অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১৩

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১৩
Mousumi Akter

” আসসালামু আলাইকুম শ্রদ্ধেয় ভাবি।
প্রথমেই আমার সালাম নিবেন। আমার সালাম আপনার পায়ে। জানি এমন সম্মানসূচক ভাষায় চিঠি পেয়ে কিছুটা অবাক হবেন। অবাক হওয়ার ই কথা কারণ এই প্রথমবার আমি আপনার সাথে এভাবে কথা বলছি। বিশ্বাস করুন ভাবি আমি গতরাত থেকে ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছি যে প্রভাত ভাই আমার বড় ভাই।

আমার বড় ভাই যাকে বিয়ে করতে চলেছে সে আমার বড় ভাবি।বড় ভাই এর বউ অনেক সম্মানের পাত্রী হয়।আমার একদম উচিৎ নয় আপনার দিকে অন্য কোনো নজর দেওয়া। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী আর পাপী মনে হচ্ছে।আজ থেকে আমি আপনার দেবর। আপন দেবর। আগে পরে যা ঘটে গিয়েছে সে বিষয় এ আমি ক্ষমাপ্রার্থী। অতীতের সব আমি আজ থেকে মন থেকে মুছে দিয়েছি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি ওয়াদা করছি আর কোনদিন কু-দৃষ্টি দিবনা আপনার দিকে ভাবি।আর কোনদিন যদি আমি আপনাকে প্রেম ভালবাসা বিষয়ক কিছু বলি আপনার জুতা আমার মুখে মা’র’বে’ন। প্রয়োজনে প্রভাত ভাই-এর জু’তা ও আমার মুখে মা’ র’ বে’ন।জুতা মে’ রে আমাকে উলঙ্গ করে গায়ে কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিবেন ভাবি।আমার চিঠিটা পেয়ে আপনি খুশি কীনা তা জানালে আমি ধন্য হবো।আশা করি আমাকে উত্তর টা জানাবেন ভাবি।
—————— ইতি আপনার দেবর সজল।

পূর্ণতা চিঠিটা পড়ে খুব জোরে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।গতকালের সমস্ত মন খারাপ উধাও হয়ে গেল।হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার।পুষ্পের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“এই আপু ওঠো প্লিজ! আমি ম’ রে গেলাম হাসতে হাসতে।”
পূর্ণতার হাসির শব্দে ঘুম ভাঙল পুষ্পের।বড় বড় চোখে পূর্ণতার দিকে তাকাল।সারারাত চেষ্টা করেও যার মন ভাল করতে পারেনি ঘুম থেকে উঠেই এত হাসছে কেন? হঠাৎ এত হাসির মত কি কান্ড ঘটল।পুষ্প দু’চোখ ডলে ডাগর চোখে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল,

” কিরে পূর্ণ সকাল সকাল কি স্বপ্ন দেখে হাসছিস।”
পূর্ণতা হাসি আটকাতে পারছে না।হাসির মাঝে কথা বলার চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না।পুষ্পের দিকে চিঠি এগিয়ে দিল।
পুষ্প কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করল,
“কিরে কার চিঠি।”
পূর্ণতা হাসতে হাসতে কোনো কথা বলতে পারছেনা।

পুষ্পের কৌতুহল আরো কয়েকগুন বেড়ে গেল।বিছানা ছেড়ে এক লাফ দিয়ে উঠে এসে পূর্ণতার হাত থেকে চিঠি নিয়ে পড়তে শুরু করল।কেবল দু’লাইন পড়েছে এমন সময় জমেলা কটমট করতে করতে ওদের রুমে প্রবেশ করল।জমেলা দু’দিন ধরে পূর্ণতার সাথে কথা বলেনা।পূর্ণতা জমেলাকে দেখে মুখ বন্ধ করে দিল।থমথমে হয়ে এল মুখের অবয়ব।
পুষ্প জমেলাকে দেখে বলল,

“কি হয়েছে দাদী?”
জমেটা খিটমিট মেজাজে বলল,
“এমন অত্যাচার সহ্য না করে আমার জন্য বৃদ্ধাশ্রম -ই ভাল ছিল।”
পুষ্পর হাসি পাচ্ছে।গাল টিপে হেসে আড়চোখে পূর্ণতার দিকে তাকাল।কিন্তু পূর্ণতার থমথমে মুখের অদলের কোনো পরিবর্তন হলনা।পূর্ণতা পুষ্পের মত সরল মনের শান্ত মেয়ে না।কেউ কিছু বললে সাথে সাথে ভুলে গিয়ে তার সাথে মিশতে পারেনা সহযে।মনের মাঝে রাগ,জেদ দীর্ঘ সময় স্থায়ী থাকে।
জমেলার নাকে কাপড়।সে নাকে কাপড় দিয়ে বলল,

“দেখছিস না কীসের বাজে গন্ধ। আমার রুমে যেন বেশী।এমন থাকলে আমি এই বয়সে ম’রে যাব।”
পুষ্প বলল,
“এমন বয়স মানে? কী এমন বয়স হয়েছে তোমার?”
জমেলা পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাও তোর বোন আমাকে বুড়ি বুড়ি করে।তোদের মত বাপের ঘরে থেকে আমি বুড়ি হইনি।আমি সাবালক হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছিলো।”
পূর্ণতার শরীর আবার জ্বলে উঠল।চোখ দু’টো জ্বলে উঠল রাগে।পুষ্প পূর্ণতাকে চোখের ইশারায় থামতে বলল।জমেলাকে বলল,

“কিছু হয়েছে দাদী? কিছু বলতে এসেছো?”
” তোদের নিচে ডাকছে।এখনি যা।সবাই মিলে বাগানে গিয়ে খুজে দেখ কোথায় কি মরেছে।”
“তুমি যাও আমরা আসছি।”
“না,আমার সাথে চল দু’জন।এখনি চল।”
“আচ্ছা চলো।”
জমেলার পিছ পিছ পুষ্প আর পূর্ণ দু’জনে হাঁটছে।পূর্ণতা পুষ্পের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে চিঠিটা হাতের মাঝে দলাবদ্ধ করল।
পুষ্প ফিঁসফিঁস করে বলল,

“আমাকে কিন্তু পরে দিবি পড়তে।”
পূর্ণতাও ফিঁসফিঁস কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা দিব।”
“এখন তো বল কে তোকে ভাবি ডেকেছে।”
“পরে বলছি আপু।তুমি বেঁহুশ হয়ে যাবা।”
“না শুনলে ভাল লাগছে না।”

“মজা ফুরিয়ে যাবে এখন শুনলে।আর প্রচুর হাসিও পাবে।এখানে হাসির মত পর্যাপ্ত জায়গা ও নেই।”
বাগানে প্রবেশ করতেই সজলের সাথে দেখা পুষ্প আর পূর্ণতার।সজল লজ্জা রাঙা মুখে পূর্ণতার দিকে তাকাল।লজ্জায় পূর্ণতার দিকে তাকাতে পারছে না।সজল নিশ্চিত পূর্ণতা তার চিঠি পড়েছে।চিঠি পড়ে নিশ্চয়ই সে উত্তর জানাবে।সজল মনে মনে ভীষণ এক্সসাইটেড।সজলকে দেখে পূর্ণতার চিঠির কথা মনে পড়ল।পুষ্পের হাত শক্তভাবে চেপে ধরে পূর্ণতা ও হেসে দিল।পূর্ণতার ভীষণ হাসি পেল।এই বাগানে গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছা করছে পূর্ণতার।পুষ্প জানে সজল পূর্ণকে পছন্দ করে।এই হাসির কারণ বুঝতে সময় লাগল না। কিন্তু পূর্ণতার হাসির কারণ পুষ্পের বোধগম্য হলনা।এমন সময় এস আই রাজন পুষ্পদের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এক্সকিউজ মি! আপনারা তিনজন এদিকে আসুন।”
রাজনের সাথে দাঁড়িয়ে আছে চারজন পুলিশ কনস্টেবল আর ওয়াসেল চৌধুরী সাথে চৌধুরী বাড়িতে কর্মরত সবাই।চৌধুরী বাড়ির বিশাল বড় বাগান।বাড়ির সবাই আজ সাত-সকালে বাগানে।চারদিক দিয়ে শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দ হচ্ছে।রাজনের পরণে ব্লু জিন্স আর অফ হোয়াইট শার্ট।শ্যামবর্ণ শরীর। তবে মুখের ফেস অধিক আকর্ষনীয়।চোখে কেমন কাজল পড়ার মত।চেহারায় মেয়েদের মত মায়াবী মায়াবী একটা চাহনি।পুষ্প রাজনের দিকে চকিতে চাইল।

পুষ্পের পরণে সম্পূর্ণ লাল রঙের একটা সুতি থ্রি পিস।বেশ লম্বা চুল।গোলগাল ফর্সা মুখশ্রী।একটা গেজ দাঁত ও আছে।গতকাল ই রাজনের হৃদয় রাজ্য অদ্ভুত এক অনুভূতি দোলা দিয়েছিল।আজ ও ঠিক তাই হল।ভাল লাগার শীতল এক হাওয়া বয়ে গেল।কাউকে ভাল লাগলে অজান্তেই নিঃশব্দে হাসি ফুটে ওষ্টদ্বয়ে,না চাইতেও তার দিকে চোখ চলে যায়।রাজনের ও তাই হল।পাশে প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ওয়াসেল চৌধুরী।তার সামনে একটু উল্টো পাল্টা করলেই ধরা পড়ে যেতে হবে।রাজনও পুলিশের এস আই।সেও বুদ্ধিতে কম যায়না। একবার তাকিয়েই দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরাল।ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটল।সেই হাসি থামিয়ে কাজে সিরিয়াস হওয়ার ভান করে বলল,

“একেকজন একেকদিক যান।তাহলে খুজে পেতে সুবিধা হবে।”
ওয়াসেল সজলের দিকে তাকিয়ে বলল, “পুকুরের দিকে যাও তুমি।”
রাজন বাকিদের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিল।পুষ্পকে আমবাগানের দিকে যেতে বলল।পুষ্প আমবাগানের দিকে গেল।সব শেষে পূর্ণতাকে বলল,

“আপনি গেস্ট হাউজের দিকে যান।”
গেস্ট হাউজের কথা শুনেই পূর্ণতার চোখ কপালে উঠল।প্রভাত তো আজ গেস্ট হাউজেই আছে।এখনি হয়ত উঠে যাবে।তার সাথে দেখা হলেই উল্টা-পাল্টা বলবে।আবার ঘরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে কাল রাতের মত শুরু করতে পারে।পূর্ণতাকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাজন বলল,
“কি হল?”
পূর্ণতা থমথমে মুখে বলল,

“দেখুন আমি পুষ্প আপুর দিকে যাচ্ছি,ওদিকে যেতে পারব না।”
রাজন বিনয়ের সুরে বলল,
“দেখুন সবাই একদিকে গেলে হবেনা।আপনাদের বাগান বাড়ি অনেক বড়।আপনি প্লিজ ওদিকেই যান।”
ওয়াসেল বলল,
“পুলিশ অফিসার যখন বলছে ওদিকেই যাও পূর্ণতা।”

পূর্ণতা উপায় না পেয়ে গেস্ট হাউজের দিকে গেল।বুকের মাঝে কেমন ঢিপ ঢিপ শব্দ হচ্ছে।প্রভাত উঠলেই সে একটা ঝামেলায় পড়বেই।তাকে দেখেই প্রভাত কিছু না কিছু বলবেই।
রাজন আর ওয়াসেল দু’জনে হাঁটছে।হাঁটতে হাঁটতে ওয়াসেল-কে বলল,
“আপনার কি মনে হচ্ছে কীসের এমন বিশ্রী গন্ধ ছড়াচ্ছে?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না।চারদিকে শত্রুর অভাব নেই।কেউ আবার কোনো কেসে ফাঁসাতে চলেছে কীনা বোঝার উপায় নেই।”

ওয়াসেল রাজনের সামনে সাভাবিক ভাবে উত্তর দিলেও ভেতরে ভেতরে তার রাগ হচ্ছে।পুলিশ মানেই বিশাল ঝামেলা।সামান্য দোষ ত্রুটি পেলেই মিডিয়ার সামনএ তুলে ধরবে।ওয়াসেল সারাজীবন পরিবার আর কাজ আলাদা জায়গা রেখেছে।তার পারিবারিক বিষয় বাইরে যাক এটা সে কখনোই পছন্দ করেনা।নিজের ঘরের ঘটনা নিজেই মিমাংসা করতে পছন্দ করে এই প্রথমবার তার বাড়িতে পুলিশ।রাজন বুঝতে পারল ওয়াসেল বিরক্ত।প্রভাত রাজনের বন্ধু।প্রভাত ওয়াসেল এর ব্যাপারে টুকটাক ধারণা দিয়েছে তার বাবা বাড়িতে পুলিশ আনা পছন্দ করেনা।রাজন তাও মিষ্টি হেসে পরবর্তী প্রশ্ন করল,

“আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কিন্তু।”
“চিন্তার ই বিষয়। এই গন্ধ টা কোথা থেকে ছড়াচ্ছে।কোনো জীব জন্তু হয় যেন।”
“আপনার এলাকায় আপনার কিন্তু দারুণ প্রশংসা।পারলে জীব জন্তুরাও প্রশংসা করত।আমার ও খুব শ্রদ্ধাবোধ আপনার প্রতি।মানুষ ক্ষমতা গরীব-দুঃখীদের কথা ভুলে যায়।অথচ আপনি নিজের বাবা-দাদার সব সম্পত্তি পর্যন্ত মানুষের উন্নয়নে বিলিয়ে দিয়েছেন।এত ভাল মানুষ আজকালকার যুগে যাওয়া যায়না।”

“সারাজীবন তো বেঁচে থাকব না।মানুষের কল্যানে যা করে যেতে পারি।”
“আপনার বাড়ির কাজের লোক এভাবে হুট করে গায়েব হল, আপনার প্রতিক্রিয়া টা কী? ”
“আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই এখানে।”
“কেন?”
“মহিলা মানুষ নিয়ে এত ভেবে লাভ কী? সে যদি অন্য পুরুষের সাথে ভেগে যায় তাকে নিয়ে কি প্রতিক্রিয়া দেখাব।”
“আপনার কেন মনে হচ্ছে, সে অন্য পুরুষের সাথে ভেগে গিয়েছে।”

“প্রভাতের গাড়ির ড্রাইভারের সাথে ফিস ফিস করতে দেখেছি।জয়নাব কে প্রভাতের গাড়ির ড্রাইভার ই এনেছিলো।এদিকে ড্রাইভার ও দু’দিন আসেনা।আমি কারো সাথে শেয়ার করিনি।এখন বাধ্য হলাম বলতে।”
“ওরা পালিয়ে না গিয়ে কোনো ক্ষতি হলে, এর দায়ভার কিন্তু আপনাকেই নিতে হবে।”
ওয়াসেল হেসে জবাব দিল,
“সে কোথায় আমি কিছুই জানিনা।তবুও দায়ভার আমার হবে।”
“আপনার বাড়ি থেকে যে গায়েব হয়েছে তার দায়ভার তো আপনাকেই নিতে হবে। নাহলে আইন আপনাকে ছাড়বে না।”

“আমার অন্যায় হলে আইণ আমাকে শাস্তি দিবে।”
“আমাকে ভুল বুঝবেন না।যেহেতু আপনার বাড়ি থেকে হারিয়েছে কিছুটা প্রভাব আপনার উপর পড়া স্বাভাবিক।আমার বিশ্বাস আপনি নির্দোষ।আইন কাউকে বিনা কারণে শাস্তি দেয়না।”
“খুব সাহসী আপনি।বাড়ি কোন জেলায়।”
“এই মুহুর্তে আপনার পাশের এলাকায়। যেহেতু এখানেই জব করি।”
“হ্যাঁ, তাইতো।”

আচ্ছা এতবছর তো আপনাদের পরিবারে অনেক মহিলা কাজ করেছে কেউ তো এভাবে গায়েব হয়নি।হঠাৎ এই নতুন আসা মহিলাটা গায়েব হল কীভাবে?”
“সেটাই তো আমি বুঝতে পারছিনা।গেল কোথায় এই জয়নাব।”
“এটাতো একটা রহস্যজনক ব্যাপার।গভীর রহস্যর গন্ধ পাচ্ছি।কেঁচো কুড়তে সা’প বেরোবে মনে হচ্ছে।”
ওয়াসেল কিছুটা চিন্তিত মুখে বলল,
“মনে হচ্ছে আমাদের চৌধুরী পরিবার নিয়ে চক্রান্ত চলছে।”

“আপনারা কত যুগ ধরে এমন ক্ষমতার অধিকারী বলুন তো।এত সম্পত্তি আপনাদের কীভাবে হয়েছে।”
“খুব বড় ব্যবসায়ী ছিলেন আমার পূর্ব পুরুষ। যুগ যুগ ধরেই আমরা ক্ষমতাবান।প্রাচীন যুগ থেকেই আমার বাপ-দাদারা ব্যবসা করে সম্পত্তি বানিয়ে রেখে গিয়েছেন।পরে আমরা কিছুটা বানিয়েছি।”
“আচ্ছা,সব সম্পত্তির উৎস কি হালাল উপায়ে? শুনেছি আপনার বাপ-দাদার আমলে তারা অনেক অবৈধ কাজে লিপ্ত ছিল।অনৈতিক কাজে জড়িত ছিল সবাই।”

ওয়াসেল হেসে জবাব দিল,
“খোজ নিয়ে দেখবেন এলাকায় গরিবদের পাশে যুগ যুগ ধরে আমাদের পরিবার কীভাবে পাশে আছে।আমাদের সব সম্পত্তি গরিব দুঃখীরা ফসল ফলিয়ে খাচ্ছে বিনিময়ে আমরা কোনো সুযোগ নিইনা।এলাকার মানুষদের মুখে শুনবেন চৌধুরীরা কেমন।”
” ওরা আপনাদের ফেরেশতার মত ভাবে।পুলিশ হিসাবে উচিৎ আপনাদের বিষয় এ একটু তদন্ত করার।”
ওয়াসেল চোখ কপালে তুলে বলল,

“এসব বিষয় এ কে উষ্কাচ্ছে আপনাকে।কেউ না কেউ তো আছেই।”
রাজন হেসে বলল,
“প্রভাত চৌধুরী।”
ওয়াসেল এর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।বড় বড় চোখে তাকাল রাজনের দিকে।মনে মনে বলল,
“এই ছেলে আমার সর্বনাশ করে ছাড়বে।”

গেস্ট হাউজের দরজার সামনে এক ফালি নরম রোদের আলো পড়েছে।দূর্বাঘাসের উপর শিশির কণা রোদের আলোয় চিকচিক করছে। পূর্ণতা গেস্ট হাউজের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।মনে পড়ল প্রভাতের কথা।গতরাতের স্মৃতিচারণ হল তার।প্রভাতের অগ্নিদৃষ্টির কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠল সে।মুহুর্তের মাঝেই মন উদাস হল।মনে পড়ল প্রভাতের র*ক্তা’ক্ত পায়ের কথা।

পা কি অনেক খানি কে’টে’ছি’লো।ওষুধ খেয়েছিলো?খুব ব্যাথা পেয়েছিলো নিশ্চয়ই?রাতে কি সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো?বাড়িতে এত কান্ড ঘটে যাচ্ছে অথচ ঘুম থেকে উঠল না।এই পুলিশ তো তার -ই পরিচিত। পুলিশ এসে কি তাকে ফোন দেয়নি।তাহলেও সে উঠল না কেন?তাহলে কি সে অসুস্থ। মনের অজান্তেই প্রভাতের জন্য দুঃচিন্তা বাসা বাঁধল হৃদয়ে।এসব ভাবতে ভাবতেই পূর্ণতা বিরক্ত হল।প্রভাতের যা খুশি হয়ে যাক সে কেন চিন্তা করছে?কিছুই ভাববে না সে প্রভাত কে নিয়ে।প্রভাত তার জীবন টা নরক বানিয়ে ছেড়েছে।

এই ন’র’ক পুরিতে সারাজীবনের জন্য প্রভাত তাকে আটকে দিয়েছে।প্রভাত তাকে বিয়ে করতে না চাইলে সারাজীবন এ বাড়িতে থাকা লাগত না।সব কিছুর জন্য প্রভাত ই দায়ী।এমন সময় গেস্ট হাউজের মেইন সদর খুলল।দরজার কপাটের শব্দে পূর্ণতা আচমকা ঘুরে দাঁড়াল।সাত-সকালে মুখোমুখি হল পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর স্নিগ্ধ দুজন মানব-মানবী।দুজন দু’জনের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কারো দৃষ্টিতে এখন আ’গু’ন নেই।পূর্ণতা প্রভাতের পায়ের দিকে চোখ রাখল।পায়ে ব্যান্ডেজ করা।পূর্ণতা প্রভাতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাল।আগাগোড়া তাকিয়ে লজ্জায় চোখ সরাল পূর্ণতা।প্রভাতের ফর্সা শরীরে কালো পশমের আবরণে অধিক সুন্দর দেখাচ্ছে।খালি গায়ে, পরণে কালো একটা শর্ট প্যান্ট শুধু।পূর্ণতা অন্যদিকে চোখ রেখে মনে মনে বলল,

“ছিঃ কি নির্লজ্জ মানুষ। এত বড় একজন মানুষের পরণে ছোট বাচ্চাদের মত কীনা একটা শর্ট প্যান্ট।উনার কি একবিন্দু লজ্জা নেই।বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে কি এখন অর্ধনগ্ন অবস্থায় বেরিয়ে আসবে নাকি।এই অবস্থায় এসে এখন আমার হাত ধরে টেনে অসভ্যর মত দুনিয়ার খারাপ খারাপ কথা বলবে।”
ভাবতে ভাবতেই পূর্ণতার বিড়াল এদিকে এগিয়ে এল।পূর্ণতা বিড়াল-কে দেখেই হেসে দিয়ে ডাকল,
“আমার কাঠগোলাপ।”

পূর্ণতাকে অবাক করে দিয়ে কাঠগোলাপ পূর্ণতার কাছ দিয়ে সোজা প্রভাতের দিকে এগিয়ে গেল।গিয়েই প্রভাতের পা ঘেষছে।প্রভাত কাঠগোলাপ-কে কোলে তুলে নিল।কোলে নিয়ে আদর করছে।পূর্ণতা অবাক হয়ে কাঠগোলাপের দিকে তাকাল।মনে মনে বলল,
“ঘরের শত্রু বিভিশন।আমার বিড়াল হয়ে তুই কীনা ওই প্রভাতের কাছে চলে গেলি।বুঝেছি তুই মেয়ে আর প্রভাত ছেলে বলে প্রভাতের সাথে ভাব।”

প্রভাত একবার ও পূর্ণতার দিকে তাকাল না।সে কাঠগোলাপকে কোলে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।নিঃসন্দেহে প্রভাত একজন সুদর্শন পুরুষ। লম্বা,ফর্সা সুঠাম দেহের অধিকারী। খালি গায়ে একটা বিদেশী সাদা বিড়াল কোলে নিয়ে আদর করছে।দেখতে ছবির মতই সুন্দর দেখাচ্ছে।মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য এত সুন্দর দেখায় চাইলেও চোখ ফেরানো দায় হয়।প্রভাত কে এই মুহুর্তে যত সুন্দর দেখাচ্ছে পৃথিবীর যে কোনো মেয়ে দেখলেই মুগ্ধ হবে।এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলোতে ইচ্ছা করবে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপাল জুড়ে পড়েছে।
এ সময়ে জিন্স আর গেঞ্জি পরিহিত একটা মেয়ে এসেই প্রভাতকে দেখে বিস্মিত হল।খুব জোরে চিৎকার দিয়ে বলল,

“ওহ নো প্রভাত ইউ আর লুকিং সো হট।”
পূর্ণতা মেয়েটার দিকে তাকাল।মেয়েটাকে সে চিনে।মেয়েটার নাম অজান্তা।প্রভাতের বেষ্ট ফ্রেন্ড।অজান্তা প্রভাতের কাছে গিয়ে প্রভাতকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কেমন আছিস তুই।”
প্রভাত আস্তে করে অজান্তা কে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“হঠাৎ তুই,না বলে।”
“শুনলাম তুই অসুস্থ। ”
“কে বলল?”

“খবর দেওয়ার মানুষ আমার আছে।”
“আমি তো অসুস্থ না,ফেইক নিউজ কে দিল?”
“তোর না পা কে’টে গিয়েছে।”
“এত টুকু মাত্র।বাট অসুস্থ না।”
“তবে প্রভাত ইউ আর লুকিং সো হট।পুরাই ড্যাশিং লাগছে।”
প্রভাতের কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে।গোমড়া মুখে বলল,
“আমি কাপড় পরে আসি।”
অজান্তা প্রভাতের হাত টেনে ধরল।প্রভাত দাঁড়াল।দাঁড়িয়ে বলল,

“কিছু বলবি?”
“হুম।”
“হাত না ধরেও তো বলা যায়।”
অজান্তা হাত ছেড়ে দিল।মলিন মুখে বলল,
“কি হয়েছে প্রভাত।এতদিনের পরিচয় কোনদিন তো তোকে এমন গম্ভীর আর চুপচাপ দেখিনি।একাই সব মাতিয়ে রাখা ছেলেটা এমন চুপচাপ কেন?”
“কিছু হয়নি।তোর এমনি এমন মনে হচ্ছে।”

বলেই প্রভাত ভেতরে প্রবেশ করল।অজান্তা জানে প্রভাতের কি হয়েছে।জেনেও সুক্ষ্মভাবে অভিনয় চালিয়ে গেল।অজান্তা অনেকদিন ধরে প্রভাতকে ভালবাসে।সব রকম চেষ্টা করেও প্রভাতের মনে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশী জায়গা পায়নি।প্রভাত ও জানে অজান্তা তাকে ভালবাসে।প্রভাতের বাবার বন্ধুর মেয়ে সে।গতরাতে প্রভাতের বাবা ওয়াসেল চৌধুরী ই অজান্তাকে খবর দিয়ে এনেছে।অজান্তা পূর্ণতাকে দেখে এগিয়ে গেল।পূর্ণতাকে দেখে মৃদু হেসে বলল,
“কি হয়েছে পূর্ণতা, তুমি কিছু জানো?”

পূর্ণতা মিহি কন্ঠে উত্তর দিল,
“না আপু জানিনা।”
অজান্তা একতা ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তোমাদের বিয়ে কবে?”
“জানিনা আপু।”
“এত সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে তাও মুড অফ কেন? আমি হলে সারা শহর কে জানাতাম আনন্দে।”
“উনাকে বিয়ে করাই তো সব আনন্দে পানি ঢালার মত।”
“তাই নাকি,তাহলে প্রভাতকে আমার হাতে দিয়ে দাও।ওর মত হ্যান্ডসাম ছেলেকে পেলে সারাজীবন মাথায় তুলে রাখব।”

“তাহলে নিন আপু,আমি বেঁচে যায়।”
মনে মনে কেন যেন জেলাস ফিল হল পূর্ণতার।সে ভাল না বাসুক তাই বলে অন্য কেউ কেন ভালবাসবে।কেন প্রভাতকে নিয়ে মানুষ এত টানাটানি করবে।
এমন সময় প্রভাত বেরিয়ে এল ঘর থেকে।পরণে সাদা হাতা লম্বা গেঞ্জি।গেঞ্জির হাতা গোটানো।পরণে ব্লাক জিন্স।অজান্তা হা করে তাকিয়ে আছে প্রভাতের দিকে।ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।সেই হাসি নিয়ে বলল,

“প্রভাত তোকে আমি যতবার দেখি ততবার ই প্রেমে পড়ি।”
প্রভাত অজান্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রেমে না পড়ে ওপাশে গিয়ে পুকুরে পড়।”
“মানে?”

“পুকুরের পাড়ে একটা বস্তা পাওয়া গিয়েছে।আর বস্তায় একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে।রাজন ফোন দিয়েছে চল।”
লাশের কথা শুনে অজান্তা ভয়ে লাফিয়ে উঠে প্রফাতের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।প্রভাতের হাত শক্ত করে ধরে প্রভাতের সাথে ওদিকে এগিয়ে গেল।যাওয়ার সময় পূর্ণতার দিকে একবার ও তাকাল না।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১২

বিরহের একটা ব্যাথা কেমন চিনচিন করে উঠল পূর্ণতার বুকের মাঝে।যত যা হয়ে যাক প্রভাত তার সাথে কথা বলেনা এমন কখনো হয়নি।আজ প্রথমবার প্রভাত তার সাথে কথা বলেনি।তার দিকে তাকায় ও নি।পূর্ণতা মলিন চোখে তাকাল প্রভাতের পথপানে।কেন যেন কষ্ট হচ্ছে তার।সেই কষ্ট ভুলে সে-ও সামনে এগিয়ে গেল।এই বাড়িতে লাশ কার আসবে।আগে পরে তো এই বাড়িতে কোনো লাশ পাওয়া যায়নি।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১৪