অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৬

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৬
Mousumi Akter

লেডি অফিসার মেরির দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আবারও বললেন, ‘ আমি জানিনা আপনাকে কীভাবে সম্মানিত করা উচিৎ। আপনার মত মা, আপনার মত স্ত্রী এ দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়তা আছে কীনা! এত ধৈর্য্য, এত কষ্ট সহ্য করে থেকেছেন তাও জানিনা। যা অনুভব করে আমি শিউরে উঠছি। শুধু বলুন, খু’ন গুলো কি আপনিই করেছেন?’

তখন প্রভাত এসে উপস্থিত হয়। প্রভাতের হাতে র’ক্তা’ক্ত একটা ছুরি। চোখ দু’টো লোহিতবর্ণ ধারণ করেছে।প্রভাতের সমস্ত শরীরে র’ক্ত মাখা। প্রভাতকে এ অবস্থায় দেখে সবাই প্রভাতের দিকে তাকালো। পূর্ণতার সমস্ত পৃথিবী ঘুরতে শুরু করল। পূর্ণতা এক ছুটে প্রভাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রভাতের মুখটা মলিন, যেন এক আকাশসমান মেঘ জমেছে। পূর্ণতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে শুধু চেয়ে আছে প্রভাতের দিকে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। কিছু বলতে চাওয়ার আগেই প্রভাত স্মিথ হাসল। যে হাসিটা বড্ড ভয়ংকর।একে একে সবাই ঘিরে ধরল প্রভাতকে। পূর্ণতা কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আপনার এ অবস্থা কেন?’
প্রভাত ছু’রিটা ফেলে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। পূর্ণতার পায়ের কাছে বসে মাথা গুজে রইলো মাটিতে। পূর্ণতা ও মাটিতে বসে পড়ল। প্রভাতের দুই গালে হাত রেখে বলল,
‘ কি হয়েছে চৌধুরীসাহেব আপনার? আপনাকে এমন লাগছে কেন?’
প্রভাত পূর্ণতার হাতদুটো আগলে ধরল। পূর্ণতার মুখপানে তাকিয়ে বলল,

‘ ক্ষমা করো আমাকে তুমি পূর্ণ। আমি তোমাকে একটা অভিশপ্ত জীবন উপহার দিলাম। তোমাকে একা করে দেওয়ার জন্য ক্ষমা করো আমাকে। আমি পারলাম না সব ঠিক করতে পূর্ণ। আমি নিজ হাতে সব পা’পীদের খু’ন করেছি পূর্ণ। বাবা বলে যাকে ভীষণ ভালবাসতাম, সেই নাকি আমার সত্যিকারের বাবার খু’নি। আমার মত এমন অসহায় ছেলে এ দুনিয়াতে একটাও নেই। আমি আমার বাবার খু’নীর হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি, তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি, তার আদর ভালবাসায় বড় হয়েছি।

তাকেই ভীষণ ভালবেসেছি। শেষে কি হলো, আমার পুরো জীবন,আমার পরিচয়টাই পাল্টে গেলো। যাকে আমি ভরসা করেছি, সেই আমার জন্মদাতা পিতার খু’নী, আমার আম্মুকে সেই একদিন বিঁধবা করেছিলো। আমার আম্মুর পুরো জীবনটা নষ্ট করেছে সে। আজ আমি বুঝি কেন আমার আম্মু ওই কবর টা আমাকে দিয়ে জেয়ারত করাতো। কেন আমাকে বলতো বেশী বেশী দোয়া করতে। আমি আমার আম্মুর পুরো জীবনটা ভেবে পা-গ-ল হয়ে যাচ্ছি। আমি খু’ন করে দিয়েছি পূর্ণ। সবাইকে খু’ন করে দিয়েছি। আমার বাবার হত্যাকারীকে খু’ন করে দিয়েছি। বাবার হত্যাকারীকে খু’ন করে আমি আরোও অশান্তিতে পুড়ে মরছি।

ওয়াসেল চৌধুরীর আর্তনাদ আমাকে পোড়াচ্ছে। যন্ত্রণা দিচ্ছে। মৃত্যুর আগে ওয়াসেল চৌধুরী অসহায়-এর মত আমাকে বলেছিলো, আমার সব মিথ্যা প্রভাত,কিন্তু তুমি আমার সন্তান তোমাকে আমি ভালবাসি এটা সত্য ছিলো। আমার সারাজীবনে মানুষকে যত কষ্ট দিয়েছি তার চেয়ে হাজারগুন ফিরে পেলাম, যখন জানলাম তুমি আমার সন্তান নও। আমি এটা মেনে নিতে পারছিনা প্রভাত। তুমি একবার আমাকে বাবা বলে ডাকো। ওয়াসেল চৌধুরীর ওই আর্তনাদ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে পূর্ণতা। অথচ ওই মানুষটাই আমার আম্মুর জীবন ধ্বংস করেছে। আমি যার সন্তান তাকে তো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অজানা এক কষ্ট আমাকে পোড়াচ্ছে। ‘

পূর্ণতা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে প্রভাতকে জড়িয়ে ধরল। ভীষন এক কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে কি বলবে জানেনা, কিছুই বুঝতে পারছে না। সে প্রভাতের কষ্ট অনুভব করে ম’রে যাচ্ছে। প্রভাত পূর্ণতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আমি জানি আমার ফাঁ- সি হবে পূর্ণ। আমি পারলাম না তোমাকে আমার বুকে চিরকাল আগলে রাখতে। আমি কার কাছে তোমাকে রেখে যাবো জানিনা। তোমাকে চিরকালের মত একা করে দিলাম পূর্ণ। আমি ম’রে যাবার পর তুমি একা এত বড় একটা জীবন কীভাবে কাটাবে এটা ভেবে আমার অশান্তি হচ্ছে। চেয়েছিলাম তোমার আর আমার একটা সুখের নীড় হবে। সে নীড়ে আজন্মকাল কাটিয়ে দিবো তোমার হাসি মুখ দেখে। কিছুই হলোনা আর। আমাকে শাস্তি দাও তুমি। তোমাকে বিঁধবা করে দেওয়ার জন্য শাস্তি দাও আমাকে।’

পূর্ণতা কোনো কথা বলতে পারছে না। সে শুধু কাঁদছে। কান্না যেন ও আজন্মের সঙ্গী হয়ে গেলো। রাজন এত সময় চুপচাপ ছিলো। সে এবার নিচে বসে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমার বাবা কোথায় প্রভাত ভাই?’
‘নদীর পাড়ে লা’শটা রেখে এসেছি। ‘

রাজন চোখটা বন্ধ করল। দম বন্ধ একটা কষ্ট হচ্ছে তার। সে প্রভাতের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
‘ খুব ইচ্ছা ছিলো, এমন জঘন্য মানুষকে তীলে তীলে মারার। আপনি কেন ওই নোংরা মানুষকে মেরে আইন নিজের হাতে নিলেন। ভাবির কি হবে এখন প্রভাত ভাই। ‘
‘ তুমি আমার পূর্ণতাকে দেখে রেখো রাজন। আমি ছাড়া ওর কেউ ছিলোনা এতদিন। আজকের পর থেকে আরোও একা হয়ে যাবে। ‘

পূর্ণতার কান্নার মাত্রা বাড়ল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ প্রতিটা মেয়ে হই বাবার রাজকন্যা আর আমি হয়েছি আমার স্বামীর রাজরানি। কিন্তু আমার ভাগ্য এত খারাপ কেন? আপনি ছাড়া আমার চারদিকটা এত অন্ধকার, আমি কিছু চোখে দেখিনা। মা-বাবা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে তাও আমি বেঁচে আছি। কিন্তু আপনি? আপনার কিছু হলে, আমি করব। ‘
পুষ্প প্রভাতের কাছে এগিয়ে এসে বলল,

‘ তাহলে কি আমি তোমার বোন নই? আমাকে কি আর ভালবাসো না তুমি আর আম্মু।’
প্রভাত পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ তুই আমার বোন। একমাত্র বোন। পূর্ণকে দেখে রখিস।’

সবাই প্রভাতের কাছে কান্নাকাটি করছে। শুধু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মেরি। কেন সে ছেলের কাছে আসছে না কেউ জানেনা। মা-ছেলে দূর হতেই দুজন-দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে একটা দম বন্ধ পরিবেশ। রাজন হারালো বাবা, পুষ্প হারালো বাবা, পূর্ণতা হারালো বাবা, একই দিনে গোটা একটা পরিবার এলোমেলো হয়ে গেলো। কালো অন্ধকারে, শোকে ছেয়ে গেলো সবার জীবন। রাজন এর উপায় নেই। সে প্রভাত-কে নিয়ে গেলো জেলে। প্রভাত এখন জেলে আছে। কিছুদিনের মাঝেই রায় হবে। আদালত কি রায় দিবে কেউ জানেনা।

আজ কতদিন কৃষ্ণ হসপিটালে ছিলো। কৃষ্ণ আজ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। পা-গ-লে-র মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। হাত কে’টে পূজার নামটা বড় অক্ষরে লিখে রেখেছিলো। সেই নামের দিকে তাকায় আর হু হু করে কেঁদে ওঠে। পূজার নাম ধরে ধরে চিৎকার করে। রাজন জানে তার বাবা জড়িত ছিলো পূজার খু’নের পেছেন। কৃষ্ণের এই অবস্থার জন্য রাজনের নিজেকে দায়ী মনে হয়। রাজন কৃষ্ণকে সুস্থ বানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু চাইলেই কি সব হয়। দিন যাচ্ছে আর কৃষ্ণ মানসিক ভাবে বেশী খারাপ হয়ে পড়ছে। চারদিকে তাকায় আর বলে,

‘ ওইযে পূজা আসছে। ওইযে পূজা। ‘
কে জানে সব ঠিক হবে কীনা!
প্রভাত জেলে যাওয়ার দু’মাস পরে আদালত সমস্ত ঘটনা শুনে প্রভাতকে সাত বছরের কারাদন্ড দেয়৷ রাজন নিজে সাক্ষী দেয় তার বাবার বিরুদ্ধে, পূর্ণতা নিজে সাক্ষী দেয়, পুষ্প ও সাক্ষী দেয়৷ সবার সাক্ষীর পরে আইন নিজ হাতে নেওয়ার জন্য প্রভাতের কারান্ড ফাঁসির বিনিময়ে কারাদন্ড হয়। আদালতের রায়-এর পরে আজ প্রভাতকে জেলে নেওয়া হবে। প্রভাত পূর্ণতা আদালতে মুখোমুখি হয়।
পূর্ণতা কাঁদছে, কেঁদেই যাচ্ছে। অথচ প্রভাতের মুখে হাসি। প্রভাতের ভেতরে বিন্দুমাত্র দুঃখ-কষ্ট নেই। পূর্ণতা অশ্রুসিক্ত চোখে প্রভাতের গেঞ্জির কলার খামচে ধরে বলল,

‘ আপনার কি কষ্ট হচ্ছেনা? আপনি হাসছেন কেন?’
প্রভাত পূর্ণতার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘ আমি বেঁচে থাকব, জেল থেকে আবার বের হতে পারব। আবার এসে তোমাকে ভালবাসতে পারব। এটা কি আনন্দের নয়?’
‘ কিন্তু আমি থাকব কীভাবে? আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না। ‘

‘ আমাকে ছাড়া থাকতে হবেনা। এখন তুমি বাচ্চা আছো। এতদিন বিয়ে করেছি ঠিককরে বাসর টুকুও করতে পারিনি। আমি জেল থেকে বের হতে হতে তুমি বড় হয়ে যাবে। তখন এসে বাসর আগে বাসর টা সারব। আর শোনো মাত্র পাঁচ বছরে আমি কিন্তু বুড়ো হবোনা। একদম ইয়াং থাকব। এর চেয়ে বেশী রোমান্টিক হয়ে ফিরে আসব।’
প্রভাতের এসবের কথায় পূর্ণতার মন গলল না। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৪৫

‘ আপনার মত পুরুষের অর্ধাঙ্গী হতে পেরে আমি ভাগ্যবতী প্রভাত চৌধুরী। আমি অপেক্ষা করব আপনার জন্য। এ পাঁচটা বছর আপনি ছাড়া কষ্টের তীব্রতা আমার বাড়বে শুধু।’
প্রভাত আবারও পূর্ণতার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘ সুখের তীব্রতা বাড়াতে খুব শিঘ্রই ফিরব জা’ন।’

অর্ধাঙ্গিনী শেষ পর্ব 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here