ের অবস্থা দেখে বলে,

“তুই এতো ঘাবড়ে গেলে কিভাবে হবে?সকালের আব্বা আম্মা এসেও কান্নাকাটি করছে কাকে সামলাবো বল?”
ধ্রুব বললো,
“উনাদের কাছে যা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুম কাঁপিয়ে বাচ্চারা কাঁদছে,ওদের যে মাকে চাই,জন্মের পরে যে মায়ের গায়ের গন্ধ পাচ্ছে না।বাচ্চাদের কান্না ধ্রুবর ভালো লাগছে না।দুই হাতে চুল টেনে বিরবির করে,”আল্লাহ আমার সকালকে ভালো করে দাও,বাবুদের উছিলায় ভালো করে দাও।আর কিছুই চাওয়ার নাই।”

ডাক্তার বেড়িয়ে আসে।
ধ্রুব উনার কাছে যায়।ডাক্তার দেখলেই এখন ধ্রুবর ভয় হয় যে এই বুঝি কোন খারাপ সংবাদ দিলো।ডাক্তার বলে,
“প্রেসেন্টের প্রেশার খুবই বেড়ে গেছে,আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি,আপনি একবার আসুন।”

ধ্রুব চুপচাপ যায়।সকালকে কয়েকটা কম্বল দিয়ে চেপে ধরে রাখা হয়েছে।মুরগী জবেহ করলে যেমন লাফায় সকাল ওমন করেই কাঁপছে।মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো।ধ্রুবর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।হাত পা কাঁপে,এগিয়ে যায় প্রিয়তমার দিকে।অথচ সকাল চোখ বন্ধ করে রেখেছে।ধ্রুবর বুকে কি যে যন্ত্রনা হচ্ছে তা বলে বুঝানো সম্ভব না।মনে হচ্ছে কলিজা খুবলে কেউ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।ধ্রুব সকালের একটা হাত চেপে ধরে।তার ঠোঁট কাঁপছে তিরিতির করে।হৃদপিণ্ডের চলাচল বোধহয় বন্ধ হয়ে যাবে।সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো,

“সকাল?”
সকাল চোখ খুলল না কোন উত্তর দিলো না।ধ্রুবর বুকটা ব্যাথায় টনটন করে উঠে।সকালের বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খায়,
“সকাল এই সকাল।বাবুদের দেখবে না?একবার চোখ খুলো বউ।তোমার ধ্রুবকে একবার দেখবে না জানপাখি?”
ধ্রুব বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কাঁদে।সকাল তিরতির করে চোখের পাতা একটু খুলে।ধ্রুব বলে,
“তুমি ঠিক হয়ে যাবে,এইতো আর একটু শুধু।”

সকালের চোখের কোন বেয়ে পানি পরে।
ধ্রুব নিজেকে শক্ত করে বলে,
“টেনশন করো না,আমিতো আছিই।”
ডাক্তার ধ্রুবকে বেরিয়ে যেতে বলে।সকালের চোখের কোন বেয়ে শুধু পানি পড়ে।ধ্রুব বের হতে ইচ্ছে করেনা।আর যদি চোখ খোলা না পায়।
ডাক্তার ধ্রুবর কাধে হাত রেখে বললো,

“রক্তের ব্যবস্থা করুন।রক্ত দিলে কিছুটা আশা রাখা যায়।”
ডাক্তারের কথার ধরনে ধ্রুব যা বুঝার বুঝে নিলো।এই মূহুর্তে তার কোন বুদ্ধি মাথায় আসছে না।কেমন ফাকা ফাকা লাগছে।বারবার সকালের থরথর করে কাঁপা দেহটা চোখে ভাসছে।চোখের সামনে প্রান পাখি এভাবে উড়ে যাবে মানা যাচ্ছে না।
ভার্সিটির প্রফেসর সালাম শিকদার এক্সিডেন্ট করেছে,উনার ব্লাড গ্রুপ এ বি নেগেটিভ।প্রায় সাত আটজনের একটা গ্রুপ এসেছে সবার রক্ত এ বি নেগেটিভ।ধ্রুব এতোক্ষণ তাদের কথা শুনছিলো,তারপর উঠে ছেলেদের দলের কাছে যায়,

“ভাই একটা কথা বলি?”
লম্বামতো একটা ছেলে এগিয়ে আসে।
“বলেন ভাইয়া।”
ধ্রুব বললো,
“আপনাদের কি এ বি নেগেটিভ রক্ত?”
“জ্বী”
“ভাই তিন ব্যাগ রক্ত দিতে পারবেন?আপনারা তো অনেকজন।”
ধ্রুবর ঘাবড়ানো চেহারা কারোরই নজর এড়ায় না।ছেলেটা ধ্রুবকে বলে,
“কখন লাগবে?”

ধ্রুবর মুখে আশার আলো ফুটে। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“এখনি আমার ওয়াইফের অবস্থা খুব খারাপ।একটু তাড়াতাড়ি চলেন।”
অবশেষে রক্তের যোগার হয় ।সকালের খিচুনি বন্ধ হয়েছে,রক্ত দেয়ার পরে কিছুটা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে।কেবিনে শিফট করার পর থেকে ধ্রুব হাত ধরে বসে আছে।সকাল সারা রাত অজ্ঞানের মতো পড়ে থাকে।সকাল সাতটার দিলে ঘুম থেকে জেগে দেখে ধ্রুব তার হাত ধরে বসে আছে।

সকাল মুচকি হাসে।সকালের হাসি দেখে ধ্রুব কেঁদে দেয়,এইতো তার পাখি হাসছে!এই হাসিটা দেখেই ধ্রুবর বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেলো।সকাল দুর্বল হাতে ধ্রুবর মুখটা ছোঁয়ে দেয়।
ধ্রুব মাথাটা কাছে এনে বললো,
“সকাল এখন ভালো লাগছে?”
সকাল খুব আস্তে করে বললো,”বাবুরা কই?কান্না শুনিনা কেন?”
প্রেশেন্টের ঘুম প্রয়োজন বিধায়,সকালকে আলাদা কেবিনে রাখা হয়েছে।বাচ্চাদের কান্নায় সমস্যা হবে।

“বাবুরা পাশের কেবিনে।”
খুশীতে সকালের চোখ চিকচিক করে,
“কার মতো দেখতে হয়েছে?”
ধ্রুব সকালের দিকে তাকিয়ে থাকে সব কষ্ট ভুলে হাসিমুখে বেবীদের কথা জানতে চাইছে।সে মাথায় হাত ভুলিয়ে বলে,
“জানি না।আমি তো এখনো দেখিনি।”

সকাল অবাক হয়ে বললো,
“কেন দেখেননি?”
“তোমার সাথে দেখবো যে এইজন্য।”
সকাল ঠোঁট উলটে কাঁদে।এই ধ্রুবটা এতো ভালো কেন?এতো যত্ন নেয় কেন?এতো কেনোর উত্তর সকালের এখন জানা নেই।
“কেঁদো না সেলাইয়ে সমস্যা হবে।”

“বাবুদের আনেন আমি দেখবো।”
ধ্রুব ছুটে গেলো।তারও যে দেখা হয়নি চড়ুইপাখিদের চেহারা।তারপর
দু’জনে অবাক হয়ে ছোট ছোট চড়ুইপাখিদের দেখলো।ছোট ছোট হাত পা নেড়ে খেলছে।ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওদের ফর্মুলা মিল্ক দেয়া হয়েছে।
সকাল নিঃশ্বব্দে কাঁদে।নড়তে পারছেনা বলে চুমুও খেতে পারছেন।ধ্রুবকে বললো,
“ওদের একটু কাত করে ধরেন তো একটা চুমু খাই।”

ধ্রুব হেসে সকালের ইচ্ছা পুরুন করে।সারাদিন সকাল নড়তে পারলো না।এরপরের দিন ডাক্তার বললেন হাটাচলা করতে হবে।সকালকে উঠাতে নিলেই কেঁদে দেয়।মনে হচ্ছে ব্যাথায় মরে যাবে।অনেক কষ্টে দাঁড়িয়েছে,পা দিয়ে নেমে যায় রক্তের স্রোত।সকালের মা পায়ের রক্ত মুছে দেয়।ধ্রুব মনে মনে ভাবে আর কখনোই বাচ্চা টাচ্চার নামও মুখে নিবো না।ধ্রুব সকালকে ধরে ধরে হাটায়।হাটতে কি কষ্ট এটা একমাত্র সিজারিয়ান মানুষেরাই জানে।ধ্রুব সকালের কষ্ট দেখে বললো,

“আর হাটতে হবেনা শুয়ে পড়ো।”
সকাল এমন অবস্থায়ও হাসে।সুখের হাসি।
সাতদিন পরে সকালকে বাসায় আনা হয় এই সাতদিন,ধ্রুব এক মূহুর্তের জন্যও সকালের থেকে দূরে যায়নি।এখন সারাবাসা বাচ্চাদের কান্নাকাটিতেই হইহই করে।
ধ্রুব বাসায় এসে সকালকে জড়িয়ে ধরে।কোন কথা বলেনা।সকালই বললো,

“কি হলো?”
“আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম জান।”.
“আমাকে আইসিইউ তে নেয়ার পরে আপনি নাকি খুব কেঁদেছিলেন?”
“তোমকে কে বললো?”
“সব নার্সরাই বলছিলো,আমার ভাগ্য খুবই ভালো।”
ধ্রুব কিছু বলেনা বুকের মাঝে নিয়ে রাখে তার পাখিটাকে,যেন ছাড়লেই হারিয়ে যাবে।
সকালই আবার বলে,

“আপনার ভালোবাসা আমাকে মরতে দিলো না।”
“আল্লাহর সু নজর ছিলো যে তাই।”
সকাল ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বলে,
“ভালোবাসি খুব।”
ধ্রুব গালে অনেকগুলো চুমু দিয়ে বললো,
“তোমাকে এখন আরো বেশী আদর আদর লাগে সোনা।”

বাচ্চাদের নাম রাখা হয়,সানভি মির্জা,আর দিবা মির্জা।সকাল দুই হাতে দুটো ছানাকে কোলে নেয়।ধ্রুব অপলক দেখে।সুখে তার ভেতরটা কেঁপে উঠছে।সকালের কপালে চুমু খেয়ে বাবুদেরও চুমু খায়।সকাল আসলেই তার খাটিসোনা,মনের খোরাক,অন্তরের তৃপ্তি।ফিসফিস করে বলে,
❝দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঞ্চাসোনা ❞আমার কাঞ্চাসোনা তুমি সকাল”
সকাল দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,

“উহু আপনি আমার কাঞ্চাসোনা।আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাওয়া।”
তখনি বাচ্চারা তাদের স্বরে কেঁদে উঠে,ধ্রুব মাথা নেড়ে অসহায় চোখে তাকায়,সকাল হেসে ফেলে।
ধ্রুব দুই বাবুকেই তার মায়ের কাছে দিয়ে আসে।রুমে ফিরে এসে সকালকে বুকে নিয়ে শুয়ে বলে,
“কতোদিন বউয়ের ভাগ পাইনা।পিচ্ছি বউ ছাড়া কি থাকা যায়?”
সকাল মাথা তুলে তার মিষ্টি হাজবেন্ডকে দেখে।দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে ভিজা ঠোঁটের স্পর্শ নেয়।ধ্রুব বিরবির করে বললো,

“তোমাক খুব ধন্যবাদ সকাল আমার জীবনটা এভাবে পূর্ণতায় ভরিয়ে দেয়ার জন্য।”
সকাল তখনও কেঁদে দেয়।ধ্রুব বলে,
“এখন কাঁদো কেন?”
“সুখে”

ধ্রুব থামায় না।কাঁদুক না একটু সুখে,দোষ কি তাতে?
সকাল মনে মনে বলে,”আল্লাহ তোমার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আমার জীবনে ধ্রুবকে স্বামী হিসেবে দেয়ার জন্য।”
ভালোবাসারা ভালো থাকুক।সুখে সুখে কেঁদে দিক সকাল।আবেশে রাঙ্গিয়ে দিক ধ্রুব।নজর না লাগুক, নজর না লাগুক, নজর না লাগুক।

কাঞ্চাসোনা পর্ব ১৪