প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৩

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৩
Writer Mahfuza Akter

চা খাবেন? নাকি কফি অর্ডার করবো?”
মুগ্ধর নিঃসংকোচ প্রশ্ন। সে বেশ আয়েসী ভঙ্গিতে অরুণীর বিপরীত চেয়ারে বসেছে। অরুণী বেশ থমথমে চোখে মুগ্ধকে দেখছে। ছেলেটার হাসি-হাসি মুখ আর সাহসের মাত্রা দেখে সে অবাক না হয়ে পারে না। কীভাবে নিজের বাবার চোখে ধুলো দিয়ে ওকে টেনে নিয়ে রিকশায় করে রেস্টুরেন্টে চলে এলো!
অরুণীর থমথমে মুখটা একবার দেখে নিয়ে মুগ্ধ বললো,

“আপনার জন্য বরং চা-ই অর্ডার করি। সিনিয়র আপুর ফায়ারিং মোড অন হয়ে যাওয়ার আগে ঠান্ডা ঠান্ডা আইস-টি ব্যবস্থা করা উচিত।”
মুগ্ধ ওয়েটারকে ডেকে চা অর্ডার দিতেই অরুণী গম্ভীর সুরে বললো,
“বারবার সিনিয়র আপু বলে বলে কী বোঝাতে চাও তুমি? আর তোমার চোখে তো আমি এখন খুবই জঘন্য একটা মেয়ে! তাহলে আমার সাথে দেখা করা ও কথা বলার জন্য কেন তোমার এতো আয়োজন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মুগ্ধর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ধীরে ধীরে মলিন হয়ে গেল। সে অরুণীর দিকে পূর্বদৃষ্টিতে তাকালো। অরুণীর চোখ জুড়ে থাকা এলোমেলো অভিযোগগুলো যেন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে! তাই মলিন মুখে বললো,
“আমি জানি আমার সেদিনের বলা কথাগুলো আপনার খারাপ লেগেছে। আমার আসলে আপনাকে ঐভাবে বলাটা উচিত হয়নি। আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি যে, সেদিন আমার ঠিক কী হয়েছিল যে আপনাকে আমি ঐ ভাবে কথা শুনিয়ে…..”

মুগ্ধর কথার মাঝেই অরুণী শুকনো হেসে বললো,
“আরেহ্ তুমি এভাবে গিল্টি ফিল করছো কেন? সেদিন তুমি আমাকে যা যা বলেছো, সেসব নিয়ে আমার তোমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তুমি ওভাবে আমায় না বললে হয়তো আজ আমি কারো জীবনে বা সংসারে আগুন লাগানোর খেলায় ডুবে যেতাম। কিন্তু আমি অনেক ভাবার পর বুঝতে পেরেছি যে, ভালোবাসা একটা পবিত্র অনুভূতির নাম। অন্যের কথায় প্ররোচিত হয়ে সেটা কলুষিত করার মতো অন্যায় করাটা আমায় সাজে না। এটা বুঝতে আমায় সাহায্য করার জন্য তোমায় ধন্যবাদ।”

মুগ্ধ অরুণীর কথায় কতটা খুশি হয়েছে, সেটা ওর মুখের হাসি দেখেই অরুণী বুঝতে পারছে। সে কিছুটা অবাক হলো। এই ছেলেটা অতি অল্পতে কেন খুশি হয়ে যায়, ভেবে পায় না অরুণী। এরই মধ্যে চা চলে এলো। মুগ্ধ অরুণীর দিকে চায়ের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তাহলে আপনি আমার ওপর এতো রেগে আছেন কেন?”
অরুণী আগের মতো গম্ভীর মুখ করে বললো,

“তোমার ওপর রাগার আমি কে? আমার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা! তুমি তো আমার দিকে তাকানোরও সময় পাচ্ছিলে সেদিন! কীভাবে আমায় ইনগোর করছিলে!! আমায় কত খারাপ মানুষ ভাবছিলে কে জানে!”
মুগ্ধ চায়ে চুমুক দিতেই এমন কথা শুনে ওর কাশি চলে এলো। সে কাশতে কাশতেই বললো,
“ঐদিন তো আমি রেগে ছিলাম একটু! আর আপনিই-বা এতো অদ্ভুত কেন? আমি রেগে ছিলাম দেখে আপনি একটু রাগ ভাঙানোর চেষ্টা তো করবেন! সেটা না করে উল্টো আমাকে রাগ দেখাচ্ছেন?”
অরুণী অবাক হয়ে বললো,

“আমি তোমার রাগ ভাঙাবো? তুমি আমার কোনো ভাই-ব্রাদার-বন্ধু-প্রেমিক কিচ্ছু নও যে, তোমাকে মানানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে যাবো আমি। তুমি শুধু আমার কলেজের একজন জুনিয়র, ছোট-বাচ্চা একটা ছেলে।”
মুগ্ধ চোখ ছোট ছোট করে বললো,
“আমি বাচ্চা ছেলে?”
অরুণী হাতে হাত ভাজ করে বললো,
“হুম।”

“শুধু বয়স বিবেচনা করলেই হয় না। আপনার থেকে হাইট, জ্ঞান, বুদ্ধি আর ট্যালেন্ট সবকিছুতেই আমি এগিয়ে। পাশাপাশি দাঁড়ালে তো আমার কাঁধের নিচে পড়ে থাকবেন আপনি! লোকে আপনাকে দেখলেই বাচ্চা-মেয়ে বলবে তখন।”
অরুণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি জ্ঞান-বুদ্ধি আর ট্যালেন্টে আমার থেকে কীভাবে এগিয়ে?”
মুগ্ধ ভাব নিয়ে বললো,

“ইয়ার-ফাইনালের রেজাল্ট দেবে কয়েকদিনের মধ্যে। তখন দেখে নিয়েন এবারেও কে টপ করে!”
অরুণী বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, টপার বলেই তো ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে আমার সাথে আড্ডা দিচ্ছো রেস্টুরেন্টে বসে!”
মুগ্ধ আয়েসি ভঙ্গিতে বসে বললো,
“সেটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। বাইকটা ক্যাম্পাসেই রেখে এসেছি। বাবা সেটা দেখবে, আর ভাববে আমি ক্যাম্পাসেই আছি। দেখেছেন? কী বুদ্ধি আমার! মাঝে মাঝে নিজের বুদ্ধি দেখে আমি নিজেই অবাক হই।”
অরুণী বিরক্ত হয়ে বসা থেকে উঠে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
“তুমি এখানে বসে বসে নিজের বাবার চোখে ধুলো দেওয়ার চিন্তা করতে থাকো। আমার ক্লাস আছে, আমি গেলাম।”

রায়হান সাহেব ও আফনাদ হক হাসপাতালের করিডোরে বসে আছেন। আফনাদ হকের মুখ জুড়ে চিন্তার ছাপ আর রায়হান সাহেবের মুখভঙ্গিতে প্রচন্ড বিতৃষ্ণা প্রকাশ পাচ্ছে। সুজাতাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। শারীরিক দূর্বলতা আর মানসিক ধাক্কায় সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিল নিজের ঘরে। দরজা ভেঙে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তাঁরা। কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে তাঁদের আশ্বস্ত করে বললেন,

“উনি এখন ঠিক আছেন। জ্ঞান ফিরলেও বারবার উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন বলে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আজকের দিনটা এখানে রেখে কাল আপনারা ওনাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।”
রায়হান সাহেব বিরক্তিতে বিড়বিড় করে বললেন,
“ছেলের শোকে এখন উত্তেজিত হলে কী হবে? ছেলে তো বুদ্ধিমানের মতো নিজের দায়িত্ব রক্ষা করার জন্য সঠিক রাস্তা-ই বেছে নিয়েছে!”
আফনাদ হক কিছু বলার আগেই তাঁর ফোন বেজে উঠলো। আফনাদ হক দ্রুত ফোন হাতে নিতেই দেখলেন, সৌহার্দ্য কল করেছে।

“সৌহার্দ্যের কল এসেছে!” বলেই তিনি ফোন কানে লাগালেন। রায়হান সাহেব বেশ কৌতূহলী ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন আফনাদ হকের দিকে।
“সৌহার্দ্য! কোথায় তোমরা? তোমরা ঠিক আছো? তরী কোথায়?”
“আমরা দু’জনেই ঠিক আছি, আঙ্কেল! ভালো আছি। আপনি কি এখন গ্রামে চলে গেছেন বাবার সাথে?”
“হ্যাঁ, বাবা! তোমাদের চিন্তায় আর কোয়ার্টারে বসে থাকতে পারছিলাম না।”
“চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনাকে ফোন দিয়েছি এটা জানানোর জন্য যে, কাল আমি গাড়ি পাঠাবো। মধু আর ছোট-মাকে সেই গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেবেন।”

আফনাদ হক চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
“তরীকে একবার নিয়ে এসো তুমি। ওকে না দেখে তো আমি থাকতে পারবো না।”
“এখন আমি চাই না গ্রামে যেতে আর গ্রামের কারো সাথে দেখা করতে। তরী ঠিক আছে। ও আপনার সাথে রোজ ফোনে কথা বলবে। আপনি শুধু কাল সকালে মধুকে আর ছোট-মাকে পাঠিয়ে দেবেন।”
“ঠিক আছে।”
ফোন রাখতে গিয়েও সৌহার্দ্য ইতস্তত করে বললো,

“আমি জানি আমার মা এখন ভালো নেই। আমার মায়ের খেয়াল রাখতে বলবেন। রাখছি।”
সৌহার্দ্য ফোন রাখতেই রায়হান সাহেব ভ্রু কুঁচকে আফনাদ হকের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কিচ্ছু বলতে হবে না আমায়। আমি সব শুনেছি। ছেলেটা আর মানুষ হলো না আমার। নিজের বাবাকে রেখে তোমাকে কল দিয়েছে। এখন তার কাছে বাবার চেয়ে বাবার বন্ধু বেশি আপন! কোন গ্রহের প্রাণীকে উপরওয়ালা আমার ছেলে বানিয়ে পাঠিয়েছেন, সেটা তিনিই ভালো জানেন। অবিশ্বাস্য!”
রায়হান সাহেব হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন। আফনাদ হক তাঁর যাওয়ার দিকে অবাক হয়ো তাকিয়ে রইলেই। এই বাবার-ছেলে অনৈক্য করবে শেষ হবে কে জানে!

তরীকে কোচিং-এ ভর্তি করিয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য হসপিটালে চলে এলো। একটা বেসরকারি হাসপাতালের চেম্বারে পার্ট-টাইম বসবে সে। সরকারি-মেডিক্যালে ঢুকতে মাসখানেক সময় লেগে যাবে সকল প্রসেসিং করতে করতে। তাই আপাতত এখানেই বসবে সে।
চেম্বারে এসে বসতেই পিয়ন এসে সৌহার্দ্যকে জানালো,
“স্যার, ড. আরমান আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন।”
সৌহার্দ্য এপ্রোন গায়ে দিতেই বললো,

“পাঠিয়ে দাও।”
পিয়ন বের হয়ে যাওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ড. আরমান ভেতরে এলেন। তাঁর গায়ে থাকা সাদা শার্টের ওপর এপ্রোন দেখেই সৌহার্দ্য বুঝতে পারলো, তিনি এখানে আজ ক্লাস নিতে এসেছেন আর ক্লাস শেষেই তাঁর সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। সৌহার্দ্যকে দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে ড. আরমান তার মুখোমুখি বসলেন এবং বললেন,

“আজ থেকে জয়েন করছো তাহলে!”
সৌহার্দ্য স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ।”
“আমার রিসার্চ সেন্টারে কবে ব্যাক করছো?”
“পরশু।”
ড. আরমান সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললেন,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩২

“গুড! আমি জানতাম, তোমার মতো বুদ্ধিমান একটা ছেলে একটা মেয়ের জন্য কখনো নিজেকে গুটিয়ে বসে থাকবে না। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা!”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। ড. আরমান নিজের হাসি বজায় রেখেই বললেন,
“তরী মেয়েটা অনেক ইনোসেন্ট। দেখলেই বোঝা যায় যে, নিষ্পাপ একটা মেয়ে। ওকে তুমি এভাবে ধোঁকা দিচ্ছো! মেয়েটা জানলে সহ্য করতে পারবে তো!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৪