অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৫

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৫
Mousumi Akter

হাত এবং পায়ের নখ থেকে শুরু করে দুইহাত এবং দুই’পা কুচি কুচি করে, চোখ দুটো উপড়ে রাস্তার মোড়ে ফেলে রাখা হয়েছে ওয়াসেল এবং ওয়াজেদ চৌধুরীকে। সেই পিচঢালা রাস্তায় লিখে রাখা হয়েছে,

” এলাকার সমস্ত নিরীহ মানুষদের এতদিন খু’ন করে জেলেপাড়ায় বসবাস করা সহজ-সরল ফায়েক নামক মুঁখোশধারী শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছি এতদিন। আমরা তিনজনই এই নিকৃষ্ট পেশার সাথে জড়িত। আমরা মানুষের মানুষের পেটের মধ্য মাদক চালক দিয়েছি। আমরাই একদিন একজন অর্ধাঙ্গীর চোখের সামনে তার অর্ধাঙ্গ স্বামীকে মেরে তার পেটে মাদক প্রচার করেছিলাম। একজন নিরঅপরাধ শিশু জন্মের আগে হারিয়েছিলো তার বাবা। সেই শিশুটি আবার বেড়ে উঠল তার বাবার খু’ নী’র ভালবাসায়। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লেখাটি পড়ে গ্রামের, এলাকার প্রতিটা মানুষ এর মাথায় যেন বজ্রপাত ঘটলো। মুখোশের আড়ালে এরা এত খারাপ ছিলো। সামান্য একজন মাছ বিক্রেতার এত ভয়াবহ রুপ ছিলো। লেখাটি পড়ে রাজনের সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করল। এইজন্যই কি তার বাবা তাকে দূরে রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছিলো। বাবার পাপের টাকায় তাকে পড়িয়েছে। রাজনের মুখটা ধুলোর মত হয়ে গেলো। সহজ -সরল বাবার আড়ালে এত খারাপ একটা রুপ ছিলো। রাজন প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে এই অপরাধের সাথে জড়িত সে যেই হোক রাজন তাকে ছাড়বে না। আজ রাজনের কষ্ট হচ্ছে, নিজের বাবাকে কীনা তার ফাঁ’ সি’ র দঁড়িতে ঝুলাতে হবে। এখনো মানতে পারছে না এই কঠিন সত্য। রাজন আড়ালে গিয়ে তার বাবাকে ফোন করল। সাথে সাথে ফায়েক ফোনটা রিসিভ করল। রাজন কম্পিত কণ্ঠে বলল,

‘ তোমাকে কি বাবা ডাকা উচিৎ? ‘
‘ কেন?’
‘ তার আগে বলো, কেন জন্ম দিয়েছিলে আমাকে। কেন এত লজ্জায় ফেললে আমাকে। টাকার কি বেশী প্রয়োজন ছিলো যে, মুঁখোশধারী শ’ য়’ তা’ন সেজে টাকা ইনকাম করতে করতে হলো। ‘

‘ সবই তোমার জন্য করেছি।’
‘ আমার জন্য যখন করেছো আমিও তোমার জন্য কিছু করব। পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে থাকবে একজন সন্তান কীভাবে তার বাবাকে ফাঁ’ সি’ র দঁড়িতে ঝুলায়। আমি তোমাকে ছাড়ব না বাবা। আমি বাড়িতেই আছি, তুমি এক ঘণ্টার মাঝে এসে স্যালেন্ডার করবে।’

ঘণ্টাখানিক কেটে গিয়েছে। রাজন কাঁদছে। যেন কেউ মরে যাওয়ার মত শোক এটা তার কাছে। পুরা পৃথিবী ধরে ঘুরছে তার মাথার ওপর। ওইদিকে মেরির স্বামী মারা গিয়েছে কিন্তু মেরি কোথাও নেই। ঘন্টাখানিক পরে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় সে এসে ওয়াসেলের লা’শে’র পাশে হাজির হলো। সে হাসছে, তৃপ্তির হাসি হাসছে। যেন স্বামীর মৃত্যুই তার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। পূর্ণতার বাবা মারা গিয়েছে সেও হাসছে। কি অদ্ভুত সব সম্পর্কগুলো। কারো স্বামী বা বাবার মৃত্যুতেও কেউ কাঁদে। শুধু পুষ্পর চোখে পানি। মেরিকে এমন অদ্ভুতভাবে হাসতে দেখে সবার সন্দেহ হচ্ছে। আরেকজন লেডি অফিসার মেরির হাত ধরে বলল,

‘ স্বামীর মৃত্যুতে কষ্ট হচ্ছেনা?’
‘ কষ্ট কি মানুষ বারবার পায় ম্যাডাম। স্বামীর মৃত্যুতে যে অসহনীয় কষ্ট আর ত্রিশটা বছর ভোগ করছি সে খবর কি কেউ রেখেছে।’
এলাকার প্রতিটা মানুষ তাকিয়ে আছে মেরির দিকে। এ যেন নতুন এক গল্প। লেডি অফিসার খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন,
‘ ত্রিশ বছর আগে কি হয়েছিলো?’

‘আমাদের বাড়ি ছিলো কলকাতা। আমার দশ বছরের ভালবাসা পূর্ণতা পাওয়ায় বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছিলাম। আমি ওকে ভীষণ ভালবাসি জানেন। বিয়ের ছয় মাস যেতে না যেতেই আমি অন্তঃসত্ত্বা হই। তা টের পাই বাংলাদেশে এসে। বাংলাদেশে এসে ঘুরার প্রস্তাব টা ওনার বন্ধু ওয়াসেল ই দিয়েছিলো। ওয়াসেল তখন প্রায় প্রায় ইন্ডিয়া যেত। আমার স্বামী ছিলেন একজন সৎ আদর্শবান নেতা। যে কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না। বাংলাদেশে আসার পরে আমরা ওয়াসেলের সাথে একটা হোটেলে উঠি। তখন ওয়াসেল একটা অসৎ ব্যবসায়ের প্রস্তাব দেয় আমার স্বামীকে। উনি সেটাতে রাজি না হয়ে পুলিশকে জানানোর হুমকি দেন।

আর তখনই নেমে আসে বিপদ। এইদিকে ওয়াসেলের নজর ছিলো আমার সুন্দর চেহারার প্রতি। সুন্দর চেহারাও মানুষের জীবনের অভিশাপ হয় মাঝে মাঝে। ওয়াসেল আমার চোখের সামনে আমার স্বামীকে নির্মম ভাবে কোঁ’ পা’ তে থাকে। আমি তখন পাশের রুমে ওকে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিই। তখন আমার কোলে ওর মাথা ছিলো। র’ক্তে ভিজে যাচ্ছিলো ফ্লোর। আমি চিৎকার করছিলাম, আর্তনাদ করছিলাম যন্ত্রণায়। ওর র’ক্ত আমি কোনভাবে আটকাতে পারিনি। তখন ও শেষ যাত্রায় প্রায়। মৃত্যুপথে ও আমাকে দিয়ে প্রমিজ করিয়েছিলো আমি যেন আমাদের সন্তান এর কথা ওয়াসেল কে না জানায়।

আমার সন্তানকে যেন আমি এই পৃথিবীতে আনি। ওর সন্তানকে যেন ওর মত ভালো মানুষ বানায়। সেদিন আমার কোলের ওপর আমার স্বামী মা’রা যায়। আমার চোখের সামনে ওরা ওর পেটে বিভিন্ন মাদক ঢুকিয়ে পাচার করে। আমি কেমন পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছিলাম। যন্ত্রণায় বুকটা পুড়ছিলো। কী ভীষণ যন্ত্রণা তা কেউ অনুভব করতে পারবেনা। আমার কাছে একটা প্লাস পয়েন্ট ছিলো। সেটা হলো ওয়াসেলের দূর্বলতা। ওয়াসেল আমার প্রতি ভীষণ দূর্বল ছিলো। আমি জানতাম ওয়াসেল আমাকে কিছুই বলবেনা।

সেদিন আমি ওয়াসেলকে বলেছিলাম, ‘ আমি এখন কোথায় যাবো? কেউ তো নেই আর আমার।’ ওয়াসেল তখন সুযোগ পেয়ে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ আমি বুকে পাথর চেপে আমার স্বামীর হ’ ত্যাকারীর ওইদিনই বিয়ে করি। বুঝতে পারছেন একজন অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে আমার কষ্ট। কি ভীষণ যন্ত্রণা বুকে লালন করে স্বামীর মৃত্যুর দিন আরেক বিয়ে করি আমি।

কিন্তু আমি ওয়াসেল কে জানাই নি দু’মাসের ছোট্ট প্রভাত আমার পেটে। তারপর প্রভাতের জন্ম হয়। ওয়াসেল জানতেও পারেনি ও যাকে সন্তান বলে জেনে এসছে সে আসলে অন্য কেউ। বুঝতে পারছেন একজন নারী হিসাবে হিসাবে কি পেয়েছি আমি। তবে ‘প্রভাত তোমার ছেলে না’ এই কথাটা ওয়াসেলকে যে যবত্রণা দিয়েছেতাই আমাকে শান্তি দিছে।একজন অর্ধাঙ্গীর গল্প শুনলেন তো।
কত কঠিন ছিলো তার পথযাত্রা। তবে আজ আমার প্রতিশোধ সফল।’

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৪

লেডি অফিসারের চোখ জোড়া ভিজে উঠল।এলাকার মানুষজন সবার চোখ ভিজে উঠল। একজন নারী হিসাবে মেরির কোনো তুলনা নেই। সন্তানকে বাঁচাতে কত কি সহ্য করে গেলো। লেডি অফিসার একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘ মানুষের জীবন এমন কঠিন ও হয়। আমি যেন একটা অন্ধকার পৃথিবীর গল্প শুনলাম। খু’ন গুলো কি আপনি করেছেন?’

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here