পূর্ণতা পর্ব ১৮

পূর্ণতা পর্ব ১৮
নন্দিনী নীলা

পূর্ণতা রুমে এসেই শুয়ে পড়েছে তা দেখে রোজিনা বেগম এসে মেয়ের পাশে বসে বললেন,,” কি হয়েছে তোর?”
বলতে বলতে তিনি পূর্ণতা কপালে হাত দিতেই চমকে উঠে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। রোজিনা বেগম উত্তেজিত হয়ে বললেন,,” হায় আল্লাহ জ্বরে তো শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কেউ বাসার বাইরে যায়। পরীক্ষা দিতে পারছিস?”
পূর্ণতা দূর্বল সুরে বলল,,” নাহ।”

রোজিনা বেগম বললেন,,” কখন থেকে জ্বর আমাকে কিছু জানাসনি কেন? এখনো তোর ছেলেমানুষি গেল না‌‌।”
” আম্মু এখন আর আমার মধ্যে ছেলেমানুষি নেই থাকলে কি আর অসুখের কথা না বলে থাকতে পারতা‌ম? মনে আছে আম্মু আগে একটু অসুখ হলেই কেমন তোমায় জ্বালিয়ে মারতাম।”
রোজিনা বেগম বললেন,” তখনি ভালো ছিলি এমন হতে গেলি কেন? এতো জ্বর নিয়ে পরেছিলি আমরা কিছুই জানলাম না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রোজিনা বেগম মেয়ের মাথায় জলপট্টি দিতে লাগল পূর্ণতা মায়ের এই যত্ন টুকু লুফে নিল।
ওর এমন অসুস্থতার খবর দিঘি জানতে পারল আর জানতে পেরেই সবাই দল বেঁধে হাজির হলো ওদের বাসায়। আসতে পারল না শুধু রাসেল। রাসেলের ডিউটি ছিল এজন্য ওকে তিনদিনের জন্য সিলেট যেতে হয়েছে। সবাই এসে পূর্ণতাকে দেখে গেল। রোজিনা বেগম কাউকেই চিনত না সবাই মেয়ের নতুন বন্ধু। কিন্তু কারো অ্যাপায়নের ত্রুটি রাখল না। সবাই বিকেল ভর থেকে চলে গেল।

রাসেল আসতে পারেনি এজন্য সিলেট থেকে ফিরেই আসতে চাইল পূর্ণতা তখন একটু সুস্থ জ্বর কমছে। ও রাসেল কে বলল একটু ঘুরতে যেতে চায়। ওরা ঘুরতে বের হলো একদিন সময় করে। রাসেল বাকিদের কেউ খবর দিয়েছিল কিন্তু সবাই ব্যস্ত এজন্য ওদের দুজন কেই যেতে হলো‌। সেখানে গিয়ে হলো আরেক বিপদ সেখানে গিয়েই পূর্ণতা তৃতীয় বারের মতো দেখা হলো তুষারের সাথে। তুষারের সেকি আনন্দ। তুষার পার্কে বসে গান গাইছিল গিটার হাতে।

ওর গানের সুর শুনে পার্কের প্রায় সবাই মুগ্ধ হচ্ছিল এজন্য তো সবাই ভীড় করেছিল ওর চারপাশে। রাসেল আর পূর্ণতা ও গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল সুরের তালে ওরা তুষারের নিকটে চলে আসে। কিন্তু ভীড় ঠেলে প্রবেশ করে তুষার কে দেখে পূর্ণতা চমকে উঠে। তুষার চোখ বন্ধ করে গান গাইছিল ও তুষারের নজরে পরার আগেই চলে আসতে চাইছিল কিন্তু তুষারের নজরে থেকে বাঁচতে পারল না পরেই গেল। গান থামাতেই সবাই কড়তালি দিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে চলে যায় ভীড় কমিয়ে। এদিকে তুষার পূর্ণতা কে দেখেই গিটার কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

তুষার পূর্ণতার সামনে এসে উচ্ছ্বাস কন্ঠে বলল,,” ও মাই গড, পূর্ণতা আপনি! আমাদের আবার দেখা হয়ে গেল। বারবার দেখা হ‌‌ওয়া কিন্তু প্রেমের লক্ষণ। আমাদের মনে হচ্ছে খুব শ্রীঘ্রই প্রেম হয়ে যাবে।”
পূর্ণতা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,” ফালতু কথা‌। আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?’
তুষার বলল,,,” প্রথম বার নাম না জেনে বিদায় নিয়েছিলাম কিন্তু দ্বিতীয় বার তো সেটা করতে পারিনা বুদ্ধির জোরে এখন আপনার বলার আগেই জেনে গেছি।”

” অসহ্য।”
” আপনিও আমার গান শুনছিলেন নাকি?”
পূর্ণতা মিথ্যা করে বলল,,” ক‌ই না তো। আপনি গান কখন গাইলেন?”
রাসেলের একটা কল এসেছিল ও কল কেটে এগিয়ে এসে তুষার কে দেখেই বলে,” তুই এখানে কেন?”
” তুই এখানে কি করিস?”

এদিকে পূর্ণতা হতবুদ্ধি চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের রিয়েকশন ও কথোপকথন শুনে পূর্ণতা আন্দাজ করল দু’জনে পূর্ব পরিচিত। পূর্ণতা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। রাসেল পূর্ণতার সাথে তুষারের পরিচয় করিয়ে দিল। পূর্ণতার ধারণা সঠিক তুষার আর রাসেল স্কুল ফ্রেন্ড। তুষার অনার্স করেছে ঢাকা এজন্য দুজনে আলাদা হয়ে গেছিল। ফের রাসেল জব নিয়ে ঢাকা চলে এসেছে আর তুষার এখন মাস্টার্স করছে সাথে জবের প্রিপারেশন নিচ্ছে। দুই বন্ধুর আবার এখানে দেখা হয়েছে যোগাযোগ হয় ঘনঘন।

পূর্ণতা তুষার কে চিনে না ওভাবেই কথা বলল। কিন্তু তুষার বলে উঠল,,” রাসেল পূর্ণতা তোর পরিচিত?”
রাসেল মাথা নাড়িয়ে ওদের বন্ধুত্ব এর কথা বলল।
তারপর পূর্ণতার দিকে চেয়ে বলল,” আরে মিস পূর্ণতা আপনি তো তাহলে আমার ক্লাসমেট। ক্লাসমেটদের সাথে কেউ আপনি করে কথা বলে? আজ থেকে আমরা তুমি করে কথা বলব কেমন?”
পূর্ণতা নাক লাল করে তাকিয়ে আছে তুষারের দিকে। মনে মনে পূর্ণতা তুষার কে বদের হাড্ডি বলে গালিগালাজ করছে।

রাসেল বিস্মিত কন্ঠে পূর্ণতার দিকে চেয়ে বলল,,” পূর্ণ তুই তুষার কে চিনিস?”
পূর্ণতা অস্বীকার করে বলল,,” না তো উনাকে আমি চিনব কীভাবে?”
পূর্ণতার কথা শুনে তুষার আকাশ থেকে পড়ে তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলল,,,” পূর্ণতা মিথ্যা বলছো কেন? ওইদিন তোমাকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম ভুলে গেছো? একটা থ্যাংকস অব্দি বলো নি এখন আবার চিনতে অস্বীকার করছ?”
থেমে তুষার ফের বলল,,” তুমি তো দেখি উপকারী উপকার মনে রাখো না‌।”

পূর্ণতা বিরক্তিকর কন্ঠে তাকাল তুষারের দিকে। রাসেলের দিকে চেয়ে পূর্ণতা বলল,,” তোর এমন ফাজিল বন্ধু আছে আগে তো বলিস নি।”
তুষার পূর্ণতার কথা শুনে ক্ষেপে উঠে বলল,,” এই এই ফাজিল কাকে বলছেন আমি যথেষ্ট ভদ্র ছেলে। কিরে রাসেল বল আমি ভালো ছেলে না?”

রাসেল বলল,,” থাম তোরা কাহিনী কি সেটা বল।”
তুষার শটকাট এ সবটা খুলে বলল। তারপর ওরা তিনজন একসাথে বসল। পূর্ণতা তো তুষারের সাথে বসবেই না রাসেল জোর করে বসিয়েছে।
তুষারের ফোনে কল আসতেই তুষার দুই মিনিট এ আসছি বলে উঠে যায়।

এদিকে রাসেল পূর্ণতা কে বলতে লাগে,” পূর্ণ তুই তুষার কে ভুল ভেবেছিস। ও কিন্তু ছেলেটা ভালো। আমাদের ক্লাসের সব চেয়ে ভদ্র বলা যায়। যেচে পরে কোন মেয়ের সাথেও কথা বলেনি কখনো। আমি অন্তত দেখিনি। তোকে অস্বাভাবিক পেয়েছে এজন্য এতো বিরক্ত করেছে। সবটাই কৌতুহল থেকে।”
“বন্ধুর হয়ে সাফাই গাইবি না। বিরক্ত করে মেরেছে আমাকে জানিস?”
” আচ্ছা তুই বল ও কি তোর সাথে কোন মিসবিহেভ করেছে?”

পূর্ণতা থমকে চুপ করে গেল। আসলেই তুষার ওর মনের খবর জানতে চেয়েছে আর কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু খারাপ আচরণ তো করেনি। ওর আসলে এখন কোন ছেলে দেখলেই রাগ হয়। ছেলে বলতে শুধু বন্ধু ছাড়া বাকি সবাইকেই অসহ্য লাগে গা জ্বলে উঠে। নিজের এই বিরক্তিকর ভাবের জন্যে তুষারকে অকারণেই ওর বিরক্ত লাগে। সেটা তো আর রাসেল কে বলতে পারে না। ও উত্তর দেওয়ার আগেই তুষার এসে হাজির।

এসেই তুষার প্রফুল্ল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,” কি নিয়ে কথা হচ্ছে দুজনের মধ্যে।”
রাসেল বলল,,” ফ্রেন্ডস আমরা আমাদের সব কথা কি আর তোকে বলা যাবে?”
তুষার বলল,,” তোর ফ্রেন্ড মানে আমার ও ফ্রেন্ড।”
পূর্ণতা মাথায় হাত দিয়ে বলল,,” রাসেল চল তো এখানে থেকে। মাথা ধরিয়ে ফেলল আমার। ঘুরতে আসাই মাটি।”
তুষার বলল,,” আচ্ছা তোরা ঘুরাফেরা কর আমি চলে যাচ্ছি।”

বলেই তুষার পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বাই বলে চলে গেল।
” এবার হ্যাপি?” রাসেল পূর্ণতার দিকে চেয়ে বলল। পূর্ণতা বলল হ্যাঁ।
পূর্ণতা ভাবল তুষার চলে গেছে কিন্তু আড়াল থেকে তুষার পূর্ণতা আর রাসেল কে ফলো করল ঠিকি। সামনে আর আসলো না। এদিকে পূর্ণতা বিরক্তিকর তুষারের থেকে মুক্তি পেয়ে শান্তিতে বাকি সময় পার করল। রাসেলের জরুরি কাজে চলে যেতে হলো। পূর্ণতা ওকে চলে যেতে বলল একাই ও বাসায় ফিরতে পারবে বলল রাসেল ওকে বাসায় পৌঁছে না দিয়ে যাবে না কোনভাবেই। পূর্ণতা জোর করেই ওকে পাঠিয়ে দিল‌। রাসেল চলে যাবার পর পূর্ণতা বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়ি খোঁজ করতে লাগল। এদিকে তুষার পূর্ণতা কে একা পেয়ে আবার ওর সামনে চলে আসলো।
পূর্ণতা তুষার কে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে বিস্মিত কন্ঠে বলল,,” আপনি এখনো যান নি?”

তুষার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,,” না তো।”
পূর্ণতা রাগী কন্ঠে বলল,,” এতোক্ষণ আমাদের ফলো করছিলেন?”
তুষার বলল,,” একদমই ঠিক ধরেছো। রাসেল তোমাকে পৌঁছে দিতে পারেনি তো কি হয়েছে। আমি আছি তো। তোমার ফ্রেন্ড না হলেও রাসেলের ফ্রেন্ড হিসেবে এইটুকু করতেই পারি।”

পূর্ণতা রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তুষারের দিকে। কোন কথা বলে লাভ নাই এই লোকটা কে। এই লোকটা যে পরিমাণ ঘাড়ত্যাড়া একে কিছু বলা না বলাটা সমান। তাই পূর্ণতা আর কিছু না বলে বাসার পথে রওনা হয় তুষার ওর সাথেই আসে। তুষার নিজের মতো একাই কথা বলে সারা রাস্তা কিন্তু পূর্ণতা কোন কথা বলে না ওর সাথে।

বাসার সামনে এসে তুষার নামতে চাইলে পূর্ণতা নরম স্বরে বলে উঠে,,” আমি একজন ডিভোর্সী মেয়ে। স্বামীর সংসার থেকে বিতারিত হয়েছি। এখন যদি এলাকার মানুষ আমাকে সব সময় দেখে একটা ছেলে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে আমার সাথে চলাফেরা করছে তাহলে কি বলবে জানেন? আমার সম্মান এমনিতেই এই সমাজে নেই তার উপর আপনার এই আনাগোনায় আমি হয়তো আরো নিচু হয়ে যাব। সবাই ভাববেই পরকিয়া করি এজন্য স্বামীর সংসার করতে পারিনি‌।

পূর্ণতা পর্ব ১৭

একটা মেয়ের সম্মান নষ্ট করতে না চাইলে আর কখনো আমার পেছনে আসবেন না। এই এলাকার মানুষ এমনিতেই আমার দিকে কটু চাহনি দিয়ে তাকায় থাকে। এলাকার একসময় যারা আমার বন্ধু ছিল তাদের আমার কাছে ঘেঁষতে দেয় না। তাতে অবশ্য আমার কিছু আসে যায় না কিন্তু আমি আপনার জন্য কোন দুর্নাম ছড়াতে চাই না। নিজেও একটা ডিভোর্সী মেয়ের পেছনে থেকে সময় নষ্ট ও সম্মান ক্ষুন্ন করবেন না। আল্লাহ হাফেজ।”

পূর্ণতা পর্ব ১৯