পূর্ণতা পর্ব ১৯

পূর্ণতা পর্ব ১৯
নন্দিনী নীলা

তিন মাস পরের কথা। পূর্ণতার সাথে আর তুষারের দেখা হয়নি। তুষার তার পিছু ছেড়েছে বুঝতে পেরে পূর্ণতা নিশ্চিন্ত মনে এখন যেখানে খুশি যেতে পারে। সেদিনের কথাগুলো কাজে দিয়েছে তাহলে।
আশালতা বেগম বসে আছে পূর্ণতা দের ড্রয়িংরুমে। আয়রার বিবাহ ঠিক করেছে। এজন্য দাওয়াত দিতেই এসেছেন তিনি। এবং সঙ্গে করে পূর্ণতা কে নিয়ে যেতে চায়। তার এমন প্রস্তাব এ শাহিন আলম খেপে উঠেছেন। আশালতা বেগম এর সাথে বাজে আচরণ শুরু করে দিয়েছে‌‌। তা দেখে পূর্ণতা এসে বলে,“ মায়ের সাথে তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”

শাহিন আলম বললেন,“ কত বড় দুঃসাহস উনার। এমন একটা প্রস্তাব কীভাবে দিল উনি ভাবলেন কীভাবে তোমাকে আমরা ওই বাসায় আর যেতে দেব। তোমার সাথে এতো বড় অন্যায় করে আবার এখানে এসেছে কোন মুখ নিয়ে।”
শাহিন আলমের অভার রিয়েক্ট দেখে পূর্ণতা বিরক্ত হলো। ও নিজেই যেতো না বিয়েতে রাজশাহী যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই। কিন্তু শাহিন আলমের অপমান ও আশালতা অপরাধী চেহারা দেখে ও নরম হলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এই মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তো মিথ্যা নয়। তাকে ও কীভাবে কষ্ট দেবে এতো দূর থেকে একা শুধু মাত্র ওকে নিতে এসেছে। তার ছেলের অন্যায়ের জন্য আজ তাকে অপমানিত হতে হচ্ছে ছেলের ভুলের জন্য সে সবটা মাথা নিচু করে সহ্য করছে। তাকে এতো অপমানের পর আর কীভাবে ও অপমানিত করে একা পাঠাব।
পূর্ণতা আশালতা বেগমের হাত ধরে বলল,“ মা আমি তোমার সাথে যাব। তোমাকে আমি মা বলে ডেকেছি পাঁচটা বছর মায়ের স্নেহ পেয়েছি তোমাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না।”

আশালতা বেগম পূর্ণতার চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে নিলে খুশি হয়ে। তিনি জানতেন পূর্ণতা তার কথা ফেলবেন না। তার চোখ জলে ভরে উঠল।
পূর্ণতার কথা শুনে শাহিন আলম খেপে উঠলেন।
তিনি রেগে বললেন,“ এসব কি বলছো তুমি? ওই বাসায় যাবে?”
পূর্ণতা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,“ হ্যাঁ যাব।”
“ তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ওরা তোমার সাথে কি অন্যায় করেছে ভুলে গেছো এখন আবার সেই পরিবারের যাওয়ার কথা ভাবছে।”

“ কে কি করেছে সেটা ভাবতে গেলে আমার এখানে ও থাকা উচিত না‌। কিন্তু আমি তোমাদের সাথে থাকছি সব ভুলে। না হলে বিয়ের পাঁচবছর তো আমাকে তোমার মেয়ে বলেই আর পরিচয় দেও নি‌। আমি একবার বলেছি যাব মানে যাব। আমার জীবনে আমি কারো হস্তক্ষেপ মেনে নেব ন নেয়নি।”

শাহিন আলম রেগে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলেন। পূর্ণতা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। বাবার এই রাগ আগে দেখলে ভয়ে ও কাঁপত কিন্তু এখন ওর মধ্যে ভয়ের সিটে ফোঁটা নেই ভয় তো হারিয়ে গেছে সেই কবেই। পূর্ণতার মা এলো ওকে মানাতে, বুঝাতে কিন্তু পূর্ণতা নিজের কথায় অটল ও যাবেই‌।
একপ্রকার জেদ করেই ও আশালতাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। পূর্ণতা সবার উর্ধ্বে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিল।

শাহিন আলম ওরা বের হবার সময় ওঁদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,“দেখছ তোমার একরোখা জেদি মেয়ের কাজ? আমরা না হয় একটা ভুল করেছি কিন্তু ওর ভুলের কি কোন শেষ আছে? একেরপর এক ভুল করে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে গেছে একদম।”
রোজিনা বেগম মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে।

সন্ধ্যায় আশালতা ও পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে কমলাপুর রেলস্টেশনে। বাসার এতো ঝামেলা দেখে আশালতা বেগম ওকে বলেছিলেন না আসার জন্য ওকে শুধু গাড়িতে উঠিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু পূর্ণতা কোন জবাব দেয় নি বাসার সবার সাথে যুদ্ধ করে ও আশালতাকে নিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। টিকেট কাটতে গিয়ে চমকালো আশালতা বেগম পূর্ণতা একটা টিকেট কেটেছে। পূর্ণতা ব্যাগ প্যাক করে বাসা থেকে বেরিয়েছে উনার সাথে কিন্তু টিকেট কেন একটা কাটছে সেটাই আশালতা বেগম বুঝতে পারলেন না।

পূর্ণতা আশালতাকে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে বলল,“ মা তুমি সাবধানে বাসায় ফিরে যাও। আমি তোমার সাথে যেতে পারব না। যে শহর আমি ছেড়ে এসেছি সেই শহরে আমি আর কোনদিন ফিরে যাব না আমাকে ক্ষমা করো।”
“ তুই তো রাজি হয়েই এসেছিলি।”

“ হ্যাঁ ওই রাজি টা শুধু মাত্র বাবা মাকে দেখাতে। তারা তোমার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করছিল সেটা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তুমি আমাকে ভালোবেসে এসেছ কিন্তু তারা তোমার অপমান করেছে। এজন্য আমি তাদের সিদ্ধান্ত কে অবজ্ঞা করে তোমার সাথে এসেছি শুধু তোমার প্রতি সম্মান রাখতে। কিন্তু আদৌতে আমি তো রাজশাহী যাব না।”

“ তুই কোথায় যাবি চল না আমার সাথে। আমি ওই কুলাঙ্গার কে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি।”
“ খুব ভুল করেছ মা‌। সে তার ভালোবাসার জন্য এতো কিছু করেছে। একদিন আমিও ভালোবাসার জন্য অনেক বেপোরোয়া কিছু করেছিলাম। কারো ভালোবাসা কে নিঃশেষ হতে দিও না মা। তোমার ছেলে আমাকে মেনে নিলেও আমি হয়ত নিতে পারতাম না। তার থেকে ভালো হয়েছে না সে অন্য কাউকে বেছে নিয়েছে। তুমি আমার জন্য নিজের ছেলেকে দূরে রেখো না। তাকে বাসায় ফিরিয়ে আনো আর তার স্ত্রী কে যথার্থ সম্মান দিও। আমি চাই না আর কেউ ভালোবাসা হারাক।”

পূর্ণতা ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে এলো আশালতা তাকে জিজ্ঞেস করল সে এখন কোথায় যাবে! পূর্ণতা উত্তর দেয়নি শুধু রহস্য ভঙ্গিতে হেসেছে। ও কোথায় যাবে সেটা তো ও নিজেই জানে না‌। মন চাচ্ছে দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যেতে। পূর্ণতা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় যাবে সেই নিয়ে দুটানায় ভুগছে। পূর্ণতা কল করল মায়া কে। রাতটা ওর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা যায় নাকি।

ব্যাগ নিচে নামিয়ে রেখে পূর্ণতা ওর নাম্বারে কল ডায়াল করল। আচমকাই তখন একটা বাইক করে ছিনতাইকারী এসে পূর্ণতা হাত থেকে একটানে ফোন কেড়ে নিল। স্তম্ভিত পূর্ণতা হতবুদ্ধি চোখে তাকিয়ে আছে বাইকের পেছনে বসা ছিনতাইকারীর দিকে। গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দিয়ে উঠে পূর্ণতা। বাইকটা তরিৎ গতিতে মিনিটেই দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল। পূর্ণতা পিছু ছুটল কিন্তু দৌড়ে কি আর বাইক ধরা যায়? আশেপাশের মানুষ ওর কাছে এসে জড়ো হয়ে গেল। পূর্ণতা মাথায় হাত দিয়ে থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিটের মধ্যে কি ঘটে গেল ওর মস্তিষ্ক ধরতে পারল না। ও এতোটা গাধা হয়ে গেল কীভাবে? ওর হাত থেকে ছিনতাইকারী ছিনতাই করে নিয়ে গেল।

ট্রাফিক পুলিশ চলে এসেছে কি হয়েছে জানতে পূর্ণতা ঘটনা খুলে বলল। পূর্ণতা কে একটা জিডি করতে বলল পুলিশ। পূর্ণতা ভীর ঠেলে পরে দাঁড়াল। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর। এদিকে ফ্রেন্ডদের নাম্বার ও মুখস্থ নেই। কারো ফোন চেয়ে যে কল করবে তার ও উপায় নেই। পূর্ণতা নিজের মাথা খাটিয়ে ভাবতে লাগল মায়ার বাসার ঠিকানা। দেখা হয়েছিল সেইদিন এড্রেস দিয়েছিল মায়া।

নখ কাটতে কাটতে পূর্ণতা ভাবতে লাগল। যতটুকু মনে পড়ল সেই মোতাবেক বাসায় যাওয়ার জন্য ও সিএনজি নিল। তারপর কাঙ্খিত বাসার সামনে এসে ভাড়া মিটিয়ে নেমে দাঁড়াল। হাত ঘড়িতে সময় দেখল আটটার উপরে বাজে। তিনতলার বাসাটায় দিকে পূর্ণতা চেয়ে আছে। মায়া বলেছিল দুতালায় থাকে। পূর্ণতা দাড়োয়ানের সাথে কথা বলে কনফার্ম হয়ে নিতে চাইছিল কিন্তু বাসার সামনে দাড়োয়ান নেই। পূর্ণতা পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে ভেতরে গেল। কেয়ারলেস দাড়োয়ান দরজা খোলা রেখে কোথায় উধাও হয়েছে কে জানে!

পূর্ণতা লিফট করে দুতালায় গিয়ে কলিংবেল দিতে গিয়ে কনফিউজড হয়ে পড়ল। দুইটা রুম কোনটায় মায়া আছে এখন বুঝবে কীভাবে? পূর্ণতা দুইটা ফ্লাটের দরজার সামনে দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। মনে সাহস সঞ্চয় করে ও বাম পাশের ফ্লাটে কলিংবেল দিল। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে যদি এই রুমে মায়া না থাকে কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি পড়তে হবে।

পূর্ণতা পর্ব ১৮

মনে মনে আল্লাহ পাক কে ডাকছে যেন অপরিচিত কারো রুম না হয় এটা। ওর ডাক আল্লাহ শুনেছি নাকি পূর্ণতা জানে না কারণ দরজা খুলে যে বেরিয়েছে সে পরিচিত মায়া না হলেও অপরিচিত কেউ না।
ফ্লাটের দরজার মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে পূর্ণতা বুকের ভেতর রক্ত ছলাৎ করে উঠল।

পূর্ণতা পর্ব ২০