অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৪
Mousumi Akter
পুরো জেলেপাড়া থমথমে পরিবেশে আছে৷ প্রাণহীন হয়ে পড়েছে সবকিছু। কোথাও যেন কোনো প্রাণ নেই। পূজার মৃত্যুর আজ দু’মাস অতিক্রম হয়েছে। গ্রামে সারাক্ষণ পুলিশের বিচরণ চলছে। পুলিশ তদন্ত করে পেয়েছে কেউ বা কারা যেন কোনো অসৎ উদ্দেশ্য দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মা’থা কে’টে দেহ নিয়ে উধাও হচ্ছে। এখানে গভীর কোনো রহস্য আছে।
পুষ্প’র আজ সারাদিন ধরে বমি হচ্ছে। তাও ভীষণ বমি। বিগত সাতদিন ধরে মাথা ঝিম ঝিম, বমি বমি ভাব তার। দুপুর থেকে না খেয়ে সুয়ে আছে। এইদিকে রাজনর মা দাঁত কিড়মিড় করে যাচ্ছে পুষ্পর সুয়ে থাকা নিয়ে। সে আজও পুষ্পকে মেনে নিতে পারেনি। কেন যেন পুষ্পকে তার চক্ষুশুল লাগে। বিগত দু’মাসে পুষ্প হাঁপিয়ে উঠেছে এ বাড়িতে। কোনো ভাবেই রাজনের মায়ের মনের মত সে হয়ে উঠতে পারেনি। কেন যেন আজ পুষ্প হাল ছেড়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে সে বিছানা ছেড়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে নদীর ঘাটে গেলো। নদীর আলগা বাতাস চোখে -মুখে লাগছে। নদীর পাড়ের মাচালির ওপর বসে আছে ফায়েক। পুষ্পকে দেখে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ পুষ্পমা তুমি এই ভর সন্ধ্যায় এইহানে ক্যান মা।’
পুষ্প মলিন মুখে বলল,
‘ শরীরটা ভালো লাগছেনা বাবা। ‘
তখনই কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল ওখান দিয়ে যাচ্ছিলো। পুষ্পকে দেখে বলল,
‘ ভাবি স্যার কোথায়?’
ওদের ভেতরকার উত্তেজনা দেখে পুষ্প সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেন?’
‘নদীর পাড়ের ঝোপে একটা বিশাল বড় ছুরি পাওয়া গিয়েছে।’
পুষ্প কনস্টেবল কে বলল,
‘ দেখি ছুরিটা?’
ছুরিটা বের করতেই পুষ্পের চোখ কপালে উঠল। মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা হয়ে এলো। এই ছুরিটা তো সেই ছুরি। পুষ্প ওদের সামনে আর কথা বাড়ালো না। ওরা চলে যেতেই
পুষ্প ফায়েকের চোখে চোখ রেখে বলল,
‘ আপনার সেই গাছ কা’টা ছুরিটা কোথায় বাবা।’
ফায়েক খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘ আছে ঘরে।’
‘ ওটা পুলিশের কাছে বাবা। র’ক্ত মাখানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। ‘
‘ বলো কি। কেউ কি ঘর থেকে চু’রি করল।’
‘ আপনার বাড়িতে অচেনা-অজানা কে আসবে?’
‘ সেটাই তো বুঝছিনা।’
পুষ্প এবার সরাসরি বলে উঠল,
‘ এই ছু’রি দিয়েই কি পূজার খু’নটা করেছেন বাবা।’
ফায়েক এর চোখ কপালে উঠল। সে মিনতি ভরা কণ্ঠে বলল,
‘ এইসব কি কইতাছো মা। পূজা আমার মেয়ের সমান। আমি তারে ক্যান খু’ ন করব৷ ‘
‘ সেটাতো আপনি জানেন চাচা। সত্যি করে বলেন কি লুকাচ্ছেন। আমার কেন যেন এখন এই ছু’রি দেখে মনে হচ্ছে আপনি জড়িত।’
‘ তোমার একটা ভুল হচ্ছে মা। যাও রাজন আইছে। দু’একটা, সুখ-দুঃখের কথা কও যাও। পুষ্পর কেন যেন মনে হচ্ছে সে চাইলেই কোনভাবে সত্যটা বের করতে হবে। পুষ্প ভীষণ সাহস নিয়ে ওখান থেকে সরে আসল। সরে এসে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলো। পুষ্পর ধারণা ফায়েক ওই খু’নীদের সাহায্যকারী। যারা একের পর এক খু’ন করে চলেছে গ্রামে। ফায়েককে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা নাম্বারে ফোন করল। ফোনের ওপাশ থেকে ফায়েককে গুরু বলে ডাকল কেউ। ফায়েক কয়েকটা গালি উচ্চারণ করে বলল,
‘ গুরু, গুরু করিস না আর। আমার সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওয়াসেলের মেয়ে আমাকে সন্দেহ করছে। ছেলের কাছে যখন -তখন ধরা খেয়ে যাবো। ‘
‘কেন গুরু কি হয়েছে।’
‘ যে ছু’রি দিয়ে শ’ খানিক মানুষ গরুর মত জবাই দিয়ে মাথা লাথি মেরে ফেলে দেহ নিয়ে গুম করেছি। সেই ছুরি ওয়াসেলের মেয়ের নজরে এসেছে। আমার এত বছরের ব্যবসা একটা কাক-পক্ষী ও টের পাইনি। ওয়াসেলের মেয়ে যখন একটু আঁচ করতে পেরেছে এবার ধরা খেয়ে যাবো। কিন্তু আগামিকাল সকালেরই আমাকে মজুদ ড্রাগস গুলো ইন্ডিয়া পাচার করতে হবে। কোটি কোটি টাকার মাদকদ্রব্য রয়েছে। ওয়াসেলকে বলে দিস ওর গেস্ট হাউজে বিদেসী যে মেয়ে এসছে ব্যবসায়িক আলাপ করতে ওরে জ’ বা’ ই দিতে। ওর পেটের মাঝে মাদক দ্রব্য দিয়ে মাছের নৌকায় করে পাচার করে দিবো।
শত শত মানুষ মে’রে’ছি শুধু তাদের পেটে মাদকদ্রব্য ঢুকিয়ে তা পাচারের জন্য৷ কোটি কোটি টাকা থাকতেও আমি জেলের রুপ ধরে আছি। একজন ফকিরের জীবন-যাপন করছি। ওইদিকে সবাই ওয়াসেলকে বড়লোক ভাবে। অথচ সব আমার করে দেওয়া। জেলে পাড়ায় পড়েই আছি মাছের নামে, মাছের নৌকার নিচে মানুষের পেটে মাদক পাচারের জন্য। ওয়াসেলের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের জন্য ওদের বাড়ি মাছ বেচার নাটক করেছি। এত কিছু করেছি শুধু টাকার জন্য। আগামিকালই মাছের নৌকা সহ মাদক নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যেতে হবে। ওয়াসেল আর ওয়াজেদ কে রেডি থাকতে বল।’
পুষ্প’র সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করল। সে বিশ্বাস করতে পারছেনা ফায়েক এমন কুৎসিৎ মানুষ। এত ভয়ানক মুঁখোশ পরে কেউ থাকতে পারে তা পুষ্পর ধারণার বাহিরে ছিলো। পুষ্প থরথর করে কাঁপছে। পুষ্প একটা জোরে নিঃশ্বাস ও ছাড়লোনা। সে বুঝতে পারছে পূজার করুণ পরিণতির পেছনে কে দায়ী। পূজার কথা ভেবে কাঁন্না উপচে পড়ল পুষ্প’র। ছোট্ট পূজাকি তাহলে এভাবেই হায়েনাদের কবলে পড়েছিলো। এই ভয়ানক মানুষদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। পুষ্প মনে মনে বলল,
সে পূজার মত ম’র ‘বে না। ফায়েকের মুখোশ তাকে খুলতেই হবে। আস্তে করে ওখান থেকে সরে এক দৌঁড় দিয়ে বাড়িতে আসল। তখন পুষ্প হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দেখল রাজন কেবল-ই বাড়িতে এসছে। পুষ্প’র অমন অবস্থা দেখে রাজন পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ কি হয়েছে পুষ্প।’
‘ আমাকে এখনি আম্মুর কাছে নিয়ে যাবে প্লিজ।’
,এখনি?’
‘ হ্যাঁ, এখনি। এখনি মানে এখনি। তোমার কাছে কোনদিন কিছু চাইনি আমি বাট এখন চাইছি। আমাকে এখনি আম্মুর কাছে নিয়ে চলো।’
পুষ্পর অমন অবস্থা দেখে রাজন আর এক সেকেন্ড দেরি না করে পুষ্পকে নিয়ে চৌধুরী বাড়ির দিকে রওনা হলো। রাজনের বাইকের পেছনে বসা। পুষ্প বুঝতে পারছেনা রাজন কে কিছু বলাটা ঠিক হবে কীনা। যতই হোক ছেলেতো ফায়েকের। পুষ্প’র হঠাৎ ভ’য় করে উঠল। তাহলে কি রাজন ও অমন। রাজন কি তাহলে ওর বাবার সহায়ক। রাজন ও ওর বাবার মতই খারাপ। সারারাস্তা পুষ্প কাঁদতে কাঁদতে গেলো। চৌধুরী বাড়িতে পৌছানোর পর রাজন খেয়াল করল, পুষ্পর অবস্থা ভায়বহ খারাপ। কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে। রাজন পুষ্পের গালে হাত রেখে বলল,
‘ শরীর ভালো লাগছে এখন।’
‘হুম।’
‘তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে, রেডি হও ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।’
পুষ্প ভেজা চোখে রাজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা এই খু’ন গুলোর সাথে তোমার বাবা জড়িত নয়তো।’
রাজনের মাথা ঘুরে উঠলো। সে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ জা’ন তোমার মাথায় এসব কে ঢুকালো? বাবা মানে আমার বাবা?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ আমার বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ-সরল মানুষ। সে কেন এসবে জড়িত হবে?’
‘ যে ছু’রিটা আজ তোমরা র’ক্তমাখা অবস্থায় পেয়েছো, ওটা বাবারই ছু’রি।’
‘ তোমার ভুল হচ্ছে কিছু একটা। প্লিজ এসব কথা ভুলেও আর বলোনা।’
‘ রাজন তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো।এসবের সাথে বাবা জড়িত আছে।’
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৩
‘ এমনিই অনেক প্রেসারে আছি। তার মাঝে তুমি কি শুরু করলে? প্লিজ রেস্ট নাও এখন। আমি আসছি এখন।’
রাজন চলে গেলো। পুষ্প ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো। পরেরদিন ভোর সকালে খুব বাজে অবস্থায় রাস্তায় পড়ে রইলো ওয়াসেল আর ওয়াজেদ চৌধুরীর লা’শ।