পূর্ণতা পর্ব ২০
নন্দিনী নীলা
স্মরণের ভালো নাম ইমতিয়াজ স্মরণ হোসেন। মাস্টার্স শেষ করেই স্কুলের গণিত টিচার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে। দুই বছর হয়েছে চাকুরীর। বাবা মা ছোটো বোন ও ভাই নিয়ে সংসার। চাকুরীতে যোগদানের পর থেকে বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। নিজের পছন্দের তেমন কেউ নেই। স্টুডেন্ট লাইফে প্রেম এসেছে দুই একবার কিন্তু তেমন সিরিয়াস ভাবে আসে নি। এজন্য তাদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। স্মরণ এক্সদের বিয়েতে অবধি অ্যাটেন্ট করেছে।
নিজের চয়েজ করা কেউ নেই বিধায় পরিবারের সদস্যদের উপর দায়িত্ব পরে পাত্রী নির্বাচনের। স্মরণ পরিবারের পছন্দের কয়েকটা মেয়ে দেখে তেমন পছন্দ হয় না। সর্বশেষ মেয়ে দেখতে উপস্থিত হয়, সে পাত্রীর নাম আয়রা। স্মরণের মা, সোমা বেগম পাত্রীর ছবি দেখাতে ছেলের পিছু ঘুরে। স্মরণ তাকে জানিয়ে দেয়, ‘ মেয়ের ছবি আমি দেখব না। মেয়েকে সরাসরি, সামনাসামনি দেখতে চাই।’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
স্মরণের সিদ্ধান্ত শুনে তারা সরাসরি মেয়েকে দেখতে আয়রা দের বাসায় যায় ছেলে সমেত।
স্মরণ ভদ্রতা সহিত সোফায় বসে ছিল পাত্রীর অপেক্ষায় মাঝে মাঝে সেল ফোন বের করে টিপছিল। ওদের সামনে বিভিন্ন খাবারের সমগ্র এনে রাখছিল ট্রি টেবিলের একটা নাম না জানা মেয়ে। স্মরণ নিজের ফোনের স্ক্রিনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেয়েটির ক্লান্ত শুভ্র মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ওর আঁখি মুগল সেখানেই থমকে যায়। ও অনিমেষ চক্ষে পূর্ণতা শুভ্র মুখশ্রীতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুখ থেকে সরিয়ে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে পূর্ণতা কে।
যতই তাকিয়ে থাকে ততই তার চোখেমুখে মুগ্ধতা ফুটে ওঠে। তার চোখের মুগ্ধতা ঠোঁটে এসে ভীড় জমায়। স্মরণ আশংকা করে পূর্ণতা পাত্রী। পাত্রীর এমন সাদামাটা সিগ্ধ রূপ দেখে স্মরণ বিমোহিত হয়ে। স্মরণের মনটা একটু বাদেই সমুদ্রের উথাল ঢেউ এসে যেমন কিনারার সব তছনছ করে দেয় তেমনি ওর হৃদয়ের ঘূর্ণিঝড় নিমিষেই শান্ত বানিয়ে দেয় পাত্রী অন্যজন জানতে পেরে। আয়রা দেখতে খারাপ নয় কিন্তু নজর আটকে গেছে আরেকজনের মাঝে এখন কি আর কাউকে সামনে আনলে ওর চোখে লাগবে?
স্মরণ আড়চোখে শুধু পূর্ণতার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিল। পূর্ণতার সাথে কথা বলার একটা সুযোগ ও খুঁজছিল মনে মনে কিন্তু পাচ্ছিল না। তাই মায়ের কানে কানে বলে একাকী একটু পাত্রীর সাথে কথা বলতে চায়।
সোমা বেগম তো ছেলের কথা বেজায় খুশি হোন তিনি ভেবেছেন ছেলের মেয়েকে পছন্দ হয়েছে এজন্য তো আলাদা কথা বলতে চাইছে।
স্মরণের চাওয়াকে আরেকটু সহজ করে সবাই পূর্ণতা কে বলল আয়রার রুমে নিয়ে যেতে। পূর্ণতা এসে তাকে যখন নিয়ে গেল। স্মরণ একটা কথাই জানতে চেয়েছিল বিবাহিত কিনা।
যদি এই মেয়ে অবিবাহিত হয় স্মরণ এই মেয়ে বিনা আর কাউকে বিয়ে করবে না। নিজের সাথে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে।
পূর্ণতার থেকে ইতিবাচক খবর পেয়ে স্মরণের আনন্দ আর দেখে কে। ওর বুকের ভেতরে তখন আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতে লাগে। বাসায় ফিরে বাবা মাকে নিজের পছন্দের কথা খোলাখুলি ভাবে জানায়। সব শুনে সোমা বেগম ও ইব্রাহিম হোসেন কিংকিতব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ছেলে এসব কি বলছে? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! একজনকে দেখতে গিয়ে আরেকজনের কে পছন্দ করেছে হায় সর্বনাশ।
বাসায় ফিরেই স্মরণ জেদ ধরে বসেছে, ওই মেয়ে বিনা আর কাউকে বিয়ে সে করবে না। এতো বড়ো বুঝদার ছেলের এমন আর্জি দেখে তারা সহ বাড়ির ছোটো সদস্য স্মরণের ভাই বোন ও হতভম্ব। ছেলেকে সবসময় বিচক্ষণ বলেই জেনেছে আজ হঠাৎ এমন ছেলেমানুষী জেদে তারা বিচলিত হয়ে উঠল। ছেলেকে কোন ভাবেই শান্ত করতে পারছে না স্মরণের এক কথা, এই মুহূর্তে ওই বাসায় কল করে তার পছন্দের মেয়ের কথা জানাতে। লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট হবার দশা। জেদি একরোখা ছেলের জবরদস্তিতে তারা লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে কল করেন আশালতা কে।
আর তাদের ছেলের নির্লজ্জ,বেশরম কর্মকান্ডের কথা জানান।
স্মরণ ফের ওই বাসায় যায় পূর্ণতার ঠিকানা নিতে কিন্তু তখন পূর্ণতা ওই বাসায় উপস্থিত ছিল না। আশালতা বা তার পরিবারের কারো মাধ্যমে ওর বাসা কোথায় খোঁজ নিতে পারে না। শুধু এতো টুকু খবর নিতে পারে তা হলো পূর্ণতার বাসা ঢাকায়। এটা জানার পরই স্মরণ ঢাকায় শিফট হয়েছে নিজের পরিবার, নিজের চাকরি সব ফেলে। ঢাকা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দেখা মিলেনি পূর্ণতার। অধৈর্য হয়ে দুই দিন ধরে খোঁজা খুঁজি বাদ দিয়ে বাসায় বসেছিল।
ভেবেছিল রাজশাহী ফিরে যাবে। ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিতেই পূর্ণতা যেচে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়েছে ও ভাবতে পারছে না। অবিশ্বাস্য চোখে স্মরণ তাকিয়ে আছে পূর্ণতার দিকে। প্রথম দিনের মতোই সাদামাটা সিগ্ধ লাগছে পূর্ণতাকে। পূর্ণতার পরনে পার্পেল কালারের ছেলোয়ার কামিজ। চুলগুলো ঝুঁটি করা। বিস্মিত নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কথা বলার জন্য ওর কোমল ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্মরণ কথা না বলে নিষ্পলক চোখে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে।
এদিকে পূর্ণতা মায়ার বদলে আয়রার জন্য সমন্ধ আসা মিস্টার স্মরণ কে দেখে স্তম্ভিত। চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে ও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে স্মরণের দিকে। এই লোকের বাড়ি তো রাজশাহী জব করে রাজশাহী স্কুলে এখানে কি করছে? পূর্ণতার চোখ মুখ কঠিন হয়ে এলো স্মরণকে সামনে পেয়ে রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। পূর্ণতা নাকের পাটা ফুলিয়ে রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এইতো সেই বেয়াদব লোকটা। আয়রার বদলে ওর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল আশালতাকে। রাগে তখনি ওর মন চাইছিল লোকটা হাতের কাছে পেলে কষিয়ে একটা থাপ্পর মেরে মাথা ঠান্ডা করবে। এই নির্লজ্জ বেশরম লোকটার সামনেই ওকে পরতে হলো!
ভুল ফ্লাটে এসেছে ঠিক আছে তাই বলে এই লোকটার ফ্লাটে এসে পরতে হলো ওকে। আর কি মানুষ নেই পৃথিবীতে যতসব ফালতু লোক কেন ওর সামনে আসে।
ও কথা না বলে পাশের ফ্লাটে কলিংবেল দিতে যাবে স্মরণ বলে উঠল,“ হোয়াট এ সারপ্রাইজ। পূর্ণতা তুমি এখানে? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”
পূর্ণতা রাগে হিসহিসিয়ে বলল,“ জি আপনি স্বপ্ন দেখছেন। চোখেমুখে পানি দিয়ে স্বপ্ন ভাঙুন।”
পূর্ণতার কথা শুনে স্মরণ অমায়িক হাসি দিয়ে বলল,“ এতোক্ষণ এটাকে স্বপ্ন মনে হলেও এই ঝাঁঝালো মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নে নয় বাস্তবেই তোমাকে দেখছি। তুমি আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। ও মাই গড। আমি নিজে তোমার মনের দরজা দিয়ে ঢোকার জন্য আকুল হয়ে আছি। এখন দেখছি তুমি ও। দাঁড়িয়ে আছো কেন ভেতরে আসো না।”
পূর্ণতা পাশের দরজায় নক করল। স্মরণের কথায় মনোযোগ না দিয়ে।
স্মরণ ভ্রু কুঁচকে বলল,“ আমি তো এখানে তুমি ওই ফ্লাটে কলিংবেল দিচ্ছ কেন?”
পূর্ণতা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কপালে বোধহয় শান্তি বস্তুটা লেখা হয়নি এজন্য তো একজনের পর একজন জ্বালাতন করতে হাজির হয়ে যায়।
স্মরণ উত্তর না পেয়ে চুপচাপ দরজায় হেলান দিয়ে পেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি পূর্ণতা বিরক্তিকর মুখশ্রীর পানে নিবদ্ধ।
পাশের ফ্লাটের দরজা খুলে একটা বয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এলো পূর্ণতা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে তাকে মায়া আছে নাকি জিজ্ঞেস করল। তিনি বললেন মায়া নামের কেউ নেই। পূর্ণতা দুশ্চিন্তায় সরি বলে সরে এসে দাঁড়াল। আড়চোখে চেয়ে দেখল স্মরণ এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোনে তার হাসির রেখা ঝুলছে।
“ অদ্ভুত হাসছেন কেন?” ভ্রু কুঁচকে বলল পূর্ণতা।
“ আচ্ছা তুমি এখানে কীভাবে আসলে বলো তো? আমি এতো দিন ধরে খোঁজে ও তোমার টিকিটি পাইনি আর তুমি, আমি চলে যাব ভাবতেই খোঁজে চলে এলে। এতো ভালোবাসো আমায়!”
“ হোয়াট? কি সব আবোল তাবোল বকছেন?”
“ আই লাইক ইট।”
“ আপনি কতটা বেশরম, আমি জানি তাই আর নিজের নির্লজ্জপনা আমাকে দেখাতে আসবেন না লজ্জাবোধ থাকলে।”
“ বিলিভ মি পূর্ণতা, আমি তোমাকে দেখার পর একেবারেই লজ্জা, শরম নিজের উপর থেকে ঝেড়ে ময়লার মতো ফেলে দিয়েছি।” গা ঝাঁকিয়ে বলল স্মরণ।
“ আপনার মধ্যে যে নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই সেটা তো সেই দিনে প্রমাণ করে দিয়েছেন। ছিঃ কতটা নির্লজ্জ হলে মানুষ পাত্রীর বদলে অন্য একজন কে পছন্দ করে। শুধু তাই নয় সেটা আবার বড় মুখ করে বলে বেড়ায়।” নাক ছিটকে বলল পূর্ণতা।
স্মরণ দেয়ালে হেলান থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পূর্ণতা মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বলল,“ নিজের পছন্দের কথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা শরম লাগে না। আমি তোমাকে পছন্দ করেছি বিয়ে করতে চাই। তোমার এখানে নাক ছিটকানোর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমি তোমাকে তো অবৈধভাবে সম্পর্ক করতে বলছি না। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি এতো বিরক্ত হচ্ছ কেন?”
পূর্ণতা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে বিড়বিড় করে বলল,“বাসা থেকে বেরিয়ে একটু শান্তি পেতে চেয়েছিলাম কিন্তু জানা ছিল না বাইরে আরো বড় অশান্তি আমার ঘাড়ে চাপবে। এখানে এসে আপনার মুখ দেখতে হবে জানলে কখনোই এখানে আসতাম না।”
পূর্ণতা পর্ব ১৯
বিড়বিড় করে বললেও পূর্ণতা সম্পূর্ণ কথাই স্মরণে শ্রবণ হলো। স্মরণ কিছু বলতে যাবে পূর্ণতা গটগট পায়ে হেঁটে লিফটে উঠে পরল। স্মরণ ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে স্মিত হেসে বিড়বিড় করল,“ একবার সামনে এসে পড়েছ আর যে দৃষ্টির আড়াল হতে পারবে না প্রাণপ্রিয়া।”