কুসুম কাঁটা পর্ব ৩১

কুসুম কাঁটা পর্ব ৩১
সাবিকুন নাহার নিপা

রাফাত কে ভীষণ নার্ভাস দেখালো। এতো সকালে ও কি কারনে এখানে এসেছে সেটাও বলে নি৷ চোখ লাল, বোধহয় রাতে ঘুমায় নি। আকাশী আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার শরীর খারাপ? ”
“হ্যাঁ। সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাওয়া দরকার। ”
“সাইকিয়াট্রিস্ট? ”
“না মানে আজ ডেট আছে। যেতেও পারি, নাও যেতে পারি৷ ”
“কেন? আপনি অনিয়ম কেন করছেন?”

রাফাত ঠিক করে গুছিয়ে কথাগুলো বলতে পারছে না। আকাশী ভদ্র মেয়ে, ও যদি রাফাত কে রিজেক্টও করে তাহলে ভদ্রভাবে করবে। ভয়ের কিছু নেই৷ কিন্তু সমস্যা হলো ও তো রিজেকশন চাইছে না। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের জন্য গোটা একটা রাত নির্ঘুম কেটেছে। আকাশী সেনসিটিভ মেয়ে বোধহয়। ও যদি বলে এরমধ্যে কী করে ওর প্রেমে পড়লো! সেটার জন্য একটা ঠিকঠাক জবাব রেডি করে রাখতে হবে। এখন মনে হচ্ছে এই ব্যাপার টা নিয়ে আরেকটু হোমওয়ার্ক করা উচিত ছিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আকাশী ভাবনায় মগ্ন রাফাত কে দেখে চিন্তিত হলো। বেচারার উপর থেকে যে ধকল গেছে! আকাশী রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে রাফাতের কপালে হাত রাখলো। রাফাত চমকে উঠলো। রাফাত কে চমকে উঠতে দেখে আকাশী ভরকে গেল। বলল,
“আপনাকে দেখে অস্বাভাবিক লাগছিল, তাই দেখলাম জ্বর আছে কী না!”
রাফাত বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। আকাশী বলল,
“আপনি একজন ডাক্তার দেখান তো। রুটিন চেকাপ গুলো করে নিন। ”
রাফাত কাতর গলায় বলল,

“ডাক্তারের কাছে একা যাওয়া যায় না? তুমিও চলো। ”
আকাশী হেসে ফেলল। বলল,
“আপনি কোথাও গিয়ে ঘুরে আসুন।”
রাফাত এবারও বলল,
“তুমিও চলো।”
আকাশী স্বাভাবিক গলায় বলল,
“আমি যেতে পারব না। আমার অনেক কাজ, অনেক কাজ হাতে নিয়েছি। সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে। ”
রাফাত মূর্তির মতো বলল,

“আচ্ছা।”
“এখন যাই?”
“কোথায় যাবে?”
“রঙতুলিতে যাব। রঙ্গনা আপুকে কিছু ডিজাইন দেখাব। আপনি ডাক্তার দেখান।”
রাফাত যন্ত্রের মতো জবাব দিলো,
“আচ্ছা।”
আকাশী কিছুদূর গিয়ে ফিরে এসে বলল,
“আপনি সকালে কিছু খান নি তাই না?”

এই একটা প্রশ্নেই রাফাতের মন টা ভালো হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আজকে দিন টাও ওর ভালো যাবে।
রেস্টুরেন্টে ভরপেট খেয়ে রাফাত রঙ্গনাকে ফোন করলো। রঙ্গনা ফোনের কাছে নেই। মিশুক ফোন টা দিতে গেল। রঙ্গনা রাফাত কে বলল,

“কী ব্যাপার? ”
“তোমার রিসিপশন কবে?”
“আগামী মাসের ১২ তারিখ। কেন?”
“এমনি। ”
“এটা জানার জন্য ফোন করেছ?”
“না। ”
“তাহলে? ”
“আমার আসলে নার্ভাস লাগছে। ”

“লাগতেই পারে, স্বাভাবিক। তোমাকে দেখে মনে হয় না।”
“আসলে আমিও নিজেকে দেখে চিনতে পারছি না।”
“ইটস ওকে। এরকম হয়। হতে পারে তোমার ফ্যামিলির ওই ঝামেলার পর কনফিডেন্স লেভেল জিরোতে নেমে গেছে। ”

“আচ্ছা আকাশীর আমাকে রিজেক্ট করার সম্ভাবনা কতটুকু? ”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট। ”
রাফাত আতঙ্কিত গলায় বলল,
“কি!?”
“হ্যাঁ। ”
“কেন?”
“অবশ্যই তোমার খ*বিশ পরিবার। আমার ধারণা তুমি দুই, চার দশ বছরে বিয়ের জন্য মেয়ে পাবে না। ”
“কী বলছ এসব! রাগ ঝাড়ছো?”
“না এটা সত্যি। ”
রাফাত কথা শেষ না করে ফোন কেটে দিলো। রঙ্গনার কথাগুলো খটোমটো হলেও ঠিক। লজিক আছে, এড়ানো যায় না।

মিশুক অফিসে যাবে। রঙ্গনার মোবাইলে রাফাতের নাম টা স্ক্রিনে দেখেও কোনো প্রশ্ন করলো না। রঙ্গনা নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কী আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছ?”
“কোন ব্যাপারে?”
রঙ্গনা চোখ নাচিয়ে বলল,
“যেকোনো ব্যাপারে? ”
“না তো।”
“আমার ফোন কল নিয়েও কিছু না?”
মিশুক হেসে ফেলল। বলল,
“না। ”
“শিওর?”

মিশুক দুই পা এগিয়ে কাছে এলো। রঙ্গনার কানের পাশের চুল সরিয়ে বলল,
“যার বউ এতোটা স্মার্ট আর বোল্ড, তার হাজবেন্ড কেও খানিকটা ওরকম হতে হয়। ”
রঙ্গনা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করলো, আচ্ছা!?
মিশুকও চোখের ইশারায় জবাব দিলো।

স্বপ্নীলের অফিসে কাজে মন বসছে না। দুপুরে ব্রেক নিয়ে বাসায় চলে যাবে ভাবছে। এই অফিসে ও একদিনও ছুটি নেয় নি এখনো পর্যন্ত, কারণ এমনিতেই ও’কে দেখে সবাই ভাবতো কাজ পারবে না। ছুটি নিলে মান, সম্মান যাবে এমন একটা ব্যাপার হবে ভেবে কখনো ছুটি নেবার কথা ভাবে নি।

স্বপ্নীলের নিজের একটা ডেস্ক আছে। ডেস্কটা সুন্দর করে গুছিয়েছে। ওর এই গোছানো স্বভাব টা বুবুর থেকে পাওয়া। বুবুও সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে। অগোছালো কিছু তার পছন্দ না, তবে স্বপ্নীল কে সেটা কখনো বলতো না।
স্বপ্নীল ডেস্কের একপাশে গুছিয়ে নিজের জিনিসপত্র রাখলো। লাঞ্চবক্স, মোবাইল, চার্জার, পানির বোতল, ওয়ালেট ডায়েরি এসব। সেইসব জিনিসের সঙ্গে যুক্ত হলো শ্রাবণ্যর একটা ছবি। এই ছবিটা ঝাপসা, স্পষ্ট না। তবুও ছবিটা ওর পছন্দ কারণ ও ছবি টা তুলেছে। অফিসে থাকাকালীন অসংখ্য বার এই ছবিটা দেখবে।
দিতি আপা ফটোফ্রেম টা দেখে বলল,

“স্বপ্নীল ভাই একটা কথা বলি, তুমি কিন্তু মিয়া নায়িকা বিয়ে করছ। যেমনি স্মার্ট, তেমনি সুন্দর। ”
স্বপ্নীল আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। শ্রাবণ্যকে কেউ ভালো বললে তাকে ওর আপন মানুষ লাগে। খারাপ বললে তাকে ভালো লাগে না। এমন ব্যাপার আগে মায়ের ক্ষেত্রে হতো। ওদের কিছু আত্মীয় আছে যারা মা’কে তেমন পছন্দ করতো না। তারা স্বপ্নীল কে যতই ভালোবাসুক, স্বপ্নীল তাদের পছন্দ করতো না। ওদের এক চাচা আছেন মিজান। মিজান আঙ্কেল বলে ডাকেন। সেই মিজান আঙ্কেল কী কারণে যেন একবার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করলেন। স্বপ্নীলের মনে নেই। স্বপ্নীল যখন এইচএসসি তে ভালো রেজাল্ট করলো তখন মিজান আঙ্কেল একটা ঘড়ি পাঠালেন। স্মার্ট ওয়াচ তখন মার্কেটে অল্প কিছু সৌখিন মানুষজন ব্যবহার করে। স্বপ্নীল সেই দামী উপহার ফিরিয়ে দিলো। সবাই ভীষণ অবাক!

স্বপ্নীল অফিস ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে গেল। বহুবছর পর এমন ঘটনা ঘটলো। শিলা স্বপ্নীল কে দেখে ভীষণ খুশি হলো। জিজ্ঞেস করলো,
“বাবু তুই? কোনো সমস্যা নেই তো?”
স্বপ্নীল মিষ্টি করে হেসে বলল,
“এমনিই মা। আজ তোমার সঙ্গে বাসায় যাব।”
শিলার বহুদিন পর আনন্দে চোখে পানি এসে গেল। মাঝেমধ্যে তার ভীষণ স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে, তুই এমন ই থাক বাবু। তোর একটুও চেঞ্জ হবার দরকার নাই। তুই একটুও বদলাস না। তুই আমার সহজ সরল স্বপ্নীল ই থাকিস।

রঙ্গনা আজ মিমি আপুর বাসায় গেল। দুলাভাই এখন অনেক সুস্থ। মিমি আপু রঙ্গনাকে খুব পছন্দ করেন। রঙ্গনার শ্বশুর, শাশুড়ী এরাও। মিশুকের কাছের, দূরের সব আত্মীয় স্বজনরা রঙ্গনাকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির। যারা ও’কে দেখেন নি। এতে শ্বশুর শাশুড়ীর ক্রেডিট অনেকখানি। তারা স্পেশাল ফিল করাচ্ছে।
মিমি আপু রঙ্গনাকে বলল,

“এই রঙ্গনা তোমাকে এতো শাড়ি পরতে হবে না। তোমার যা ভালো লাগে তাই পরবা। ওয়েস্টার্নে কম্ফোর্ট ফিল করলে ওয়েস্টার্ন পরবা। কে কী ভাবছে সেটা নিয়ে ভাববে না।”
রঙ্গনা হাসলো। এই হাসির আড়ালে ওর আরও একবার মনে পড়ে গেল এক ধুরন্ধর ফ্যামিলির কথা৷

রাফাত বসে আছে রাস্তায়। আকাশী আসবে। এখন ঘড়িতে বাজে এগারো টা বেজে তেইশ মিনিট। আকাশী আসছে। পরনে সাধারণ সালোয়ার কামিজ। গরমে চুল একত্র করে উপরে উঠিয়ে বাঁধা৷ রাফাত হঠাৎ খেয়াল করলো এই মেয়েটা দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। দ্যাট মিনস রোগা হচ্ছে৷
আকাশী ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল,

“এতো রাতে? কী যেন বলবেন বলছিলেন? ”
“আমার বাসায় একা থাকতে ইচ্ছে করলো না।”
আকাশী এক পাশে বসলো। ঢাকা শহরে রাত এগারো টা বেশী কিছু না। এখনো কত রিকশা, গাড়ি, মানুষ ছুটছে। ব্যস্ত শহরে সবাই ব্যস্ত।
আকাশী বলল,
“আমি বেশীক্ষন বসতে পারব না। বারোটার মধ্যে গেট অফ হবে। ”
“আচ্ছা।”
“আপনার কী মন খারাপ? ”
“বুঝতে পারছি না।”

“একটা কথা বলি, আপনি বাড়ি ফিরে যান। আপনার একা ভালো লাগছে না, বাড়িতে গেলে ভালো লাগবে। ”
রাফাত হেসে বলল,
“বাড়ির মানুষের সঙ্গে আমার নীতির মিল নেই আকাশী। আমি যেমন করে জীবন কে ভাবি ওরা তেমন ভাবে না। আমার মামা পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ে চাকরি করে, তার কেমন স্যালারি হতে পারে! আশুলিয়ায় প্লট কিনেছে, আবাসিকে ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছে। মার্সিডিজ গাড়ি, ডায়মন্ড জুয়েলারি। এসব কোত্থেকে আসে আমি জানি, বাকীরাও জানে। তবুও তারা এই জিনিস টা বড় চোখে দেখে। ধনবান আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য মরিয়া হয়ে যায় সবাই। ”
আকাশী গভীর মনোযোগে কথাগুলো শোনে। স্মিত হেসে বলে,

“আপনি একজন অন্যরকম মানুষ। ”
“অন্যরকম তো তুমি। আমি সাধারণ ই।”
“আমিও সাধারণ। তবে সাধারণ থাকতে চাই না। অসাধারণ হতে চাই।”
“কেমন অসাধারণ হতে চাও?”
“আমি অনেক বড়লোক হতে চাই। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী দেশগুলো তে ঘুরে বেড়াতে চাই। অনেক অনেক টাকা ইনকাম করতে চাই।”
রাফাত হেসে ফেলে বলল,

“টাকা ইনকামের সঙ্গে অসাধারণ হবার কী কোনো সম্পর্ক আছে?”
“আছে। আমি জীবনের লাস্ট তিনটে বছরে শিখেছি জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টাকা। টাকা থাকলে আপনার সব আছে। ডিপ্রেশন, এংজাইটি এসবের জন্য আপনার সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যেতে হলেও কিন্তু টাকা লাগবে৷ যদি অসুখে পড়েন, ভালো ট্রিটমেন্টের জন্যও টাকা লাগবে৷ আপনার মন খারাপ হলে কোথাও থেকে ঘুরে আসার জন্য টাকা লাগবে। ”

রাফাত তাকিয়ে রইলো আকাশীর দিকে। হেসে বলল,
“তুমি সাধারণ মেয়ে না। কী সুন্দর গুছিয়ে ব্যবসা করছ, এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছ। খুচরো পয়সা গুলোও সযত্নে জমিয়ে রাখছ। পড়াশোনা, বিজনেস, টিউশনি সব একসঙ্গে সামলাচ্ছ! তুমি কী করে সাধারণ হও? তুমি তো অসাধারণ ই। ”

আকাশী গভীর চোখে তাকিয়ে রইলো। রাফাত এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল,
“তুমি যে পৃথিবী দেখছ, সেই পৃথিবীর বাইরে আরও একটা পৃথিবী আছে। মুদ্রার এপিঠ, ওপিঠ দুই পিঠ ই আছে। দুর্ভাগ্য তো সেই হতভাগা হা*রামজাদার। যে তোমার কদর বুঝলো না।”

কুসুম কাঁটা পর্ব ৩০

আকাশীর গভীর চোখে জল টলমল করছে। বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে পড়ার আগে রাফাত ওর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো ওর কপালে।
সকাল হতে আর কিছুক্ষন বাকী! মসজিদের মাইকে আজান হচ্ছে। আকাশী চমকে উঠলো। এতক্ষন! মনে হলো মিনিট দশেক আগে ও বেরিয়ে এসেছে!

কুসুম কাঁটা পর্ব ৩২